অঞ্জুশ্রী দে
ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের বিশ্বজয় কেবল একটি ক্রীড়া ইভেন্টের সাফল্য নয়; এটি অবিচল সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস এবং লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের প্রতীক। এই যোদ্ধারা দেখিয়েছেন যে, কঠোর পরিশ্রম ও জেদ যদি স্বপ্নের সঙ্গে মেশে, তবে জগতের কোনও বাধা সেই লক্ষ্যপূরণ আটকাতে পারে না
২০২৫ সালের ২ নভেম্বর, মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে রচিত হল নতুন ইতিহাস। এক ঐতিহাসিক ফাইনাল ম্যাচে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো আইসিসি ওডিআই বিশ্বকাপ ট্রফি ঘরে তুলল। এই জয় শুধু খেলার মাঠে শ্রেষ্ঠত্ব নয়, বরং ভারতীয় নারীশক্তির অদম্য উত্থানের প্রতীক। যখন দীপ্তি শর্মা শেষ উইকেটটি নিলেন আর হরমনপ্রীত কৌর ট্রফিটা হাতে তুললেন, তখন সেই দৃশ্যগুলো কেবল নৈপুণ্যের মুহূর্ত ছিল না, ছিল সমাজে গেঁথে থাকা ‘কিছু কাজ কেবল ছেলেরাই পারে’ ধারণাকে ভেঙে দেওয়ার এক সার্থক প্রয়াস। ফাইনালের মঞ্চে শেফালি বর্মার বিধ্বংসী ৮৭ রানের ইনিংস অথবা দীপ্তি শর্মার অলরাউন্ড পারফরম্যান্স (৫৮ রান এবং ৫ উইকেট)— এগুলো প্রমাণ করে যে, যেখানে পুরুষ দল ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে নারীরা অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদেরকে বিশ্বমঞ্চে প্রমাণ করেছে। এই বিজয়, যা এসেছে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ার পর, বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে ইচ্ছে থাকলে এবং তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করলে ফল অবশ্যই ইতিবাচক হয়।
প্রকৃত অর্থে, লড়াইয়ের সঙ্গে যদি একবার জেদ মিশে যায়, তবে স্বপ্নপূরণ হতে বাধ্য। এই যোদ্ধারা টাকার জন্য নয়, দেশের সম্মানের জন্য দিনরাত কাটিয়েছেন মাঠে, খোলা আকাশের নিচে রোদ, বৃষ্টি, আর ঠান্ডার মধ্যে। ওঁরা ত্বকের ট্যানিং বা শরীর-স্বাস্থ্যের কথা ভাবেনি, ভেবেছে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সাফল্যের কথা— সেই আনন্দের কথা যা কেউ পয়সা দিয়ে কিনতে পারে না, যা কেউ কাউকে উপহার দিতে পারে না। এটি একেবারে নিজের জন্য তৈরি করা এক ‘বিশেষ উপহার’।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ত্যাগের গল্প
দেশের নারীশক্তির এই উত্থানের পিছনে রয়েছে শুধু খেলোয়াড়দের নয়, তাদের পরিবারেরও বহু নীরব সংগ্রাম। এই সাফল্য এমন কিছু মানুষের ত্যাগের ফল, যাঁরা নিজেদের স্বপ্ন ও আরাম বিসর্জন দিয়েছেন।
অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর পাঞ্জাবের মোগা এলাকা থেকে উঠে এসেছেন। আধা-গ্রামীণ অঞ্চলে মেয়েদের খেলাধূলা করা নিয়ে সামাজিক চাপ এতটাই তীব্র ছিল যে, অনেকে তাঁর বাবা-মাকে চাপ দিতেন এবং বহু আত্মীয়-প্রতিবেশী তাঁদের সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। তাঁর বাবা এই সমস্ত সামাজিক প্রশ্নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছেন। ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক বা আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর খোলাখুলি প্রতিবাদ— এগুলো কেবল খেলার অংশ নয়, সমাজের তৈরি করা নানা বেড়াজাল ভাঙার চেষ্টা। তাছাড়া, সমাজমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নিয়ে তিনি যে টি-শার্টটি পরে আছেন তাতে লেখা— “Cricket is a gentleman’s EVERYONE’S game”। এই জেন্টেলম্যান শব্দটি কেটে দিয়ে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ক্রিকেট এখন আর কেবল নির্দিষ্ট কারও খেলা নয়। উচ্চবিত্ত যেমন পারে খেলতে, তেমনই পারে নিম্নবিত্তের মানুষ। ক্রিকেট পুরুষের মতন নারীদেরও খেলা।
