তিনটি অণুগল্প

শমীক ষাণ্ণিগ্রাহী

 

ভূমিকা

রিয়া আর আমি হাঁটছিলাম।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা কথা বলছিলাম।

রিয়া আমার হাতটা ধরে থাকে। কখনও আমি রিয়ার হাতটা ধরে আছি।

হাঁটতে হাঁটতে দুপুরের রোদ বাড়ল।

আমরা ছায়ার জন্য দাঁড়ালাম। ছায়াটা আমাদের জন্য একটু বড় হল।

আমরা কথা বলছিলাম সকালের বিষয়টা নিয়ে। এখন দুপুর।

রাস্তায় বাসের একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজ। একটার পর একটা বাস চলে যাচ্ছে। আমাদের জন্য এখন কোনও বাস নেই। কিংবা আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করে নেই।

আমরা হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিলাম। তারপর বিকেল হবে। আমরা হাঁটতেই হাঁটতেই ফিরে যাব।

আমাদের এলোমেলো কথা শুনতে শুনতে দুপুরটা ঝিমোচ্ছিল। ধীরে ধীরে ছায়াও বড় হল।

অফিসে হয়তো আমার টেবিলের আশেপাশে কথার পর কথা জমছে আমাদের নিয়ে।

বাড়িতে রিয়াকে নিয়ে খাওয়ার ঘরে তুমুল আলোচনা চলছে।

আমরা হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আমাদের কথাই বলছিলাম।

আমরা আমাদের জন্য শুধু শব্দ তৈরি করছিলাম। শব্দগুলো তৈরি হয়ে দুপুরের বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

দুপরটাও তার নিজের মত ঘেমে যাচ্ছে।

ফাঁকা মাঠ বরাবর রাস্তা বরাবর শহরে বাতাস ঘুরছে।

আমি আর রিয়া হাঁটছিলাম।

আমি রিয়ার হাতটা ধরেছিলাম। কখনও রিয়া আমার হাতটা ধরে থাকত।

হাঁটতে হাঁটতে বিকেল হল।

আমরা তখন কথা বলছিলাম দুপুরের বিষয়টা নিয়ে।

রাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস ছুটছিল গোঁ গোঁ আওয়াজ করে। একটার পর একটা বাস চলে যাচ্ছে।

আমরা হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে আর কথা বলছিলাম না। তারপর সন্ধে নামল।

রিয়া বাড়ি ফিরে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

রিয়া সেই আগের মতই বাড়ি ফিরে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগরেট ধরালাম।

রিয়া অস্থির হয়ে ওঠে। আমাদের চারপাশ আরও অন্ধকার হয়ে পড়ে।

এখন আমরা আর কেউ কথা বলছিলাম না। আমাদের আর কোনও কথা ছিল না। অন্ধকার বাড়তে থাকে।

রিয়া বাড়ি ফিরে যাবে। একটার পর একটা বাস চলে যাচ্ছে হেডলাইট জ্বালিয়ে।

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগরেটটা জ্বলছিল।

 

ভাড়াবাড়ির একদিন

আমরা আপাতত একটা ভাড়ার বাড়িতে এসে উঠেছি।

রিয়া বিরক্ত হয়, দয়া করে তুমি এর মধ্যে তোমার গল্পকে টেনে এনো না।

আমি কী করি। আমি তো আর গল্পকে টেনে আনি না ইচ্ছে করে। ও নিজে নিজেই চলে আসে পছন্দ মতন। তারপর সেই গল্পের কাছে আমার খাতাকলম আর হাত দুটো বাঁধা পড়ে যায়। এখন গল্পের কথা থাক। ওকে শুধু শুধু টেনে এনে খুঁচিয়ে ঘা করার মতো কিছু না করাই ভালো।

এই প্রথমবার রিয়ার ভাড়াবাড়িতে থাকা। শুধু আমারই থাকা কোনও না কোনও ভাড়াবাড়িতে। ভাড়াবাড়িতে থাকার অনেক অসুবিধে। রিয়ার অপছন্দের কারণ বেশ কয়েকটা (আলাদা করে আমাদের একসঙ্গে থাকার প্রাথমিক শুরুয়াত)। পছন্দের জিনিসগুলো নিজের পছন্দমতো জায়গায় ঠিকঠাক রাখা যায় না। ভাড়ার শর্তসাপেক্ষে বাড়িওয়ালার নিয়মগুলো মনে পড়ে।

