ফারজানা সিদ্দিকা
আত্মজৈবনিক রচনা কেন লেখে মানুষ? কী জানাতে চায় সে পাঠককে? কেন জানাতে চায়? আত্মজৈবনিক রচয়িতারা এসব প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত কিন্তু যৌক্তিক সব কারণ তুলে ধরবেন নিশ্চয়ই। হয়তো তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন পাঠকের দিকেও: কেন একজন পাঠক আত্মজৈবনিক রচনা পড়েন? কী খুঁজছেন তিনি অন্যের জীবন থেকে? কেননা, আত্মজৈবনিক রচনারও আছে নানান ভাগ। একান্ত ব্যক্তিগত জীবন, রাজনৈতিক জীবন, ভ্রমণের জীবন, জেলজীবন— এই সব থেকে শুরু করে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিবছর আত্মজৈবনিক রচনা প্রকাশিত হয় পৃথিবীজুড়ে। পাঠক তার রুচিমাফিক অন্যের জীবন থেকে তথ্য নেয়, অভিজ্ঞতা নেয়, দৃষ্টিভঙ্গি নেয়, বড়ত্ব নেয়, দায়িত্ববোধ নেয়, প্রেমময়তা নেয়— হয়তো নেয় আরও বহুকিছু।
২০২৪ সালে বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত আবেদীন কাদেরের শ্রাবণের বুকের মাঝে গ্রন্থের তেরোটি প্রবন্ধ এমনি বিচিত্র সংমিশ্রিত অনুভূতির স্বাদ দেয়। ১৯৮৬ থেকে ২০২৩ কালপর্ব জুড়ে তেরোটি প্রবন্ধের মধ্যে দুটি প্রবন্ধ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রচিত। দুটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থকে কেন্দ্র করে। দুটি প্রবন্ধ সমাজবিজ্ঞানীর দায়িত্ব থেকে রচিত, আর বাকি প্রবন্ধগুলো সেই ব্যক্তিদের নিয়ে, যাঁদের কাছে জীবনের নানা পর্বে তিনি ঋণী। এ ঋণ অর্থনৈতিক নয়, জীবনসুধা অর্জনের ঋণ।
গ্রন্থনামের প্রবন্ধ ‘এই শ্রাবণের বুকের মাঝে’ মূলত মনজুরে মওলাকে নিয়ে লেখা। প্রাবন্ধিক তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের সম্পর্কের একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষ করে, মনজুরে মওলা যখন বাংলা অ্যাকাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন, তার আগে এবং পরের অভিজ্ঞতা এখানে উঠে এসেছে। প্রাবন্ধিক জানাচ্ছেন, বাংলা অ্যাকাডেমিতে মহাপরিচালকের পদায়ন মনজুরে মওলার পছন্দের পদায়ন ছিল না। তিনি জানতেন, ‘আমলা’দের বাংলা অ্যাকাডেমি পছন্দ করে না। সেজন্য এই পদায়ন বদলাতে সংস্থাপন সচিবের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা আলাপ করেছিলেন তিনি— ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ ইংরেজিতে— যাতে সচিব বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ‘অপ্রীতি’র অভিযোগে পদায়ন বদলে দেন।
কিন্তু এই কৌশলে ব্যর্থ হন মনজুরে মওলা। তাঁকে বাংলা অ্যাকাডেমির দায়িত্ব নিতে হয়। তবে কাজ করার জন্য তিনি সচিবের কাছ থেকে অনেক অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন। বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে ‘অকাজের মানুষ’ ও ‘অপ্রয়োজনীয়’ হিসেবে প্রায় অর্ধডজন কর্মকর্তাকে বদলি করেছিলেন তিনি। বিনিময়ে জুটেছিল প্রবল প্রতিক্রিয়া। সচিবালয় থেকে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ এনে অ্যাকাডেমির জরাজীর্ণ বিভাগগুলো সংস্কার করেছেন। পুরনো পাণ্ডুলিপি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন। বইমেলা ঢেলে সাজানো, প্রবীণ ও তরুণ লেখকদের দিয়ে বই লেখা, প্রেস নবায়ন, বর্ধমান হাউজ সংস্কার, অনুষ্ঠানের জন্য হল তৈরি, খ্যাতনামা পণ্ডিতদের জন্য ফেলোশিপের ব্যবস্থা— এসব নানান শুভ কাজ তাঁর উদ্যোগে হয়েছে।
