দেবকুমার সোম
মনের কথাটা ঠিকঠাক লিখতে হবে; যথাসম্ভব জিজ্ঞাসার চিহ্ন যেন থাকে। আবার ড্যাশ-সেমিকোলনের অপচয় হলে সবটাই মাটি। অক্ষরে-অক্ষরে সহমত হয়েও শব্দগুলো অনবরত যেন ঠোকাঠুকি করে। প্রণয় মানেই সংঘাত। আকচাআকচি না-থাকলে কীসেরই বা ভাবসাব? ভাবের কথা এলেই জ্যামিতির কথাটা মনে আসে, অথচ বর্ষার ঘন-মেঘ যখন দিনের রোদ্দুরকে মুখ-চাপা দিয়েছে আর শন-শন হাওয়া বইতে শুরু করেছে, তখন বাবার নির্বাক চাহনিটুকু ছাড়া বাকি সবকিছুই কেমন যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল মেয়েটার কাছে।
কাল রাত থেকে একটানা বৃষ্টি পড়ছে— আষাঢ়ে যেমন হয়। শহর জুড়ে বৃষ্টির উৎপাতের সঙ্গে এই অ্যাপার্টমেন্টের বৃষ্টির ধরনটাও বেশ মিশে গিয়েছিল। মেয়েটা দেখছিল তার বিয়ের খাট কেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে— বালিকার মতো। সন্ধে থেকেই আক্রোশ আর প্রতিহিংসা বাদলদিনের গুমোট হাওয়ায় দমঘুটে মরছিল তাদের শয়নঘরে। ছেলেটা সেই কান্না উপেক্ষা করেছে, তবে আলমারির পাল্লাগুলো খুব জেদি আর অহঙ্কারি এমনটা তার মনে হয়েছিল। ছেলেদের কাঁদতে মানা, ফলে সে এমনিই একটা সিগারেট নিয়ে স্ট্যান্ডিং ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখেছিল জল থইথই মেঝে। তার ওপর সিলিঙের আলোগুলোর ঝুঁকে আসায় দু-কামরার আবাসটা কেমন বিচ্ছিরি— বিদঘুটে। তখন রাস্তার এ-ধার শুনশান আর ও-ফুটপাথে কাকভেজা একটা মেয়ে খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে। দু্টো গাড়ি জল ছিটিয়ে চলে গেল।
রাতে আকাশ কখন ক্লান্ত হয়ে থেমেছিল তাদের জানা নেই। সকালে ঘুম ভাঙতে গুমোট, রোদ্দুরহীন দিনটা শুরু হল ক্লান্তি আর গ্লানির মধ্যে দিয়ে। বিচ্ছিন্নতা তো ছিলই, যেমন থেকেছে এ-যাবৎ, তবু মেয়েটা আজ মোবাইল হাতে শৌচালয়ে সকালটাকে একটু বেশিই টেনে নিয়ে যেতে চাইল—। ছেলেটার আজ খুব খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। এমন ঘ্যানঘ্যানে দিন কতক্ষণ আর সহ্য হয়? কিন্তু সে যে জলকাদা ডিঙিয়ে রান্নাঘরে অনুরোধ নিয়ে যাবে তার উপায় কই? অনেক রাত অবধি বিছানা ভেজানো, জল থই-থই মেঝে এখন এঁটেল মাটি। ব্যালেন্স অসম্ভাব্য। দু-কামরার এই আবাসনে দুজন এত কাদা মেখে বসে আছে যে, ফেসবুকে হেঁয়ালি করে একটা দেওয়াল লেখা যায়। এমন প্রত্যাশিত অস্বস্তির মধ্যেও স্বাভাবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ছেলেটা দাড়িতে সাবান লাগাতে থাকে।
জীবনে জটিলতা কে চায়?
কে-ই বা চায় একটা বাঁকা পেনসিল কম্পাসে বৃত্ত এঁকে আজীবন নাজেহাল হতে?