অলরাউন্ডার দীপ্তি শর্মা-র সাফল্যের পিছনে তাঁর দাদা সুমিত শর্মা-র এক বিশাল আত্মত্যাগ রয়েছে। দীপ্তি যখন ক্রিকেটে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারছিলেন না, তখন সুমিত তাঁর কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দেন এবং দুই বছর ধরে দিবারাত্র শুধু দীপ্তির প্রশিক্ষণে নিজেকে নিয়োজিত করেন, যাতে দীপ্তি জাতীয় দলে সুযোগ পায়। সুমিতের এই নিঃস্বার্থ ত্যাগই প্রমাণ করে যে স্বপ্নের লড়াইয়ে পরিবারের বিশ্বাস কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তারকা ব্যাটসম্যান জেমাইমা রড্রিগেজের কথা ভাবুন। মুম্বাইয়ের অতি সাধারণ পরিবার থেকে এসে, স্কুলজীবনে অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেটে কাটানো এবং একসময় ওয়ান ডে ওয়ার্ল্ড কাপ দল থেকে বাদ পড়ার পরও মানসিক চাপ সামলে ফিরে আসা— এই পথটা মোটেই মসৃণ ছিল না। রিচা ঘোষের মতো তরুণ খেলোয়াড়দের ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের পিছনের শক্তিও সেই একই ‘স্ব-নির্মাণ’-এর দর্শনকে তুলে ধরে।
খেলাধূলার ক্ষেত্রে এই জয়গুলি শুধু স্কোরকার্ডে পরিবর্তন আনে না, তা সামাজিক ভাষাতেও পরিবর্তন আনে। এতদিন পুরস্কার বিতরণে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’-এর কথা শোনা যেত। এখন সেই জায়গায় ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’ বা ‘প্লেয়ার অফ দ্য সিরিজ’ কথাগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা লিঙ্গ-নিরপেক্ষতার এক ইতিবাচক বার্তা দেয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে একাকিত্ব ও আত্মনির্ভরশীলতার দর্শন
পৃথিবীর নানা প্রান্তে যারা নতুন দিগন্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে যায়, তাদের জীবন আসলে এক নীরব সংগ্রামের কাব্য— যা কেবল উচ্চাকাঙ্ক্ষার নয়, স্ব-নির্মাণের। যে শিক্ষার্থী বা কর্মী বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে ছোটখাটো ঘরে, বাথরুম শেয়ার করে বা মনের মতো খাবার না পেয়ে লড়াই করছে, তার জন্য ক্রিকেটযোদ্ধারা সেরা অনুপ্রেরণার নজির তৈরি করলেন। বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া সাফল্যের ঔজ্জ্বল্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে দিনের পর দিন ধরে জমানো অদম্য ত্যাগ, ধৈর্য এবং নিঃশব্দ পরিশ্রম।
কথায় আছে, “পরিশ্রম সৌভাগ্যের জন্মদাত্রী।” অর্থাৎ কঠোর পরিশ্রমই সফলতার জন্ম দেয়। আধুনিক জীবনে পরিশ্রমের সংজ্ঞা কেবল কাজের বোঝা টানা নয়, এটি হল লক্ষ্যের প্রতি এক অবিচল একাগ্রতা ও আত্ম-উৎসর্গ।
বস্তুত, উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথ সবসময়ই একাকিত্বের। এই পথে পরিবার বা আপনজনেরা পাশে থাকতে পারে, কিন্তু লড়াইটা একান্তই নিজের একার। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আত্ম-নির্ভরশীল হয়ে ওঠা এবং এই একার লড়াইয়ে টিকে থাকার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে, যা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দর্শন। এই একাকিত্ব কোনও দুর্বলতা নয়, এটি আসলে শক্তির উৎস— যা ধৈর্য, সহনশীলতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা জোগায়।
তবুও সমাজের অন্ধকার চিত্র: এক অদ্ভুত বৈপরীত্য
দেশের নারীশক্তির এই অভাবনীয় উত্থানের উল্টোদিকে একটি কঠিন, অন্ধকার বাস্তবতাও আমাদের দেখতে হয়। এই মেয়েরা যখন দেশকে বিশ্বজয়ী করছে, ঠিক তখনই দেশের নানা প্রান্তে, কখনও কাজের জায়গায়, কখনও বা রাস্তায়— মেয়েরা আজও তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিয়ে লড়ছে। দেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বা কোটি কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা হওয়া সত্ত্বেও নারীরা সাইবারবুলিং, ট্রোলিং এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হন।
