রিয়া মুখার্জি
আমাদের দৈনন্দিন যাপনেও বাচিক হিংসার নানা রূপ প্রকাশ পায়। আমরা প্রায়ই শুনি— “ও তো কোটা থেকে এসেছে”, “ও ওই কাস্টের বলে সুবিধা পায়”, “ওরা চামার”, “ওর তো গায়ের রং কালো।” এই বাচিক হিংসা সম্পর্কে যেমন আমাদের অনেক বেশি সতর্ক ও সচেতন হওয়া দরকার, তেমনই দরকার আমাদের বাড়ির ভেতরের সেই অদৃশ্য হিংসাকে গুরুত্ব দেওয়া— যেখানে একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাস প্রতিনিয়ত ভেঙে যায়, অথচ খালি চোখে দেখা যায় না
আমরা মাদারচোদ বোবা পশুর মতো
আমাদের জীবন বন্ধক দিয়ে কাটাই।
আমরা জানি গোলমালটা কোথায়,
কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।
আমরা যা করেছি, আমাদের মা-ঠাকুমারাও তাই করেছেন।
আমাদের ছেলেমেয়েরাও তাই করবে।ওঃ, তোমাদের কাছে মিনতি করছি— আমাদের জন্য ওই চোখের জল ফেলো না।
ওঃ, এই জোড়হাতে তোমাদের কাছে ভিক্ষা চাইছি—
আমাদের হয়ে তোমরা কণামাত্র দুঃখ পেও না।
আমাদের জীবনের ছেঁড়া কাঁথাগুলো
সম্বৎসরে একবার ধোয়াধুয়ি কোরো না।
আমরা এমনিতেই ন্যাংটো,
দুনিয়ার সামনে আমাদের আর ন্যাংটো কোরো না।
কবিতাটি লিখেছেন অনুরাধা গুরব, যিনি ভারতীয় সমাজে বর্ণভিত্তিক পরিচয়ে একজন দলিত এবং লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ে একজন নারী। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই ‘আমরা’ সম্বোধন, আর কবিতার শেষ অংশে দলিত নারীর পরিস্থিতি বোঝাতে ‘ন্যাংটো’ শব্দটির দুবার ব্যবহার।
আমরা জানি, দলিতসমাজের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে উচ্চবর্ণের হিংসাত্মক আচরণ বহাল আছে। ব্যাপারটা যেন এমন— দলিতদের ওপর হিংসাত্মক আচরণ উচ্চবর্ণের জন্মগত অধিকার। দলিতদের ওপর ঘটে চলা ঘটনাগুলো অত্যন্ত জোরালো এবং প্রায় স্পষ্টভাবে হিংসার কথাই বলে। আর সেগুলো এত প্রকটভাবে বিদ্যমান বলেই হয়তো আজ এই বিষয় নিয়ে আমাদের নিরন্তর আলোচনা করতে হয়। আমরা যদি এই হিংসার রূপগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পারতাম, তাহলে হয়তো এত বেশি আলোচনার প্রয়োজন থাকত না।
এই বিবিধ হিংসার মধ্যে আমার মনে হয় বাচিক হিংসা নিয়ে বিশেষভাবে কথা বলা দরকার। কারণ, অন্য হিংসাগুলো নিয়ে যত বেশি আলোচনা হয়, বাচিক হিংসা নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। কারণ, বাচিক হিংসা আমাদের কাছে ঠিক ‘নির্যাতন’ হিসেবে উঠে আসে না। অর্থাৎ, নৃশংসতার মানদণ্ডে তা হয়তো অতটা নৃশংস বলে মনে হয় না। কিন্তু বাস্তবে বাচিক হিংসা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এবং তার কোনও অংশে কমার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
মহাভারতের ভীষ্মের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের কথোপকথনের একটি অংশে দেখি, যুধিষ্ঠিরের নানা জিজ্ঞাসার মধ্যে উঠে এসেছে একটি প্রশ্ন: সবচেয়ে কঠোর হিংসা কী? উত্তরে ভীষ্ম বলেছেন: সবচেয়ে কঠোর হচ্ছে বাচিক হিংসা। এবং সেটি বলতে গিয়ে তিনি যে অংশটি উচ্চারণ করেছিলেন, তার ভাবানুবাদ হল— তিরবিদ্ধ শরীর সেরে উঠতে পারে, কুঠার দিয়ে কেটে ফেলা জঙ্গল আবার গজাতে পারে; কিন্তু বাক্য দ্বারা তৈরি হওয়া ক্ষত শুকোয় না।
