দেবব্রত শ্যামরায়
পাঁচই নভেম্বর রামমোহন লাইব্রেরির সভাগৃহে যারা ভিড় করেছিলেন, তারা প্রায় সকলেই জন্মপরিচয়ে হিন্দু অথবা মুসলিম বা খ্রিস্টান নিশ্চয়ই, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সূত্রেও তাই। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস, ঈশ্বরভক্তি, নিজ নিজ ধর্মের অর্থহীন আচার, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও লিঙ্গবৈষম্যের শেকল ছিঁড়ে তারা প্রত্যেকে বেরিয়ে এসেছেন অথবা বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছেন। অতএব সেদিন নাস্তিক মঞ্চের সভাগৃহে আমরা কোনও হিন্দু বা মুসলমানকে দেখতে পাইনি, আমরা সেদিন তিনশো আটজন মানবকে হাজির হতে দেখলাম। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল যখন নিজস্বার্থে ধর্ম ও রাজনীতির মারণ ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত, তখন নাস্তিক মঞ্চ অন্য সমস্ত সংকীর্ণ পরিচিতিকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে একজন মানুষের পরিচয়কে তুলে ধরার কথা বলছে
শহরে শীতের পায়ের শব্দ সবেমাত্র শোনা যাচ্ছে। এমন সময়, গত ৫ নভেম্বর, বুধবার, অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নাস্তিক মঞ্চের প্রথম কলকাতা জেলা সম্মেলন। ধর্মসংস্কারক শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপকে নাস্তিক মঞ্চ বেছে নিয়েছিল তাদের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনের ঘটনাস্থল হিসেবে। তারপর কৃষ্ণনগর, বারাসতের সম্মেলন পেরিয়ে কলকাতায় নাস্তিক মঞ্চের জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল আরেক সমাজশোধক রাজা রামমোহন রায়ের নামাঙ্কিত শতাব্দীপ্রাচীন লাইব্রেরি হলে।
১৮৩১ সালে হিন্দু ছাত্রদের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করে তাদের অবিশ্বাসী ও ধর্মহীন করে তোলার অভিযোগে হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ২২ বছরের তেজি যুবক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। আর সে বছরই ডিসেম্বরে কপর্দকহীন অবস্থায় কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যান তিনি। মারা যাওয়ার আগের মুহূর্তে তাঁর কানে কানে বাইবেলের বাণী শোনানোর জন্য পাদ্রি এসেছিলেন, কিন্তু ডিরোজিও পাদ্রিসাহেবের কাছ থেকে বাইবেল না শুনে নিজের ছাত্র রামগোপাল ঘোষের কাছ থেকে কবিতা শুনতে চান। অর্থাৎ জীবনের শেষ মহূর্তটিতে পৌঁছেও ডিরোজিও ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করেননি বরং মানবিক অনুভূতির কাছেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ১৮৩১ থেকে ২০২৫— দীর্ঘ সময়। সেদিক থেকে দেখলে ডিরোজিওর শহরে নাস্তিকদের সাংগঠনিকভাবে সমবেত হতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। তবুও, বলাবাহুল্য, বিলম্ব হলেও যুক্তিবাদচর্চা ও মুক্তচিন্তার একদা প্রাণকেন্দ্র মহানগরী কলকাতায় নাস্তিকতা চর্চার সংগঠনটির আবির্ভাবকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাতেই হয়।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এমন একটি সংগঠন কেন জরুরি? নাস্তিক মঞ্চের কার্যকারিতাই বা কী? আসুন, সংগঠনের পরিচয় ও উদ্দেশ্যের কথা তাদের নিজের মুখেই শোনা যাক। নাস্তিক মঞ্চের প্রচারপত্রে মঞ্চের মতাদর্শের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। তারই অংশবিশেষ—
নাস্তিক মঞ্চ একটি বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক সংগঠন। বিজ্ঞানসম্মত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা নেই। আমরা তাই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নই। বস্তুবাদী দার্শনিক দিক থেকে আমরা বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তায় বিশ্বাসী। ‘ঈশ্বর-বিশ্বাস’ মুক্তচিন্তার পথ অবরোধ করে গড়ে তোলে প্রশ্নহীন আনুগত্যের প্রতিষ্ঠান— ‘ধর্ম’, যা প্রসারিত ধর্মীয় কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রথায়। ধর্মান্ধতা থেকেই জন্ম নেয় ধর্মীয় মৌলবাদ; এর ফলশ্রুতিতে তৈরি হয় মৌলবাদী দখলদারিত্ব, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণহত্যার পরিবেশ।