এমনকি, যে নারীরা দেশকে সর্বোচ্চ সম্মান এনে দিচ্ছেন (যেমন বক্সার, কুস্তিগিরেরা), তাদেরও যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় এবং ন্যায়বিচারের জন্য রাস্তায় বসে আন্দোলন করতে হয়। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য! একদিকে কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ এখনও ঘটে, অন্যদিকে শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ করা যায়। এই সমস্ত প্রতিকূলতাই আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টাদের লড়াইয়ের আসল পটভূমি।
আত্ম-সৃষ্ট আনন্দ: জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ
এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার নামই সত্যিকারের জয়। মনে রাখতে হবে, যে আত্মমর্যাদা নিজের জীবন দিয়ে অর্জন করতে হয়, তা-ই সবচেয়ে দামি উপহার। এই সংগ্রাম আমাদের শেখায়: সত্যিকারের সাফল্য কখনওই রাতারাতি আসে না। এটি হল বহু বছর ধরে জমানো অদৃশ্য ঘামের ফসল— যা লোকের চোখের আড়ালে নীরবে তৈরি হয়।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল সেই ‘আনন্দ’ বা ‘তৃপ্তি’ যা কোনও আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া যায় না। এটি সেই অনুভূতি, যা মানুষ দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রমের ফলে দেখতে পান। বাইরে থেকে আসা প্রশংসা বা নিন্দা, বাহ্যিক সৌন্দর্য বা চাকচিক্যের ঊর্ধ্বে, এই স্ব-নির্ভরশীল আনন্দই মানুষকে এক সত্যিকারের ‘স্বাবলম্বী যোদ্ধা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়।
যদি হতাশা গ্রাস করে, তাহলে নিজের তৈরি করা কাজ, নিজের সৃজনশীলতা আর লক্ষ্যই হবে একমাত্র ভরসা। জীবন এক দীর্ঘ দৌড়, যা খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির কঠোরতা ও একাকিত্বের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। যে মানুষ তার লক্ষ্যের প্রতি সৎ থাকে এবং কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাসী হয়, সেই কেবল পারে ‘পুরি কায়নাত’ বা গোটা বিশ্বকে নিজের স্বপ্নপূরণে বাধ্য করতে।
আত্মমর্যাদার অমূল্য উপহার ও সমতার ডাক
ভারতীয় নারী ক্রিকেটারদের বিশ্বজয় কেবল একটি ক্রীড়া ইভেন্টের সাফল্য নয়; এটি অবিচল সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস এবং লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদের প্রতীক। এই যোদ্ধারা দেখিয়েছেন যে, কঠোর পরিশ্রম ও জেদ যদি স্বপ্নের সঙ্গে মেশে, তবে জগতের কোনও বাধা সেই লক্ষ্যপূরণ আটকাতে পারে না। হরমনপ্রীত কৌরের ‘জেনারেল’ হওয়ার বার্তা এবং ‘প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ’-এর মতো পরিবর্তনগুলি স্পষ্ট করে যে, শ্রেষ্ঠত্ব এখন কোনও লিঙ্গ বা শ্রেণির সম্পত্তি নয়, বরং তা কঠোর পরিশ্রমের ফল। সমাজের নানা অন্ধকার দিক থাকা সত্ত্বেও, ব্যক্তিগত কঠোরতা ও স্ব-উৎসর্গীকৃত আনন্দই জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। এই ক্রিকেটারদের অর্জন প্রমাণ করে যে, যখন মানুষ বাইরের প্রত্যাশা ও নিন্দাকে উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকে, তখনই সে নিজের জন্য তৈরি করে জীবনের সবচেয়ে দামি ‘উপহার’— তা হল আত্মমর্যাদা। স্বপ্ন এবং সংগ্রাম— এই দুয়ের মিশ্রণেই তৈরি হয় এক অপ্রতিরোধ্য জীবন এবং লিঙ্গনিরপেক্ষ ভবিষ্যতের পথ।
*মতামত ব্যক্তিগত

