দ্য মার্টার’স কর্নার

গল্প: ফ্য মার্টার'স কর্নার

আর কে নারায়ণ

 

তর্জমা: ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি

 

ঠিক যেখানে মার্কেট রোড ভাঙছে গলির ভেতরকার ওষুধের দোকানটার দিকে, সেখানে ছিল তার দোকান। যদিও ‘দোকান’ শব্দটাতে কারও আপত্তি থাকতেই পারে, কারণ তার ব্যবসার পুরোটাই ছিল হাওয়াই মিঠাই-এর মত। সন্ধ্যে আটটা অব্দি তাকে দেখা যেত না, আবার দশটার পরেও না। আটটার পর হাজির হয়ে দশটার মধ্যেই ব্যবসার পাট চুকিয়ে  সে চলে যেত।

লোকজন বলাবলি করত, “ব্যাটা ভাগ্যবান। দিনে একঘন্টা খাটে কি খাটে না, না হক দশটাকা পকেটে ঢোকায়– কটা গ্র‍্যাজুয়েট পারে মাসে তিনশ টাকা রোজগার করতে!” এরকম আলটপকা মন্তব্য কানে এলে সে বিরক্ত হয়ে বলত “লোকে তো আর দেখতে পায় না যে প্রায় সারাদিনই আমাকে উনুনের সামনে বসে থাকতে হয়। এত ভাজাভুজি কি মুখের কথা!”

পাশের বাড়ির মোরগটার ডাক শুনেই সে রোজ ঘুম থেকে উঠতো। সে ব্যাটার আবার রোগ ছিল মাঝে মাঝে ভোর তিনটেতে উঠে চেঁচানো। ঘুম ভেঙে রামার মনে হত, মোরগটা কি ঘুমোতে ভুলে গেলো! কিন্তু এই ডাক উপেক্ষা করে শুয়ে থাকাও সম্ভব নয়। অতএব চারটেই বাজুক বা তিনটে, সে উঠে পড়ে কাজে লাগতো।

সন্ধ্যে সোয়া আটটা নাগাদ সে লটবহর নিয়ে তার কাজের জায়গায় পৌঁছত। এত মালপত্র বয়ে আনত যে মনে হত তার হাত বুঝি দুটো নয় চারটে। মাথার ওপরে দুটো বড়বড় রেকাব, তার ওপর থরে থরে সাজানো হরেক খাদ্যবস্তু, বগলে নিজের বসার জন্য একটা টুল, একহাতে একটা বাতি, অন্যহাতে ট্রে বসানোর জন্য একজোড়া তেপায়া। রোজ ছ পয়সার কেরোসিন খেলেও বাতিটা সে রোজই জ্বালিয়ে হাতের কাছে রাখত , একগাদা খুচরো পয়সা ও অন্যান্য টুকিটাকি সামলাতে হত বলে রাস্তার বিজলিবাতির ওপর  পুরো ভরসা করতে পারত না।

মালপত্র নামিয়ে আলো জ্বেলে সে যখন পরিপাটি হয়ে বসত, তখন অগ্নিমান্দ্যে ভোগা লোকও পাশ দিয়ে পেরোবার সময় একবার না তাকিয়ে পারত না। স্তুপাকৃতি ফুলোফুলো বড়া- মাপে যতই বড় হোক মুখে দিলেই গলে যায়; স্তরেস্তরে সাজানো মসলিনের মত সাদা নিটোলগোল দোসাই; কড়ে আঙুলের ডগায় পঞ্চাশটা তোলা যাবে এমনি পাতলা চাপাটি; চুড়করে রাখা হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি গোলার মত সেদ্ধ করা হাঁসের ডিম; আর পাশে স্টোভের ওপর একটানা ফুটতে থাকা কফি। একটা আলাদা অ্যালুমিনিয়াম-এর পাত্রে চাটনিটা প্রায় সব খাবারের সাথেই ফ্রি দেওয়া হত।

