Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভোটচুরির অভিযোগ আমাদের এনে ফেলেছে এক সন্ধিক্ষণে

প্রতীক

 

 


অতি বুদ্ধিমান বাঙালি ভদ্রলোক আর সারা দেশের অন্ধ ভক্তরা ছাড়া সকলেই বুঝতে পারছে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিজেপি যে কাণ্ডটি ঘটিয়ে চলেছে, তা চিরাচরিত ভোটের দিনের রিগিং নয়। সে-সব দেশের সব দলই করেছে কোনও না কোনও সময়ে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেই এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছে যাতে একটা নির্দিষ্ট দলের সমর্থকরা যতবার ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে ভোট দিতে পারে, ভোটার তালিকায় নাম যোগ-বিয়োগ করা হচ্ছে একটা দলকে হারা আসনও জিতিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে— এ জিনিস অভূতপূর্ব। এটা চলতে থাকলে দেশে আর ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রও আছে বলা যায় না

 

এক যুগ পরে এমন একটা ঘটনা ঘটল স্বাধীনতা দিবসের ঠিক দুদিন আগে, যা এতদিনের অনভ্যস্ত কানে অবিশ্বাস্য মনে হল— ভারতের শাসক দল আর বিরোধী দল একমত হয়েছে। কোন বিষয়ে? ভোটচুরি সম্বন্ধে। যে সে লোক নয়, দেশের গদ্দারদের দেখলেই গুলি করার পক্ষপাতী যিনি, সেই অনুরাগ ঠাকুর স্বয়ং সাংবাদিক সম্মেলন[1] করে ঠিক তাই বললেন, যা লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় নেতা রাহুল গান্ধি তার হপ্তাখানেক আগে বলেছিলেন— ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপি করে ভোটচুরি করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, অনুরাগ রাহুলের বক্তব্যকে আরও জোরদার করে দিয়েছেন। রাহুল তো বলেছিলেন তাঁর দলের লোকেরা নির্বাচন কমিশনের দেওয়া কম্পিউটার স্ক্যানেরও অযোগ্য সাত ফুট উঁচু কাগজ ঘেঁটে ভোটচুরির প্রমাণ বের করেছেন মোটে একখানা লোকসভা কেন্দ্রের একখানা বিধানসভা অঞ্চলে। চাইলে কমিশন বলতেই পারত যে এত বড় দেশে একটা লোকসভা কেন্দ্রে ভুলচুক হয়ে থাকতেই পারে। এ দিয়ে প্রমাণ হয় না যে সারা দেশে এ জিনিস হয়েছে। কিন্তু অনুরাগ আরও গভীরে গবেষণা করেছেন। তিনি সারা দেশের নানা রাজ্যের আধ ডজন লোকসভা আসনের তথ্য তুলে ধরেছেন। সেগুলোতেও দেখা যাচ্ছে রাহুল-চিহ্নিত মাধবপুরা আসনের মতোই কাণ্ড ঘটেছে।

৭ আগস্ট ছিল বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ হিন্দুমতে লক্ষ্মীবার। সেদিন রাহুলের সাংবাদিক সম্মেলন এবং তারপর থেকে যা যা হয়ে চলেছে, তাতে মা লক্ষ্মী হিন্দুত্ববাদীদের উপর অপ্রসন্ন বলেই বোধ হচ্ছে। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো একাধিক বিরোধী দল ভোটে কারচুপির অভিযোগ করে যাচ্ছে। প্রায় সব অভিযোগের ক্ষেত্রেই আঙুল উঠেছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের দিকে। কমিশন পাত্তা দেয়নি, বিজেপি তো দেয়নি বটেই। নিজেরা জিতলে বলেছে ‘হেরো পার্টি অজুহাত খুঁজছে’, আর বিরোধীরা জিতলে বলেছে ‘এবার কেন ওরা ইভিএমের কথা বলছে না?’ অথচ ইভিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মোটেই ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না, অভিযোগকারীরা যে শলাপরামর্শ করে অভিযোগ করেছে তা-ও নয়। কেবল বিরোধীরাই অভিযোগ করেছে এমনও নয়। সাংবাদিকরা খবর করেছেন ইভিএম বেপাত্তা[2], গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন অভিযোগ করেছে যে প্রদত্ত ভোট আর ইভিএমে গোনা ভোটের সংখ্যার তফাত হয়েছে[3] প্রচুর আসনে— সবই মাছি তাড়ানোর মতো করে উড়িয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আদালতে আবেদন করেও লাভ হয়নি। বিজেপিবিরোধী ভোটাররাও বিশ্বাস করেছেন যে বিরোধীরা নিজেদের কাজটা ঠিকমতো করে না, তাই এসব বলে। যতটুকু যা কারচুপি হয় তা চিরকালই হত, যখন যে ক্ষমতায় থাকে সে-ই করে। ফলে হিন্দুত্ববাদীরা বেশ নিশ্চিন্তেই ছিল।

