অভ্রদীপ ঘটক
রাজদীপ্তদার বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছি। কোনার তাকিয়া জুড়ে উল্টো টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে মধ্যবয়সী পণ্ডিত প্রফেসর মোবাইল হাতে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলে উঠল… শোলে সিনেমার অথেন্টিসিটি নিয়ে তোমার কী বক্তব্য?
আমি খেঁকিয়ে বললাম, ৩-৪টে সিনেমা থেকে টুকে টুকে আর খানিকটা এদিক ওদিক মশলা মাখিয়ে একটা টাইমলাইন খাড়া করা।
–এগজ্যাক্টলি। চেঁচিয়ে উঠল রাজদীপ্তদা। উত্তেজিত হাতের চায়ের কাপ থেকে চা চলকে উঠল।
—আমি গতকাল সারা বিকেল টু সন্ধে জুড়ে পড়াশোনা করে দেখলাম, শোলেতে অমিতাভ এবং ধর্মেন্দ্র জয় এবং বীরু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, একদম ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন দ্য ওয়েস্টে চার্লস ব্রনসন এবং জেসন লম্বার্ড অভিনীত চরিত্রগুলোর ছায়ায়। বেশ গভীর ছায়া আর কী। এমনকি সেই লাইন দিয়ে মেরে শুয়ে রাখার সিনটাও। ফ্রেম বাই ফ্রেম কপি করা, এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, পোশাক, সেট সবকিছুই কপি। সেভেন সামুরাই, বুচ ক্যাসডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড, দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন, ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন দ্য ওয়েস্ট, এসব নানাবিধ ফিল্ম এর… এক নিঃশ্বাসে বলে গেল রাজদীপ্তদা।
আমি একটু খোঁচা মারলাম— প্রভাব?
রাজদীপ্তদা খিচিয়ে উঠে বলল, প্রভাব-টভাব নয়। কপি বোঝো? কপি কপি! সিন বাই সিন কপি।
আমি এটা বহু আগে থেকেই জানতাম। আমার মা শোলের ভক্ত ছিলেন। মার সঙ্গে এই নিয়ে প্রায়শই লাগত। শোলের এই নস্টালজিয়ায় নেপথ্যে এক দামী সফিস্টিকেটেড ক্রিয়েটিভ কপি মেশিনের অবদান রয়েছে। মা বলতেন, যাইই হোক, শোলে দারুণ। আমি বলতাম, সেটাই তো! কমার্শিয়াল মশলায় মাখতে গেলে এপাড়া-ওপাড়া থেকে মশলার কৌটো আনতেই হয়। আমাদের ওরিজিনাল মাথায় সুস্বাদু রেসিপি আসেই না যে!
একটা কথা বারবার মাথায় আসে। প্রযোজক এবং পরিচালক জুটি এই ভেবে মরে যে লোকে কী খাবে? এটাই সবচেয়ে জরুরি। এই খাওয়ানোর ব্যাপারটাতেই সবটা লুকিয়ে রয়েছে।
মানুষ কী চায় এটাই বুঝতে গিয়ে এক শতাব্দী ধরে পরিচালক, স্ক্রিপ্টরাইটার এবং প্রযোজক, মাথা খুঁড়ে মরছে। এবং এই চাওয়াপাওয়ার হিসেব কষতে কষতে প্রায় জামাকাপড় খুলে রাস্তাতেও দাঁড়িয়ে পড়ছে।