ঘড়ির সময় আগুপিছু হওয়ার নয়, আবার গ্লোবটা আজ একটু বেশি কাত হবে তেমন সম্ভাবনা কই? ছেলেটা দ্রুত কাদা ঘেঁটে, নোংরা জল পার করে বাথরুমে যায়— সেখানে বেশ আলো আছে। সাদা ওয়াশবেসিন। সাদা কমোড। শাওয়ারও রমণীয়। ছেলেটা জলের নিচে দাঁড়িয়ে নির্ভার হতে চাইল— মানুষ যেভাবে একা হয়ে যায় সেভাবে। কাল রাতের সেই দুরন্ত ঝড়-বাদলের পরেও সে যেন সুদক্ষ নটের মতো ফের একটু একটু করে প্রাণ বাঁচিয়ে জীবনের দিকে থিতু হতে চাইছে।
ছেলেটা পোশাক পরে নেয়। পকেটে পার্স, রুমাল, বলপয়েন্ট পেন। সিগারেট প্যাকেট। ঠাকুরের সামনে মাথা ঠেকানো। জলকাদার মধ্যে খেতে বসো; খিচুড়ি নয়। কাল রাতের না-খাওয়া মাছভাত মাইক্রো আভেনে গরম করে মেয়েটা সাজিয়ে দিয়ে এক-হাঁটু জলের মধ্যে একটু আলগোছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে ভেসে আসা রাস্তার কিছু সংলাপ আর সময়াসময় মোবাইলের রিংটোন উভয়ের নীরব শরীরভাষাকে ঢেকে রাখতে সচেতন।
সময় মেনে ছেলেটা তার আবাসন থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে কাদা-ছাপ রেখে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। তখন চারপাশে একটু একটু করে আলো ফুটে উঠছে যেন। মেয়েটা ব্যালকনিতে। করপোরেশন ম্যানহোল খুলে দেওয়ায় দু-একটা গাড্ডা ছাড়া জলসঞ্চয়ে বাড়তি কোনও তাগিদ থাকেনি রাস্তার। মেয়েটা দেখে তার বর ঘরের কাদা বিলকুল মুছে রাস্তার কাদায় নিজের পায়ের ছাপ মানানসই করে নিল। এভাবে দেখলে বোঝা যায় বহু অভ্যাসে সে রপ্ত করেছে বাইরেটাকে নিজের ভেতর গ্রহণের। বর গলির মুখ থেকে বাসরাস্তায় পৌঁছালে বউ দেখে সদ্য বাস থেকে নেমে টিকিটখানা ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রৌঢ়— যথেষ্ট বয়স হলেও বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি এখনও সেভাবে।
অ্যাপার্টমেন্ট এখন বেশ ফাঁকা। লক্ষ্মীদি শ্যাওড়াফুলি গেছে, কাল ফিরবে। ঘরে মানুষ বলতে সে, টিভি আর মোবাইল ফোন। মেয়েটার ভালো লাগছিল না কিছুই। ল্যাদ খেয়ে পড়ে থেকে, ঝুঁকে আসা আকাশটাকে আরও খানিকটা টেনে এনে দেখার আগ্রহও যেন নেই। বিছানায় বসে জানলা দিয়ে উঁকি মারে— নিচে সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। পাশের আবাসনের ছাদে শুকোতে দেওয়া বাচ্চাটার জামাকাপড়। দূরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সাদারঙের বহুতল। ওদিকে আবার সেন্ট্রাল এভিন্যুর ক্যাঁচরম্যাচর। হল্লা। ট্রাফিক সিগন্যাল পাত্তা না দিয়ে হেলমেটহীন প্রেমিক-প্রেমিকার উড়ন্ত বাইক আস্ফালন। মেয়েটা হাসে; বিষাদের হাসি। এমন ঘোর আষাঢ়ে তার জীবনেও ছিল বসন্তদিন। তার দাগ এখনও বুকের ভেতর পাকাপাকি সেঁটে আছে।
—টিভি তুমি কথা বলো।
—কী বলব? আমাকে তুমি কলতলার ঝগড়া ভাবো। তার চেয়ে ওই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দেখো, ঘেমো মানুষগুলো কীভাবে জীবনের তেতো দিয়ে মিষ্টি বানায়।
—মোবাইল তুমি কথা বলো।
—আর তো বলা যাবে না। তোমার নম্বর লোকটা ব্লক করে দিয়েছে।
—কোন লোকটা?