অর্থাৎ ঘোষণাপত্র থেকে একথা স্পষ্ট যে শুধুমাত্র ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব সম্বন্ধীয় তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকাটা নাস্তিক মঞ্চের উদ্দেশ্য নয়। বরং বর্তমান ভারতবর্ষের বৈষম্যতাড়িত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে সামগ্রিক জনজীবনে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার ও প্রসারই নাস্তিক মঞ্চের মূল লক্ষ্য। চিন্তার দাসত্বকে রুখে দিতে পারলে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকগুলি সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তাই নাস্তিক মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে—
আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল মুক্তচিন্তার বিকাশের পথে সমাজে বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে তোলা। এরই প্রয়োজনে নাস্তিক্য দর্শন অপরিহার্য। তাই [আমাদের লক্ষ্য] নাস্তিকতার প্রচার ও প্রসারে উদ্যোগী হওয়া, কুসংস্কার ও জাতিভেদ প্রথার বিলোপ করে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। আমাদের সংগ্রাম ধর্মবিশ্বাসী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, ধর্মীয় দর্শন ও তার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে।
যা লেখা আছে, তার চেয়ে অধিক ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। একেবারে শেষ লাইনটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা নিয়ে আমরা এই নিবন্ধের শেষে আলোচনায় ফিরব।
তা কেমনভাবে শুরু হল পাঁচ নভেম্বরের সম্মেলন? সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল দশটায়। তার আগে সকাল নটা থেকে আগত নাস্তিকমণ্ডলীর নথিকরণ শুরু হওয়ার কথা। প্রসঙ্গত, এই সম্মেলনে নিরীশ্বরবাদী ছাড়াও অজ্ঞেয়বাদী এবং সংশয়বাদীদের যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যাই হোক, উদ্যোক্তারা ঠিক করেছিলেন বাঙালির চিরকালের লেট লতিফ বদনামটিকে ভুল প্রমাণ করে ঠিক দশটাতেই সম্মেলন শুরু করবেন। ঠিক তাই করলেন তাঁরা। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় সম্মেলন শুরু হল। দুপুর একটায় মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। উপস্থিত সকলকে খিচুড়ি, আলুর দম, চাটনি ও পাঁপড় সহযোগে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হয়। আস্তিকরা খুশি হতে পারেন এই ভেবে যে মহাষ্টমীর ভোগপ্রসাদ ও নাস্তিক সম্মেলনের খাদ্যতালিকায় অন্তত কোনও ভেদাভেদ করা হয়নি! বিরতির পর দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হল নির্ধারিত সময় ঠিক দুটোয়। কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা অনুষ্ঠানের দিন সকালে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সম্মেলন স্থলে পৌঁছে হলটিকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পেরিয়ার-সহ যুক্তিবাদের পূর্বাচার্যদের উদ্ধৃতির পোস্টারে ফেস্টুনে সেজে ওঠে হল ও লাইব্রেরি প্রাঙ্গন। এর জন্য নাস্তিক মঞ্চের উদ্যোক্তা, কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের অতিরিক্ত সাধুবাদ প্রাপ্য। শ্রী কণিষ্ক চৌধুরীর সঙ্গে বার্তালাপে উঠে এল পাঁচজন নেপথ্য নায়কের নাম যাঁরা না থাকলে এই সম্মেলন সফল হতে পারত না। তাঁরা হলেন বাসুদেব ঘটক, আশীষ চক্রবর্তী, শ্রীমতী দীপান্বিতা দাস, পার্থ দাস এবং সুমিত চৌধুরী মহাশয়। এই পাঁচজন প্রধান স্থপতি ছাড়াও অসংখ্য নবীন ও প্রবীণ কর্মী ও সদস্যদের দিনরাতের নিরলস পরিশ্রমের ফলে কলকাতা সম্মেলন সাফল্যের মুখ দেখল।