রোজ সে ঘড়ি ধরে এসে পৌঁছত যাতে ইভনিং শো ভাঙা ভিড়টাকে ধরা যায়। তার রাজ্যপাটের এক অযোগ্য দাবিদার, রোগামত এক ছোকরা, রামা এসে পৌঁছনোর আগে ওই জায়গাতেই বসে ব্যবসা করত, কিন্তু আমাদের বন্ধু রামা তাই নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাত না। বরং দরিয়াদিল হয়ে বলত, “আমার আসার আগে বেচারা দু পয়সার ব্যবসা করে তো করুক না।” এই প্রতিদ্বন্দ্বীটি রামার এই উদারতার প্রতি সম্মানবশত রাজামশাই পৌঁছবার ঠিক একমিনিট আগে ময়দান ছেড়ে দিত।

খদ্দেররা তাকে পছন্দ করত। প্রশংসা করে বলত “কোথায় আর পাওয়া যাবে ছ পয়সায় কফি আর এক আনায় চারটে চাপাটি?” সাজিয়ে রাখা রেকাবের চারিদিকে ভিড় করে তারা নিজেদের ইচ্ছামত খাবার তুলে নিত। যে কোনও মুহূর্তে অন্তত একডজন হাত খাবারের সম্ভারের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াতো, কারণ রামার নীতি ছিল খদ্দের আগে খাবার হাতে তুলে যাচাই করে তারপর খাবে কিনা সিদ্ধান্ত নেবে।

একই সঙ্গে এতগুলো হাতের হামলা স্বত্তেও কে কী নিচ্ছে তা রামার নজর এড়াতো না। কোনও এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন তাকে বলে দিত ঠিক কোন টাঙাওলা হাত বাড়িয়ে চাপাটি নিলো- ইচ্ছে করলে তার লাইসেন্স নাম্বার অব্দি বলে দিতে পারত রামা। যে ময়লা কাঁপাকাঁপা হাতটা এগিয়ে আসছে সেটা মোড়ের কোন বুটপালিশওলা ছোকরাটার, অথবা ঠিক কোন সময় পাড়ার কুস্তিগিরের থাবা সবচেয়ে নিটোল হাঁসের ডিমটা খুঁজে নিয়ে ঠুকে ঠুকে ভাঙবে রেকাবের কিনারায়, এসব  ছিল তার নখদর্পনে।

ফুটপাত ধরে অবিরল ঘুরঘুর করতে থাকা আলিবাছি লোকজনই ছিল মূলত তার গ্রাহক- যেমন বুটপালিশওলা বাচ্ছাগুলো, যারা সারাদিন ব্যাগে ব্রাশ আর পালিশের কৌটো নিয়ে এদিক ওদিক করতে করতে অনবরত চিক্কুর ছাড়ত- “পালিশ স্যার, পালিশ”। এইসব বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো আধা ভবঘুরে ছেলেগুলোর জন্য রামার মনে একটা নরম জায়গা ছিল। কোনও মোটাসোটা বাবুকে এদের সাথে পয়সা নিয়ে দরাদরি করতে দেখলে তার মনে হত চিৎকার করে বলে, “দিলেনই না হয় বেচারাকে দুটো পয়সা বেশি, এক আনা বেশি পেলে ওর পেটে একটা দোসা আর একটা চাপাটি যাবে। খায় তো আধপেটা,  সারাদিন পেটে গামছা বেঁধে ঘোরে।” এদের ক্ষুধার্ত মুখ, কোটরে বসা চোখ দেখে তার বুকের মধ্যে চিনচিন করত, কষ্ট হত পরনের ছেঁড়া ময়লা পোষাক দেখে, আর যে বিপুল ঔৎসুক্য নিয়ে হাতের ময়লা থলিপত্র নামিয়ে তারা তার দোকানের চারিদিকে ভিড় করে আসত তাই দেখে তার মন বড় খারাপ হত। কিন্তু সেই বা কী করে? দানছত্র তো খুলতে পারে না। তবে তাদের আধগ্লাস কফি সে যতটা সম্ভব বেশি বেশি আধখানা করেই দিত। আর তার সাথে তাদের সুযোগ দিত যতক্ষন খুশি সেই গ্লাসটুকু আঁকড়ে রাখার।

