অরুণ কে সিনহা
১৯১৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জার্মানির কিয়েল (Kiel) বন্দরের নৌবিদ্রোহ এবং ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোম্বে, করাচি ও অন্যান্য বন্দরে ভারতীয় নৌসেনার বিদ্রোহ— এই দুটি ঘটনার তুলনামূলক বিচার আমরা করতে পারি। কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের সঙ্গে আইএন-এর রেটিংদের বিদ্রোহের তুলনামূলক বিচার আমাদের দেশে স্বাধীনতার প্রাক্কালে নৌবিদ্রোহের প্রাসঙ্গিকতা ও সীমাবদ্ধতা দুই-ই বুঝতে পারি
সম্প্রতি ইউটিউবের মাধ্যমে অধ্যাপক সুগত বসুর একটি বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। বক্তৃতার বিষয় ছিল “Anti-colonial Constitutionalism and the Defence of Democracy”। এই বক্তৃতার আয়োজন করেছিল New Socialist Initiative (NSI), যারা গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে প্রায়শই বিভিন্ন অধ্যাপকদের অংশগ্রহণে বক্তৃতামালার আয়োজন করে থাকে। রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, অধ্যাপক বসুর বক্তৃতাটি ছিল NSI-এর আয়োজিত ৩৭তম বক্তৃতা।
অধ্যাপক সুগত বসু ভারতীয় উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন, বিশেষ করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান নিয়ে লিখিত নানা গ্রন্থের জন্য সুপরিচিত। এই বক্তৃতাতেও তিনি তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের পরিচয় রেখেছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, এই পাণ্ডিত্যের বিষয়গুলি বহুচর্চিত ও পরিচিত। ১৯৪৬-৪৭-এর শাসনক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে দেশীয় শাসকদের আহূত সংবিধান সভার (Constituent Assembly) বিভিন্ন দিক ও তার সীমাবদ্ধতা এই বক্তৃতায় উঠে এসেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সংবিধান সভার সদস্য খুশন্ তালকদাস শাহ (কেটি শাহ) এবং হরিবিষ্ণু কামাথ (এইচভি কামাথ)-এর বক্তব্য। বিহার ও যুক্তপ্রদেশ থেকে কংগ্রেস পার্টির তরফে সংবিধান সভার সদস্য মনোনীত হলেও, এই দুই প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। ১৯৩৫ সালের ব্রিটিশ-প্রণীত ভারত সরকার আইন (Government of India Act)-কে প্রায় হুবহু অনুকরণ করে শাসনবিধি রচনার প্রসঙ্গে তাঁদের আপত্তি ও সাবধানবাণী অধ্যাপক বসুর বক্তৃতায় গুরুত্ব পেয়েছে।
অধ্যাপক বসুর বক্তৃতার বিষয় ছিল, কীভাবে ভারতীয় জনতার উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের পটভূমিতে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আক্ষরিক অর্থে নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে সার্বজনিক ভোটাধিকার সংবিধানস্বীকৃত অধিকার ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শাসনক্ষমতার হস্তান্তর, জনগণের স্বাধীনতার নামে দেশীয় শাসকবর্গের প্রকট আধিপত্য, সর্বোপরি দেশভাগের নামে এক বিচিত্র ক্রূর ব্যবস্থার প্রতিদানে প্রাপ্ত শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি অধ্যাপক বসুর বক্তৃতায় স্থান পেলেও— উপনিবেশবিরোধী সামরিক সংগ্রাম, বিশেষত আজাদ হিন্দ ফৌজ ও রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির (আরআইএন) নৌবিদ্রোহ— এই ধারালো সংগ্রামের উপস্থিতি ও অবদান তাঁর আলোচনায় অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু আমরা আশা করেছিলাম।
হতে পারে, আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং আরআইএন-এর নৌবিদ্রোহের ইতিহাস অধ্যাপক বসুর বক্তৃতায় স্থান পায়নি, কারণ এই বিদ্রোহগুলির কুশীলবদের কেউই সংবিধান প্রণয়নের স্থান পাননি। সংবিধান রচয়িতাদের কেউই ভারতীয় জনতার এই সশস্ত্র বিদ্রোহগুলির কোনও ভূমিকা সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় বিবেচনা করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। অথচ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি স্বয়ং স্বীকার করে গিয়েছেন যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাবিদ্রোহ ও আরআইএন-এর নৌবিদ্রোহই ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্ধারক প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তখন পিভি চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং পরে, ১৯৫৬ সালে, পশ্চিমবাংলার অন্তর্বর্তী রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। ডঃ আরসি মজুমদারের লেখা A History of Bengal গ্রন্থের প্রকাশককে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে লেখা এক চিঠিতে চক্রবর্তী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির সঙ্গে নিজের কথোপকথনের বিবরণ লিখে গেছেন। সেখানে অ্যাটলি অকপটে জানান— “গান্ধিজির নেতৃত্বে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের তুলনায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাবিদ্রোহ এবং আরআইএন-এর নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর ত্বরান্বিত করতে বাধ্য করেছিল।”[1] অপর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনও এই দাবিকেই সমর্থন করে:
“কলকাতার রাজভবনে, ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বিচারপতি পিভি চক্রবর্তীর কাছে এই সত্যটি প্রকাশ করেছিলেন যে, আইএনএ-র ব্যর্থতার ঠিক পরেই শুরু হওয়া আরআইএন বিদ্রোহই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হয়েছিল— সত্যাগ্রহ বা অহিংস আন্দোলন নয়। একই গল্প ভিন্ন শব্দে মাউন্টব্যাটেনও প্রকাশ করেছিলেন।”[2]
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানকালীন সময়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবিদ্রোহ
১৯১৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জার্মানির কিয়েল (Kiel) বন্দরের নৌবিদ্রোহ এবং ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বোম্বে, করাচি ও অন্যান্য বন্দরে ভারতীয় নৌসেনার বিদ্রোহ— এই দুটি ঘটনার তুলনামূলক বিচার আমরা করতে পারি। কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের সঙ্গে আইএন-এর রেটিংদের বিদ্রোহের তুলনামূলক বিচার আমাদের দেশে স্বাধীনতার প্রাক্কালে নৌবিদ্রোহের প্রাসঙ্গিকতা ও সীমাবদ্ধতা দুই-ই বুঝতে পারি।
কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাজিত জার্মানিতে শ্রমিক বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সূচনা করেছিল। অপরদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের প্রাক্কালে ভারতীয় নৌসেনার বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানকে ত্বরান্বিত করলেও, এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অদীন জনতার মধ্যে বিদ্রোহের আবেদন ও বার্তা অত্যন্ত সীমিত পরিসরে গ্রহণযোগ্যতা ও আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
প্রসঙ্গত, কিয়েল বন্দরের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের আরও একটি অদ্ভুত যোগসূত্র রয়েছে। আবিদ হাসানকে সঙ্গে নিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এই কিয়েল বন্দর থেকে U-180 মডেলের সাবমেরিনে চেপে জাপান-অধিকৃত মালয়ের উদ্দেশে রওনা হন। সমুদ্রতলে প্রায় ৯০ দিন ভ্রমণ শেষে জাপানি সাবমেরিনের সহায়তায় তাঁরা সুমাত্রায় পৌঁছন।
১. জার্মানির কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহ, অক্টোবর-নভেম্বর ১৯১৮:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানকালে কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহ গোটা জার্মানিতে শহুরে নিপীড়িত শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে ‘রেট রিপাবলিক’ (Rate Republik) নামে একটি সংগঠনের ভিত্তিতে এক বিপ্লবী শাসনব্যবস্থার বিউগল বাজিয়ে দিয়েছিল। ১৯১৮ সালের নভেম্বর থেকে ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময় জুড়ে কারখানার শ্রমিকদের ‘শ্রমিক কাউন্সিল’ নামে জার্মান জুড়ে স্বেচ্ছাশাসনের সংগঠন শিল্পপতিদের সমাজ-সহ যুদ্ধকালীন সামরিক নেতৃত্বের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। কিয়েল বন্দরের বিদ্রোহী নাবিকরা জার্মান শ্রমিক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত এই বিদ্রোহে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। রেলগাড়িতে চড়ে তাঁরা জার্মানির বিভিন্ন শহরে ঘুরে শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন বিদ্রোহের বার্তা। জার্মান নৌসেনাদের এই বিপ্লবী নাবিকদের বার্তাবাহক ভূমিকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক এরিক ঊইৎজ (Eric Weitz) লিখেছেন—
“১৯১৮-১৯ সালের বিপ্লব কিয়েল থেকে রেলপথের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহের গতিবিধি রেলওয়ের সময়সূচি অনুসারে অনুধাবন করা যায়। নাবিকেরা বন্দর শহর থেকে রেলে চড়ে এই খবর ছড়িয়ে দিতে বেরিয়েছিল যে তারা যুদ্ধের যথেষ্ট ভোগান্তি সহ্য করেছে এবং তাদের অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তারা ব্রেমেন, হামবুর্গ, বোখুম, এসেন, ব্রাউনশোয়াইগ, বার্লিন, আরও দক্ষিণে মিউনিখ ও বাভারিয়াতে পৌঁছে গিয়েছিল। বিদ্রোহের বার্তা জনতার কাছে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিল কারণ নাবিকেরা যুদ্ধের অবিলম্বে সমাপ্তি চাইছিল। বিদ্রোহী নাবিকেরা কাইজার ও তাঁর জেনারেলদের অপসারণ এবং একটি নতুন, গণতান্ত্রিক সরকারের আহ্বান জানিয়েছিল। কারখানার নারী-পুরুষ শ্রমিকরা তাঁদের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ইত্যাদি ফেলে দিয়ে খোলা জায়গা বা কারখানার প্রধান হলে জড়ো হয়েছিল এবং একই দাবি করেছিল। সবদিক থেকে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানানোর আবেদন উঠে এসেছিল।”[3]