—সেই যে প্রৌঢ়— যথেষ্ট বয়স হলেও বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি এখনও সেভাবে।
—বড্ড ঘ্যানঘ্যানে লোক। কাজবাজ নেই— সারাদিন ফর্দ নিয়ে বসে থাকে। পোসেসিভ। কিছু বললেই ক্লাস টেনের ছেলের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান।
—কম তো জ্বলাওনি তাকে।
—জ্বালাব না কেন? ভালোবাসার কত মুরোদ দেখব না?
—তা দেখো। তবে তুমি যা মানুষ, কখন যে ঝটকা দেবে বেচারা বুঝতেই পারবে না।
—বেচারার কী হল? যত্তসব।
—বয়স হলে মানুষের যে হারানোর ভয় থাকে দিদি।
—বাপের বয়সী মানুষ।
—তো? বাপ-মেয়েতে প্রেম হয় না বুঝি?
—ধ্যাত— ভালগার। ওকে আমি খুব সম্মান করি। মানি। তাছাড়া প্রেমটেম আমার দ্বারা হবে না।
—এত সহজ নয় গো দিদি, নিজেকে চেনা এত সহজ নয়।
—লক্ষ্মীদি তুমি যা জানো না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। যাও আমাকে একটু কফি করে দাও।
মেয়েটার ধমকে হাওয়া থম মেরে যায়। সে বিছানায় এসে বসে। খটখটে শুকনো বিছানা— নিভাঁজ। নিভাঁজ। শরীর তো চায় কাউকে ভালোবাসতে। দাম্পত্যের অধিকারে ও-পাড়ার মেয়েগুলোর মতো শুধু ঠ্যাং ফাঁক করে শোয়া? একের ছায়া অন্যের শরীরে পড়লে চন্দ্রগ্রহণের মতো কিছু…। খুব বাড়তি চাওয়া? বর-বউ খেলার মধ্যে এত ফাঁকি, এত ফাঁক— জলকাদার সংসার।
দেওয়ালে টিকটিকিটা তিনবার ডেকে উঠল।
তাহলে কী মেয়েটা মনে-মনে যাকে চাইছে, সে বীর্যবান কোনও সুপুরুষ? নাকি হারিয়ে যাওয়া বাবার অনুকৃতি— ভরসা; সোহাগ?
এই তিরিশ বছরে কম পুরুষ জানা হল না; চেনা হল না। সকলেরই তীব্র অধিকারবোধ— আমি যেন কোনও দামী ট্রোফি, চাম্পিয়ন হতে চায়। মেয়েটার স্মৃতিকথার মধ্যে দমচাপা পড়তে থাকে সদ্যোজাত কথাগুলো। সে জানে কথা মরে গেলে অক্ষর হয়ে যায়। অক্ষর মানে দ্বিমত। শব্দ মানে ব্যবধান। বাক্য মানে একটা অর্থহীন সম্পর্ক আর পুরো প্যারাগ্রাফ ভুল বোঝাবুঝির স্মৃতি। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ডায়রিতে কাটাকুটি+কাটাকুটি+কাটাকুটি। তার মরেহেজে যাওয়া কথাগুলো নিয়ে হিজিবিজি হরফগুলো ক্রমশ অক্ষর হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমশ।
এতকাল জমিয়ে রাখা বিভিন্ন মানুষের বাস-টিকিটগুলো সিলিং থেকে নেমে আসা ভিজে হাওয়ায় বিছানায় ছড়িয়ে দিলাম। পঁচিশ পয়সার এই টিকিটগুলো আমার বাবার দেওয়া। বাবা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাসে করে স্কুলে যেতেন— দি বলেছে। বাবা যখন হারিয়ে যান আমি তখন দু-বছর আট মাস। দি বলে বাবা স্কুল থেকে ফিরে আমায় কোলে তুলে এই সবজে রঙের টিকিটগুলো মুঠোতে ধরিয়ে দিতেন— আমার মুখ উপচে উঠত খিলখিল হাসি। আমি জানি এই টিকিটগুলোর মতো পুরনো বইয়ের গন্ধের মধ্যেও আমার বাবা লুকিয়ে আছেন। সেদিন ওই প্রৌঢ় লোকটা, আরে যার যথেষ্ট বয়স হলেও বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি এখনও সেভাবে; সিসিডি-তে আমাকে একটা বই দিল। সেই উনিশশো চল্লিশ সালের বৈষ্ণব পদাবলি। লালচে কড়-কড়ে পাতাগুলোর সুঘ্রাণ আমাকে বাবার স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছিল। বিশ্বাস করো তারপর থেকে আমি বইটা খুলতেই পারছি না। যতবার খুলছি চোখ ছাপিয়ে নেমে আসছে বৃষ্টি। আচ্ছা বাপি, এমন কেন হয়?