আসলে যেসব যন্ত্রণা খালি চোখে ধরা যায় না, তাদের ব্যাখ্যা করা সবসময়ই কঠিন। আর ঠিক এইভাবেই, সাধারণত প্রান্তিক মানুষের যে আন্দোলনগুলো হয়, যখন সেগুলো সম্প্রদায়ভিত্তিক হয়ে ওঠে, তখন পুরো সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর অনিবার্যভাবে পুরুষালি হয়ে যায়। এর ফলে অনেক সময় ঘরের কথাগুলো অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কারণ, সেগুলো ঠিক সম্প্রদায়ের যৌথকথন নয়— বরং একান্তই ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর, যেগুলো গুরুত্বহীন হয়ে পথের পাশে পড়ে থাকে। এই লেখাটিতে আমি তেমনই কিছু ঘরের কথা তুলে আনতে চাইছি।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে জর্জ অরওয়েলের অ্যানিম্যাল ফার্ম উপন্যাসের কথা— যেখানে অনিবার্যভাবেই প্রলেতারিয়েতরা নিজেদের অধিকারের দাবিতে একটি সংগঠন তৈরি করে। কিন্তু সেখানেও প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে আবার উচ্চ-নিচ অবস্থান বজায় রাখা হয়। আন্দোলনের ইতিহাসের এই ছকটা আজ আমাদের কাছে খুব একটা অচেনা নয়।
এই পথ ধরেই একদিন সর্বহারা সম্প্রদায় থেকে দলিত মানুষ, যারা বর্ণভেদের শিকার— সেখান থেকে আবার দলিত নারী, আরও সেখান থেকে দলিত প্রান্তিক নারী, তারও পরে দলিত মুসলিম নারী, সমকামী দলিত নারী— এমন নানা বর্গবিভাজন তৈরি হয়েছে। যা আজ দলিত আন্দোলনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আলোচনার কেন্দ্র।
আপনাদের মনে পড়বে, যখন কালো মানুষরা তাদের দাবিতে লড়াই শুরু করেছিল, তখন ইউরো-আফ্রিকান ও আফ্রো-আমেরিকান, আবার আফ্রো-আফ্রিকান পুরুষ ও সেই সম্প্রদায়ের মেয়েরা, তাদের মধ্যে আবার যারা দক্ষিণ আফ্রিকার দাসব্যবসার শিকার— প্রত্যেকের জীবনের অভিজ্ঞতা আলাদা ছিল। ইউরো-আফ্রিকানরা আফ্রো-আমেরিকানদের মতোই বর্ণবিদ্বেষের শিকার। কিন্তু আফ্রো-আমেরিকান নারী-পুরুষদের ওপর যে অত্যাচার, যৌন শোষণ এবং বর্ণবিদ্বেষ চাপানো হয়েছিল, তা সম্পূর্ণভাবে এক অন্য ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়।
আমার দীর্ঘদিনের কাজ হচ্ছে দলিত আত্মকথন নিয়ে। এই আত্মকথনগুলোর মধ্যে ছোট ছোট কিছু অংশ পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে, আরও গভীরে গিয়ে দেখা দরকার। সেই সমস্ত হিংসা নিয়ে, যেগুলো একজন মানুষ কিংবা একজন মেয়ের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ব্যাপারটা কেমন? যেমন ধরুন, মহারাষ্ট্রের মাহার সম্প্রদায়ের একজন মেয়ে বেবি কাম্বলে। তিনি তাঁর আত্মজীবনী The Prisons We Broke-এর একটি জায়গায় লিখছেন—
I hid everything. I wrote in the most ignored dusty corners. My son had started going to school when I started to write. So for me he was a knowledgeable, learned man. I used to be scared of both my son and my husband, scared of their reaction.
একটি মেয়ে তাঁর নিজের বাড়িতে বসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখতে পারছেন না। একজন দলিত মেয়ে পরিবারের পরিসরের মধ্যে বসে নিজের কথা বলতে পারছেন না। তাঁর স্কুলে পড়া ছেলেও তাঁর আত্মপ্রকাশের পথে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। আরেকটি জায়গায় তিনি লিখছেন—
Look, husbands did not have anything else to do. No education, no jobs; even food they had to beg for. Their male ego gave them a sense of identity— “I am a man, I am superior to women. I am somebody.” If the whole village tortured us, we would torture our women. Fathers used to teach their sons to treat their wives as footwear.