থিয়োডর প্লেভিয়র (Theodor Plievier) ছিলেন এমনই এক বিদ্রোহী নৌসেনা, যিনি কিয়েল বন্দরের অদূরে ভিলহেল্মশ্যাফেন (Wilhelmshaven) নামক সামরিক নৌঘাঁটিতে যুদ্ধজাহাজে কর্তব্যরত অবস্থায় বিদ্রোহের লাল পতাকা উড়িয়েছিলেন। বহু নাবিকের (রেটিং) মতো তিনিও একটানা ৪৫১ দিন মাটিতে পা রাখার সুযোগ পাননি। এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার মধ্যেই প্লেভিয়র বিপ্লবী ভাবধারার সংস্পর্শে আসেন— যদিও তিনি বিশেষ কোনও রাজনৈতিক দলের সভ্যপদ নেননি।
১৯৩২ সালে তিনি নৌবিদ্রোহ তথা জার্মান শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের অনুপুঙ্খ দলিল হিসাবে এক অনবদ্য উপন্যাস রচনা করেন— Der Kaiser ging, die Generale blieben। অর্থাৎ, কাইজার গেল, জেনারেলরা রয়ে গেল। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর নিযুক্ত হওয়ার পর প্লেভিয়রের সমস্ত রচনা নিষিদ্ধ করা হয় এবং জনসমক্ষে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এই উপন্যাসে প্লেভিয়র নাবিকদের রেলগাড়িতে চেপে বিদ্রোহের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের একটি পরিচ্ছেদের নাম— বিদ্রোহীরা দেশের ভেতরে যাত্রা করল (The Mutineers Go Inland)। সেখানে লেখা আছে:
রাউমশুহ্, বনচিঝক্, ফিয়েট, হেইন-সহ নয়জন নাবিক— যারা আরও অনেকের মতো কিয়েল ছেড়ে ট্রেনে কিংবা পায়ে হেঁটে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে একত্রিত হয়েছিল— কিয়েল স্টেশনে হামবুর্গগামী একটি ট্রেন খুঁজে পায়… নয়জন লোক ট্রেনে উঠে তাদের আসনে বসে।
—ঠিক আছে, আমরা ট্রেনে বসতে পেরেছি।
—গতকাল হামবুর্গে একটা বড় সভা হওয়ার কথা ছিল। বন্দরের শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে। দুর্ভাগ্য যে আমরা সেখানে থাকতে পারলাম না।নাবিকরা ভয় পাচ্ছে যে তারা হামবুর্গে পৌঁছাতে দেরি করে ফেলতে পারে। সব ঘটনা হয়তো হয়ে যাবে ততক্ষণে। তাদের এটা মনে হয় না যে, বিপরীতে তারা হয়তো খুব তাড়াতাড়িও পৌঁছাতে পারে এবং তখন হয়তো স্টেশনে সেনাবাহিনীর গুলির মুখে পড়তে হবে…
একটি ছোট সাইডিং-এ যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কারখানার কিছু মহিলা শ্রমিক ট্রেনে ওঠে। তাদের বয়স কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যে।
—আমরা ধর্মঘটে আছি, এক মহিলা বলেন।
—আমরা হামবুর্গে বাড়ি যাচ্ছি।
—এতেই সব শেষ হবে, এবার নিশ্চিত।
—তবে উপরের লোকজন অযথা সময় নিচ্ছে।রেলযাত্রা, যা সাধারণত তিন ঘণ্টার কম সময় নেয়, তা অবিরাম চলতে থাকে। ট্রেন বারবার থামে। হামবুর্গ যত কাছে আসে, গতি যেন তত ধীরে হয়।
মেয়েদের কাছে কোনও সংবাদপত্র নেই, কিন্তু খবর ঠিকই আছে:
—হামবুর্গের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
—আপনি শুনেছেন? ব্লোম অ্যান্ড ভস ডকে লাল পতাকা উঠেছে।
—হাইলিগেনগাইস্টফেল্ডে সকালে বড় বিক্ষোভ হয়েছে।
—নাবিকরা হলস্টেনগ্লাসিস জেল থেকে বন্দিদের মুক্ত করেছে।
—বুন্দেসস্ট্রাসের ব্যারাক থেকে সৈন্যরা বিক্ষোভকারীদের মধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত বোমা ছুড়েছে।
—গুলিও চলেছে। কিছু লোক মারা গেছে।
—এই ট্রেনটা আর চলবে না নাকি?
—এই যে গার্ড, আমরা কখন যাব?অবশেষে কেউ একজন দুটি পুরনো সংবাদপত্র খুঁজে পায়— বার্লিনার টাগেব্লাট এবং ভোরওয়ার্টস, দুটিই গতকালের। কোনওটিতেই বিপ্লবের বিস্তার নিয়ে একটি শব্দও নেই।
—পোজেনের বাসিন্দারা জার্মানিতেই থাকতে চায়— এক মহিলা বনচিঝকের কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে পড়ে।
বনচিঝক্ পাতা উল্টে কিয়েল বা হামবুর্গ সম্পর্কিত কোনও খবর খোঁজার বৃথা চেষ্টায় পাতা ওল্টায়।
হঠাৎ সে চমকে ওঠে। তার হাত মাথায়।
—আমি কি পাগল হয়ে গেছি? কেউ আমায় চিমটি কাটো!
—এই আস্তে… এত জোরে না।
—তোমার কী হয়েছে?
—আরে দেখো… এটা শুধু পড়ো…সে ভোরওয়ার্টস-এ বড় অক্ষরে ছাপা একটি বিজ্ঞপ্তির দিকে ইঙ্গিত করে:
শেষ সুযোগ!
বুধবার দুপুর ১টার মধ্যে যুদ্ধ ঋণ (War Bond)-এ যোগ দেওয়ার তালিকা বন্ধ হয়ে যাবে। যাঁরা এখনও করেননি, এখনই অংশগ্রহণ করুন!—আশ্চর্য!
—আর রবিবার কিয়েলে লোক মারা গেছে।
—সোমবার আমরা সৈনিক পরিষদ গঠন করেছি।
—মঙ্গলবার নস্ককে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে।
—এবং এই কাগজ বুধবারের!
—ভোরওয়ার্টস-এর এই খবর বিশ্বাস করা যায়? এই ছেলেরা, আমাদের বার্লিন যেতে হবে, সেখানেই যাব। দুঃখের কথা, সঙ্গে কিছু নৌ-কামান আনতে পারিনি, না হলে ওদের দপ্তরে কটা শেল ছুঁড়ে দিতাম! তাহলে যদি ঘুম ভাঙত।
—এই রেলগাড়ি কি কখনও চলবে না?
—চলতে শুরু না করলে, আমি বলছি, আমরা নেমে হেঁটে যাই।
—হামবুর্গ কত দূর?