তিরিশ পয়সার এই টিকিটগুলো মায়ের। বাবা হারিয়ে গেলে আমাদের তিন বোনকে নিয়ে মায়ের একলা সফর শুরু হয়। দি তখন তেরো, ছোড়দি আট। তিরিশ পয়সার টিকিটগুলো নীলরঙা। ওই রঙের টিকিট আমাদের হাওড়ার নয়। মাকে বাবার পাওনা টাকাপয়সার জন্য কলকাতায় যেতে হত। লোকটা এইমাত্র বাস থেকে নেমে যে টিকিটটা ছিঁড়ে বর্ষার হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল সেটার রং সবজে। এমন ছিঁড়ে ফেলা দেখলে আমার খুব রাগ হয়, কষ্টও। ছিঁড়ে ফেলা মানে মুছে ফেলা। সফরযানের স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা। কিন্তু আমার যে এখনও বাসনা কেউ এসে প্রতিদিন আমার হাতে তার সফল ফিরে আসার টিকিটখানা গুঁজে দিক। আগেকার টিকিটগুলো এমন পাতলা কাগজে ছাপা হত না। সফরনামার নথি বৃষ্টির তোড়ে নর্দমায় ভেসেও যেত না। শুনেছি স্কুলে যাওয়ার তোড়জোড় করলেই আমি খলবলে ছুটে যেতাম এবং অবধারিত বাঁ-পায়ের জুতো ডান-পায়ে আর ডানেরটা বাঁয়ে গলিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
এই পর্যন্ত লিখে মেয়েটা থেমে যায়। হাঁপিয়ে ওঠে। বাবাহীন জীবনে পুরুষের থাবা খুব বিপজ্জনক। তখন কতই বা বয়স? ছয়। মা প্রায়দিন বাবার পাওনাগণ্ডার জন্য সকালের বাসে চলে যেতেন। দি স্কুলে। ছোড়দিও। আমি স্কুল থেকে ফিরে জবাকাকিমার কাছে থাকি। ওখানেই খাই। তনিমার সঙ্গে খেলি। মা কিংবা দি বাড়ি ফেরার সময় আমাকে নিয়ে যায়। সেদিনটাও এমন বৃষ্টিদিন ছিল। জবাকাকিমা আর তনিমা ছিল না, কাকু ছিলেন। ছ-বছরের বালিকাকে সেদিন তিনি অন্য এক বাসের টিকিট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই টিকিটে না ছিল কোনও রং, না দাম কিংবা কোনও অক্ষরচিহ্ন। বাবার কথা আমার মনে পড়ে না। ছবিতেই তাঁকে দেখা, কথা বলা। সেদিন ওই কাকুটা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল দমকে ওঠা কান্না কীভাবে দমিয়ে রাখতে হয়। কীভাবে ভয় আর বিতৃষ্ণা নিয়ে বয়স্ক পুরুষদের ঘৃণা করতে হয়। দি-কে বলেছিলাম; বিশ্বাস করেনি। আজও মা কিংবা দিদিরা ভাবে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম সেদিন বর্ষাদুপুরের নোংরামির কথা। ওরকম কিছু হয়নি। হয় না।
—ছিঃ, এইটুকু বয়সেই তোর এমন নোংরা মন। যাঁরা আমাদের দেখভাল করেন, তাঁদের বদনাম করিস?
