শ্যামলকুমার চক্রবর্তী
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রাগিতিহাসের আগে’ বইটি হাতে পেয়ে চমকে উঠি— যেমনি সুন্দর প্রচ্ছদ, বাঁধাই, তেমনি পরিপাটি ঝকঝকে ছাপা— সচরাচর বাংলা বইয়ে যা দেখা যায় না। এই তারিফ না হয় প্রকাশকের প্রাপ্য। পরের বিস্ময়, লেখিকা কী করে ‘প্রাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (উপশিরোনাম) আড়াইশো পাতায় সারলেন? বইটির আলোচ্য বিষয় যাঁদের জানা, তাঁরই বুঝবেন এই কাজটা কত কঠিন ছিল। কী রাখব আর কী বাদ দেব, যেখানে এই ধরাভূমে প্রাণপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস অন্তত ৩৫০ কোটি বছর দীর্ঘ? দক্ষিণ আফ্রিকার ফিগ-ট্রি চার্ট স্তরে কিংবা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পিলবারা ক্রেটন-এ শার্ক-বে অঞ্চলে এখনও যার নিদর্শন অক্ষত।
মধুশ্রী শুরু করেছেন আরও আগে থেকে— মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে বিগ-ব্যাং থেকে প্রাণের সৃষ্টি ছুঁয়ে, ওপারিন-হলডেনের প্রোটো-সেল থেকে মিলার-ইউরি পরীক্ষা, আরএনএ জগৎ, লুকা, মায় প্লেট টেকটনিক্স। অবশ্য আলফ্রেড ভেগনার এবং কন্টিনেন্টাল ড্রিফট থিওরির উল্লেখ দেখলাম না, যার থেকে প্লেট টেকটনিক্সের জন্ম। ভূতাত্ত্বিক সময়ের সারণি, তাদের নানা যুগ, অধিযুগের কথা বারে বারে এসেছে। আসবেই। তাই বইয়ের ফ্রন্ট কভার বা ব্যাক কভারের ভেতরেই যদি দু-পাতা জুড়ে এই সারণিটি থাকত, পাঠকদের মিলিয়ে দেখতে সুবিধে হত। এই গ্রহে, প্রাণের পাঁচ-পাঁচটি মহাবিলোপের প্রসঙ্গ এসেছে, একটু খাপছাড়াভাবে। একাধিক ‘গ্রেট অক্সিডেশন ইভেন্ট’-এর উল্লেখ রয়েছে, তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘প্রাণের বিস্ফোরণ’, বিষয়টি যাঁদের কাছে নতুন, তাঁরা হয়তো হোঁচট খাবেন। বস্তুত, বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদগুলির আখ্যানে ধারাবাহিকতার খানিকটা ঘাটতি রয়েছে, যেন জাম্প-কাট। যদিও পরিচ্ছেদগুলি ছোট হওয়াতে পড়তে অসুবিধে হয় না। তাছাড়া, প্রাণের বিবর্তনে প্রধান অবলম্বন যে জীবাশ্ম, তার প্রাপ্তি-ই তো খাপছাড়া, অনিশ্চিত। তাই স্বল্প-পরিসরে কথা সারতে গেলে, খানিক আপাত-অসঙ্গতি এড়িয়ে চলা মুশকিল। সকল প্রাণের উৎস, প্রতিটি অক্সিডেশন ইভেন্টের মূলে যে সবুজ উদ্ভিদ, জগতে প্রাণের জলসাঘরে যারা উদ্বাহু মূক সাক্ষী, জীববিবর্তনে তাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা আরেকটু গুরুত্বের দাবি রাখে— ‘ট্রি অফ লাইফ’ কিন্তু নিছক রূপক নয়।
গোটা বইতে ইংরেজি এড়িয়ে চলা সত্যিই কৃতিত্বের, কিন্তু জীবের বিজ্ঞানসম্মত নাম উচ্চারণানুগ বাংলা করাটা বাড়াবাড়ি— নামগুলি লাতিন। দুনিয়ার সব ভাষাতেই লাতিন নামটা অপরিবর্তিত রাখা হয়, সেটাই দস্তুর।
মুদ্রণপ্রমাদ যৎসমান্য: চিত্র ৫.৫— কথাটা স্পোরোফাইট (রেণুধর); চিত্র ৬.১: নিটোফাইটস (Gnetophytes), জেনেটোফাইটস নয়। ‘নির্দেশিকা’-তে গন্ডোয়ানাল্যান্ড-এর উল্লেখ ১২৮, ১৫১ পাতায় পেলাম না, বাদ পড়েছে ১৫০ পাতা। প্লেট টেকটনিক্স ১০৯-এর বদলে ১০৮ পাতা হবে।
প্রাগিতিহাসের আগে
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহিত্য সংসদ, জানুয়ারি ২০২৫
মুদ্রিত মূল্য: ৫৫০ টাকা
তথ্যসূত্র খুবই সমৃদ্ধ, বোঝা যায় মধুশ্রী কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন বইটি লিখতে। পাঠকেরা অনায়াসেই প্রদত্ত তথ্যসূত্র থেকে এক একটি বিষয় নিয়ে আরও গভীরে যেতে পারেন।
ভূতাত্ত্বিক যুগ ধরে প্রাণের বিবর্তনে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য আমাদের সামনেই আছে, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলবে আলোচ্য বইটিতে। সকল গবেষণালব্ধ ফল পাঠকের সামনে তুলে ধরা এই ধরনের বইতে, খুবই বিরল ঘটনা— শুধু কয়েকজনের নাম এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে: সমরেন্দ্রনাথ সেন, গৌরীপ্রসাদ ঘোষ, পলাশবরণ পাল, পার্থ ঘোষ, বিমান নাথ। এর আগেও মধুশ্রীর ‘প্রাগিতিহাস’ বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়, ২০২১-এ তিনি মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার পান। এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, লেখিকা উল্লিখিত বিরল গোষ্ঠীতে তাঁর জায়গা করে নিয়েছেন। সেই লেখক সম্প্রদায়, যারা বাংলা ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানকে একটুও তরল না করে বিজ্ঞান-প্রিয় বাঙালি পাঠকের পাতে তুলে দিয়েছেন। ইংরেজিতে ডকিন্স-সেগন-পেনরোজ়-পাইনকার-কোয়েন-ব্রাইসন যাঁরা উৎসাহ নিয়ে পড়েন, তাঁরা এবার বাংলাতেও যাতে খোরাক পান, মধুশ্রী তা নিশ্চিত করলেন। লেখিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বাংলা বিজ্ঞান-সাহিত্যে এই ঘরানার লেখার গুরুত্ব নিয়ে বার বার কথা বলেছি। পাঠকের যে অভাব হবে না, মধুশ্রীর বইয়ের জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ।