যে অন্ধ ভিখিরিটা হোটেলের সামনে সারাদিন কাঁদুনি গায়, সন্ধেবেলা তার রোজগারের একাংশ দিয়ে পেট ভরাত এখানেই। ঘাসুড়ে মেয়েগুলোও। ওদের তীক্ষ্ণ, চড়া গলার আওয়াজ কানে লাগে বলে রামা ওদের খদ্দের হিসেবে পছন্দ করত না। তবু তারা মাথায় করে বয়ে আনা ঘাসের বোঝাগুলোর গতি করে তারই কাছে হাজির হত। আর আসত লাজুক মুখচোখের,  একটু খুঁড়িয়ে চলাএক মানুষ। ঠোঙা ভর্তি করে এটা-ওটা কিনত প্রতিদিন, তারপর উল্টোদিকের ফুটপাথে গাছের তলায় দাঁড়ানো একটা সম্ভবত বাজারি মেয়ের কাছে চলে যেত।

মহাবিশ্বের এই বিশেষ কোণাটিতে তামাম নারী-পুরুষ বহু বিচিত্র উপায়ে যা রোজগার করত, তা দিনের শেষে রামার তবিলে এসে পৌঁছত। শার্টের তলায় গলা থেকে ঝোলানো একটা ছোট কাপড়ের থলিতে সব টাকাপয়সা রাখত সে, আর সিনেমাহলে নাইট শো শুরু হলেই তবিল সমেত সোজা বাড়িমুখো হত। বাজারের পেছনে দু নম্বর গলিতে তার বাড়ি। বৌ দরজা খুললেই বাড়ির ভেতর সারাক্ষণ ঘুরতে থাকা পোড়া তেলের গন্ধের একটা ঝলক রাতের বাতাসে এসে মিশত। চটপট স্বামীর হাত থেকে লটবহর নামিয়ে বৌ তার শার্টের তলায় হাত গলিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা বের করে আনত। তারপর দুজনে মিলে বিপুল উৎসাহে টাকা গুনতে বসত। ‘ সকালে যে পাঁচটাকা ঢাললাম, সেটা আরও পাঁচ টাকা নিয়ে এসেছে……’এই গুণনের অপার সৌন্দর্যময় রহস্যে তারা বুঁদ হয়ে যেত। কাপড়ের থলেটায় পরের দিনের জন্য পুঁজি সরিয়ে রেখে লাভের টাকাটুকু সাবধানে গুনে তার বৌ তুলে রাখত বহুযুগ আগে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া ছোট একটা কাঠের বাক্সে।

রাতে খাবার খেয়ে গালে দোক্তাপান ঠুসে বাড়ির দাওয়ার ওপর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রামা স্বপ্ন দেখত– কখনও দেখত মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ তাকে তাড়া লাগাচ্ছে, কখনও  বা স্যানিটারি ইন্সপেক্টর এসে বলছে যে সে নাকি শহরে রোগ ছড়িয়ে সবাইকে সাবড়ে দিয়েছে। সৌভাগ্যবশত বাস্তবে তাকে সেরকম ভাবে কেউই ঘাঁটাত না। কখনও সখনও ট্রাফিক পুলিশকে সে খাবারের একটা ঠোঙা ধরিয়ে দিত, কখনও হঠাৎ চোখে পড়া স্বাস্থ্য দপ্তরের কোনও নিচুতলার কর্মীর হাতেও।  হ্যাঁ, হেলথ অফিসার ভিজিটে আসতেন, আর বলতেন, “সব কিছুর ওপর কাঁচের ঢাকনা লাগাও, নইলে কোনদিন এসে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেব, বুঝলে? ” কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানুষটি ছিলেন বড় নরম, তাই ব্যাপারটা নিয়ে আর না এগিয়ে নিজের মনেই ভাবতেন,  “কী করে যে ওই খাবার খেয়ে খদ্দেররা বেঁচে থাকে কি জানি! মনে হয় বিষ খেতে খেতে লোকের মধ্যে একরকমের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। চারিদিকে ধুলো উড়ছে, পেছনে নর্দমা…..” একথা সত্যি যে রামা পরিচ্ছন্নতার যাবতীয় মানদণ্ডকে সাফ অস্বীকার করত, কিন্তু তাও  খদ্দেররা তার খাবার খেয়ে শুধু যে টিকে থাকত তা নয়, তাদের গায়ে গত্তিও বেশ লাগতো। বহু বছর ধরে ওই খাবার খাওয়ার পরেও তাদের মধ্যে খারাপ থাকার কোনও লক্ষন দেখা যায়নি।

