মৃত পাখিদের গান — ১৪শ পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 

পর্ব — দুই

এক

কতদিন এমনি কেটে গিয়েছে, সূর্য ওঠা সূর্য ডোবা দেখেনি সাধুচরণ। মাতৃ-জঠরের এক নিকষ অন্ধকারের ভিতরে সে যেন বসবাস করে আজকাল। শরীর তার ঢের খারাপ, ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে সে, কেন কে জানে! রান্না খাওয়া কোনও কিছুই যেন তার ভালো লাগে না। অথচ এই কয়েকদিন আগে সে কতই না খলবলে ছিল। গঙ্গার অঢেল হাওয়ার ভিতরে সে বিকেলে বসে থাকত, দেখতে পেত লঞ্চের কেমন নিবিড় আসা যাওয়া। এখন আর সে বাইরে বের হতে পারে না। শরীরে যেন বল নেই। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছা করে না তার। চোখের সামনে শুধু ভাসতে থাকে বিদীর্ণ উদর, চোখ উপড়ানো, কানকাটা লড়বড়ির দেহটা। সেই দৃশ্যটাই তার মাথার ভিতর বনবন করে ঘুরে বেড়ায়, সে মাথা তুলে বসতে পারে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে একটা ঘড়ির শব্দ শোনে। শুনতে পায়। সাধুচরণ বুঝতে পারে এ তার জিয়ন মরণের ঘড়ি। তার বাপ তাকে বলেছিল একবার, ‘মানুষের মরণ ঘনিয়ে এলে টিক টিক করে ঘড়ি ডাকে।’ সাধুচরণ বুঝতে পারছে ঘড়ি তাকে ডেকে ডেকে সারা হচ্ছে। বুঝতে পারছে ঘড়ির শব্দটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ। ক্রমশ এগিয়ে এসে এসে তাকে গিলে নিতে চাইছে যেন জঠরের এক প্রগাঢ় অন্ধকার।

কিন্তু তার এই নিদারুণ অসময়ে বদু তার কাছে এসে জুটে গিয়েছে। বদুর ঘর কোথায়, কোথা থেকে সে এল, সাধুচরণ সে সব জানে না। সে বুঝতে পারছে বদু তার এখানেই জুটে গিয়েছে। সে আর যাবে না। সে দেখতে পায় এই বাড়িটার প্রতি বদুর দারুণ মায়া। সারাদিন বদু এই বাড়িটার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ঠুকঠাক শব্দ পায় সে, অথচ কোথাকার শব্দ সে ঠিক বুঝতে পারে না। আজকাল নিজের রান্নাটাও সে করতে পারে না। বদু কোনও দিন ভাত ডাল বানিয়ে নেয়, কোনও দিন বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে, রুটি ঘুগনি, আলুর তরকারি। খাবারেও তার তেমন রুচি নেই, মুখের ভিতরে খাবার নিলে কেমন হেঁয়ালির মতো মনে হয়।

মাঝ রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায় তার, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। সে বুঝতে পারে না, এখানে কোথায় গাড়ির শব্দ? তার বাড়ির সামনের রাস্তায় তো তেমন গাড়ির চল নেই। সে কি ভুল শোনে? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। না আজকাল সে কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না। কোনটা সে শুনছে বা দেখছে কিংবা কোনটা তার মনের ভুল সে তফাত করতে পারে না। যেন নিজের চোখ কানের উপরে তার আর কোনও আস্থা নেই! সে কি অন্ধ হয়ে যাবে একদিন? কিংবা বধির?

সন্ধ্যার পরে আজ বদু মুরগির ছাঁট দিয়ে একটা তরকারি বানিয়ে এনেছে। সেই সঙ্গে তারিণীর দোকানের গরম রুটি। কী এক দারুণ সুবাস দিচ্ছে মাংসের। ডিসে ঠান্ডা করার জন্য মেলে দেওয়া ছাঁটের মাংস আর রুটির দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে, ‘আহা কি সুবাস’। পরক্ষণেই সে ভাবছে সত্যি কী এমন সুবাস? নাকি এ তার মনের ভিতরে এক হেঁয়ালি উইপোকার মতো তার চিন্তাভাবনাকে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে।

সাধুচরণকে এমন ডিসের মাংসের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বদু বলে,

কি সাধুদা খাবে না? বসে আছ কেন?

সাধুচরণের যেন চটকা ভাঙে। মুখ তুলে বলে,

বদু, মাংসটা খুব ভালো গন্ধ দিচ্ছে, তাই না রে?