সত্তরের দশক। সেলিম-জাভেদ জমজমাট স্ক্রিপ্টরাইটার। ওঁদের নামে সিনেমার বিজ্ঞাপন বের হচ্ছে। আকাশছোঁয়া পেমেন্ট। কিন্তু ওই যে, মাথা যখন কাজ করে না তখন কমার্শিয়ালি বাবার নামে কপি। টুকতে থাকুন আর কি। কাজ করে যেতেই হবে যে! থামলে চলবে না। ডাল-ভাতে তো স্ট্যাটাস চলে না, বিরিয়ানিই চাই। অগত্যা এখান থেকে ওখান থেকে খাবলে খাবলে নিয়ে চলতে থাকুক শিল্পবিপ্লব।
যা হোক, আবার শোলেতে ফিরি।
এদিকে আমাদের মর্ডান মার্ভেল আরডি বর্মনও ডেমিস রুসোসের “সে ইউ লাভ মি” গান থেকে শোলের সেই মেহেবুবা ও মেহেবুবা গানটির সুর হুবহু ইয়ে করেছেন। অবিশ্যি শুধু এটি নয়, আরডি বর্মনের ঝাঁকে ঝাঁকে গানই, ওই যাকে বলে অনুপ্রাণিত! আমাদের শ্রদ্ধেয় আরডি-র ওপর একটু আলো ফেললেই দেখা যাচ্ছে, চুরা লিয়া হ্যায় তুমনে, মিল গয়া হামকো সাথী মিল গয়া, জীবন কে দিন ছোটে সহি, কহিন করতি হোগি ওহ মেরা ইন্তেজার, দিলবার মেরে কব তক মুঝে, ও মারিয়া ও মারিয়া, ইয়ে শাম মাস্তানি… অর্থাৎ আরডি বর্মনের সেরা ১০ বা ১৫টি ভারতবিখ্যাত গানই হুবহু “অনুপ্রাণিত“। কী বলবেন? এই ইন্টারনেট এসে সব নস্টালজিয়ায় জল ঢেলে চলে যাচ্ছে যে! কাল্ট ক্লাসিকগুচ্ছ সবই সিরিজ ধরে ধরে…।
এমনকি শোলের সেই বিখ্যাত ধর্মেন্দ্রর জলের ট্যাঙ্কের দৃশ্যটি সিক্রেট অফ সান্তা ভিক্টোরিয়া থেকে হুবহু কপি। সেই জলের ট্যাঙ্ক, সেই মদের বোতল হাতে, সঙ্গে এক পাল গ্রামবাসীর সামনে মাতলামো আর সুইসাইডের হুমকি।
শোলে নিয়ে ভারতীয় ইমোশনের শেষ নেই।
তবে শোলের দৃশ্য, স্ক্রিপ্ট, গল্প, মিউজিকের কপি কিন্তু কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়।
ভারতীয় সিনেমার টাইমলাইন জুড়ে, শোলের আগে-পরে, হলিউড-বলিউড-টলিউডের প্রচুর প্রচুর ছবির দৃশ্য, কাহিনি, মেকিং স্ক্রিপ্ট সবই কপি হয়ে চলেছে।
আশিকি, সাজন, কহো না পেয়ার হ্যায়, দিল তো পাগল হ্যায়, হাম আপকে হ্যায় কৌন, হাম দিল দে চুকে সনম, ধুম, মাচিস, ইয়েস বস, কুছ কুছ হোতা হ্যায়, মুন্নাভাই, জব উই মেট, সব সব সব লাইন দিয়ে অনুপ্রেরণার দলে দাঁড়িয়ে আছে!
এমনকি আমাদের মুন্নিও বদনাম হয়েছে বহু আগেই পাকিস্তানের উমর শরিফের গানে!
আমাদের প্রাচীন বলিউডের হাজার হাজার বিখ্যাত গান, সিনেমা, গল্প দশকের পর দশক ধরে শুধু অনুপ্রাণিতই হয়ে আসছে।
কয়েকটা ক্লাসিক আরও জাস্ট ছুঁয়ে যাই…
স্টিফেন পটারের গেমসম্যানশিপ সিরিজের বই থেকে অনুপ্রাণিত, রবার্ট হ্যামার পরিচালিত স্কুল ফর স্কাউন্ড্রেলস ১৯৬০ সালের একটি পপুলার ব্রিটিশ কমেডি চলচ্চিত্র। এটি থেকে হুবহু অনুপ্রাণিত হয়ে বাসু চ্যাটার্জি অমল পালেকর আর বিদ্যা সিনহাকে নিয়ে তৈরি করেন ছোটি সি বাত! যেটা আমার আর আমার মায়ের দুজনেরই বড় প্রিয় ছবি! কী আর করব, সবই অনুপ্রেরণা!