রামার জীবনকে মোটের ওপর বেশ সন্তোষজনকই বলা যেতে পারতো–উদ্বেগহীন, ঈর্ষাহীন এক জীবন। এরকমই চলতে পারত চিরদিন, এ গল্প কোনওদিনই না ফুরোতে পারত, অন্তত যতদিন না এ মহাবিশ্ব মরে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে– তার মত সৎ ও খাটিয়ে লোকের সাথে সেরকমই হওয়া উচিৎ ছিল। টাকা সে কামাত, কিন্তু কারও ক্ষতি করে নয়। তার বানানো খাবার খেয়ে কোনওদিন কেউ মারা গেছে এমনও শোনা যায়নি। পৌর প্রশাসনের স্রেফ উদাসীনতার কারণে যত মানুষের ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি অন্তত রামার ব্যবসার কারণে হয়নি।

কিন্তু এরকম নিশ্চয়তা মনুষ্যজীবনে মেলে না। দেবতারা কারও বেশি সুখ সহ্য করতে পারেন না, এবং দুম করে একদিন ভ্রুকুটিকুটিল আনন মেলে ধরেন। এক রাতে যথাসময়ে মোড়ে হাজির হয়ে রামা দেখল তার বসার জায়গাটায় ভিড় জমে আছে, কী নিয়ে যেন উত্তেজিত আলোচনা চলছে। পাত্তা না দিয়ে সে বেশ কর্তৃত্বের সুরেই বলল, “একটু সরে দাঁড়ান বাবুরা”। তার কথা কেউ শুনতে পেল বলে মনে হল না। তবে খাতা-পেনের দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরাটা এইসময় তার জামার হাতায় আলতো টান মেরে বলল, “আরে সন্ধেবেলা থেকেই দুপক্ষের লড়াই লেগে গেছে যে….”।

“কী নিয়ে?”, রামা প্রশ্ন করে।

“হবে কিছু একটা…শুনছিলাম সেলস ট্যাক্স অফিসের কাছে নাকি কে ভোটের কাগজ বিলোতে এসে ছুরি খেয়ে মরেছে। হয়তো অন্য ব্যাপার, ঘরোয়া ঝগড়ার জের, কিন্তু সেসব আর কে উল্টে দেখে? লড়াইয়ের একটা ছুতো পেয়ে গেলেই লড়াই শুরু।”

এমন সময় ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ চীৎকার করে উঠল, “এতবড় সাহস! মুখ সামলে!” সবার খরশান দৃষ্টি লোকটির ওপর নিবদ্ধ হল। কেউ একজন বলতে শুরু করেছিল, “বেশ করেছে বলেছে…”। পাশে দাঁড়ানো লোকটা সপাটে এক থাপ্পড় মেরে তাকে থামিয়ে দিল। রামা অসহায়ভাবে লটবহর ঘাড়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ঐ একটা থাপ্পড়ে যেন একটা অদৃশ্য বোমার পলতেয় আগুন পড়ল। এ ওকে, সে তাকে থাবড়াতে শুরু করল, কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, “অমুক নিপাত যাক”। ভিড়ের একাংশ প্রতিবাদে গর্জে উঠল,”তাহলেই বুঝে দেখুন বন্ধুগণ! আমাদের  নিপীড়ন করতেই এসব ষড়যন্ত্র করে, আটঘাট বেঁধে করা হয়েছে!”