বদু যেন কেমনভাবে হাসে, অন্ধকারের ভিতর মস্করার মতো হি হি, কী শীতল আর শান্ত হাসি, যেন হাসির ভিতর কুচি কুচি চুলের কণা উড়ে বেড়ায়। সে চুলের কণা গায়ে লাগে কি? সাধুচরণের গাটা শিরশির করে ওঠে, সে আর কিছু বলে না। তার চোখের আলো যেন ক্রমশ কমে গিয়েছে, স্বল্প ওয়াটের আলোয় সে দেখতে পায় চার পাশে কুচি কুচি চুলের কণা উড়ে বেড়ায়। সাধুচরণ এক টুকরো রুটিতে মাংসের দলা মাখিয়ে নিয়ে মুখের মধ্যে ঠুসে দেয়। তারপরে ক্রমশ চিবাতে চিবাতে সে বদুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। বদুকে যেন অন্ধকার ছায়ার মতো মনে হয়। বদুর মতো যেন এক কালো ছায়ার পর্দা তার সামনে দুলে দুলে রুটি চিবিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু সাধুচরণ কোনও স্বাদ পাচ্ছে না। না মাংসের, না রুটির। তবু যেন কিসের এক ব্যস্ততায় সে রুটি চিবিয়ে যায়। হঠাৎ তার কি মনে পড়ে যায় যেন, সে বলে,

বদু, কাল যেন এক মেয়েমানুষের কান্নার শব্দ শুনলুম। তুই শুনিচিস?

বদু আবার তেমন করে হাসে। শান্ত হিম।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে সাধুদা। তোমার তো মেয়েমানুষের রোগ ছিল না!

তার পরে সে আবার হিল হিল করে সাপের জিভের মতো দুলে দুলে হাসে।

সাধুচরণ আবার টিক টিক ঘড়ির শব্দ শুনতে পায়।

কিন্তু সে সেই শব্দ শুনেও যেন শুনতে চাইছে না। সে বদুকে জিজ্ঞাসা করে,

এই রাস্তায় কি রাতবিরেতে গাড়ি আসতে দেখেছিস বদু?

বদু এ কথারও উত্তর দেয় না। সে শুধু বলে,

খাও খাও সাধুদা। আরাম করে খাও। আজ মাংসটা কিন্তু হেব্বি হয়েছে।

বদুর কথা শুনে তার মনের ভিতর থেকে আচমকা সব উদ্বেগ উড়ে যায়। জিভের মধ্যে সে যেন স্বাদু মাংসের আরাম টের পায়। তার খেতে ভালো লাগছে যেন। সে বদুর ভালো বলার ভিতর দিয়ে নিজের জিভের ডগায় মাংসের স্বাদের সুস্বাদ যাচাই করতে পেরে নিশ্চিন্ত হয়।

সে খেয়াল করে না সামনে একটা অন্ধকার ছায়া যেন দুলে দুলে উঠছে। সাপের ফণার আস্কারার মতো।

 

দুই

ডাঃ দিবাকর সোম পড়ার টেবিলে ঝুঁকে এক মনে কাগজপত্রগুলো দেখছেন। উল্টোদিকের চেয়ারে প্রবাল বসে এক মনে সে দিকেই তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার পরেই প্রবাল চলে এসেছিল সোম সাহেবের কাছে। তার পরে দুজনে কেসটা নিয়ে গভীর আলোচনা করেছে। সোমসাহেব আগেই একটা প্রোফাইল বানিয়েছিলেন। পরে প্রবালের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে কিছু পরিবর্তন করছেন।

বাইরে ডোরবেল বাজল। গোপাল দরজা খুলে দিতে তন্ময় সামন্ত হাসিমুখে ঘরে ঢুকল। প্রবাল বলল,

সামন্তবাবু কিছু নতুন খবর আছে নাকি?

