উই আর দ্য রুইন্স

উই আর দ্য রুইন্স

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

জর্জ সেফেরিস। গ্রিস। আর আমার কাছে হঠাৎ এক পশ্চিম মেদিনীপুরের দুপুর। স্থাপত্য। ধ্বংসচিহ্ন। সেইজন্যই জর্জের কথা। ‘স্ট্যাচুস আর নট দ্য রুইন্স। উই আর দ্য রুইন্স।’ একেকদিন এরকম হয়। কেশপুর, নাড়াজোল, ন্যাড়াদেউল, চন্দ্রকোনা টাউন, ক্ষীরপাই। কন্ডাক্টর টিকিট চান। কোলে দুই বাচ্চা নিয়ে শাখাঁ সিঁদুর আমায় জায়গা দিতে বলেন। আমি সরে আসি। বাসের সামনে কুমার শানু। ইতিহাসের চাকায়, ধোঁয়ায় ডিজে। আমি নেমে যাই পরের স্টপেজে। একাই…

রমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের এস্টেট আমায় উচ্চতার কথা মনে পড়ায়। এক আঙুল দূরত্ব দিয়ে চলে যাওয়া খরিশ জন্মবৃত্তান্ত জানতে চায়। একটা ঠাণ্ডা স্রোত আমার বিলাসখানি তোড়ির ভেতর বিরতি হিসেবে বয়। আমি বহমানতাকে পাশের দিঘির ভেতর চুপ করে থাকতে দেখি। রমাপতিবাবুর সমাধি মন্দির, দুর্গামণ্ডপ, খিলান, মাটিতে লুটনো থাম, দালানের প্রাচীর ঘেঁষা পাশের বাঁধানো ঘাট, দিঘির জল, দ্বিতীয় চন্দ্রকেতুর জহরা, রাজমহিষীদের আত্মঘাতের চিহ্ন– তার সমগ্রতা নিয়েই ‘লালবাবুর পাকা’ আমায় বেঁচে থাকা প্রমাণ দিতে বলে। কথা বলি না। ক্যামেরার শাটারে জনান্তিকে আমার যান্ত্রিক প্রত্যুত্তর। কেন আছি? কেন আজও আছি?

লালবাবুর পাকা (চন্দ্রকোনা)

মল্লেশ্বর শিবমন্দির থেকে একটা এঁদো পুকুর দেখা যায়। ‘সিদ্ধ পুষ্করিণী’। তার আধো-লাল জল, পড়ে জমে থাকা কলাপাতার পচনশীলতা, চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার কথা ধারণ করা এক গোলাকার ক্ষত। ইতিহাস, জল কি তোমার কোনও ব্যথা বোঝে? মল্লেশ্বরে রাত্রি নামে। বারদুয়ারী গড়ের মাকড়া পাথরের বিগ্রহ শান্তি পায়। পাশের নহবতখানায় ধ্বংস সম্পূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়। পথ তৈরি করে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি কখন স্বরূপ নারায়ণ ধর্মের আটচালার দিকে চলে এসেছি। দরজার ওপর লাল টকটকে মালা। ‘পুজো হয়।’ পাশ থেকে বললেন স্থানীয় সুশান্ত দাস নাম্নী এক যুবক। চোখে মায়া, আতিথেয়তা। আমি যুবককে চন্দ্রকেতুর বংশধর ভাবি। সে চোখ নামিয়ে দেয়। হয়? পুজো সত্যিই হয় আজও? এখনও?

চন্দ্রকোনার মল্লেশ্বর শিবমন্দির

স্বরূপ নারায়ণ ধর্মের মন্দির (চন্দ্রকোনা)

সোনার ফসল। আলের ভেতর দিয়ে ভূতের মতো তার গায়ের রঙের খোঁজ। দেউল? পুরনো কোনও রত্নরীতি? নাকি চালা? বুঝতে পারিনি। পোড়ামাটিতে আমি শুধু নৃসিংহ অবতারকে চিনেছি। বুঝেছি, ছাদ ভেঙে গেলেও দরজার পাশের পঙ্খসজ্জা অতিথি চলে যাওয়ার পর হাত নাড়ায় অনেকক্ষণ। স্থাপত্যগাত্রের গাছ বাড়তে বাড়তে খেয়ে নেয় আশ্রয়কে। আলো দেয়, বাতাস দেয়, মৃত্যু দেয়। অনেক দূরে বাঁশের বেড়ার ভেতর দিয়ে প্রতিবন্ধী উন্মাদ অস্ফুটে কিছু বলে। দুপুরের খাঁ খাঁ শূন্যতায় আমি সরে আসি। বাসন মেজে ফেরার পথে যুবতীর সঙ্গে তাড়াহুড়োয় অঙ্গস্পর্শ হয়ে যায়। চাঁদের গায়ে যে চাঁদ লাগার গল্প বলি, তার সঙ্গে এসব ব্যক্তিগত সত্তার সম্পর্ক নেই। একটা সাইকেল রিকশ আমায় স্লো-মোশনে পরিত্যক্ত সেই ঐশ্বর্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। কেন যায়?