এরপর প্রাবন্ধিক নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে জানান, কিছু মানুষের ‘কানভারি’ করা ও ‘কিছু সত্য ও কিছু মিথ্যা’ অভিযোগের ভিত্তিতে উত্তরাধিকার-এর দায়িত্বে থাকা কবি রফিক আজাদের সঙ্গে মনজুরে মওলার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়, এবং কবি চাকরিতে ইস্তফা দেন।
এ-সব দাপ্তরিক আলাপের বাইরে, এ-প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক শ্রাবণ পত্রিকার সম্পাদক মনজুরে মওলার অন্য এক রূপও প্রকাশ করেছেন। বইয়ের আলোচনা ছাপানোর জন্য বই বাছাই, বিদেশ থেকে বই সংগ্রহ, কোন আলোচনা কার মাধ্যমে লেখানো যায় তার তালিকা করা, প্রতিটি লেখা নিজে পড়া এবং ‘নির্মমভাবে’ কাটাকাটি করে সংশোধন করা— এসব কাজের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। আরও আছে মনজুরে মওলার সঙ্গে মননশীল আড্ডার স্মৃতি। একজন বিদগ্ধ পাঠক হিসেবে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন নিউইয়র্কের বইয়ের দোকানগুলোতে। আর সেখানেই হদিস মিলেছিল মনজুরে মওলার ব্যক্তিগত জীবনের গোপন মায়াময় গল্পগুলো।
এ-প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে মনজুরে মওলার মৃত্যুর পরে। প্রাবন্ধিক আবেদীন কাদের জানাচ্ছেন, দশ বছর ধরে যে আমলার চাকরি তিনি করেছেন, সেই জীবনেও চাকরিসংক্রান্ত নানান প্রতিকূলতায় মনজুরে মওলা পরামর্শ দিয়ে পাশে থেকেছেন। ব্যক্তি মনজুরে মওলা সম্পর্কে তিনি নিরপেক্ষ ও সজ্ঞানে লিখেছেন:
আমার ধারণা, তাঁর পেশা আমলাতন্ত্র তাঁকে মানুষের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপিত করেছে, কিন্তু ভীষণ কোমল এবং মানবিক এই হৃদয়ের হদিশ আমাদের পাঠকরা খুব বেশি পাননি, যার ছবি তাঁর কবিতা এবং রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধগুলোর মাঝে ছড়িয়ে আছে।
এ-ধরনের মন্তব্য পাঠককে ব্যক্তিকে বিচার করার ক্ষেত্রে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়, নিশ্চয়ই।
বাংলা অ্যাকাডেমির কর্মকর্তা আবদুর রব খান তাঁর লেখক-নামে ফরহাদ ব্যবহার করতেন। প্রাবন্ধিক লিখেছেন, “আমাদের তরুণ বয়সের আড্ডার সবচেয়ে রুচিশীল এবং স্নিগ্ধ স্বভাবের সুশিক্ষিত মানুষ ছিলেন ফরহাদ ভাই।” তিনি দারুণ অনুবাদ করতেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় ‘খুচরো লেখা’ লিখতেন। রাজশাহী বেতারে সংবাদ পাঠ করতেন, পরবর্তীতে ঢাকার জীবনেও অনুষ্ঠান করতেন রেডিও ও টেলিভিশনে। রোববার ঘিরে তাঁদের অনেক যৌথ স্মৃতি রয়েছে। মৃত্যুর পরে স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে ‘আদিউ ফরহাদ ভাই’ শিরোনামে নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটিও লেখা হয়েছে।
… হাবীবুল্লাহ ভাই শিল্প সাহিত্য নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবনে আমাকে ভীষণভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। তিনি জানতেন, তাঁর কবিতা বা গদ্য আমার প্রিয়দের তালিকায় নেই, কিন্তু তাঁর স্নেহ তাতে বিন্দুমাত্র টলতো না।
১৯৭৫ সালে গণসাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত এবং পরে ১৯৭৭ সালে মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত, যার প্রথম লাইন: “জলের দেবতা এসে জেলেকে জানায়/ বেলা বেলা বাড়ি চলে যাও, সমুদ্রে টাইফুন হবে।” শুধু একবারই এই একটি কবিতা প্রাবন্ধিকের পছন্দ হয়েছিল, এবং এ কথা কবিকে জানালে তিনি শিশুর মতো খুশি হয়ে উঠেছিলেন। ‘বেলা বেলা বাড়ি চলে যাও, সমুদ্রে টাইফুন হবে’ শিরোনামের প্রবন্ধটিতে প্রাবন্ধিক অত্যন্ত নির্মোহভাবে দোষ-গুণে আবৃত ‘তিনটি সত্তা’— কবিখ্যাতির কাঙাল-মেধাবী প্রকৌশলী-কোমল দরদি বন্ধু— সবমিলিয়ে চেনা হাবীবুল্লাহ সিরাজীকেই নতুন মোড়কে হাজির করেছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হওয়ার পরে লিখেছেন কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষার অজস্র জলধারে প্রবন্ধটি। এখানে প্রাবন্ধিক অভিনেতা সৌমিত্রের বেড়ে ওঠার সঙ্গে পাঠাভ্যাস, সাহিত্যচর্চা, বর্তমানে প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনার বিষয়গুলো আলোচনা করতে করতে আফসোসের প্রতিধ্বনি তুলে ধরেছেন। কারণ, অভিনেতা সৌমিত্র যত বেশি আলোচিত, তত কম আলোচিত রয়েছেন কবি ও নাট্যকার হিসেবে। এমনকি প্রাবন্ধিক মনে করেন, বন্ধু, স্বামী বা বাবা হিসেবেও ‘মানুষ সৌমিত্র’ অনালোচিত থেকে গেছেন।
জীবনের যেসব দিনে প্রাবন্ধিক “খুব রুক্ষ ছিলেন” এবং “মেয়েদের মুখে আংরেজি শুনলে” অকারণে তাঁর “গা জ্বলতো,” এমন দিনগুলিতে একটি তিক্ত ঘটনার মধ্যে দিয়ে পরিচয় হয়েছিল নুসরাত ইসলামের সঙ্গে। তারপর ছাত্রজীবন থেকেই বিদূষী, আধুনিক কিন্তু “ধার্মিক ও মরাল কোড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত,” মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দুর্বল নুসরাত হয়ে ওঠেন আবেদীন কাদেরের প্রিয় বন্ধু। এই বন্ধুকেই প্রাবন্ধিক তাঁর প্রথম বই উৎসর্গ করেছিলেন।
বন্ধুত্বের দায় ও দায়িত্বের স্বরূপ কেমন, তা ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ’ প্রবন্ধটি পাঠ করলে অনুভব করা যায়। নুসরাতের কাছে কোনও বই সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আগ্রহ প্রকাশ করলে, দেশ-বিদেশের নানান জায়গা থেকে সে বই হাজির করতেন তিনি। কেবল বই নয়, বিপদে অর্থ কিংবা পছন্দের পোশাকও। বেইজিঙে একবার ব্যাগ হারিয়ে ভীষণ বিপদে পড়লে, দূরে থেকেও উদ্ধারকর্তার ভূমিকা পালন করেছিলেন নুসরাত। এই বন্ধুত্ব কেবল দুইজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; নুসরাতের মা ও ভাইবোনেরাও প্রাবন্ধিককে অপার স্নেহজ্ঞান করতেন। এমন বন্ধুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া এবং দীর্ঘ যন্ত্রণার পরে ২০১৩ সালে মৃত্যু— বন্ধু হারানোর এই শোক যেন অবিরাম বেদনার ক্ষরণ তৈরি করে চলেছে।
আরও এক অনন্য ব্যক্তিত্বের বন্ধুর দেখা মেলে ‘এখনও বৃষ্টির দিনে মনে পড়ে তাকে’ প্রবন্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলেন নাদিরা মজুমদার। পশ্চিমা পোশাক পরিহিতা, ঘাড় পর্যন্ত ছাটা চুলে, ঠোঁটে প্রায় সর্বত্র সিগারেট রাখা নাদিরার “কাছে এসো-না ধরনের ঘোষণামিশ্রিত রুক্ষতা” থাকলেও, তার আড়ালে শুধুমাত্র বন্ধুরাই “অতিমাত্রায় মমতা মাখানো কোমল বাঙালি নারীর হৃদয়টির” সন্ধান পেত।
এ-প্রবন্ধে পত্রিকায় কবি রফিক আজাদের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ ও নাদিরার আগ্রহের বিষয়ে মজার এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন প্রাবন্ধিক। রাজনৈতিকভাবে ঘোরতর প্রগতিশীল নাদিরা রোববার পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে বিজ্ঞান পাতা দেখতেন। প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেন, “অধিকাংশ বিজ্ঞানের ছাত্রদেরই বিজ্ঞানমনস্ক মন থাকে না; নাদিরার সেটি ছিল কিছুটা বেশি মাত্রায়ই।” তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি প্রবল ঘৃণা পোষণ করতেন এবং রোববারে পর্দাপ্রথা ও বোরকার বিরুদ্ধে, নারীর অশিক্ষা নিয়ে অসাধারণ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