রামমোহন লাইব্রেরি সভায় আসনসংখ্যা ছিল দুশো কুড়ি জনের। উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ দুশ্চিন্তায় ছিলেন অনুষ্ঠানে মেরেকেটে শ-দেড়েক লোক হবে কিনা। কিন্তু না, সবকটি আসন ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরেও লোক বসানোর জন্য বাইরে থেকে আরও চেয়ার আনতে হল। এছাড়াও বেশ কিছু অতিথিকে হলের সিঁড়িতে বসার জায়গা করে দিতে হল। মোট তিনশো আটজন শ্রোতা অনুষ্ঠানের পূর্ণ সময় রামমোহন লাইব্রেরির হলে উপস্থিত ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে তিরিশজন ছিলেন মহিলা এবং পঁচিশজন ছিলেন জন্মসূত্রে মুসলিম নামধারী। শুধু তাই নয়, এর বাইরেও প্রায় সাড়ে চারশো জন অতিথিকে স্থানাভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হল, তাঁদের মধ্যেও একটা বড় অংশ ছিলেন জন্মসূত্রে মুসলমান৷ অনেকেই হলের ভেতরে ঢুকতে না পেরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মাইকে ভেসে আসা বক্তব্য শুনছিলেন৷ এছাড়াও হলের বাইরে খোলা জায়গায় যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্কতার বই ও পত্রপত্রিকা নিয়ে স্টল সাজিয়েছিলেন আটটি প্রগতিশীল প্রকাশনা ও পত্রিকাগোষ্ঠী। একটা ছোটখাটো বইমেলার চেহারা নিয়েছিল লাইব্রেরি প্রান্তর। সব মিলিয়ে প্রথম কলকাতা জেলা সম্মেলন জনসমাগমের ও স্বতঃস্ফূর্ততার দিক থেকে অত্যন্ত সফল। আশা রাখব, এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নাস্তিক মঞ্চ ভবিষ্যতে এই ধরনের সমাবেশ করার আগে আরও প্রশস্ত ও যথাযথ স্থান নির্বাচনের কথা ভাববে।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, দুটি অর্ধে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হল। প্রথম অর্ধের শুরুতে নাস্তিক ম্যানিফেস্টো-র প্রথম খণ্ড প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলটি সংগ্রহ করা গেল। এই ইস্তেহারের শুরুতেই ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বস্তুবাদী চিন্তার প্রাচীন ও আবহমান ধারাটি সহজ বাংলায় আলোচিত হয়েছে৷ নাস্তিকতাবাদ ও বস্তুবাদ যে বিদেশ থেকে আমদানি করা কোনও ধারণা নয়, মহামতি মার্ক বা বার্ট্রান্ড রাসেলের কাছ থেকেই আমরা যে বস্তুবাদের কথা প্রথম শুনলাম তাও নয়, এর শিকড় রয়েছে এই ভারতভূমিতেই— এই সত্যকে আরেকবার প্রতিষ্ঠা করল এই ইস্তেহার। প্রশ্ন, যুক্তি, নাস্তিকতাকে চিরকাল নেতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখেছেন সমাজের ধর্মীয় নেতৃত্ব, এমনকি ‘নাস্তিক’ কথাটি সর্বদাই নিন্দার্থে ব্যবহার করেছেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা। অথচ তা যে কত বড় মিথ্যাচার, তা তুলে ধরা হয়েছে এই ইস্তেহারে। ইস্তেহারটির আরও একাধিক খণ্ড বের করানোর পরিকল্পনা আছে, যাতে পর্বে পর্বে তুলে ধরা হবে বৈদিক যুগে নাস্তিক্য, উপনিষদে জড়বাদ, লোকায়ত দর্শন সহ সংশয় ও নাস্তিকতার নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক৷
প্রথমার্ধে তিনজন বক্তা সেমিনারের আধারে নাস্তিকতা ও যুক্তিবাদের নানা দিক নিয়ে বক্তব্য রাখেন। উদ্বোধনী ভাষণ রাখেন কণিষ্ক চৌধুরী মহাশয়। তাঁর বক্তব্যে ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্য যে শুরু আধ্যাত্মিকতা বা ভাববাদ নয়, বস্তুবাদ ভারতীয় সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ— তা আরেকবার তথ্যপ্রমাণাদি-সহ তুলে ধরেন। সংখ্যাগুরু ধর্মবিশ্বাসী ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর তরফ থেকে দীর্থ অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করেও ভারতীয় উপমহাদেশে যুক্তিবাদ ও নিরীশ্বরবাদের চর্চা কীভাবে ফল্গুধারার মতো বয়ে গেছে কণিষ্কবাবুর বক্তব্য থেকে তা জানা যায়। দ্বিতীয় বক্তা আশীষ লাহিড়ী মহাশয়ের বক্তব্যে ঈশ্বরবিশ্বাসের সঙ্গে এথিক্স বা নৈতিকতার আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কিনা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি উঠে এল। ১৯৪৩ সালে রচিত রসসাহিত্যিক রাজশেখর বসুর এক স্বাদু প্রবন্ধ ‘প্রার্থনা’ থেকে পাঠ করে আশীষবাবু দেখালেন আস্তিকতার সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক কতখানি দূরতর। দুনিয়ায় ভালো লোক বা খারাপ লোক থাকবেই, ধর্ম থাকলেও থাকবে, না থাকলেও থাকবে। কিন্তু ধর্ম আছে বলেই একজন তথাকথিত ভালো