আমি আসলে এই অংশগুলোকেই ঘুরেফিরে বুঝতে চেয়েছি। শুধুমাত্র গার্হস্থ্য হিংসার বয়ান হিসেবে নয়, বরং এভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি যে পারিবারিক পরিসরেও আধিপত্যের চিরাচরিত পিতৃতান্ত্রিক স্বর কত সহজে একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। এর ফলে দলিত মেয়েদের আত্মপ্রকাশের উপায়গুলোর নাগাল পাওয়া আরও কঠিন হয়ে ওঠে। দলিত সাহিত্য আন্দোলনের এই পুরুষতান্ত্রিক আবহাওয়াকে স্পষ্টভাবে সামনে আনা, দলিত সমাজের ভেতরে পিতৃতন্ত্রের অবস্থান এবং দলিত মহিলাদের প্রান্তিকীকরণ-সংক্রান্ত প্রশ্নগুলোকে উন্মুক্ত করা— আজকের বর্ণবিরোধী আলোচনাকে বহুমাত্রিক করে তুলেছে।
এভাবে আরেক ধরনের লড়াইয়ের কথা বলছেন দলিত লেখিকা মল্লিকা ধাসাল, প্রখ্যাত দলিত সাহিত্যিক নামদেও ধাসালের স্ত্রী। ‘দলিত সাহিত্যিক’ এবং ‘দলিত প্যান্থার মুভমেন্ট’ নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই, তবে ১৯৭০–৮০-র দশকে সামগ্রিকভাবে দলিত সাহিত্যকে পথনির্দেশ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নামদেও ধাসাল। সেই নামদেও ধাসালের স্ত্রী মল্লিকা অমরসেখ (ধাসাল) নিজেও স্বনামে পরিচিত। তাঁর বাবা অমর শেখ ছিলেন লোকশিল্পী, অনেকটা চারণকবিদের মতো নিজের ঐতিহ্য আজীবন সংরক্ষণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই নাচ, গান, অভিনয়ে পারদর্শী মল্লিকা বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। মুম্বাইয়ের খ্যাতনামা নাট্যগোষ্ঠী ‘আবিষ্কার’-এ তিনি নিয়মিত অভিনয় করেছেন। কবিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশে মল্লিকা ছিলেন অসমসাহসী। দরিদ্র ও দলিতদের প্রতি উচ্চবিত্ত সমাজের উদাসীনতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থগুলোতে তীব্র ক্রোধ জ্বলন্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিনিধি-স্বর— তাঁকে কখনওই ‘অবলা নারী’ বলা যায় না। তাঁর স্বামী নামদেও ধাসাল, যিনি দলিত সাহিত্যের একেবারে প্রথমদিককার প্রতিনিধি লেখকদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীকালে মল্লিকার সঙ্গে নামদেওর প্রেম ও বিবাহোত্তর জীবন— সেটা কেমন ছিল?
তাঁর আত্মজীবনী I Want to Destroy Myself-এর লেখক পরিচিতি অংশে বলা হয়েছে—
I Want to Destroy Myself is Malika’s searing, angry account of her life with Dhasal. The unvarnished story of a marriage, and of a woman and writer seeking her space in a man’s world, it is also a portrait of the Bombay of poets, activists, prostitutes and fighters. There isn’t another memoir in Indian writing as honest and pitiless as this.
বিবাহিত জীবনে তিনি নিজের আত্মপ্রত্যয় নতুনভাবে নির্মাণ করতে গিয়ে এমন এক লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যা হয়তো তাঁর কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ হল এই যে, কর্মক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী ও প্রতিভাবান একজন নারী হয়েও, বিখ্যাত মানুষের স্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে আবার নতুন করে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলার লড়াই শুরু করতে হয়েছিল। কিন্তু কেন?
এক জায়গায় তিনি লিখছেন—
I came home. Namdeo was in high spirits. He appeared to be very far away from me. Or had I moved away from him? My needs, my existence and its joys had been erased from his life. This hurt me deeply. Far more than a child, I needed a husband, a companion in those days. Namdeo had no enthusiasm for family life.