৫০-এর দশকের নো ম্যান অফ হার ওন কেটেছে ৭০ দশক কাঁপানো শক্তি সামন্ত ক্লাসিক কাটি পতঙ্গ-এর ঘুড়ি! বাসু চ্যাটার্জির ১৯৭৮-এর বিখ্যাত কমেডি খাট্টা মিঠা-ও হুবহু অনুপ্রাণিত ১৯৬৮ সালের আমেরিকান কমেডি ইয়োরস মাইন অ্যান্ড আওয়ারস থেকে।
হেরা ফেরি-র বিখ্যাত ট্রায়ো গল্প, দৃশ্য, বাবুভাইয়া, শ্যাম আর রাজুর কেমিস্ট্রি কিন্তু লক স্টক অ্যান্ড টু স্মোকিং ব্যারেল থেকে গোটাই অনুপ্রাণিত।
সম্প্রতি টিভিতে বহুল জনপ্রিয় কমেডি ২০০৭-এর ছবি ওয়েলকাম, ১৯৯৯-এর মাইকি ব্লু আইজ-এর হুবহু, সিন-টু-সিন কপি। তিস মার খান হল গিয়ে আফটার দ্য ফক্স! সলমন-গোবিন্দার ২০০৭-এর পার্টনার ২০০৭-এর হিচ-এর সিন-টু-সিন কপি। কপিমাস্টার আমির খানের আকেলে হাম আকেলে তুম হল গিয়ে ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার। এই আমির খানের সিনেমা, গান, ছবির প্লট এবং অরিজিনালিটি নিয়ে অবিশ্যি আর একটা গোটা প্রবন্ধই হয়ে যায়। মিস্টার পারফেকশনিস্ট, পারফেক্টলি কপি করে গেছেন দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর নানান সিনেমার নানা কিছু।
কিছু বলার আছে?
টাইমমেশিনে চাপলে, আমরা যদি অল্প করে এই শিল্প-কপির ইতিহাস এবং পুরাণের দিকে তাকাই, প্রাচীন গ্রিস ও রোমে, শিক্ষানবিশ শিল্পীরা মানে জুনিয়াররা বিখ্যাত সো-কলড সেলিব্রিটি শিল্পীদের কাজ কপি করেই শিখত। তখন কিন্তু প্রশিক্ষণেরই অংশ ছিল এবং এই কপি সম্মানজনক হিসেবে গণ্য করা হত।
রেনেসাঁ যুগের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েলরা প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য ও বিভিন্ন প্রাচীন চিত্রকর্ম কপি করে নিজের শৈলী গড়ে তুলেছেন। এই কপি করা অবিশ্যি জাস্ট শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য।
সের্গেই আইজেনস্টাইনের ব্যাটেলশিপ পটেমকিন ছবির পৃথিবীবিখ্যাত দৃশ্য “ওডেসা স্টেপস”-কে ট্রিবিউট জানিয়ে ব্রায়ান ডি পালমা পরিচালিত ১৯৮৭-র আনটাচেবলস ছবিতেও হাড় হিম করা সিঁড়ি থেকে প্যারামবুলেটার গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য রাখা হয়।
এ নিছকই অফিসিয়াল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
এই শ্রদ্ধার নামেই বলা যায় রাজ কাপুরের আওয়ারা, শ্রী ৪২০ দেখলে ৫ বছরের বাচ্চাও বলে দেবে, এই স্ট্রাকচারাল ডার্ক কমেডি, এবং শোম্যানশিপ দুনিয়া কাঁপানো গ্রেটেস্ট শোম্যান চার্লি চ্যাপলিনের ব্যবসায়িকভাবে সফল ভারতীয়করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবে সত্যজিতের অপ্রকাশিত ক্লাসিক চিত্রনাট্য অবতার অনুকরণে স্টিভেন স্পিলবার্গের ইটি কিন্তু ট্রিবিউট নয়। জাস্ট ঝেঁপে দেওয়া কেস আর কি। আর সেই ইটি থেকেও সরাসরি ঝেঁপে, আমাদের রাকেশ রোশন বানিয়ে ফেললেন চরম খিল্লিমার্কা, বিজ্ঞানের মা-মাসি এক করে দেওয়া দেশীয় দেহাতি সায়েন্স ফিকশন ছবি কোই মিল গয়া!
এইভাবে পরমাণু বোমার মতো চেন রিয়্যাকশন চলছেই।
ইতিহাস ঘাঁটতে থাকলে ক্ষেতে পাম্প দিয়ে জল দেওয়ার মতো ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে নানা উদাহরণ। কোনটা ছেড়ে কোনদিকে যাই!