রিয়া সারাদিন ধরে শুধু গজগজ করে চলেছে। একটা কিছু নতুন পছন্দের জিনিস এখনও কেনা হল না। সেই পুরনো আমলের দেওয়ালে পুরনো নিয়মগুলোই কোথাও কোথাও দাঁত বের করে হেসে ওঠে।

তারপর বিকেলের চা হয়। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের নাড়াচাড়া। সবশেষে একটা সিগরেট ধরিয়ে পড়ার টেবিলে বসতেই রিয়া ঝাঁজিয়ে ওঠে, আবার তুমি সেই গল্প নিয়ে বসলে। এ বাড়িতে ঢোকার সময় প্রথমেই তোমাকে না আমি বারণ করেছিলাম। মাথা থেকে ওসব নামিয়ে রেখে আমাকে সাহায্য করবে এসো দেখি। এখনও অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে।

আমি একদম ভোঁতা মেরে গেলাম। কোথায় চেয়ারে বসে আরাম করে চায়ের পরে সিগরেটটা খাব তা না ঘরের কোথায় কোথায় কী কী করতে হবে তার একটা লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বসল!

ভাড়াবাড়িতে থেকে কোনও কাজ নেই, তার চেয়ে বরং নিজের একটা আলাদা বাড়ি থাকলে ভালো হত। তার নিজস্ব একটা ঘর শুধু আমার জন্য। পড়ার টেবিল চেয়ার অ্যাশট্রে আর পড়ার বইগুলো সব গোছানো থাকবে। শেষমেশ সেই নতুন বাড়ির কথায় কথায় গল্প এসে ঢুকে পড়ল। শুনতে পেলে রিয়া বিরক্ত হবে।

আসলে রিয়ার বিরক্ত হবার কারণ আছে। এ পর্যন্ত আমি যে ২১টি গল্প লিখেছি এই মধ্য বয়েসে এসে তার সবকটি গল্পের নায়িকা সেই রিয়া।

প্রকাশিত এই গল্পগুলো পড়ে পাঠকের (রিয়ার ধারণা) রিয়ার সব কথা জানা হয়ে গেছে। কোনও কিছুই আর গোপন থাকছে না। যাই হোক আমি রিয়ার চিন্তাভাবনায় কিছুটা প্রশ্রয় দিই।

প্রশ্রয় পেয়ে রিয়ার আগলগুলো সমস্ত খুলে যায় একে একে। সুযোগ বুঝে গল্প ঢুকে পড়ে আমাদের মাঝে। গল্পকে তারিয়ে তারিয়ে আমি রিয়াকে আদর করি। রিয়া নড়েচড়ে ওঠে বিছানায়। ঘরের মধ্যে আটকে পড়া বাতাস হাঁফিয়ে ওঠে আমাদের দ্রুত নিঃশ্বাসে।

 

আমার ২২তম গল্পে নতুন বাড়িটা সাজিয়ে গুছিয়ে রিয়া কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। আমিও স্বস্তিতে পড়ার ঘরে বসে সিগারেট ধরিয়েছি। টেবিলের ওপর ২৩তম গল্পের একটা পাতাও লেখা হয়ে ওঠেনি এখনও।

 

বিরুদ্ধকথা

সিগরেটটা খাব বলেই বসেছিলাম। গঙ্গার ধার, আমি একাই বসে। বাঁধানো ফুটপাতের ধারে একটা কাঠের বসার বড় বেঞ্চের মত। তাতে হেলান দেওয়া যায়। রংটা চটে যাওয়া কালচে সবুজ। আজ ফুটপাতটা প্রায় ফাঁকা আছেই বলতে গেলে! অন্যদিন বিকেলের এইসময়টায় পুরো ভরে যায় লোকজনে। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয়। সবাই গঙ্গার হাওয়া খেতে আসে!

আসলে এটা গঙ্গা নয়। ভূগোল অনুসারে হলদি নদী। দিক বদল হলে তার নামও বদলে যায়। আসলে আমরা গঙ্গা বলতেই ভালোবাসি!