তিনি ক্রমশ ঘরে-বাইরে একা হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলো অনেক সময় একাকী, নিঃসঙ্গ এক নারীর যন্ত্রণা প্রকাশ করে—
আমার স্বপ্নের বাসা সযত্নে রাখার জন্য
একটি গাছও আর বেঁচে নেই।(‘ঝড়’, অনুবাদ: স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায় গুহ)
বেবি কাম্বলের আত্মজীবনীর পাশে মল্লিকার আত্মজীবনী আমাদের আরেকটি জীবনের আখ্যান শোনায়। অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে, লিঙ্গ-যৌনতা এবং হিংসা প্রান্তিক সমাজে আসলে বহুমুখী ও বহুস্তরীয়।
আমি আর-একজন মেয়ের কথা বলব— চুনি কোটাল। লোধা-শবর গোষ্ঠীর মেয়ে, এবং তাঁদের গোষ্ঠীর প্রথম গ্র্যাজুয়েট। ছোট্ট জীবনে তিনি একটি আত্মকথনমূলক লেখা লিখেছিলেন, নাম আমার জীবন। সেখানে তিনি বারবার জানিয়েছেন, লোধা-শবর গোষ্ঠীর মেয়ের পক্ষে পড়াশোনা করাটা যেন একরকমের অন্যায়। এর ফলে তিনি গোষ্ঠীর ভেতরেও একা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লিখছেন—
কোন লগ্নে কোন তিথিতে যে এই মাটির পৃথিবীতে এসেছিলাম জানি না। নিশ্চয়ই সেই মুহূর্ত ভালো ছিল না। কিসের প্রয়োজনে যে আমাদের মতো ছেলেমেয়েরা আসে তার উত্তর আর খুঁজে পাই না। আমরা কয়েকটা লোধা ছেলেমেয়ে তখন স্কুলে যেতাম। আমাদের স্কুলে আসাটা মাস্টারমশাই পছন্দ করতেন না। তিনি কখনও আমাদের পড়া ধরতেন না, পড়া নিয়ে গেলে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধরতেন। কোথাও একটু ভুল হলে যেখানে ওদের ছেলেমেয়েদের গায়ে মাথায় হাত বুলাতেন, সেখানে আমাদের ভুল হলে পেতাম অকথ্য বেতের ঘা। বলতেন— ভদ্র হবি বলে স্কুলে এসেছিস, আর পড়া করতে পারিসনি! মাস্টারমশাই কী করে বুঝবেন স্কুল থেকে ফিরে রাস্তার জাম-কুল কুড়িয়ে খেয়ে যাদের দিন যায়, তাদের ব্যথা? কোনও কিছু বলে বোঝাতে চাইলে বলতেন— এমন লোকের স্কুলে না আসাই উচিত। ফলে নীরবে আমাদের ঘা খেতে হত। কত অশ্রুই যে ঝরে পড়েছে, তার আজ কোনও সাক্ষী নেই।
চুনির জীবনে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সহপাঠীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। বই ছিঁড়ে দেওয়া থেকে শুরু করে নানারকম অত্যাচার। দরিদ্র ও অসহায় এই প্রান্তিক ছেলেমেয়েরা প্রায়শই অনাহারে দিন কাটাত; বস্ত্র ও বাসস্থানের কোনও নিশ্চিত সংস্থান ছিল না। চুনি কোটাল লিখেছেন, ছেঁড়া জামা পরে স্কুলে গেলে মাস্টারমশাই চাবুকের ডগা সেই জামার ছিঁড়ে যাওয়া অংশে গলিয়ে টান দিতেন। স্পষ্টতই তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হত— তাঁদের আসল কাজ মাঠে গরু চরানো, বিদ্যাশিক্ষা নয়। দিনের পর দিন এই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অধিকাংশ ছেলেমেয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন ত্যাগ করত। কিন্তু চুনি কোটাল আর তাঁর ছোড়দা অসহনীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও স্কুলে টিকে ছিলেন। মেধাবী চুনি অনেক সময় অন্যদের থেকে বেশি নম্বর পেতেন, আর সেই কারণেই সহপাঠীদের একাংশ তাঁকে কারণে-অকারণে অপমান করত— ডাকত ‘কামিনের ঝি’, ‘কটাতীর ঝি’, ‘ধান ভাঙানির ঝি’ ইত্যাদি নামে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে তাঁর দাদা জানিয়ে দেন যে ফর্ম-ফিলআপের টাকা তিনি দিতে পারবেন না। বহু কষ্টে চুনি সেই টাকা জোগাড় করেন এবং লেট-ফি দিয়ে শেষ তারিখে ফর্ম-ফিলআপ করতে সক্ষম হন। দাদার অমানবিক ব্যবহার ও নিজের শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেই তাঁর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়। দীর্ঘদিনের অনাহার, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং প্রবল মানসিক চাপে শুরু হয় মাথা ও চোখের যন্ত্রণা। পারিবারিক অসহযোগিতা ক্রমশ তাঁর পড়াশোনার পথকে আরও কষ্টকর করে তুলেছিল।