চীৎকার-চেঁচামেচি হতে হতে সোডা বোতল ছোঁড়াছুড়ি চালু হল। কে কাকে মারছে তার আর কোনও হদিশ রইল না। একদল লোক হঠাৎ হুড়মুড় করে দোকানে দোকানে ঢুকে ঝাঁপ ফেলে দিতে বলল। দোকানিরা কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা যারপরনাই অবাক হয়ে প্রতিপ্রশ্ন করল,”দেশের এই অবস্থায় কি করে ব্যবসা করার কথা ভাবতে পারেন আপনারা?”

দেখতে দেখতে সভ্য অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সমস্ত সংযমের নিগড় ভেঙে পড়ল। সবাই যেন সবার ওপর ক্ষেপে উঠল। এক ঘন্টার মধ্যে মোড়ের চেহারা হয়ে দাঁড়াল যুদ্ধক্ষেত্রের মত। একথা ঠিক যে পুলিশ অনতিবিলম্বে এসে পড়েছিল, কিন্তু লড়াইতে তৃতীয় পক্ষ যোগ দেওয়ার ফলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে গেল। পুলিশ আটকে গেল ত্রিবিধ কর্তব্যের প্যাঁচে–আইনশৃঙখলা রক্ষা, নিজেদের চামড়া বাঁচানো এবং সাথে যে দল বেশি মার খাচ্ছে তাদের যথাসম্ভব বাঁচানো। ফাঁকতালে যেসব দোকান তখনো বন্ধ হয়নি সেগুলোর মাল লুঠ হয়ে গেল। এর মাঝে সিনেমার শো-ভাঙা  ভিড় রাস্তায় নেমেই কেমন করে যেন চটপট পক্ষ বেছে নিয়ে লড়াইটা আরও পাকিয়ে তুলল। ছোরাছুরি নিয়ে কারা যেন ছুটে বেড়াচ্ছে, রক্তাক্ত লোকের গোঙানি আর আর্তচীৎকার, অ্যাম্বুলেন্সের ইতস্তত ছোটাছুটি। পুলিশ লাঠি আর টিয়ার গ্যাসেও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে অবশেষে গুলি চালাল। অনেকে মারা পড়ল। লোকে বলে সব মিলিয়ে তিন হাজার হতাহত হয়েছিল, কিন্তু সরকারি হিসেব অনুযায়ী আহত হয়েছিল মোটে পাঁচ জন আর পুলিশ ফায়ারিঙে মারা গিয়েছিল সোয়া চার জন। রামা একটা কালভার্টের তলায় লুকিয়ে পড়ে ছিল, মাঝরাতে সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরল।

পরের দিন রামা তার বৌকে বলল,” আজ অন্যদিনের মত অত মাল নিয়ে যাব না। ভগবান জানে এই ভোটওয়ালাদের মাথায় কী শয়তান চেপেছে! ভোটের জন্য এরা খুনোখুনি অব্দি করতে পারে।” তার অনুমান একদম সঠিক ছিল। মার্কেট রোডে সেদিন সাধারণ মানুষের থেকে পুলিশের সংখ্যা ছিল বেশি। আর মোড়ের মাথায় ঠিক তার বসার জায়গাতে ছিল আরও কড়া পাহারা। একজন পুলিশ অফিসারের নির্দেশে তাকে বেশ খানিকটা দূরে দোকান পাততে হল।

দিনদশেক পরে পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হল। ইতিমধ্যে খবরের কাগজে কাগজে জোরালো দাবি উঠতে শুরু করেছে তদন্ত কমিশন বসানোর, প্রশ্ন উঠছে পুলিশের গুলি চালানোটা আদৌ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল কিনা অথবা পুলিশ এই হঠাৎ-দাঙ্গা রুখতে আগে থেকে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল, ইত্যাদি। খবরের কাগজ বেচা ছোকরাদের চীৎকারের মাধ্যমে সমসাময়িক ইতিহাস পরতে পরতে রামার সামনে নিজেকে মেলে ধরছিল। অবশেষে একদিন সে চেষ্টা করলো নিজের কোনটিতে ফিরে যেতে। কিন্তু রেকাব- কাঁসি সাজিয়ে সে বসেছে কি বসেনি, বুকে ব্যাজ আঁটা দুই ছোকরা এসে বলল, “এখানে তো আমরা আর দোকান লাগাতে দেব না।”

“কেন বাবু?”

