ভারতবর্ষের মানুষের উৎস

জয়ন্ত দাস

 

২০১৮ সালের শেষাশেষি প্রকাশিত টনি যোসেফের ‘আর্লি ইন্ডিয়ানস’ বইটি বেস্টসেলার হয়েছিল। তারপর সিন্ধুনদ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কবে এসেছে, কারা ভারতের আদি বাসিন্দা, তা নিয়ে বিতর্ক আরেকটু এগিয়েছে। ইংরেজি ভাষায় সংবাদপত্রের নানা প্রবন্ধ থেকে তার হদিশ মেলে, বাংলায় মাঝে-মধ্যে দু-একটা লেখা এদিক ওদিকে পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় তাই নিয়ে একটা বই? পাইনি। সত্যি বলতে কি পাওয়ার আশাও করিনি। বাংলায় জনপ্রিয় এবং মননশীল লেখাপত্র হচ্ছেই না বলে যারা মনে করেন আমি তাঁদের দলে নই। কিন্তু বহুবিধ সমস্যার জন্য বাংলা বা ভারতবর্ষ নিয়ে গবেষণার সাম্প্রতিক খবর পেতে আমাদের ইংরেজি ভাষারই দ্বারস্থ হতে হয়। লেখক-প্রকাশক বলেন, বাংলায় গবেষণাধর্মী বইয়ের পাঠক কোথায়? আর পাঠক হা-হুতাশ করেন, বাংলায় তেমন বই কোথায়? এই ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ বিতর্কের মধ্যে অবরে-সবরে একটা-দুটো ভালো বই বেরোয়, কিন্তু তা বাজার পায় না। কারণ আগ্রহী পাঠক জানেন, বাংলা বইয়ে তেমন কিছু থাকে না, অতএব তিনি ইংরাজিতে পড়ে নিয়েছেন।

অবশ্য বাংলায় জনপ্রিয় গবেষণাধর্মী লেখা সোজা কাজ নয়। পরিভাষার সমস্যা রয়েছে। সমস্ত আকর-গ্রন্থ ইংরাজি ভাষায় লেখা। যে কোনও কাজই একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। তার ওপর আমাদের প্রকাশকদের মধ্যে সম্পাদনা করার কাজটা অবহেলিত। ইংরাজিতে একটি বই যে পরিমাণ সম্পাদনা-সাহায্য পায় বাংলায় তা অকল্পনীয়।

এর মধ্যেও কেউ কেউ লিখছেন, কেউ কেউ রীতিমত ভালো লিখছেন। তেমন বই মাঝে মধ্যে হাতে পড়ে। যেমন বর্তমান বইটি। এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ভারতীয়দের উৎস সন্ধান। কারা ভারতীয়? তারা কি এই ভূমিতেই ছিল, নাকি অন্য কোনওখান থেকে এসেছে? আমাদের সুদূরতম আদি পুরুষের উদ্ভব কি এদেশেই? আদি নারীর উদ্ভব কোথায়? যেখান থেকে পুরুষেরা এসেছে সেখান থেকেই কি নারীরা এসেছে? শেষ প্রশ্নটি আপাতদৃষ্টিতে একটু ধাঁধার মত শোনায়। পুরুষ আর নারী আলাদা জায়গা থেকে আসবে কেমন করে? আসতে পারে। আমার মা ও বাবার বংশের পূর্বজদের উৎস হতে পারে পৃথিবীর ভিন্ন প্রান্তে। এই ধাঁধার বিশদ উত্তরের জন্য অবশ্য পড়তে হবে বংশগতির কথা— আলোচ্য বইতে তার সারকথা দেওয়া আছে।

চিরাচরিত প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব আর ভাষাতত্বের সাহায্যে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে কিছু কথা অবশ্যই বলা যায়, তবে খুব নিশ্চিত করে উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। সেখানে দরকার জেনেটিক্স বা জিনবিদ্যা। দরকার মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা, জীববিদ্যার সম্পর্কে ধারণা। আমাদের অ্যাকাডেমিক ঐতিহ্যে লালিত ঐতিহাসিকরা অনেকেই এসব ব্যাপারে তেমন স্বচ্ছন্দ নন। আর ইতিহাস-প্রাগিতিহাস পড়তে আগ্রহী পাঠকদের অনেকেরই বিজ্ঞানের জটিলতা মাথায় রাখতে কিঞ্চিৎ অনীহা আছে।