চন্দ্রকোনায় এক পরিত্যক্ত মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ

রঘুনাথগড়ের পরিত্যক্ত দালানবাড়িতে নিষিদ্ধ সাট্টার গন্ধ। টাকা নেই, উদ্যোগ নেই, সংরক্ষণ নেই। বরং আগাছা আছে, সরীসৃপ আছে, পাশের অযোধ্যা প্রাথমিক স্কুলে ইতিহাসের এত পাশে অথচ সম্পূর্ণ অগোচরে বাড়তে থাকা শৈশব আছে। একটা গোল পরিত্যক্ত জলাধারে উঁকি মারতে গিয়ে নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখি। রঘুনাথ জিউ-এর কিন্নর কিন্নরীর ইশারা, দালানবাড়ির সিমেট্রির জাদুবাস্তব, গোপীনাথ জিউয়ের উচ্চতা, রাসমঞ্চের পলেস্তারা, কামেশ্বর শিবের মাকড়া পাথরের পঞ্চরত্নের কান্না। কে মোরে ফিরাবে অনাদরে? কে মোরে ডাকিবে কাছে?

চন্দ্রকোনার রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন অংশ

রঘুনাথগড় ঠাকুরবাড়ির রঘুনাথজীউ ও পাশে গোপীনাথজীউ মন্দির

সরকারি রেড টেপ, ইতিহাস, পাঁচশ বছরের সনাতন হিন্দু ধর্ম, পুঁথি এবং জীর্ণতার বোধ। ছোট অস্থল থেকে আমি আয়ু কমিয়ে ফিরে আসি। ইতিহাস দমবন্ধ লাগে। তোরণ, খিলান, প্রবেশপথ, স্থাপত্যের রাধা কৃষ্ণ– মনে হয় একটার পর একটা পাতা খুলে শেষমেশ বইটার শুরুটা ধরতে পারছি না। বাড়ির দরজা খোলা। রান্না। পুরনো অসংখ্য বই। সংস্কৃত। আইন, কাগজ, দলিল দস্তাবেজ– আমার এসব কিছুই না বোঝার ভেতর এসে যাওয়া বুদ্ধচর্চা। ব্যারিটোন কণ্ঠ। ‘আমরা এসেছি দ্বাদশ শতকে’। ইতিহাস তোরণের পর তোরণ পেরোতে পেরোতে এগোয়। সবশেষে আমি ‘চলি’ বলে উঠে পড়তেই, খালি গায়ের মুণ্ডিতমস্তক মোহন্তজির সলিলোকি– ‘চলেই তো যাবেন…’

চন্দ্রকোনার ছোট অস্থলের মন্দির

ছোট অস্থলের মোহন্তজি

কেশপুরের কাছে আনন্দপুরের সরকার বাড়ির ১২৬ বছরের পুরনো পঞ্চরত্নে নতুন রং। রেড অক্সাইডে একটু যেন চকচক করা রাবণবধ, কালীয়দমন, রাসচক্র, দশাবতার। উনিশ শতকের শেষভাগের কিছু পঙ্খসজ্জায় দাগ পড়েনি এতটুকু। মন্দিরের থামের উপর গ্রেকো-রোমান আয়োনিক ঘরানার স্থাপত্যরীতির মিনিয়েচার। ব্রিটিশ যুগ। বাতায়নবর্তিনীর উপরেই বিদেশি পোশাকের অবয়ব। কলিচুনের প্রলেপের সারিবদ্ধ আনুভূমিকতায় যেন অতিথিবৎসলতা। যেন আমি আসব জানত ওরা। কবে, কখন আসব, চলে যাব, আর আসব না, তাও…

আনন্দপুরের সরকার বাড়ির মন্দিরের পঙ্খসজ্জায় বাতায়নবর্তী

আনন্দপুর পেরিয়ে কানাশোলের ঝাড়েশ্বর শিবমন্দিরে কালো পাথরের দুই দ্বাররক্ষীকে দেখেছিলাম। পেছনে কালো রঙের দরজা। ওরা কেউ দরজা খোলেনি। আমি কিন্তু এসেছিলাম। মূল মন্দিরগাত্রে মাকড়সার জালের ভেতর স্থবির এক পোড়ামাটির কুর্মাবতার। শ্যামের জীবনের গল্প।

কানাশোলের ঝাড়েশ্বর মন্দিরের অলঙ্করণ

ঝাড়েশ্বর মন্দিরের টেরাকোটা

আমার শেষটুকু অপূর্ণতায় ঢাকা। কাজের চাপে নাড়াজোল যাওয়া হল না। অস্থলে আরও খানিকটা কথা বাকি ছিল। গুপ্ত গহ্বরে আরও কিছুটা জীবনদর্শন বাকি ছিল। সন্ধের পর কেমন লাগে লালবাবুর পাকা? দেখা হল না। রঘুনাথগড়ের জন্য একটা গোটা দিনও কি যথেষ্ট হত? আনন্দপুরের কালাচাঁদের বাগান থেকে ফিরে আসার রাস্তায় এক দেড়শ বছরের পুরনো ম্যানসন, দোতলায় জাফরি কাটা রেলিঙে ঝোলানো লাল পাড় সাদা শাড়ির দোলায়মানতা, প্রবেশপথ, গড়ের ধ্বংসাবশেষ সেইসব অপূর্ণতাকে নিয়েই একটা লাজবাব উত্তর দিয়ে দেয়।

‘চলেই তো যাবেন …’

আনন্দপুরের এক পুরনো ম্যানসনের প্রবেশদ্বার

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...