তবু সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লোধা-শবর গোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম গ্র্যাজুয়েট মেয়ে হিসেবে উত্তীর্ণ হন চুনি কোটাল। পরে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পারিপার্শ্বিক নানাজনের কাছ থেকে শুরু হয় আবার সেই একই হিংস্র নির্যাতন— যার বড় অংশই ছিল তীব্রমাত্রার বাচিক হিংসা। এটাই শেষপর্যন্ত সেই একা হয়ে যাওয়া মেয়েটির একমাত্র সম্বল— তাঁর অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাসের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। ১৯৯২ সালে আত্মহননের মধ্য দিয়ে চুনির জীবনের ইতি ঘটে।
একজন প্রান্তিক সমাজ থেকে উঠে আসা মেয়ের আবাল্য অভিজ্ঞতা তাঁকে অনেকখানি প্রস্তুত করেছিল বৈষম্য ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু প্রস্তুতি ছিল না ঘরের ভেতরের লড়াইয়ের জন্য— নিজের আত্মজনদের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য।
আমি যখন প্রথম চুনির কথা জেনেছিলাম, তখন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়, আজ এত বছর পরেও সেই স্তব্ধতার ভার আমাদের অনেকের কাছেই সমানভাবে দুর্বিষহ।
এই তিনটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি আসলে একটা বিষয় বোঝাতে চেয়েছি— যে হিংসাগুলো আমরা সরাসরি দেখতে পাই, তাদের পাশাপাশি যে হিংসাগুলো অদৃশ্য থেকে যায়, সেগুলো নিয়েও বহুস্তরীয় আলাপ-আলোচনার পরিসর তৈরি হওয়া জরুরি।
কালো মেয়েদের লেখালেখির ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি একটি কৌতূহলকর ঘটনা দেখেছিলাম। ১৭৭৩ সালে বস্টনের মেয়ে ফিলিস হুইটলির প্রথম কবিতার বই Poems on Various Subjects, Religious and Moral ছাপা হয় ইংল্যান্ডে। কিন্তু বই প্রকাশের আগে বোস্টনের পাঁচজন নাগরিককে শপথ করে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল যে, কবিতাগুলো সত্যিই সেই মেয়ের নিজের লেখা।
সেকালে কালো লেখকদের আত্মজীবনী প্রকাশের সময় লেখকের নামের সঙ্গে “Written By Himself” ঘোষণা করতে হত— এই প্রচারের জবাবে যে, “কালোরা লিখতে অক্ষম।”
দলিত মহিলাদের ভিন্নভাবে কথা বলার কেবলমাত্র সামাজিক নয়, রাজনৈতিক তাগিদও আছে। গোপাল গুরুর মতো তাত্ত্বিকরা এ বিষয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন, যেমন তাঁর ‘Dalit Women Talk Differently’ (EPW, 1995)। মূলধারার নারীবাদী আন্দোলনে তাঁরা দলিত বলে প্রান্তিক, আবার দলিত আন্দোলনে তাঁরা নারী বলে প্রান্তিক। কিন্তু এখানেই শেষ নয়— দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেও আবার বহু স্তর আছে। কিছু সম্প্রদায় যেমন দীর্ঘ লড়াই করে সামান্য কিছু সুবিধা অর্জন করতে পেরেছে, তেমনই অনেক প্রান্তিকতম সম্প্রদায় সেই সুযোগটুকুও পায়নি। তাই এই সম্প্রদায়ের ভিতরে যে বহুস্তরীয় প্রান্তিকতা তৈরি হয়, সেগুলো নিয়েও সমানভাবে কথা বলা জরুরি।
আমাদের দৈনন্দিন যাপনেও এই হিংসার নানা রূপ প্রকাশ পায়। আমরা প্রায়ই শুনি— “ও তো কোটা থেকে এসেছে”, “ও ওই কাস্টের বলে সুবিধা পায়”, “ওরা চামার”, “ওর তো গায়ের রং কালো।” এই বাচিক হিংসা সম্পর্কে যেমন আমাদের অনেক বেশি সতর্ক ও সচেতন হওয়া দরকার, তেমনই দরকার আমাদের বাড়ির ভেতরের সেই অদৃশ্য হিংসাকে গুরুত্ব দেওয়া— যেখানে একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাস প্রতিনিয়ত ভেঙে যায়, অথচ খালি চোখে দেখা যায় না। আমার কাছে মনে হয়, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য— উভয় প্রকার হিংসাকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ভাবা এখন অপরিহার্য।