মধুশ্রী তাঁর বইটি মানুষের বিবর্তনের কাহিনি থেকে শুরু করেছেন। এতে একটা সমস্যা থাকে। চিরাচরিত ইতিহাস পাঠে অভ্যস্ত পাঠককে অপরিচিত বিষয়ের মধ্যে দিয়ে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার সমস্যা। সেটা করতে না পারলে বই তথ্য ও তত্ত্বভারে ভারাক্লান্ত হয়ে যায়। সুখের বিষয় এখানে তেমন ঘটেনি। লেখক সরল ভাষায়, অকারণ পাণ্ডিত্য প্রদর্শন না করে লিখেছেন। আরেকটা জিনিস বইটাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তা হল মাঝে-মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে বলা নানা গল্প। না, গল্পগুলোর পাত্র-পাত্রীর ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। তবে বিষয়বস্তুর যুক্তিনিষ্ঠ সত্যতা আছে। এই গল্পগুলোর প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এবং তার প্রেক্ষাপটে গাছপালা, পশুপাখিকেও পাঠকের কাছে নিয়ে এসেছে। সেই চিরকালীন মানুষের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তা এক মুহূর্তে অনুভূত হয়—

দিনটা উষ্ণ ও আর্দ্র। আকাশের এক কোণে ঘাপটি মেরে থাকা কালো মেঘ মাঝে মাঝে সূর্যকে ঢেকে দিচ্ছে। চারিদিকে সবুজ তৃণভূমি; দূরে নীল পাহাড়ের ঢালে স্লেটের মত ধূসর অরণ্যভূমির রেখা দেখা যায়। সহস্র পশু চলেছে একে অপরকে অনুসরণ করে। ওয়াইল্ডবিস্ট, এলান্ড, ইম্পালার দল খাদ্যের সন্ধানে ধীর গতিতে চলেছে। ওই পশুদের অনুগমন করছে শতখানেক মানুষ। মানুষগুলো লম্বা, কালো, হিলহিলে। ওদের কোমরে এক টুকরো পশুচর্ম বাঁধা আছে। হাতে আছে পাথরের কুঠার। ওরা জানে না কোথায় চলেছে, শুধু জানে ওই পশুদের সঙ্গে হেঁটে যেতে হবে। তবে মিলবে নতুন খাদ্যসমৃদ্ধ ভূমি।

এই হল এক লক্ষ তিরিশ থেকে আশি হাজার বছর আগেকার পূর্ব আফ্রিকার এক খণ্ডচিত্র।

বইটির পাঁচটি অধ্যায়। প্রথম তিনটি অধ্যায়ে আছে ভারতবর্ষে মূল তিনটি পরিযানের আলোচনা। চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে বাংলায় পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আরও দুটি পরিযান এবং বাঙালি জাতিগোষ্ঠী গঠনের কথা। আর শেষ অধ্যায়ে আছে মানবসভ্যতার প্রাগিতিহাস ও ইতিহাসে মানুষ কেমন করে ‘মানুষ’ হল, সেই কথা।

প্রথম অধ্যায়ে কেমন করে হোমো স্যাপিয়েন্স অন্য মানবপ্রজাতির চাইতে আলাদা হল, কেমন করে অন্য প্রজাতিগুলো হারিয়ে গেল, কেমন করে আফ্রিকা থেকে মানুষ বাইরে এল তার চিত্তাকর্ষক কাহিনি এসেছে। এসেছে বংশগতি, জেনেটিক্স, পৃথিবীর নানা কালপর্ব নির্ণয়ের মত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিষয়ও। তার যেটুকু না জানলে নয়, সেটুকু জানিয়ে বাকিটা পরিশিষ্টে পাঠানো হয়েছে। এতে পড়বার সুখ নষ্ট হয়নি, কাহিনির গতি রুদ্ধ হয়নি। এসেছে ভারতের প্রথম পরিযানের কথা। ভারতবর্ষের আদি মানুষের জীবনচর্যার সামান্য ইতিবৃত্ত দিয়ে শেষ হয়েছে এই অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসেছে ভারতের দ্বিতীয় পরিযান। সিন্ধু সভ্যতার কথা। কারা গড়ে তুলেছিল সিন্ধু সভ্যতা? তাই নিয়ে ইতিহাস-বহির্ভূত নানা কারণে প্রভূত বিতর্ক গত কয়েক বছর ধরে হচ্ছে। জিনবিদ্যার সাহায্যে আগের চাইতে অনেক সুনির্দিষ্ট উত্তর এখন পাওয়া সম্ভব।

তৃতীয় অধ্যায়ে আছে ইন্দো-ইউরোপীয়দের ভারতে আগমনের কথা। ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে বহুদিন ধরে বলা হচ্ছে রাশিয়ার স্তেপভূমিতে উদ্ভূত একটি ভাষা ‘প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়’র এক শাখা হল বৈদিক-সংস্কৃত। এখন সমগ্র রাশিয়া, ইরান, তুরান ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ও আজকের ভারতীয়দের সঙ্গে তার তুলনা করে এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে।