লোককে দিয়েও অনেক খারাপ কাজ করিয়ে নেওয়া যায়৷ এই পর্যবেক্ষণ যে কতখানি সত্য ও মর্মান্তিক, তা আজকের উপমহাদেশের দিকে তাকালেই বোঝা যায়৷ এছাড়াও বাংলার ‘ফার্স্ট র্যাশনালিস্ট’ অক্ষয় কুমার দত্তের জীবন ও কাজের কথা উঠে এল আশীষবাবু ও তৃতীয় বক্তা বর্ষীয়ান শুভরঞ্জন দাশগুপ্তের ঋজু, মনোজ্ঞ ভাষণে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্ব উন্মুক্ত ছিল প্রশ্নোত্তরে, নানা প্রসঙ্গে একাধিক আলোচনায়। তরুণ প্রজন্মের বেশ কিছু ছেলেমেয়েরা, ছাত্রছাত্রীরাও অংশ নিলেন নাস্তিক সম্মেলনে, নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন। এক বক্তা মনোবিদ মোহিত রণদীপ উত্থাপন করলেন এক ভিন্ন কিন্তু জরুরি প্রসঙ্গ, সতর্ক করে দিলেন নাস্তিক্যের অহঙ্কার বিষয়ে। অর্থাৎ আমরা নিজেরা নাস্তিক বলে আমাদের আশেপাশে সহনাগরিক আস্তিক বা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষদেরকে যেন অবজ্ঞা না করি। ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষই আজও আস্তিক। কিন্তু আমরা যদি ঔদ্ধত্য দেখাই, নাস্তিকতার দম্ভে আস্তিকদের সঙ্গে অকারণে রুঢ় ব্যবহার করি, তাহলে যারা একদিন চার্বাকপন্থীদের পাষণ্ড বলে হেয় জ্ঞান করতেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনও তফাত থাকবে না৷ নাস্তিকদের সাংগঠনিক যুথবদ্ধতা যেন দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মতো হিংস্র না হয়ে ওঠে। আস্তিক মানুষদের সঙ্গেও সুস্থ সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, কথোপকথনের মাধ্যমে সেতু তৈরি করতে হবে৷ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের সঙ্গে সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা মোটেই কাজের কথা নয়, আর তা নাস্তিক মঞ্চের উদ্দেশ্যও নয়৷ তাছাড়া আস্তিকতা থেকে সংশয়বাদ কিংবা অজ্ঞেয়বাদ এবং তারও পরে ধীরে ধীরে নিরীশ্বরবাদে পৌঁছনো একটা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক প্রক্রিয়া। আমরা আজ যারা নাস্তিক, তাদের মধ্যে প্রায় সবাই একদিন না একদিন ধর্মে ও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলাম। কারণ আমাদের দেশের চূড়ান্ত আস্তিক্যবাদী পরিবেশে বেশিরভাগ মানুষই সামাজিক কনডিশনিং-এর কারণে শৈশবে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই যুক্তিনির্ভর চিন্তাভাবনার দ্বারা চালিত হয়ে একদিন না একদিন নাস্তিকতার দিকে এগিয়ে আসেন। এবং এই ধর্মবিতৃষ্ণ মানুষের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। ২০২২ সালের সমীক্ষা বলছে সেই মুহূর্তে ভারতবর্ষের ১৮ শতাংশ মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না৷ নিশ্চয়ই প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, কারণ ভারতবর্ষে আজ অবধি অবিশ্বাসীদের সংখ্যা সরকারিভাবে গণনা করা হয়নি।
পাঁচই নভেম্বর রামমোহন লাইব্রেরির সভাগৃহে যারা ভিড় করেছিলেন, তারা প্রায় সকলেই জন্মপরিচয়ে হিন্দু অথবা মুসলিম বা খ্রিস্টান নিশ্চয়ই, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সূত্রেও তাই। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস, ঈশ্বরভক্তি, নিজ নিজ ধর্মের অর্থহীন আচার, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও লিঙ্গবৈষম্যের শেকল ছিঁড়ে তারা প্রত্যেকে বেরিয়ে এসেছেন অথবা বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেছেন। অতএব সেদিন নাস্তিক মঞ্চের সভাগৃহে আমরা কোনও হিন্দু বা মুসলমানকে দেখতে পাইনি, আমরা সেদিন তিনশো আটজন মানবকে হাজির হতে দেখলাম। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল নিজস্বার্থে ধর্ম ও রাজনীতির মারণ ককটেল তৈরিতে ব্যস্ত, পাশাপাশি নাস্তিক মঞ্চ যখন অন্য সমস্ত সংকীর্ণ পরিচিতিকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে একজন মানুষের পরিচয়কে তুলে ধরার কথা বলে, আশা জাগে— এই পৃথিবীকে এখনও নবজাতকের বাসযোগ্য করে তোলবার সুযোগ রয়েছে৷ আগামী দিনে নাস্তিক মঞ্চের এগিয়ে চলার পথে রইল অফুরান শুভেচ্ছা।