ছোড়দি আমার মাথার ঝুঁটি ধরে মারতে মারতে বলেছিল। যে ছোড়দি আজ বলে তোর মতো গতর থাকলে আমি বরকে ভেড়ুয়া বানিয়ে রাখতাম।
দি বুঝেছিল আমার কষ্ট। মা বোঝেনি। আজও না।
মেয়েটা বিছানায় ছড়ানো টিকিটগুলোকে ভাগ করে, ফের এলোমেলো করে উঠে দাঁড়ায়। মোবাইল ঘাটতে ইচ্ছে করছে তার। নাচের মুদ্রায় সে মাটিতে পা রাখে। এখন এই খটখটে মেঝেতে সে নাচতেই পারে। মঙ্গলাচরণে ভূমিপ্রণাম। নাচ তার শরীরে, তার চোখে, গ্রীবায়, পদছন্দে। সেই বালিকা সময় একদিন প্রবল বৃষ্টির দুপুরে ছাদে একা একা উদ্দাম নেচেছিল। সেদিন আকাশ ভেঙে বাজ পড়ছিল নারকেলগাছের মাথায়। ঘন-বাদল মেঘ ঠিক যেন শ্রীগীতগোবিন্দমঃ হয়ে নেমে এসেছিল তাদের ছাদে। কেউ কোত্থাও ছিল না। শুধু পাশের বাড়ির কার্নিশে একটা কাক চুপচুপে ভিজে তাকে দেখছিল। সেদিনের নাচ তাকে যেন পিতৃবিচ্ছেদ ভুলিয়ে দিয়েছিল, ওই কাকুটার নোংরা ঘিনঘিনে হাতগুলোকে চোখের ওপর ঝাপসা করে দিয়েছিল। তারপর রাতে প্রবল জ্বর। সেই নাচ এতদূর অবধি তাকে টেনে নিয়ে এল, তারপর ধীরে চলেও গেল, মোক্ষ অসমাপ্ত রেখে।
কলেজ থেকে ফেরার সময় তমাল টিকিট নিয়ে খুনসুটি করত। দিতে চাইত না। ফলে প্রায়দিন মেয়েটা দুজনের টিকিট কেটে নিত। একই বাসস্টপে নামা, পাশাপাশি কিছুটা হাঁটা, তারপর বিশালাক্ষ্মীতলার মুখ থেকে বাঁদিক বরাবর বেঁকে যাওয়া। ইটের রাস্তা পেরিয়ে পুকুর টপকে সাদা দোতলা বাড়িটা তমালদের। তখনও বাসের টিকিটের গায়ে ফুটো থাকত। দু-রঙা সেই টিকিটগুলো মেয়েটা পুড়িয়ে দিয়েছে। দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে মা আর ছোট মেয়ে। মেয়ের নাচ, গান, প্রেমে মায়ের আবছা আশকারা কি ছিল? ভেবেছিলেন কি কাছাকাছি থিতু হোক?
বুড়ো লোকটা সত্যিই মেয়েটাকে ব্লক করে দিয়েছে। হোয়াটস্অ্যাপ-এ স্যারের সঙ্গে খানিক চ্যাট করতে ইচ্ছে করে। কতদিন হয়ে গেল সে আর নাচে না— মুদ্রাগুলো ভুলেছে প্রায়। তার বর তো বলেই দিয়েছে ঘরের বউ ধেই-ধেই করে নাচবে এমন কালচারে তারা অভ্যস্ত নয়। প্রিয় কবিবন্ধুকে ফোন করে, তার কবিতায় মেয়েটা দ্রবীভূত সেটাও ঠারে-ঠারে জানিয়ে দেয়। বহু রাত বিছানা যখন বানের জলে ভাসে, তখন সে প্রিয়তমার মতো কবির বইতে ডুব দেয়। এই কি সেই বীর্যবান সুপুরুষ যাকে সে কামনা করে? পুরুষে যে খুব ভয় তার। তমালের সিগারেটের ছ্যাঁকা শরীরের কোথায় কোথায় পড়েছিল তা এখনও স্মৃতিতে টাটকা। খবরটা রটে গিয়েছিল খুব দ্রুত। মফস্বলে কেচ্ছা এমনিতেই দ্রুত ডালপালা মেলে। তমাল মানসিক রুগী, অসুখটা মামার বাড়ি থেকে পাওয়া। বাড়াবাড়ি হলে ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। একদিন এমনই দুপুর, রোদ ঝলমলে; তমাল মেয়েটাকে বিছানায় পেড়ে ফেলে