—রাত হয়ে যাবে পৌঁছাতে, এক মহিলা বলে ওঠে।অবশেষে ট্রেনটি চলতে শুরু করে। এক–দুবার বগিগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায়। স্প্রিংগুলো কিচিরমিচির করে, চাকা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তোলে।[4]
কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের ঘটনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান ইতিহাসে এক সুপরিচিত অধ্যায়। যুদ্ধশেষে কাইজারের শাসন জার্মান সমাজে এতটাই পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল যে, এমনকি হিটলারের আমলেও রাইখ্ (Reich) সরকার পদচ্যুত কাইজার উইলহেল্ম দ্বিতীয়কে (Wilhelm II) হল্যান্ডের নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনও উদ্যোগ নেয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নায়ক, একদা প্রুশিয়ার রাজত্বকারী মহাপ্রতাপশালী হোহেনজোলার্ন (Hohenzollern) রাজবংশের শেষ প্রতিনিধি, সেই কাইজারের জীবন শেষ হয় হল্যান্ডে নির্বাসনের মধ্যে। ১৯৪১ সালের ৪ জুন, একান্ত নিভৃত জীবনযাপনের মধ্যেই সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
১ক. ভিলহেল্মশ্যাফেন দুর্গ ও কিয়েলে নৌবিদ্রোহের রাজনৈতিক পটভূমি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নৌবহরে বিদ্রোহের একটি স্পষ্ট ধারাবাহিকতা ছিল। ১৯১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ভিলহেল্মশ্যাফেন দুর্গে দুই তরুণ বিদ্রোহী নাবিক— ম্যাক্স রাইখপিয়েটশ (Max Reichpietsch, ১৮৯৪–১৯১৭) এবং আলবিন কোবিস (Albin Kobis, ১৮৯২–১৯১৭)-কে যুদ্ধবিরোধী প্রচার ও সংগঠনের অভিযোগে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই বিদ্রোহী তরুণ রেটিংদের অধিকাংশই যুদ্ধ শুরুর সময়ে নৌবাহিনীতে যোগ দেন এবং তাঁদের অনেকেই এর আগে মজুরশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন। যেমন, প্লেভিয়র নিজে ১৯১০ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত চিলিতে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম নাইট্রেট (যবক্ষার) খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯১৪ সালে হামবুর্গ শহরে এক সন্ধ্যায় মদ্যপ অবস্থায় গোলমাল করায় তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং পরবর্তীতে নৌবাহিনীতে পাঠানো হয়।
জার্মানির শ্রমিক জনতার মধ্যে সমাজ-গণতন্ত্রী রাজনীতির প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুপরিচিত। যুদ্ধে নিযুক্ত মজুর-শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমশই প্রথম মহাযুদ্ধকে ঘিরে ব্যাপক মোহভঙ্গ দেখা দেয়। এই জনসমষ্টির একটি বড় অংশই সমাজ-গণতন্ত্রীদের বামপন্থী শাখা স্পার্টাকাস গোষ্ঠীর (Spartakusbund) মহাযুদ্ধবিরোধী প্রচারে আকৃষ্ট হতে থাকেন। বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের নৌসৈনিক, রেটিং এবং পদাতিক সেনাদের মধ্যে কার্ল লেইবকনেখট (Karl Liebknecht) একটি জনপ্রিয় সুপরিচিত নেতার নাম হয়ে ওঠেন। সমাজ-গণতন্ত্রী ডেপুটিদের মধ্যে তিনিই প্রথম ডেপুটি যিনি War Bond তথা যুদ্ধ-ঋণপত্রের নামে জনতার কাছ থেকে অর্থসংগ্রহের বিরোধিতা করেন। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মান সংসদ (Reichstag)-এ দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অপরাধে লেইবকনেখটকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংসদের ডেপুটি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এক বছরের জন্য ফৌজে সশ্রম নির্দেশ পালনের শাস্তি দেওয়া হয়। তবু কাইজারের প্রুশিয়ান শাসন তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯১৬ সালের ১ মে, বার্লিনের পটসডাম স্কোয়ারে একটি বিশাল যুদ্ধবিরোধী জনসভায় তিনি পূর্ণ সামরিক পোশাকে উপস্থিত হন এবং জার্মানির এই সর্বনাশা যুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র বিরোধিতা করেন। রেইখ সরকার তৎক্ষণাৎ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে চার বছর ছয় মাসের সশ্রম কারাবাসের নির্দেশ দেয়। একমাত্র বিপ্লবের প্রাকমুহূর্তে, ১৯১৮ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মুক্তি লাভ করেন।[5]
বিদ্রোহী নাবিক ও সৈনিকদের মধ্যে কার্ল লেইবকনেখটের জনপ্রিয় আহ্বান ছিল: “Der Feind steht im eigenen Land” অর্থাৎ, “যুদ্ধ নিপাত যাক! শত্রু নিজের দেশের মধ্যেই আছে।”
ভিলহেল্মশ্যাফেন নৌঘাঁটি ও কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী তরুণ নাবিকদের মধ্যে সমাজ-গণতন্ত্রীদের বামপন্থী ধারার যুদ্ধবিরোধী প্রচার এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। এই ধারার অন্যতম একটি গোষ্ঠী ছিল International Communistan Deutschlands (IKD) বা International Communists of Germany। জার্মানির শ্রমিক, নাবিক ও সৈনিকদের অভ্যুত্থানের সন্ধিক্ষণে, ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে এই IKD গোষ্ঠী ও স্পার্টাকাস গোষ্ঠী মিলে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির (Kommunistische Partei Deutschlands, সংক্ষেপে KPD) প্রতিষ্ঠা করে।
IKD-র অনুগামী বিদ্রোহী নাবিক এর্নস্ট শ্নাইডার (Ernst Schneider) ছিলেন ভিলহেল্মশ্যাফেন নৌঘাঁটি বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক। বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি দেশত্যাগ করে লন্ডনে আত্মগোপন করেন। সেখানেই ইকেরাস্ (Icarus) ছদ্মনামে ১৯৪৩ সালে তিনি ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে ভিলহেল্মশ্যাফেন নৌবিদ্রোহের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল রচনা করে রেখে যান।