সিগারেটটা অনেকক্ষণ হাতে ধরে বসে আছি! খাব কি খাব না? প্রতিবারই তাই করি! খাব কি খাব না! একটা ভীষণ অস্বস্তি আর অসহায় অবস্থায় থাকি।

গলার অসুখ অনেক দিন ধরে। একবার অপারেশন হয়ে গিয়েছে। আমার সিগারেট খাওয়া বারণ। কিন্তু শোনা হয় না। খেয়ে যাই। একটা দুটো করে দিনে বেশ কয়েকটা খাওয়া হয়। তবে বার কয়েক হিসেব রেখে দেখেছি পাঁচটার বেশি না।

সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে ভাবি খাব কি খাব না। এই একটাই কিনেছি। গত চারদিন না খেয়ে কেটেছে। প্রতিবারই ভাবি একদম ছেড়ে দিই। আর না অনেক হয়েছে! এই নিয়ে রিয়ার সঙ্গে অনেক কথাকাটাকাটি, কান্নাকাটি অনেক কিছু হয়েছে। আজকের দিনটায় এই এখন একটা সিগারেট শেষ পর্যন্ত আমার হাতে। আমি হাতে নিয়ে বসে আছি অনেকক্ষণ হল।

খাবো কি খাবো না
আমার গলার অসুখ
আমার বেশি জোরে কথা বলা বারণ
ঠান্ডা জল খাওয়া বারণ
আমার সিগারেট খাওয়া বারণ।
চুপ করে বসে থাকি। শেষমেশ সিগরেটটা ধরিয়ে ফেলি। আজ পাঁচদিনের দিনে হাতে শেষ পর্যন্ত একটা সিগারেট!
রিয়ার অভিযোগ অভিমান মাথার দিব্যি
ডাক্তারের রাশভারী গলা, এবার সিগরেট খেলে সামলানো মুশকিল
আমি সিগরেট খাব কি খাব না ভাবছি
রিয়া বলল
ডাক্তার বলেই চলেছে
আমি নিজেই নিজেকে বলছি
রাহুল দ্রাবিড় বলছে প্রত্যেক সিনেমার শুরুতে
ইত্যাদি ইত্যাদি।

ক্রিকেট খেলাটাও অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। সকালের হাঁটাটাও বন্ধ! খালি বিকেলে কখনওসখনও এই একটু গঙ্গার ধারে একা একা।

আজকাল আর কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না। লিখতে বসলেই ভীষণ সিগারেট ধরানোর কথা মনে হয়! লেখার টেবিলে রিয়ার আর আমার ছবি হাসিমুখে কেমন তাকিয়ে থাকে যেন।

সিগারেট তখন থেকেই পুড়ছে আঙুলের ফাঁকে।

টেবিলের ড্রয়ারেই কোথাও ডাক্তার প্রেসক্রিপশন, বুকের ছবি, রক্তে ব্লাডসুগারের পরিমাণ এইসব আছে, কোথাও আছে নিশ্চয়ই! রিয়াই সব গুছিয়ে রাখে। আমার ওসব খেয়াল থাকে না কোনওদিনই। সিগারেটের খালি প্যাকেটগুলো নাড়াচাড়া করি সারাদিন।

সিগারেট সেই পুড়ছে আঙুলের ফাঁকে…

ডাক্তার বলছেন, ব্লাডসুগারের রিপোর্ট কিন্তু ভালো নেই। শুধু ওষুধ খেলেই হবে না। সঙ্গে আপনাকে ডায়েট অবশ্যই মেনটেন করতে হবে। আর হ্যাঁ, সিগারেটটা কিন্তু স্ট্রিক্টলি না। এবার তিনমাস পর আসবেন সঙ্গে এই রিপোর্টগুলো করিয়ে আনবেন। এরপরও যদি আপনার কন্ট্রোল না হয় তাহলে ইনসুলিন ছাড়া গতি নেই।

সিগারেটটা পুড়ছে আঙুলের ফাঁকে…

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4243 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুব ভালো। তিনটে মিলে একটা গল্পও বটে। প্রেম আর সিগারেট কবে একসঙ্গে এভাবে দেখেছি, মনে করতে পারছি না। বিরুদ্ধকথা তো প্রায় চোখে জল এনে দেয়।

আপনার মতামত...