সিগারেটের ছ্যাঁকায় অঙ্কিত করেছিল শরীর। তারও আগে একবার গলা টিপে মারতে চেয়েছিল। আর একবার বেল্ট ব্যবহার করেছিল নিখুঁত চাবুকের মতো। বুকের ভেতর ভালোবাসা আর চামড়ায় তার হিংস্র দাগ সে চানঘর ছাড়া কোথায় লোকাবে? কান্না দিয়ে কি সবটা ভোলা যায়? মুছে দেওয়া যায় অপমানকথা? সেদিনও মা বুঝতে চাননি। ভেবেছেন মেয়েটা ছেলে পেলেই প্রেমে পড়ে, তারপর কমিটমেন্টের সময় সরে আসে। মেয়েদের প্রেম মানে একটা কমিটমেন্ট এবং আত্মসমর্পণ। এর বেশি কিছু নয়।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে সরে আসা। একা একা লোকাল ট্রেনে সফর। শেষ বিকেলে একমুঠো বানানো হাসি হো-হো হাওয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া। এভাবেই ফের উদ্ভাসিত হতে চেয়েছে। বাবাকে যত ভুলতে চেয়েছে, তত বেশি তাজা হয়েছে বালিকা বয়সের নোংরা স্মৃতি। নাচের ক্লাসে, রাস্তায়-স্টেশনে শত শত সুঠাম তরুণের চাহনির নিবিড়তায় নিজেকে যতবার খুঁজতে চেয়েছে, ততবার মাঝখানে তমাল এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে আঁতকে উঠে ফের নাচের মুদ্রার মধ্যে বহু রাত ঘুমিয়ে পড়েছে। পুরুষ অভিভাবকহীন জীবন কোনও মর্যাদা দেয়নি তাকে। মা-দিদিদের ঝাঁঝালো আক্রমণে নাচের স্যারও আক্রান্ত হয়েছেন। তিনিও বাপ-কাকার বয়সী। সকলে তনিমার বাবা নন, এইটুকু জেনেও সম্মানজনক দূর থেকে স্যারকে ভালোবেসেছে। বলেছে তুমি আমার বন্ধু। সে সময় এক দুর্বল মুহূর্তে স্যারও চেয়েছিলেন তাঁর ছাত্রীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবেশে সে যে কী কুৎসিত কেচ্ছা মা-দিদিরা মুখ লোকাবে কোথায়?
মেয়েটা বুঝেছিল তার গন্তব্য তার হাতে নেই। বুঝেছিল যে রাস্তায় সে হাঁটতে চায়, সে রাস্তায় তার কোনও বাপ নেই। মেনে নেয়। সমর্পণ করে। বিয়েও। ছেলেটা উজ্জ্বল— সপ্রতিভ; ভালো চাকুরে। মানানসই জামাই। বিয়ে না দিলে মেয়েটা বিগড়ে যেত। এমন কিছু ভেবে নিয়েছিলেন মা; কারণও তো বহুবিধ। স্বামী তিন মেয়েকে তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশে চলে গেলে যাবতীয় সন্দেহ আর রাগ এসে পড়ে বউয়ের ওপর। ভরন্ত সময়ে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি আর বানানো প্রতিশ্রুতিগুলোকে পাশ কাটাতে কাটাতে মায়ের এই শিক্ষা হচ্ছিল পুরুষ অভিভাবকহীন জীবন সাধারণ মেয়েদের কাছে হানিকর।