১খ. ভিলহেল্মশ্যাফেন ঘাঁটি এবং কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের ঘটনাবলি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম পর্যায়ে জার্মান নৌ-অধিনায়কমণ্ডলী নৌবাহিনীর আত্মসম্মান রক্ষার স্বার্থে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক সর্বশেষ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯১৮ সালের ২৯ অক্টোবর রাতে কাইজার দ্বিতীয় উইলহেল্ম বার্লিন থেকে পালিয়ে সামরিক সদর দপ্তরে আশ্রয় নেন। একই সময়ে কার্ল লেইবকনেখট বার্লিনে বিপ্লবীদের এক জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন এবং এক ব্যাপক গণবিপ্লবের আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
এই সময়েই জার্মানির ‘গভীর সমুদ্রগামী নৌবহর’ (High Seas Fleet)-কে সমুদ্রযাত্রার আদেশ দেওয়া হয়। সামরিক সদর দপ্তর থেকে অ্যাডমিরাল ফন শেয়ার কিয়েলের নৌবহরের অ্যাডমিরালকে নির্দেশ পাঠান— “ইংরেজ নৌবাহিনীকে আক্রমণের জন্য হাই সিজ ফ্লিটকে প্রস্তুত করা হোক।” স্কোয়াড্রন অধিনায়কদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লেখা হয়— “হাই সিজ ফ্লিট ইংলিশ চ্যানেলের দিকে অগ্রসর হবে যাতে জার্মান স্থলসেনাবাহিনীর দক্ষিণদিকের অংশকে সহায়তা করা যায়। যদি আমাদের যুদ্ধজাহাজ ইংরেজ নৌবহরের মুখোমুখি হয়, তবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।”[6]
জার্মান নৌসেনাধ্যক্ষদের এই আত্মঘাতী পরিকল্পনা ভিলহেল্মশ্যাফেন ঘাঁটি থেকে কিয়েল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া নৌবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধজাহাজে কর্মরত নীল উর্দিধারী নাবিকেরা এবং জাহাজের ফার্নেসে কয়লা সরবরাহকারী ইঞ্জিনকর্মীরা আদৌ এই আত্মঘাতী অভিযানে যোগ দিতে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। ২৮-২৯ অক্টোবর রাতের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় স্কোয়াড্রনের নাবিকেরা বিদ্রোহ করেন, নিজেদের জাহাজের অফিসারদের নির্দেশ অমান্য করেন। এরপর, নৌ-কমান্ড যখন তৃতীয় স্কোয়াড্রনকে কিয়েল বন্দরে ফেরার নির্দেশ দেয়, সেইসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত নেতাদেরও জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন বিদ্রোহ প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে আরও তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯১৮ সালের ৩ নভেম্বর কিয়েল শহরে নাবিক ও শ্রমিকদের এক প্রতিবাদসভা হয়, যেখানে যুদ্ধ বন্ধের দাবি তোলা হয় এবং বন্দি বিদ্রোহীদের মুক্তির উদ্দেশ্যে একটি সুবৃহৎ মিছিল সংগঠিত হয়। এই মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালালে সাতজন নিহত হন। বিক্ষোভকারীরা সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সন্ধ্যার মধ্যেই কিয়েল শহর কার্যত বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। পরদিন শহরের বিভিন্ন অংশে মিছিল শুরু হয়, ও প্রশিক্ষণ মাঠে গিয়ে তা একত্রিত হয়। প্রথমে বিদ্রোহীদের বক্তব্য ও ঘটনাবলির রিপোর্টের পর শ্রমিক ও নাবিকদের কাউন্সিল নির্বাচনের ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি যুদ্ধজাহাজ, প্রতিটি কারখানা ও শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড বা অঞ্চলের জন্য একটি কাউন্সিল ও একজন প্রতিনিধি নির্ধারিত হয়। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রতিনিধিদের এক সভায় কিয়েল শহরের একটি নির্বাচিত বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। প্রতিনিধিসভা থেকে ২১ জনের একটি নির্বাচিত পরিষদ ঘোষিত হয়, যা কার্যত কিয়েলের প্রশাসনিক সরকার ছিল। এই পরিষদ ৫ সদস্যের একটি কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচন করে। সর্বসম্মতিক্রমে যার সভাপতি হন নৌসেনা সদস্য কার্ল আর্টেল্ট। তবে এই ৫ সদস্যের কমিটির প্রথম বৈঠকে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে চারজনই বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী নন। পঞ্চম সদস্য অন্যদের বলেন, দুর্বল এবং দোদুল্যমান সদস্যদের দ্বারা বিপ্লব সম্ভব নয়, এবং তিনি তাঁদের সঙ্গে সফলভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন না। তবে, তৎকালীন পরিস্থিতি তাঁদের কিছু সময়ের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে সুযোগ করে দিয়েছিল।
একইভাবে ভিলহেল্মশ্যাফেন নৌঘাঁটিও ৬ নভেম্বর ১৯১৮-তে বিদ্রোহী নাবিকদের দখলে চলে যায়।
অস্থায়ী পরিষদের তরফে কিয়েলের গভর্নর অ্যাডমিরাল উইলহেল্ম সৌশহনের (Wilhelm Souchon) সামনে বিদ্রোহীরা তিন দফা দাবিসনদ পেশ করেন। এই দাবিগুলি ছিল:
- জার্মান নৌসেনাধ্যক্ষদের প্রস্তাবিত আক্রমণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা,
- গতদিনের মিছিলে গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি,
- তৃতীয় স্কোয়াড্রনের বন্দি নাবিকদের অবিলম্বে মুক্তি।
বিদ্রোহী জনতার রোষের সংগঠিত চাপে অ্যাডমিরাল সৌশহন শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন।
প্লেভিয়র তাঁর উপন্যাসে লিখছেন:
—অ্যাডমিরাল দাবি মেনে নিয়েছেন!
—বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
—নৌবহর বাইরে যাবে না।
—যুদ্ধ শেষ।
—শান্তি!
—শান্তি!
—সৈনিক পরিষদ নির্বাচন করুন।এই বার্তাগুলি ব্যারাকের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জাহাজে জাহাজে উত্তেজনা বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ে। বাঁধ অবশেষে ভেঙে গেছে, বিদ্রোহ আর ধরে রাখা যাচ্ছে না।… শহরের গোটা চেহারাটাই বদলে গেছে। বিশাল জনতা— নাবিক, ডক-কর্মী, মহিলা— রাস্তা জুড়ে নেমে এসেছে। ট্রামগুলো জনতার ভিড়ে তাদের ট্র্যাকে আটকে গেছে। যাত্রীরা নেমে পড়েছে, চালক ও মহিলা কন্ডাক্টররাও তাদের স্থান ছেড়ে মিছিলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।…
উইলহেল্মসপ্লাটজ জুড়ে, হোলস্টেনস্ট্রাসে এবং ড্যামটোরস্ট্রাসে দিয়ে নাবিক ও সৈনিকদের সারি মার্চ করে— “চলো ফেল্ডস্ট্রাসেতে! দুর্গের কারাগারে!”