কিন্তু বিষ্যুদবার দুপুরে রাহুল একেবারে অন্যদিক থেকে আক্রমণ করলেন। বললেন, গোড়ায় গলদ। ভোটার তালিকা ঘেঁটে বের করা তথ্য চোখের সামনে তুলে ধরলেন, দিস্তা দিস্তা কাগজ হাতে দেখিয়ে দিলেন— অভূতপূর্ব কারচুপি হচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্রের নানা ত্রুটি থাকলেও, সেরা বৈশিষ্ট্য হল— মুকেশ আম্বানির একটা ভোট, আমার বাড়ির কাজের দিদিরও একটাই ভোট। ওটাই ভারতের গণতন্ত্রের জোর, আমাদের গর্বের জায়গা। এই জায়গাটা সেই ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকেই স্বাধীন ভারতে তৈরি করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম দিন থেকে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টান, উঁচু জাত-নিচু জাত— সবার ভোটাধিকার আছে, এই গর্ব করার অধিকার গোটা দুনিয়ায় একমাত্র আমাদের। এমনকি গ্রেট ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও এই ইতিহাস নেই। আর ৭৮ বছরের অবহেলায় অর্থবল, বাহুবলের গুরুত্ব বাড়তে বাড়তে ভারতীয় গণতন্ত্র যেখানে পৌঁছেছে তাতে আজ আপামর ভারতবাসীর গণতান্ত্রিক সম্বল বলতে ওই ভোটটুকুই। সেটাই যে চুরি হয়ে যাচ্ছে তা রাহুল আক্ষরিক অর্থে কাগুজে প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। যতই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ঢাক বাজানো হোক, দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও মোবাইল ছাড়া আর কোনও ইলেকট্রনিক জিনিসের ব্যবহার জানেন না। তাঁদের কাছে কাগজে ছাপা জিনিসের মর্যাদা এখনও বেশি। এই কথাটা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না, গরিব মানুষের পার্টি বলে যারা নিজেদের দাবি করে তারাও অনেকে বোঝে না। রাহুল বা কংগ্রেস যে সেটা বুঝেছে, সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলন তার প্রমাণ। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে দেশের বড় অংশের মানুষকে কিছুই বোঝানো যেত না, যদি রাহুল ইয়া মোটা মোটা বইয়ের মতো করে প্রমাণগুলো চোখের সামনে হাজির না করতেন। লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল, সাংবাদিকরা কিন্তু ইভিএম কারচুপির প্রশ্নও তুলেছিলেন। রাহুল সেদিকে গেলেনই না, বললেন আসল গলদ নির্বাচন কমিশনের। ওই জায়গাটা ঠিক না থাকলে ব্যালটেই ভোট হোক আর ইভিএমে— ভোটচুরি হবেই।

বিষ্যুদবারের ক্ষত মেরামত করার চেষ্টা করতে করতে এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলল নির্বাচন কমিশন আর বিজেপি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ-দেশের নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে কেশব নাগের অঙ্ক বইয়ের চৌবাচ্চার মতো। রাহুল জল বেরোবার এত বড় গর্ত করে দিয়েছেন যে জল ঢোকার নল দিয়ে কমিশন আর বিজেপি যতই জল ঢোকাক, চৌবাচ্চা দ্রুত খালি হয়ে যাওয়ার দিকে এগোচ্ছে। প্রথমে কমিশন বলল হলফনামা জমা না দিলে রাহুলের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করব না। অবিলম্বে জানা গেল নিয়মানুযায়ী এতে হলফনামা জমা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।[4] তারপর নির্বাচন কমিশনের কর্নাটকের সিইও একখানা হাস্যকর কাজ করে বসলেন।[5] রাহুলকে নোটিস পাঠালেন, তিনি যেন অভিযোগ তথ্যপ্রমাণ-সহ জমা দেন। একে তো যার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ সে-ই দাবি করছে তার কাছে চুরির প্রমাণ দিতে হবে, তার উপর তারই কাছ থেকে নেওয়া নথিকে প্রমাণ বলে মানতে সে রাজি নয়। জনপ্রিয় বাংলা ছবির ফুটো মস্তানের সংলাপই এখানে পরিস্থিতির সবচেয়ে যথার্থ বর্ণনা দিতে পারে— ‘এ কে রে সান্তিগোপাল! এ তো আজব কালেকসন!’