মেয়েটা, যে এই কিছুক্ষণ আগে জমানো বাসের টিকিটগুলোকে পাট-পাট সাজিয়ে নিচ্ছিল নিজের অবসরে, সে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। মেনে নিয়েছিল বানানো পুরুষসমাজ। তারপরও তো আশা থাকে, ছিল, মানুষটা নেহাত তার বর না-হয়ে প্রেমিক হয়ে উঠবে। হয়ে ওঠেনি। বিছানায় শীতলতা আর সেকেলে বঙ্গবধূর মতো সেবাদাসী মেয়েটা এমন ভূমিকা নিলে, ছেলেটাও বাইরেটা ভেতরে গ্রহণ করতে শিখে নিল। অমনযোগে অমনযোগে ঘরের ভেতর ঘর, তার ভেতরে আরও বহু ঘর বানিয়ে নিল দুজন। এভাবে তাদের ভাগ হয়ে যাওয়া রাস্তায় কখন যেন এসে দাঁড়াল সেই তরুণ কবি। তার তন্ময়তা, তার আলোড়ন, সমগ্রতা নিষিদ্ধ রাস্তার দিকে মেয়েটাকে যেন টেনে নিয়ে গেল। সেই সফরে হাত ধরে গড়িয়াহাটের ফুটপাথ বদল, কবির কিনে দেওয়া মাটির গয়না। রাস্তার ধারে বুনোফুলের গন্ধ আবিলতা। দিন শেষে ঘরে ফিরে আসা। এসব খুব আপন হয়ে উঠল জীবনে। দুদিকে দুই তরুণ শরীর। রাতে একজন তার বিছানায়, অন্যজন বইয়ের অক্ষরে। দুই শরীরের মাঝখানে ড্যাশের মতো তমাল-স্মৃতি।
মেয়েটা শুনেছে প্রৌঢ় নিয়মিত বাসে যাতায়াত করে। নিশ্চিত তার কাছেও প্রচুর টিকিট এতদিনে জমেছে। সেদিন হঠাৎ হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজ এল: কাল আমার মায়ের মৃত্যুদিন, তুমি কি বিকেলে কিছুটা সময় আমাকে দিতে পারো? এমন উটকো বহু আবদার এ-যাবৎ পুরুষেরা তাকে করেছে, করে থাকে। মনে-মনে সে হাসে। দুজনের সংযোগ খুবই সামান্য। লোকটার মায়ের নাম আর পদবির আদ্যক্ষরের সঙ্গে মেয়েটার নাম আর পদবির আদ্যক্ষর হুবহু কীভাবে যেন মিলে গেছে। এমন সাধারণ মিলের মধ্যে অলৌকিক কিছু তো নেই? তবু বুড়ো লোকটার এমন আবদারে সে বুড়ো আঙুলের একটা ইমোজি পাঠায়। সত্যি বলতে আর যারা মেয়েটাকে কফিশপে নিয়ে যেতে চায়, তাদের চোখের ধূর্ততার সঙ্গে এই বুড়োটার দৃষ্টি মেলে না। কেমন ক্যাবলা কিশোর। আবার ইদিপাস কমপ্লেক্স এমনটা ভেবে নিলে সমস্যা খামোকা জটিল হয়ে যায়। মেয়েটা দেখা করেছিল; একা নয় সঙ্গে তার বড়দি, যাকে সে ‘দি’ বলে ডাকে। দি-র সঙ্গে লোকটাকে ভিড়িয়ে দিয়ে সে কবিতাপাঠের আসরে চলে যায়। বুড়োটা আহত হয়েছিল এবং নিশ্চিত করেছিল জটিল এক সম্পর্কের মধ্যে সে যেতে চাইছে, যেখানে অক্ষর মানে দ্বিমত, শব্দ মানে ব্যবধান।
দি-র মধ্যস্থতায় ফের আনব্লক হয়েছিল মেয়েটা। পুনরায় ঘনিষ্ঠতা, দূর থেকে কাছাকাছি আসা। বই পাওয়া, পুরনো বই। যেখানে লালচে খসে পড়া পাতাগুলোয় ঘ্রাণ আছে। দুপুরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সেই গন্ধ শোঁকা, আড়চোখে বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে মৃদু সুখ। সে কি তবে সুগারড্যাডির প্রেমে পড়ল? পঞ্চাশ থেকে ষাটের কোঠায় স্বচ্ছল পুরুষদের মধ্যে সে কাকে খোঁজে? তাদের টান কেন সে অস্বীকার করতে পারে না? বুড়োটে লোকেরা তাকে কেন এমন টানে? আর সেই বা কেন তাদের কাছে সুখ চায়। সঙ্গসুখ। পুরনো পদাবলির মতো। তার স্যারের সঙ্গে নিবিড় সখ্য বাড়িতে ধরেই নিয়েছিল তার বিয়েতে অমত, বাচ্চা না-নেওয়ার কারণ।