কারাগারের চারপাশে তখন অগণিত জনতার ঢল। ভিতরে সি ব্যাটালিয়নের একটি সশস্ত্র কোম্পানি তখনও প্রহরায় থাকলেও, সৈনিক পরিষদের প্রতিনিধি ও নেতা গেইমরাট আইশাইম (Geheimrat Eichheim) কারারক্ষীদের সঙ্গে তখন বন্দি নাবিকদের কক্ষগুলির তালা খুলে দিচ্ছেন।
এবং অবশেষে তারা আসে— বন্দিদের ধূসর শোভাযাত্রা। ড্রামের রোল, বিউগলের বাজনা— ‘ইন্টারন্যাশনাল’-এর গান:
জাগো, জাগো! সর্বহারা,
অনশন ও বন্দি ক্রীতদাস!
১গ. ভিলহেল্মশ্যাফেন ঘাঁটি এবং কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহের বিপর্যয় ও গুস্তাভ নোস্কের ভূমিকা
ভিলহেল্মশ্যাফেন ঘাঁটি ও কিয়েল বন্দরে নাবিক, জাহাজকর্মী এবং সৈনিকেরা গণবিদ্রোহের মাধ্যমে জার্মান নৌসেনার উচ্চপদস্থ নেতৃত্বের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আত্মঘাতী পরিকল্পনাকে রুখে দিতে পেরেছিলেন। ভিলহেল্মশ্যাফেন ঘাঁটি থেকে নতুন আর কোনও নৌবহর সমুদ্র অভিযানে যায়নি।
এরই মধ্যে কাইজার উইলহেল্ম দ্বিতীয় দেশত্যাগ করেন, এবং তারপর জার্মান সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ও বার্লিনের অন্তর্বর্তী রেইখ্ (Reich) সরকার মিত্রশক্তির সঙ্গে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে (Armistice) স্বাক্ষর করে। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় রেইখ সরকারের প্রতিনিধি ম্যাথিয়াস এরজবার্গার এবং মিত্রশক্তির সর্বাধিনায়ক মার্শাল ফার্দিনান্দ ফশ্ (Marshal Ferdinand Foch) ফ্রান্সের কোঁপিয়েন (Compiègne) শহরের নিকটবর্তী কোঁপিয়েন বনের মাঝে সংরক্ষিত মার্শালের রেলওয়ে স্যালুন কামরায় (railway saloon)।
কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহ এবং জনতার বিদ্রোহের আবেদন কেবলমাত্র যুদ্ধের অবসানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিদ্রোহীরা চেয়েছিলেন আরও কিছু— আরও বড়, আরও গভীর এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন। তাঁরা চেয়েছিলেন জার্মানিতে রেইখ্ সরকারের অবসান, নাবিক-সৈনিক-শ্রমিকদের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা কাউন্সিল-রাজ, একটি জনতার রাজ— যা গঠিত হবে জনতার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে। ভিলহেল্মশ্যাফেন নৌঘাঁটির বিদ্রোহী নাবিকরা নিজেদের “বিপ্লবী ভিলহেল্মশ্যাফেন কম্যুন” (The Revolutionary Wilhelmshaven Commune) হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহী নাবিক আর্নস্ট স্নাইডার (Ernst Schneider) ইকেরাস (Icarus) ছদ্মনামে লিখে গেছেন:
উত্তর সাগর দুর্গে (North Sea Station) বিপ্লবী নাবিকরা লড়াই করতে, জয়লাভ করতে বা তাঁদের অভীপ্সার জন্য প্রাণ দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁরা শপথ নিয়েছিলেন— পুরনো শ্রেণিসমাজের অবসান ঘটবে, আর কখনও তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না; আর থাকবে না কোনও দাসত্ব, থাকবে না পুঁজিবাদী যুদ্ধ— তাঁদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই নাবিকদের আত্মাকে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। তাঁদের মনে তাঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রমিকদের এক নতুন বিশ্বব্যাপী সমাজের, এক স্বাধীন সমাজ যেখানে থাকবে না ভয় বা অভাব। সেই সমাজ গড়ে উঠবে শ্রমিক-গণতন্ত্রের ভিত্তিতে, এবং তা বিকশিত হবে একক মানবসমাজ হিসেবে।
[…]
১৫ জানুয়ারি, রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লেইবকনেখটকে বার্লিনে এবার্টের সৈন্যদের অফিসাররা হত্যা করে। উইলহেল্মশ্যাফেনে আইকেডি (IKD) ১৬ জানুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। সেই সময়ে ঘাঁটিতে উপস্থিত কয়েকশো শিল্পশ্রমিকের পাশাপাশি নৌবাহিনীর পাঁচ শতাধিক নাবিকও ধর্মঘটে সামিল হন। গণমিছিল ও সশস্ত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধজাহাজ ও থাউজেন্ড-ম্যান ব্যারাকের পতাকাদণ্ডে লাল পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় বাতাসে উড়ছিল। সমুদ্রকর্মে নিয়োজিত প্রলেতারিয়েতরা তাঁদের দুই প্রিয় কমরেডের স্মৃতিতে শোক পালন করেছিলেন— ঠিক সেই সময়েই Vorwärts-এর হত্যা-উস্কানিদাতা লেখক তার রচনার রক্তাক্ত পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিল।[7]
এইখানে আমাদের রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লেইবকনেখটকে হত্যার নির্দেশদাতা গুস্তাভ নোস্কের উল্লেখ করতে হয়। গুস্তাভ নোস্কে ছিলেন সমাজ-গণতন্ত্রী (এসপিডি) দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, স্পার্টাকাস গোষ্ঠীর চরম বিরোধী এবং সামরিক ব্যবস্থার সমর্থনকারীদের অন্যতম প্রবক্তা। কাইজার শাসনের অবসানের পর তিনি যুদ্ধফেরত পরাজিত, হীনম্মন্য, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, ভবঘুরে সেনাদের (Freikorps) নিয়ে এক সামরিক শক্তি গঠনের কাজে লিপ্ত হন। ১৯১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, সমাজ-গণতন্ত্রী অধিকর্তা ফ্রিডরিখ এবার্টের নেতৃত্বে বার্লিনের অন্তর্বর্তী রেইখ্ সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন নোস্কে।