একদম সম্প্রতি একগুচ্ছ পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি, ভারত জুড়ে জনপ্রিয়, এবং আমিরবাবুর সোনামুখ করে দেওয়া কিরণ রাও-এর ছবি লাপাতা লেডিস ২০১৯-এর ছবি বুর্খা সিটি থেকে গোটাটাই অনুপ্রাণিত। এর সঙ্গে, ১৯৯৯-এর টেলিফিল্ম ঘুঙ্ঘট কি পট খোল-এর সঙ্গেও দৈব দুর্বিপাকে মিলের পর মিল পাওয়া যায়। যাকে বলে ফ্রেম-টু-ফ্রেম কপি। স্ক্রিপ্টরাইটার কিন্তু এই চেনা গল্প ছেপেই লক্ষ লক্ষ টাকা নিজের ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে বসে আছেন! এঁরাই যখন আবার “অরিজিনালিটি”র দাবি করেন, তখন এইচপি-র জেরক্স মেশিনও খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠে।
এত জল তিস্তায় বয়ে যাওয়ার পর, ১৯৫৭ সালের অ্যাক্ট অনুযায়ী কপি ও অনুকরণে নৈতিক এবং আইনি প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এই অ্যাক্ট ২০০৫ সালের পর থেকে— ইন্টারনেট যখন ভারতে জাঁকিয়ে বসেছে— জোরদার হতে থাকে। ”কপিরাইট ক্লেম” কথাটা শোনা যায় বারবার।
তবে আমাদের বাংলায় কিন্তু কপির ইতিহাস স্বর্ণাক্ষর।
হিন্দি ওয়েব, তামিল, বলিউড সিনেমা থেকে বাংলাতেও দেদারসে টোকাটুকি করাটা কাইন্ড অফ আমাদের প্রাচীন টলিউডি ঐতিহ্য।
আমি কিন্তু সিনেমার ইতিহাসে বাংলার নিউ থিয়েটার্সের গোল্ডেন এরার কথা বাদ দিচ্ছি।
সাম্প্রতিককালে কচি প্রেমিক-প্রেমিকার চোখের মণি, সুপারডুপার হিট, বাংলার স্বর্ণযুগের রত্নমণিমাণিক্য, বোঝে না সে বোঝে না, চ্যালেঞ্জ, পরান যায় জ্বলিয়া রে, পাগলু— এইসব আরকি। এ-সবই কিন্তু ভালোভাবে বলতে গেলে অনুপ্রাণিত, আর সোজাসাপ্টা বললে কপি করিয়াছে, বা ডাইরেক্ট ঝেঁপেছে!
এতে লজ্জা নেই বাবুমশাই। কারণ ওই— বেওসা করিয়াছে। আর বেওসাই সব।
আমাদের মহানায়ক সোহমকে তো ‘বাংলা রিমেকের তারকা’ই বলা হয়। জিত, অঙ্কুশ, বনি, কোয়েল এবং আমাদের পরমব্রতবাবু, এঁদের নিয়ে বাক্যব্যয় না করে সোজাসুজি বলা যায়— যা যা এই জীবৎকালে করিয়াছেন, সবই ট্রু কপি। জেরক্স কপি। ডিভিডি চালিয়ে কপি থেকে এখন জাতে উঠে, অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
সবই বেওসা।
অবিশ্যি, মা-বোন-দিদি-প্রেমিকার সম্মান-টম্মানও আজকাল বেওসার পার্ট।
মিডিয়ার এক অদৃশ্য আদর্শ নীতি, যাকে বোকা সাধারণ মানুষ সম্ভ্রমের চোখে দেখে, এবং ভাবে মিডিয়া বুঝি সব সত্যি বলার দায় কাঁধে নিয়ে ঘুরছে— মিডিয়া যাহা বলিবে তাহাই সত্য! সেও এক সূক্ষ্ম অথচ দুর্দান্ত লাভজনক বেওসা ধর্মাবতার। এই ওয়েব আর নিউজ মিডিয়াই থার্ড গ্রেড কপি ফিল্মগুলোকে বাংলার স্বর্ণযুগ বলে চালিয়েছে বছরের পর বছর।