“এই হচ্ছে সেই পবিত্র ভূমি যেখানে আমাদের নেতা সেদিন প্রাণ দিয়েছেন। পুলিশ সরাসরি বুকে গুলি চালিয়েছিল, বুঝেছ। আমরা এখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানাবো। এখন এটা আমাদের জায়গা। মিউনিসিপালিটি আমাদের রীতিমত হস্তান্তর করেছে।”

অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা ঘিরে ফেলা হল, সেখানে আজ জমায়েত হয় তো পরের দিন সভা। চাঁদার বাক্সের ঝনঝনানি শোনা যেতে লাগলো সারাক্ষণ। রামা আগে থেকেই জানত রাস্তার এই কোণাটুকু কিভাবে টাকাকে টেনে আনে, এখন বাকিরাও জানতে পারল।  দেখতে দেখতে চাঁদার পয়সায় খাড়া হয়ে গেল একটা স্মৃতিফলক, বসল বাহারি বেড়া, ফুলের চারা বসানো টব– পুরো বদলেই গেলো জায়গাটা। এখন সেখানে গম্ভীর, গেরাম্ভারি মানুষদের আনাগোনা। রামাকে তাই প্রায় দুশো গজ দুরে গিয়ে গলির অনেকটা ভেতরে দোকান পাততে হলো। ফলত তার খদ্দেরদের নজরের বাইরে চলে এল সে, তাদের দৃষ্টিপরিসরের অন্ধবিন্দুতে। সন্ধের শো-ভাঙা ভিড় এখন তার দোকানের বহুদূর দিয়ে বয়ে যায়; টাঙ্গাওয়ালারা আগে মোড়ের ট্রাফিক পুলিশের বদান্যতার সুযোগ নিয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে তার দোকানে চটজলদি কিছু খেয়ে নিতে পারত, এখন গলির ভেতরে ঢোকার অসুবিধে বলে তারা আর আসে না; বুট-পালিশের ছেলেগুলো এখন ফুটপাথের উল্টোদিকে এক দোকানির গাহক হয়েছে, সে আর কেউ নয়, রামার নেহাৎই অযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী সেই রোগামত ছোকরা। তার ব্যবসাভাগ্য ফিরে গিয়েছিল।

রামা আজকাল অল্প করে মাল বানাত, কিন্তু তাও পুরোটা বিক্রি হত না। বাড়িতে ফেরৎ নিয়ে গিয়ে নিজে যতটা পারত খেত, বাকিটা বৌয়ের কথায় পরের দিন গরম করে ফের বেচত। যে এক দুজন সেই বাসি খাবার খেয়েছিল তাদের মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল যে রামার খাবারের আর সেই আগের কোয়ালিটি নেই। অবশেষে একদিন, থলিতে মাত্র দু আনা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর, বাড়ির দাওয়ায় থপ করে বসে পড়ে সে বৌকে বলল,”বুঝলে, আমাদের ব্যবসা এবার লাটে উঠল। আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই।”

রেকাব-বাসন-কোসন আর সেই কেরোসিনের বাতিটা তুলে রেখে অবসর নিল রামা। তারপর জমানো টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে যেতে যেখানে সারাদিন তারস্বরে গান বাজে সেই কোহিনূর রেস্তোরাঁয় কাজের জন্য লাইন দিল। কাজ মিলল–মাসে কুড়ি টাকার বিনিময়ে দিনে আট ঘন্টা বেয়ারার কাজ। অনবরত খদ্দেরদের যাতায়াত, রেডিওর চিৎকারে কান ঝালাপালা, তবুও সে লেগে রইলো – আর কোনও উপায়ও ছিল না। শুধু যখন কোনও খদ্দের খুব হম্বিতম্বি করলে সে বলত, “একটু আস্তে, ভাই। এই আমিই একটা হোটেলের মালিক ছিলাম একসময়।”

মনে হয় এই স্মৃতিটুকু তাকে বড় তৃপ্তি দিত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4821 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...