এদিকে রাহুল ভাঙা বেড়া দেখিয়ে দিতেই শেয়ালরা বেরিয়ে এল পালে পালে। মহম্মদ জুবেরের মতো সাংবাদিক[6] থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের কংগ্রেস কর্মী, সাধারণ উৎসাহী মানুষ, এমনকি গোদি মিডিয়ার একটা অংশও (যেমন ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ) তদন্তে নেমে পড়ল এবং দেখা গেল, যেখানে ছাই উড়ছে সেখানেই অমূল্য রতন পাওয়া যাচ্ছে। রাহুল যতরকম কারচুপির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন সেগুলো আছে তো বটেই, আরও নানারকম রূপকথা পাওয়া যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রে প্রায় ধৃতরাষ্ট্রের মতো বীর্যবান এক অবিবাহিত বাবাজির কথা জানা গেল। ভোটার তালিকা বলছে তাঁর পঞ্চাশটি সন্তান[7], তাদের কারও কারও জন্ম আবার বাবাজিরও আগে। সাধুসন্তরা অবশ্য বলেছেন গুরুকে এই শিষ্যরা জন্মদাতার স্থান দিয়ে থাকেন, তাই এই ব্যবস্থা। অন্যত্র দেখা গেল মিন্তা দেবী[8] বলে একজনের বয়স ১২৫ বছর, কিন্তু ভোটার পরিচয়পত্রের ছবিটি দেখলে ২৫ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কেরলের ত্রিচুরের এক মহিলা যে অভিযোগ করেছেন তাতে আবার ভৌতিক কাহিনির আভাস আছে।[9] তিনি বলছেন তাঁর অজ্ঞাতে তাঁরই ঠিকানায় নয়জন ভোটার ঢুকে পড়েছে কোত্থেকে। এ যেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’ গল্পের ফুটবলাররা। এরা খেলা চলার সময়ে গোল দিয়ে চলে যায়, কিন্তু খেলোয়াড় গুনতে রেফারি খেলা থামালে দেখা যায় ১১ জনই আছে। এ-খেলায় অবশ্য রেফারির সন্দেহ-টন্দেহ হয় না। বরং যে খেলোয়াড় গুনতে বলে রেফারি পারলে তাকেই লাল কার্ড দেখায়। রাহুল এবারে শটটা তাই গোলে না মেরে রেফারিকে তাক করে মেরেছেন।

এমতাবস্থায় রেফারির হয়ে মাঠে নামতে হত বিজেপির চাণক্যকে, যদি তিনি সত্যিই চাণক্যের মতো কূটবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি স্পিকটি নট, মাঠে নামিয়ে দিলেন অনুরাগকে। তিনি ভাবলেন রাহুল আর প্রিয়াঙ্কা গান্ধির জেতা রায়বেরিলি আর ওয়ায়নাড়, তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক ব্যানার্জির জেতা ডায়মন্ড হারবার আসনের ভোটার তালিকাতেও গোলমাল আছে দেখালেই সব কোলাহল থেমে যাবে। কিন্তু বাপু তা কী হয়? অতি বুদ্ধিমান বাঙালি ভদ্রলোক আর সারা দেশের অন্ধ ভক্তরা ছাড়া সকলেই বুঝতে পারছে, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিজেপি যে কাণ্ডটি ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হচ্ছে, তা চিরাচরিত ভোটের দিনের রিগিং নয়। পেশিশক্তির জোরে লোককে ভয় দেখিয়ে ভোট দিতে না দেওয়া, নিজের লোক ঢুকিয়ে পরের পর ভোট দেওয়ানো বা ভোটার তালিকা দেখে অনুপস্থিত ভোটারের জায়গায় নিজের লোককে ভোট দেওয়ানো দেশের সব দলই করেছে কোনও না কোনও সময়ে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন নিজেই এমন ব্যবস্থা করে দিচ্ছে যাতে একটা নির্দিষ্ট দলের সমর্থকরা যতবার ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে ভোট দিতে পারে (এখনও আমরা জানি না ব্যাপারটা ঠান্ডা ঘরে বসে মেশিনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে কিনা), ভোটার তালিকায় নাম যোগ-বিয়োগ করা হচ্ছে একটা দলকে হারা আসনও জিতিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে— এ জিনিস অভূতপূর্ব। এটা চলতে থাকলে দেশে আর ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রও আছে বলা যায় না। ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া হয়ে উঠতে আর দেরি নেই আমাদের।