সামন্ত একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল,

খুব কাজের হবে কি না জানি না তবে কিছু খবর পেয়েছি স্যার।

তা শোনান আমাদের।

সামন্ত টেবিলে রাখা একটা জলের বোতল থেকে ঢক ঢক করে কয়েক ঢোক জল খেয়ে নিয়ে শুরু করল,

অরুণ করের বাড়িতে যে মেয়েটি মরে গিয়েছিল, আমরা তার খোঁজ পেয়েছি। মেয়েটিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা গ্রাম থেকে সিনেমায় নামাবার লোভ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। গরীবের মেয়ে। স্কুলে পড়ছিল তবে পড়াশুনায় তেমন মন ছিল না। কলকাতার মানিকতলার কাছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে অরুণ করের সঙ্গে তার আলাপ হয়। বলা ভালো অরুণ করই তাকে সিনেমায় নামাবার লোভ দেখিয়ে ফাঁসায়। তাকে ফুঁসলে নিয়ে এসে প্রথমে তাকে টালিগঞ্জের কাছে একটা বাড়িতে রেখেছিল। সেটা যার বাড়ি সেই মন্টু সর্দার ছিল রাহুল বৈদ্যর সাগরেদ।

সামন্ত থামল।

প্রবাল বলল,

তার মানে অরুণ করের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে রাহুল বৈদ্যর একটা যোগাযোগ ছিল।

হ্যাঁ, স্যার।

তার মানে এই সমস্ত ঘটনাই কোনও না কোনওভাবে একটা সুতো দিয়ে জড়ানো। এখন আমাদের এই সব সুতোগুলোর জট ছাড়াতে হবে।

ঠিক স্যার।

ওই মেয়েটির বাড়ির লোকজন, আত্মীয়স্বজন ইত্যাদির খোজ নিয়েছেন?

হ্যাঁ, স্যার। তবে মনে হয় না তাদের মধ্যে থেকে কেউ এইসব ভয়ঙ্কর মার্ডারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। কারণ এই খুনগুলোর পিছনে যেমন পাকা মাথা কাজ করেছে, তেমন এই সবের পিছনে ভালোই টাকা খরচ যেমন করতে হয়েছে, তেমন একান্ত অনুগত কিছু মানুষের সহযোগিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। একার পক্ষে কি এইভাবে কিডন্যাপ আর মার্ডার করা সম্ভব?

ঠিক তাই।

প্রবাল তার কথায় সায় দেয়। সে আবার বলে,

আমার মনে হয় খুনি একজনই, কিন্তু তার সাগরেদ আছে। এখন কথা হচ্ছে সাগরেদরা নিশ্চয়ই টাকার বিনিময়েই তাকে সাহায্য করছে।

সামন্ত ঘাড় নাড়ল।

ডাঃ সোম বোধহয় এই সব আলোচনা শুনছিলেন না। তিনি এক মনে টেবিলের উপরে ঝুঁকে তাঁর প্রোফাইলিং-এর কাজ করছিলেন।

প্রবাল বলল,

ওই “আবাদ” না কি নাম যেন এনজিওটার, সেটার বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন?

সামন্ত তার হাতের ফাইলটা খুলতে খুলতে বলল।

হ্যাঁ, স্যার। ওটার নাম আবাদ। খুব বড় কিছু না। স্মল স্কেলে কাজ করে। ওটার কর্ণধার হচ্ছেন প্রবাহিনী দেবী নামের এক বৃদ্ধা মহিলা। উনি আবার আমাদের সিপি সাহেবের কোনও এক সম্পর্কের পিসি হন। তবে এখন সব কাজকর্ম দেখাশুনা করে ওঁর নাতনি রুচিরাদেবী।

কথাটা বলেই সামন্তবাবু খুক খুক করে হেসে উঠলেন।

প্রবাল অবাক। সে জিজ্ঞাসা করল,

কী ব্যাপার সামন্তবাবু?

স্যার, আপনার বন্ধু মানে আমাদের সাহেবের সঙ্গে ওই রুচিরাদেবীর তো এখন খুব ভালো সম্পর্ক।

কথাটা বলে সে আবার হেসে ফেলল।

প্রবালও হাসে।

বটে! ব্যাটা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে নাকি? ব্যাটাকে ধরতে হচ্ছে তো!

সামন্ত হাসি না থামিয়েই বলল,

স্যার, আমি বলেছি বলে কিন্তু বলবেন না। তা হলে আমার চাকরি যাবে।

ধুর তা কেন? ঠিক আছে, আপনার কথা বলব না।

ওদিকে ডাঃ সোম তার প্রোফাইলিং শেষ করে ফেলেছিলেন। তিনি বোধহয় তাদের হাসিটা শুনতে পেয়েছিলেন। বললেন,

কীসের হাসি এত?