মনে পড়ে আমাদের ছোটবেলায় ২০০০-এর দশকে বাংলা পুজো অ্যালবাম ও প্রাইভেট অ্যালবামে পাকিস্তানি পপ গানের হুবহু সুর নকল করে এক ধরনের রিমিক্স কালচার গড়ে উঠেছিল, যা একদিকে সেই সময়ের শ্রোতাদের কাছে ছিল জনপ্রিয়, আবার অন্যদিকে এটাই আজকের চোখে তা ছিল প্ল্যাজিয়ারিজম। ৯০-এর দশকে নচিকেতা চক্রবর্তীর ৯০ শতাংশ গানের সুরই নাকি “অনুপ্রাণিত”।
এরপরে কোর্ট থেকে আইন-টাইন পাশ করে কপি করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়।
তবুও বিহঙ্গ, হে বিহঙ্গ মোর… অনুপ্রাণিত হওয়া থেকে বিরত থাকা বড় দায়। এপাশ-ওপাশ-ঝপাস থেকে ঝাড়াঝাড়ি চলতেই থাকে। কখনও হিন্দি ওয়েব সিরিজ থেকে, কখনও ফরাসি সিনেমা থেকে, কখনও ব্রাজিলিয়ান ফিল্ম থেকে, তো কখনও রাশিয়ান ফিল্ম থেকে। অনুপ্রাণিত হয়েই চলছে… হয়েই চলছে। হিন্দি ওয়েব, হিন্দি সিনেমা থেকে ডাইরেক্ট কপি করে বাংলা ওয়েব বানানো হচ্ছে!
একটা ফুটনোট দিই। আমাদের রায়বাবুর গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর দৃশ্যকল্প, ফ্রেম, কম্পোজিশন, কিছু কিছু সের্গেই আইজেনস্টাইনের ইভান দ্য টেরিবল থেকে অনুপ্রাণিত। চারুলতা আর ভূপতির সমুদ্রের ধারে বসে থাকার দৃশ্যটি এক বিশ্ববিখ্যাত পেন্টিং-এর ফ্রেম থেকে নেওয়া।
মৃণালবাবুর কলকাতা ৭১, কোরাস-এ কি পাওয়া যায় না গোদারের চলচ্চিত্রভাষার ভয়ানক প্রভাব? সে-প্রভাব কতটা অরিজিনাল শিল্পকর্মটিকে আরও জ্বলজ্বলে করে তুলেছে, আর কতটা স্বকীয়তা হারিয়ে মিশে গেছে কালের স্রোতে, তা সময়ই বলবে।
কপিবিহীন বিশুদ্ধ শিল্পকর্ম, যাকে বুক বাজিয়ে বাঙালি বিশ্ব্বের দরবারে বলতে পারবে “অরিজিনাল”, তা হল একমাত্র ঋত্বিক ঘটক। থ্রিলার, খুন, গোয়েন্দা আর তন্ত্রসাধনার এই ঘোর দুঃসময়ে একমাত্র ঋত্বিকতন্ত্রই আধুনিক, ত্রিকালজয়ী এবং বিশুদ্ধ অরিজিনাল।
সত্যজিৎ রায়ের এক কালজয়ী গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। “গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো”। বিখ্যাত এক ব্যবসায়ী তারিণীখুড়োকে গল্পলেখক হিসেবে পুষে তাঁকে দিয়ে গল্পলিখিয়ে নিজের নামে বেমালুম চালিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা জানতে পেরে তারিণীখুড়ো বিখ্যাত সাহিত্যিকদের গল্প ওঁকে বলা শুরু করলেন। ব্যস, প্ল্যাজিয়ারিজমের কেসে সেই ব্যবসায়ীর হেনস্থার একশেষ!
আজকের সময়ে দাড়িয়ে অবিশ্যি এই কপি-টপির হেনস্থা বা লজ্জা-টজ্জা কেউ দেখে না, কারও হয়ও না। এখন শুধু দেখে বেওসা, বেওসা আর বেওসা। সেটা ঠিক চললে, আপনি যা ইচ্ছে করুন, কপি করুন পেস্ট করুন… “অর্থ” আপনার মুখ বন্ধ করে অলরেডি বসে আছে।
ইন্টেলেকচুয়ালদের এত এত মৌলিকত্বের ধ্বজা ওড়ানোর পর দেখবেন কিন্তু সেই কমার্শিয়াল কপিক্যাটরাই জিতে বসে আছে অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের স্টেজে।