ব্যক্তিগত জীবনে, গুস্তাভ নোস্কের বাবা ও ঠাকুরদা দুজনেই কাপড় বুনতেন, নোস্কের জন্মের সময়ে তাঁর বাবা নিম্নস্তরের তত্ত্বাবধায়ক পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তবে, পরিবারের আয় কম ছিল এবং তাঁর মা স্থানীয় চুরুট কারখানায় কাজ করতেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি স্কুল ছেড়ে একজন শিক্ষানবিশ তাঁতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। সতেরো বছর বয়সে নোস্কে ঝুড়ি বোনার একজন দক্ষ শ্রমিক হয়ে ওঠেন। শ্রমজীবী আন্দোলনে প্রাথমিক সাফল্যের সুবাদে তিনি ট্রেড ইউনিয়নকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর কাকার মাধ্যমে, যিনি প্রথমদিকের জার্মান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, নোস্কে সমাজ-গণতন্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলেন এবং জার্মানির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় সমাজ-গণতন্ত্রী নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে তৎকালীন এসপিডি-র অন্যতম নেতা অগাস্ট বেবেলের অনুরোধে নোস্কে প্রথমবার স্যাক্সনি প্রদেশ থেকে রাইখস্ট্যাগে নির্বাচিত হন। এরপর থেকে নোস্কে বরাবর রাইখস্ট্যাগে এসপিডি দলের সামরিক মুখপাত্র হয়ে বক্তব্য রাখেন, কাইজার শাসনের অধীনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের সমর্থনে রাইখস্ট্যাগে জোরলো ভাষণ দিতে থাকেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে রাইখস্ট্যাগে ভাষণ দিতে গিয়ে নোস্ক বলেন, “সমাজ-গণতন্ত্রীরা জার্মানির উপর যে-কোনও আক্রমণ প্রতিহত করবে ডানপন্থী সদস্যদের মতোই দৃঢ়তার সঙ্গে।” তিনি চেয়েছিলেন জার্মানি যতটা সম্ভব সামরিকভাবে সুসজ্জিত হোক এবং সাধারণ জনগণও সেনাবাহিনীর প্রতি নিষ্ঠাবান থাকুক। ১৯১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি রাইখস্ট্যাগে তাঁর সবচেয়ে জোরালো এবং বিতর্কত বক্তৃতাটি জার্মানির সমরবাদের প্রতি এই সমাজ-গণতন্ত্রী নেতার একনিষ্ঠ সমর্থনের অবস্থানকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এই ভাষণটিতেই এসপিডি-র র্যাডিক্যাল অংশের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত দূরত্ব চূড়ান্ত হয়ে ওঠে। তাদের মুখপাত্র রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদে কলম ধরেন ১৯১৬ সালের এপ্রিলে। তিনি নোস্কের বক্তব্যকে ‘রক্তাক্ত অত্যাচারের জন্য চিৎকার’ বলে আখ্যা দেন এবং তাঁকে ও অন্যান্য সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের ‘পৈশাচিক যুদ্ধপ্রবণতা’ উসকে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে মন্তব্য করেন।
কিয়েল বন্দরের নৌবিদ্রোহকে প্রশমিত করতে বার্লিনের সামরিক কর্তৃপক্ষ গুস্তাভ নোস্কেকেই উপযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করে। কিয়েলের গভর্নর অ্যাডমিরাল সৌশহনের বার্তা থেকে তাদের মনে হয়েছিল বিদ্রোহী নাবিকেরা কোনও সমাজতান্ত্রিক নেতাকে তাঁদের বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করতে পারেন, এমনকি তাঁকে তাঁদের মিত্র বলেও ভাবতে পারেন। আবার নোস্কেরও নৌবহরের বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল, এবং নৌ-কমান্ডের অনেক অফিসারই তাঁর পরিচিত, এমনকি বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। কিয়েলের গভর্নরের এক টেলিগ্রামের উত্তরে বার্লিনের অন্তর্বর্তী রেইখ্ সরকারের পক্ষ থেকে রাইখস্ট্যাগের দুই সদস্যকে— একজন প্রগতিশীল মন্ত্রিসভার সদস্য কনরাড হাউসম্যান, এবং অপরজন গুস্তাভ নোস্কে— কিয়েলে পাঠানো হয়। ৪ নভেম্বর তাঁরা রেলগাড়িতে করে কিয়েলে পৌঁছন। স্টেশনে নীল ঊর্দিধারী নাবিক ও রাইফেলধারী সৈনিকেরা তাঁদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। তাঁদের ‘নিজেদের লোক’ মনে করে সৈনিকেরা মোটরগাড়িতে করে শহরে নিয়ে চলেন বিদ্রোহীদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য।
সংসদীয় রাজনীতির একজন অভিজ্ঞ নেতা হিসেবে নোস্কে দ্রুত বিদ্রোহী নাবিক ও সৈনিকদের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা এবং তাঁদের বিশৃঙ্খল অবস্থা বুঝতে পারেন। শহর জুড়ে বহু স্থানে বিদ্রোহী সৈনিক ও নাবিকদের সঙ্গে অফিসারদের গুলিবিনিময় চলছিল। সৈনিকেরা বহু অফিসারকে গ্রেপ্তার করে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছিলেন। তাঁদের নির্বাচিত কাউন্সিল সদস্যদের ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর; সর্বত্রই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ে নোস্কে তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন—
কাউন্সিলের কোনও সাংগঠনিক শৃঙ্খলার চিহ্ন ছিল না। ইউনিয়ন হলটি যেন একটি বিশাল মৌচাক, যেখানে বিভ্রান্তি ও গুঞ্জন একসঙ্গে ছড়িয়ে ছিল। একশো কণ্ঠ প্রতিটি বিষয়ে ডজনখানেক মত দিচ্ছিল। সেখানে এমন কেউ ছিল না, যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।[8]