মেঘলা দিনে সময়ের ঝামেলা কিছু কম নয়। বেলা পড়ে এলেও নজর পড়ে না সেভাবে। তার ওপর মাঝে-মাঝে ঝির-ঝির বৃষ্টি। তার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজতে কিংবা শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে খোলা মাঠে দুদ্দাড় দৌড়াতে। কিন্তু সেই ছাদ কোথায়? কোথায় তার বালিকা বয়সের পাড়ার খেলার মাঠখানা? কানামাছির মতো মেয়েটা এ-ঘর, সে-ঘর, ব্যালকনি, বাথরুমে ধাক্কা খেয়ে-খেয়ে ফিরে আসে। কবিবন্ধুর ফের ফোন আসে। তার আশ্লেষ স্পষ্ট কানে ভাসে, নিবিড়তার আস্বাদ জেগে ওঠে। এতক্ষণে সূর্য পশ্চিমপাড়ে পৌঁছে যাওয়ার আগে একটু রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার লাল চূর্ণ আলো এসে পড়ছে মেয়েটার মুখে, সে কি একটু লাল হয়ে উঠছে ফোনের ও-প্রান্তের কোনও প্রগলভতায়? লক্ষ্মীনারায়ণের ছানার গন্ধ, আর চিত্তরঞ্জন এভেন্যুর পোড়া পেট্রোল গন্ধকে ঢেকে দিচ্ছে কাটলেট-ফিসফ্রাই গন্ধ। ব্যালকনি থেকে দেখে সোনাগাছির মেয়েরা একে-একে সেজেগুজে রাস্তায় এসে দাঁড়াচ্ছে। সারাদিনের ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি থেমে চারপাশ আলো হয়ে উঠছে। বাস ছুটছে, উবের, হলুদ কিংবা নো রিফুউজ়াল ট্যাক্সি। দামি, মাঝারি গাড়ির অনবরত ছোটাছুটি। ট্র্যাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে যাওয়া রুদ্ধশ্বাস জ়োম্যাটো-বয়ের মোটরবাইক। ফেরিওলা। হুল্লোড়। হুল্লোড়।
টিং-টং।
মেয়েটা নিশ্চিত প্রত্যাশায় ছিল আজ এমন বেলের আওয়াজে। যদিও এমন উটকো কেউ নেই তার জীবনে আগাম না-জানিয়ে বেল বাজাবে। তবু সে বুঝি তদ্গত ছিল এমন উদ্দাম বিকেলে কলিংবেলের আওয়াজের।
দরজা খুলতেই সামনে সেই প্রৌঢ়— যথেষ্ট বয়স হলেও বয়স যাকে ছুঁতে পারেনি এখনও সেভাবে। মেয়েটার চোখের পলক অজান্তেই থেমে যায়। ঠোঁট দুটো ফাঁক করে কিছু বলার, কীইবা বলার, ধ্যুৎ সব ঘেঁটে গেল।
লোকটা ভিজে কাক, বোধহয় এই শহরে কোথাও তার কোনও কার্নিশ জোটেনি। হাতটা বাড়িয়ে দেয় ইদিপাস কমপ্লেক্স। দু-টুকরো হয়ে যাওয়া ভিজে চুপচুপে একটা বাসের টিকিট, যেটা বাস থেকে নেমে ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল।
যন্ত্র কি নিজে থেকে কিছু ভাবতে পারে? নাকি অ্যালগরিদম্ তার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, পরিচালনা করে? মেয়েটা ডান হাত বাড়ায়। কাকভেজা লোকটা ছেঁড়া টুকরো দুটো হাতে ধরিয়ে মুহূর্তে পেছন ঘোরে। ছপছপে শরীর সটান সিঁড়িতে জলছাপ রেখে নিচে নেমে যেতে থাকে।
মেয়েটা মিত্র কাফের কাটলেট খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে ভুলে যায়।
*‘মোক্ষ’ ওডিশি নাচের বিশেষ এক শৈলী।