তিনি একটা কাগজ প্রবালের হাতে ধরিয়ে দিলেন।

প্রোফাইলটার তিনি একটা নাম দিয়েছেন বাংলায়— ‘মৃত্যু-দূত’।

“মানুষটি পুরুষ, শক্তপোক্ত আর শক্তিশালী চেহারা। লম্বায় কম করেও ছ-ফুটের কাছাকাছি হবে। মানুষটার বয়স (আমার মনে হয়) পঁয়ত্রিশের ওপরে নয়। চেহারায় একটা আভিজাত্য আছে এমনটাই আশা করা যায়। মানুষটা শৌখিন। পরিচ্ছন্ন আর রুচিসম্মত পোশাক-আশক পরে। নিজস্ব গাড়িতে ঘোরাফেরা করাই তার অভ্যাস। এবং গাড়িটা মনে হয় এসইউভি  টাইপের। লোকটি শিক্ষিত, তার রুচিবোধ আছে। সে চাকরি করে না। ব্যবসা করে বলেই মনে হয়। তার অর্থের কোনও অভাব নেই। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ সে রোজগার করে। ব্যবসার কারণেই তার সঙ্গে অপরাধজগতের মানুষজনের পরিচয় থাকতে পারে। (থাকতে পারে কেন?) নিশ্চিতভাবে তার সঙ্গে এক বিশেষ শ্রেণির অপরাধীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। অপরাধী বলতে এখানে যারা কালো ধান্দা করে। এবং কালো ধান্দার বিষয়টা সহজ নয় বরং গুরুতর। লোকটি নিজে বোধহয় সরাসরি ওই সব কালো ধান্দা করে না। কিন্তু কালো ধান্দার সহযোগীদের সাহায্যে তার ব্যবসা চলে। লোকটা অভিনয় জানে। জানে বলতে খুব ভালো জানে। এবং যদি সে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত হয় তা হলে আমি অবাক হব না। (আমার মোটামুটি নিশ্চিত ধারণা) মানুষটি সিনেমা কিংবা নাটকের (?) জগতের সঙ্গে যুক্ত।

লোকটি সেক্স ম্যানিয়াক নাও হতে পারে। কিন্তু সেক্সুয়াল ডিস-অর্ডার আছে বলে আমি নিশ্চিত। মহিলাদের মৃতদেহগুলি নিয়ে সে কী করেছে? সেটা আমাদের অজানা। কিন্তু একটা যে মহিলার লাশ পাওয়া গিয়েছে সেটা থেকে ব্রুটালিটির ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। পুরুষদের সে যেভাবে খুন করেছে তাতেও ব্রুটালিটি বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু লোকটি খুনগুলিকে শুধু তার রক্তের প্রতি উত্তেজনা কিংবা সেক্সুয়াল ব্রুটালিটি চরিতার্থ করার জন্য করছে না। সে খুনগুলিকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। সে খুনের শিল্পী। তা ছাড়া খুনগুলির পিছনে তার একটা প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করছে। সেই সঙ্গে একটা আদর্শবাদী চিন্তাধারা। সে খুন করছে না, সে ভাবছে সে অপরাধীদের বিচার করে মৃত্যুণ্ড দিচ্ছে। আমার মনে হয়, এই প্রতিশোধের পিছনে কোনও নারীর প্রতি ভালোবাসা বা অসীম স্নেহ কাজ করছে। লোকটির কোনও প্রিয় নারীর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও গর্হিত ক্রাইম ঘটেছিল। আর যারা যারা খুন হচ্ছে তারা সেই ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত ছিল কিংবা যে বা যারা জড়িত ছিল তারা ছিল তাদের নিকটজন। অর্থাৎ প্রতিটা ভিকটিমের ইতিহাস আমাদের ভালো করে অনুসন্ধান করতে হবে।

অপরাধীর কর্মস্থল বা বলা ভালো বিচরণক্ষেত্র টালিগঞ্জ এবং কালীঘাটের নিকটবর্তী হওয়া বাঞ্ছনীয় কিংবা এই দুই এলাকার কোনও একটিতেও হতে পারে। তবে আমার ধারণা সেটা টালিগঞ্জ হওয়াটাই বেশি স্বাভাবিক। তার স্বভাব বা আচরণের সঙ্গে টালিগঞ্জের সম্ভাবনা খাপ খায় ভালো। তবে তার নিজস্ব একটা বধ্যভূমি আছে। প্রতিটা নারীকে সে সেখানেই হত্যা করেছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় তার সেই বধ্যভূমি গঙ্গার পারে কোনও একটা খেয়াঘাটের কাছে অবস্থিত। কারণ হত্যা করার পরে দেহগুলিকে গঙ্গার জলে সে সহজেই ডিসপোজ করে দিতে পেরেছে বলেই অনুমান। কিন্তু একটি মৃতদেহ ডিসপোজ করার কাজে সে সাবধানী হল না। তার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে সেটা অনুমানের বিষয় এবং তদন্তসাপেক্ষ