নানা কারণে এই ইতিহাস আমাদের দেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর খুবই না-পসন্দ। তাদের এক তত্ত্ব আছে। তাতে বলে, মুসলিম ও ব্রিটিশরা এই দেশে আসবার আগে আমরা সকলে ছিলাম দেশজ। এক কথায়, ইতিহাস লিখতে গেলে প্রথমেই ধরে নিতে হবে, কেবল ‘ওরা’ বাইরের, বাকিরা সবাই ভেতরের। লেখক এই বইতে স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, প্রাগিতিহাস রচনায় এখন আর মনোগত অভিপ্রায়কে বিজ্ঞানসম্মত বলে চালানো সম্ভব নয়। ভারতে কেন, পৃথিবীর প্রায় কোথাও আর ‘পিওর রেস’ বা বিশুদ্ধ জাতির অস্তিত্ব নেই। ‘পিওর জার্মান রেস’ আর ‘পিওর এরিয়ান’-দের সৃষ্টি করা হয়েছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে। এখন আমরা জানি, পিওর রেসের সবথেকে কাছাকাছি থাকা মানুষরা হল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন প্রজাতি, যেমন এদেশে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে লুপ্তপ্রায় কিছু মানুষ। জাতিগত ‘বিশুদ্ধতা’ প্রকৃতির আনুকূল্য পায় না।

চতুর্থ অধ্যায়ে আছে বাংলায় পাঁচটি পরিযানের কথা। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ঐতিহাসিক কালে মূলত পাঁচটি ঢেউয়ে বাংলায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এসেছে আর বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে। সেই আলোচনার শেষে এসেছে দুই হাজার বছর আগেকার বাংলার মানুষ কেমন ছিল সেই ইতিবৃত্ত। এই বিষয়ে জিনতাত্ত্বিক তথ্য কম। লেখক সেই ঘাটতি খানিকটা পূর্ণ করতে পেরেছেন, কিন্তু তাঁর কাছে প্রত্যাশা আরেকটু বেশি ছিল।

পঞ্চম অধ্যায় হল চিন্তাশীল মানুষের আবির্ভাব, তার শিল্পবোধ, তার প্রযুক্তি, বিশ্বাস। সব মিলিয়ে মানুষের সংস্কৃতি, মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার আলেখ্য। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির উন্মেষ আর সেই সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এই অধ্যায়টি প্রথম চারটি অধ্যায়ের গভীরতায় পৌঁছাতে পারেনি। হয়ত লেখকের সেরকম অভিপ্রায়ই ছিল, বইটিকে তিনি গুরুভার করতে চাননি। বিশেষত যেখানে মুখবন্ধে অধ্যাপক পার্থপ্রতিম মজুমদার বলেই দিয়েছেন, বইটি স্রেফ হালকা চালে পড়ার মত গ্রন্থ নয়।

বিষয়বস্তু ও আলোচনার গভীরতার দিক থেকে এটি পড়ার মত বই। আর প্রাঞ্জল ভাষার জন্য শক্ত বিষয়গুলিও সুস্বাদু হয়ে উঠেছে। তবে ত্রুটি যে নেই তা নয়। বিশেষ করে চিত্রগুলি আরেকটু স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল। প্রচ্ছদটি অসাধারণ, কিন্তু সেই প্রচ্ছদের ছবিটিই ২৯ পাতায় খারাপ ছাপা হয়েছে। মানচিত্রের মধ্যে লেখাগুলি অত্যন্ত ছোট, পড়া যাচ্ছে না। পরের সংস্করণে এইসব ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশক আড়াআড়িভাবে গোটা পাতাজোড়া চিত্র দিলে ভালো হয়। সুপারস্ক্রিপ্টে তথ্যসূত্র আর সাবস্ক্রিপ্টে পাদটিকা দেবার প্রচেষ্টাটি অভিনব, কিন্তু পাঠকবান্ধব নয়।

বিশিষ্ট জিনতাত্ত্বিক ও গবেষক অধ্যাপক মজুমদারের মুখবন্ধ এই বইটিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর শেষ বাক্যটি এখানে উদ্ধৃত করছি। “এটি মানব-বিবর্তন, মানুষের পরিযান এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলা ভাষার প্রথম বই। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে লেখা নির্ভরযোগ্য এবং অসাধারণ পাঠযোগ্য এই বই।”

সত্যি কথা।

প্রাগিতিহাস – ভারতবর্ষে পরিযান ও জাতিগোষ্ঠী গঠন
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশক গাঙচিল, ২০২১ পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৫৪ । দাম ৪৫০ টাকা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...