খুব দ্রুতই নোস্কে পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এক সভায় একদল বিদ্রোহী নাবিক তাঁকে বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তাঁদের অধিকাংশের বিশ্বাস ছিল— দীর্ঘদিনের সমাজ-গণতন্ত্রী এই নেতা কমরেড নোস্কে তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। প্রস্তাবটি বিপুল সমর্থন পায়। এর পরেই—
নোস্কে কিয়েল স্টেশনের হলঘরে শ্রমিক শপ স্টুয়ার্ড প্রতিনিধি এবং নাবিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন, যার উদ্দেশ্য ছিল নতুন কাউন্সিল গঠনের জন্য প্রতিনিধিদের নির্বাচন। সভায় উপস্থিত ছিল প্রায় ষাটজন— যাঁদের অনেকেরই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। নোস্কে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিলেন, এমন অনভিজ্ঞ একটি দলের সঙ্গে কীভাবে কোনও শাসন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। অবশেষে, আলোচনা একটি রূপ পায়, এবং নোস্কে তাঁর নিজের সভাপতিত্বে সাত সদস্যের একটি পরিষদ গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি দ্রুত গৃহীত হয়। তবে পরিষদ সদস্য নির্বাচন ছিল একটি জটিল কাজ, কারণ অধিকাংশ প্রতিনিধি একে অপরকে চিনতেন না।[9]
এইভাবে নাবিক-সৈনিকদের প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি আস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে নোস্কে নিজেই নিজেকে বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এরপর তিনি কিয়েল বন্দরে উপস্থিত নৌবহরের জাহাজগুলি পরিদর্শন শুরু করেন, নাবিকদের আস্থা অর্জন করেন এবং অফিসারদের আশ্বস্ত করতে থাকেন।
অন্যদিকে, বার্লিনের শাসনকর্তারাও কিয়েলের গভর্নর অ্যাডমিরাল সৌশহনের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছিলেন। অবশেষে পরিস্থিতির চাপে সৌশহন পদত্যাগ করেন। নোস্কের বর্ণনায়, সৌশহন “তাঁর কোট এবং টুপি নিয়ে রাতের বেলা চুপচাপ চলে গেলেন”— কিয়েল ত্যাগ করেন, কিয়েল বন্দরে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। নোস্কের সামনে কিয়েলের নাবিক-সৈনিক কাউন্সিল রাজকে অঙ্কুরেই নিঃশেষ করার সুযোগ এসে পড়ে। সে সময়কার এক বিবরণ অনুযায়ী—
৭ নভেম্বর, স্থানীয় নাবিক পরিষদের তিনশত প্রতিনিধির একটি সভায় নোস্কেকে যথাযথভাবে গভর্নর নির্বাচিত করা হয়। মূলত, কিয়েলের কট্টরপন্থী উপাদানগুলির সঙ্গে একটি আপস-মীমাংসার ফলে লোথার পপ, কট্টরপন্থী আন্দোলনের এক নেতা এবং ইউএসপিডি-র প্রতিনিধি, সৈনিক পরিষদের চেয়ারম্যানের শূন্য পদে নির্বাচিত হন। নোস্কের ক্ষমতা দৃঢ় হয়ে ওঠায়, নাবিক আন্দোলনের ভিতরে বলশেভিজমের শিকড় গাঁড়ার সুযোগ খুব কম হয়ে যায়।[10]
কিয়েল বিদ্রোহের সূচনায় কাউন্সিলের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন নৌসেনা সদস্য কার্ল আর্টেল্ট। গুস্তাভ নোস্কের কিয়েল আগমনে তিনি সহযোগিতাও করেছিলেন। কাউন্সিলের শেষ দিনগুলি নিয়ে তিনি লিখে গেছেন:
নোস্কে যখন বুঝলেন যে কিয়েলের বিপ্লবী উন্মাদনা দেশের অন্য অঞ্চলে একইভাবে ছড়াচ্ছে না, তখন তিনি সৈনিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি ও কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের কার্যক্রম ব্যাহত করার দিকে মনোযোগ দিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল কালক্ষেপ করা, যাতে পরিস্থিতির সুযোগে একটি দমনকারী আঘাত হানার জন্য প্রতিবিপ্লব সংগঠিত হতে পারে।[11]
[ক্রমশ]
[1] Borra, Ranjan. “Subhas Chandra Bose, The Indian National Army, and The War of India’s Liberation”. The Journal of Historical Review, Winter 1982 (Vol. 3, No. 4). pages 407-439-এ উদ্ধৃত।
[2] Royal Indian Navy uprising in 1946. Indian Economy and Market (Monthly). Mumbai. Feb 2017.
[3] Weitz, Eric D. Weimar. Germany: promise and tragedy. Princeton University Press. 2007.
[4] PLIVIER, THEODOR. THE KAISER GOES: THE GENERALS REMAIN. Translated from German by WHEEN, A. W. London: Faber and Faber. May 1933.
[5] Liebknecht, Karl (1871-1919). Bibliography. encyclopedia.com.
[6] দ্রষ্টব্য, টীকা ৪, পৃঃ ৪৪।
[7] Icarus, “The Wilhelmshaven Revolt A Chapter of the Revolutionary Movement in the German Navy, 1918–1919” in All Power to the Councils! Gabriel Kuhn. PM Press. 2018.
[8] Noske, Gustav. Von Kiel bis Kapp: Zum Geschichte der deutschen Revolution. Berlin: Verlag ftir Politik und Wirtschaf. 1920.
[9] RATLIFF, WILLIAM GRANT. “THE POLITICAL CAREER OF GUSTAV NOSKE, 1918-1920”. Master of Arts Thesis, Texas Tech University. Aug, 1980.
[10] পূর্বোক্ত।
[11] Artelt, Karl. “With the Red Flag to Vice-Admiral Souchon”, in All Power to the Councils! Gabriel Kuhn, PM Press. 2012.