প্রবাল সমস্তটা খুঁটিয়ে পড়ে। তারপরে সে সেটা তন্ময় সামন্তর হাতে দিয়ে বলে,

সামন্তবাবু এবার খোঁজা শুরু করুন।

ডাঃ সোম বললেন,

হ্যাঁ। এবং সেটা দ্রুত করতে হবে। কারণ খুনির হত্যালীলা এখনো শেষ হয়নি বলেই আমার ধারণা।

সামন্ত বলল,

কেন স্যার?

পাসোয়ানের খুনটা হওয়া এর প্রধান কারণ। পাসোয়ানকে খুন করে সে তোমাদের সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

প্রবাল সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। খুনি এবার দ্রুত আঘাত হানবে।

তার পরে সে সোমসাহেবের দিকে ঘুরে বলল,

বিশাখা দত্তর ঘর থেকে একটা ছবির অ্যালবাম পেয়েছি। তাতে দেখলাম বিশাখার নিজের ছবি আছে, পরিবারের ছবি আছে। বন্ধুবান্ধবদেরও ছবি আছে। কিন্তু রাহুল বৈদ্যর ছবি নেই একটাও।

সামন্ত বলল,

ঠিক ধরেছেন স্যার, আমরা খবর নিয়ে দেখেছি, রাহুল বৈদ্যর সঙ্গে বিশাখার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি লেগে থাকত। এমনকি স্টুডিওতে প্রকাশ্যে ঝগড়াও হতে দেখেছে কয়েকজন।

ডাঃ সোম বললেন,

প্রবাল, রাহুল আর বিশাখার ফোনের কল লিস্ট দেখেছ?

দেখেছি। সেখানেই খটকা। দু-তিনজন কমন বন্ধু আছে দুজনেরই। তাদের সঙ্গে দু-জনেই কথা বলেছে রেগুলার। এক ডিরেকটরের সঙ্গে তো খুব কথা হয়েছে বিশাখার। এমনকি যে দিন সে নিখোঁজ হয়েছে সেদিনও সকালে কথা হয়েছে।

সামন্ত বলল,

স্যার, ওই ডিরেকটরের সঙ্গে বিশাখার ইদানিং একটু বেশি মাখামাখি চলছিল। আর সেই নিয়েই রাহুলের সঙ্গে তার অশান্তি চলছিল বলে সন্দেহ।

একটু থেমে সে আবার বলল,

আমাদের এই খুনের মামলাটাকে কি প্রেমের অ্যাঙ্গেল দিয়ে দেখা যাবে?

প্রবাল ঘাড় নাড়ল। বলল,

না, অন্য ব্যাপার আছে।

ডাঃ সোম তার কথায় সায় দিলেন।

সামন্ত ঘড়ি দেখল। বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। সে উঠি উঠি করছিল তখনই তার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সে ফোনটা রিসিভ করে নিয়ে বাইরে চলে গেল। মিনিট খানেক পরেই সে ফিরে এল। তার চোখ দুটো উত্তেজনায় চক চক করছে। সে বলল,

স্যার, হ্যামিলটনের ট্রেস পাওয়া গেছে।

কথাটা শুনে প্রবাল উত্তেজিত হয়ে উঠল,

কোথায়?

টালিগঞ্জের এক ডিরেকটরের কাছে হ্যামিলটন নামে একজন আসে।

একজন? মানে?

চেহারার সঙ্গে মিল আছে স্যার।

কী করে সে?

কিছু না, টাউট। তবে স্যার আর একটা খবর আছে।

কী?

রুবি পাল আজ সন্ধ্যার সময় হ্যামিলটনের সঙ্গে ছিল। দু জনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলেছে মিনিট পাঁচেক।

প্রবাল তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বলল,

সামন্তবাবু কুইক। এখুনি রুবির বাড়িতে লোক পাঠান। তাকে এখুনি অ্যারেস্ট করুন।

সামন্ত প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। সেটা সামলে উঠে সে দৌড়ল দরজার দিকে।

 

এরপর আগামী সংখ্যায়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...