এই সেদিনও রাহুলকে বিজেপির বিরুদ্ধে উপযুক্ত নেতা বলে মনে করত না তৃণমূল কংগ্রেস। সেই অজুহাতে ত্রিপুরা, মণিপুর, মেঘালয়, গোয়ার মতো রাজ্যে জিতবে না জেনেও লড়তে চলে গেছে। সেই তৃণমূলের দু-নম্বর নেতা অভিষেক ৭ তারিখের সাংবাদিক সম্মেলনের পর থেকেই রাহুলের প্রত্যেক কথায় সায় দিচ্ছেন। তাঁর দলের সাংসদরা দৃশ্যতই রাহুলের বাহিনীর সৈনিক হয়ে উঠেছেন। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসকে সাবোতাজ করতে গোয়া, গুজরাতের মতো রাজ্যে নির্বাচনে লড়তে চলে যাওয়া আম আদমি পার্টির সাংসদরা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে প্রায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরাও রাহুলের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, ১১ তারিখের নির্বাচন সদন অভিযানেও যোগ দিয়েছিলেন। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবের ব্যারিকেড টপকে যাওয়ার স্পর্ধা আর রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদবের মারমুখী মেজাজের রাজনৈতিক স্বার্থ সহজবোধ্য। সামনে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন, ২০২৭ সালে উত্তরপ্রদেশে। তেজস্বী আর অখিলেশ ওই দুই রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেতা, ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তৃণমূল তো ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনেও হইহই করে জিতবে বলছেন বোদ্ধারা। বিরোধীরাও আড়ালে তা স্বীকার করে। আর আপের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্ঘাত স্বয়ং অরবিন্দ কেজরিওয়ালও আশাবাদী নন, তাই এত বড় কাণ্ড নিয়ে একটা সোশাল মিডিয়া পোস্ট পর্যন্ত করছেন না। তাহলে এই দুই দলের কংগ্রেসের সঙ্গে এমন শক্ত জোট বাঁধার কারণ কী?

কারণ গত এক সপ্তাহে যা ঘটছে তার সঙ্গে বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর নামে যেভাবে মানুষের ভোটাধিকার হরণ চলছে (এরপর পশ্চিমবঙ্গে এবং তারপর গোটা দেশে চলবে), তা মিলিয়ে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারে— এরপর থেকে সব ভোটে জিতবে বিজেপিই। এখন বিজেপি বাদে সবাই একজোট না হলে কোনও দলেরই আর অস্তিত্ব থাকবে না। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়া তৃণমূল সাংসদ মিতালী বাগকে একদিক থেকে রাহুল, অন্যদিক থেকে সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাস ধরে আছেন— এই ভাইরাল ছবি আসলে মানুষের বিপদে জোট বাঁধার আদিম অভ্যাসের চিত্র। সবাই মিলে রাস্তার দখল নিয়ে, পাহাড়প্রমাণ আন্দোলনের ঢেউ তুলে যদি বিজেপির ইমারত ভাঙতে পারেন, তবেই আলাদা আলাদা দল করার মানে থাকবে। তখন কে ভালো কে মন্দ, কে কম রিগিং করে কে বেশি রিগিং করে, কে বুর্জোয়া কে কমিউনিস্ট, কোনটা ফ্যাসিবাদ কোনটা নয়া ফ্যাসিবাদ— এসব নিয়ে তর্কাতর্কি, মারামারি করার ফুরসত পাওয়া যাবে। না পারলে কী হবে? তার ট্রেলার বিজেপি দেখিয়ে দিয়েছে ১১ তারিখেই। প্রায় সমস্ত বিরোধী সাংসদ যখন পথে এবং দিল্লি পুলিশ তাঁদের আটক করেছে, তখন কোনও আলোচনা ছাড়াই একাধিক বিল পাশ করিয়ে নিয়েছে সংসদ থেকে, যার মধ্যে আছে নতুন আয়কর আইনও। এই আইন[10] অনুযায়ী আয়কর বিভাগ যে কোনও করদাতার ইমেল, সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেল পর্যন্ত দেখতে পারে। বলা বাহুল্য, এ কেবল ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ নয়। আইনের এই ধারা ব্যবহার করে সরকারবিরোধী যে কোনও মানুষকে হয়রান করা সম্ভব, গ্রেপ্তার করাও সম্ভব। এই সরকারের আমলে একবার গ্রেপ্তার হলে আপনি দোষী না নির্দোষ তার বিচার কত কঠিন তা যদি না বুঝে থাকেন, শুধু দুটো নাম মনে করুন— স্ট্যান স্বামী আর উমর খালিদ।

বিরোধীশূন্য সংসদে বিল পাশ করানো সম্পর্কে সেদিন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু কী বলেছিলেন?

‘কংগ্রেস পার্টি আর বিরোধীরা অনেক সময় নষ্ট করেছে। এখন আমরা আর দেশের সময়, সংসদের সময় নষ্ট করতে দেব না। সরকার গুরুত্বপূর্ণ সব বিল পাশ করাতে চায়। আমরা আজ সেগুলো লোকসভা আর রাজ্যসভা— দুই জায়গাতেই পাশ করাব। দেশ একজন লোকের আর একটা পরিবারের বোকামির জন্যে এত ক্ষতি সহ্য করতে পারে না। অনেক বিরোধী সাংসদও এসে বলেছেন তাঁরা নিরুপায়। তাঁদের নেতারা জোর করে গোলমাল পাকাতে বলে। আমরা প্রতিদিন একটা ইস্যু নিয়ে দেশের সময় আর সংসদের সময় নষ্ট হতে দেব না। সুতরাং আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলো পাশ করাব।’

এই একটা ইস্যু কোনটা? ভোটচুরি। অর্থাৎ যা দিয়ে সংসদ তৈরি হয়েছে, সেটাকেই ফালতু বলে উড়িয়ে দিচ্ছে সরকার। সংসদ ব্যাপারটার গুরুত্বই আসলে স্বীকার করছে না, প্রকারান্তরে বলা হচ্ছে— আমরা যা চাইব সেটাই আইনে পরিণত করব।

গণতন্ত্রকে অস্বীকার করা এবং সগর্বে ‘বেশ করেছি’ বলার এই ঔদ্ধত্যই ফ্যাসিবাদ। এর সঙ্গে অন্য কোনও সরকারের অন্যায়ের, অপশাসনের তুলনা চলে না। এ-কথা যাঁরা আজ বুঝবেন না, ফ্যাসিবাদ জাঁকিয়ে বসতে পারলে ভারতের গণতন্ত্রের পাশাপাশি তাঁদেরও ঠাঁই হবে জাদুঘরে। তবে গণতন্ত্রের এখনও বাঁচার আশা আছে, কারণ এই অতি বুদ্ধিমান অবুঝরা সংখ্যায় কম এবং রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। রাহুল, অখিলেশ, তেজস্বী, ব্রিটাসরা জানেন কোনটা নির্বাচনী বাধ্যবাধকতা আর কোনটা ঐতিহাসিক প্রয়োজন। তাছাড়া ও পক্ষে আছেন অনুরাগের মতো কালিদাসের বংশধররা।


[1] Tweet by Shantanu. X.com. 4:30 pm, Aug 13, 2025.
[2] Mehrotra, Khushi. Fact-Check: 2019 Video Of Journalist’s Take on EVMs Linked To Recent Elections. The Quint. Jun 10, 2024.
[3] Sheoran, Abhishek. Report claims discrepancies between votes cast and votes counted. ADR. Jul 30, 2024.
[4] ‘Took oath inside Parliament’: Rahul Gandhi responds to EC’s ‘sign affidavit’ dare; demands full e-voter data. TOI. Aug 8, 2025.
[5] Dey, Arun. Karnataka CEO issues notice to Rahul Gandhi over voter fraud claims. HT. Aug 11, 2025.
[6] Tweet by Mohammed Zubair. X.com. 6:48 pm, Aug 11, 2025.
[7] Pandey, Sanjay. Viral voter list shows unmarried seer as ‘father’ of 50 in Varanasi; Congress smells rat. Deccan Herald. Aug 13, 2025.
[8] Tweet by Manish RJ. X.com. 1:20 pm, Aug 12, 2025.
[9] Shibimol, KG. Woman alleges 9 fake votes registered on address in BJP’s lone Kerala seat. India Today. Aug 12, 2025.
[10] Chokhawala, Mohammed S. Income Tax Officials Can Access Emails & Social Media Accounts Under Section 247 of the Income Tax Bill, 2025. Cleartax. Apr 21, 2025.


*মতামত ব্যক্তিগত