সত্তরের দশকের শেষদিকে, ঢাকার কূটনীতিক পাড়ায় কর্মরত চেকোস্লোভাকিয়ার এক নাগরিককে ভালোবেসে নাদিরা দেশ ছাড়েন। ১৯৯৮ সালে যখন এই প্রবন্ধটি লেখা হয়, তখন দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থাকা নাদিরার স্বামী মাত্র প্রয়াত হয়েছেন। স্বামীর কফিনের সামনে বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিঃসঙ্গ বন্ধুর মুখের কল্পনায় পাঠকের হৃদয়ও আর্দ্র হয়ে ওঠে।
প্রাবন্ধিক আবেদীন কাদেরের ব্যক্তিগত জীবনের দীর্ঘ বয়ান পাওয়া যায় ‘সে-সত্য জানার আগে মিলনের মুহূর্ত ফুরাল’ প্রবন্ধে। ছাত্রজীবনে ‘ভূতলবাসী রাজনৈতিক দলের’ সদস্য হিসেবে কাজ করতে গিয়ে লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হয়ে যায় তাঁর। জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি ক্লাসে উপস্থিত হতেন না। ঢাকায় চলত তাঁর বিরামহীন আড্ডা। এসব আড্ডা ও রাজনৈতিক চিন্তার সাদৃশ্য থেকেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় গল্পলেখক আহমদ বশীরের সঙ্গে। একে একে আরও বন্ধুদের নাম উঠে আসে— জাহিদ, জুবেরী, মোমেন আল হায়দার, সুবল, পিউ প্রমুখ।
প্রাবন্ধিক অনায়াসে লেখেন তাঁর জীবনের অন্ধকার অংশের কথাও। কেবল আড্ডা নয়, কীভাবে নানান নেশায় আক্রান্ত ছিলেন তখন তাঁরা। কোনও কিছুই আড়াল করেননি তিনি। এসব দিনে বাড়ির কথা, মায়ের কথা মনে পড়লে অপরাধবোধ তৈরি হত তাঁর মনে। ছোটবেলা থেকে রুগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য তাঁকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা ছিল। পুত্রের শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে মা চাইতেন, লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরে যাক ছেলে। গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করুক। এমএ পরীক্ষার পরে ঢাকার আড্ডার মোহ কাটিয়ে সত্যিই তিনি বাড়ি ফিরে যান। আড্ডাপ্রিয় আবেদীন কাদের তখন বাল্যবন্ধু ‘দুলালের কাপড়ের দোকানে’ই আড্ডা দিতেন। জাজিরায় পোস্টিং নিয়ে আসা সমবয়সি চিকিৎসক সাখাওয়াতের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুর উদ্যোগে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চরমুগরিয়া কলেজে তাঁর শিক্ষকতার জীবন শুরু হয়। নিস্তরঙ্গ সেসব দিনে কলেজের লাইব্রেরির সব বই পড়ে শেষ করার পর পুনরায় ঢাকার জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে। ফিরে যান ঢাকায়। আবারও আড্ডা, আবারও নেশা, আর নিজের ভরণপোষণের জন্য টিউশনি-জীবন শুরু হয়। বন্ধুরা মিলে বিপক্ষে নামে একটি পত্রিকা বের করেন। সে-পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘ভারতীয় রাজনীতি’ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা করার পর লিখেছেন:
…সত্যিকার কিছু পড়াশোনা করতে গিয়েই আমার মনে সন্দেহ জাগে, আসলে ভারতীয় সমাজ কখনই ধর্মনিরপেক্ষ নয়।
এ-প্রবন্ধে বন্ধুদের প্রেম, বিয়ে, পিতৃবিয়োগ, পরীক্ষায় নকল করা ইত্যাদি প্রসঙ্গ যেমন আসে, তেমনি উঠে আসে বন্ধুর প্রথম বই প্রকাশের টানটান উত্তেজনার স্মৃতি। আরও আছে মাতাল হয়ে এক রাত হাজতবাসের কৌতুকী স্মৃতি। পাশাপাশি বন্ধুদের পারস্পরিক ঈর্ষা ও দায়িত্বহীনতার কথাও এসেছে।
আত্মজৈবনিক এ-প্রবন্ধে আড্ডার উত্তাল তরঙ্গ যেমন প্রবাহিত, তেমনি এর বিপরীতে বয়ে চলে গহীন গোপন বেদনার এক স্রোত। চিরকাল লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা একজন মানুষ মূলত বাস্তবের চোরাগলিতে হারিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি লিখেছেন, “সেদিন যেমন ভেবেছি, আজও ভাবি লেখকের পেশা বা জীবিকা একেবারেই স্বাধীন হওয়া উচিত, যা আমার পক্ষে পাওয়া বা নির্বাচন করা কঠিন ছিল। কারণ ছিল একাধিক, বিশেষ করে আমার পারিবারিক দায়িত্বটি ছিল আমাকে সেই পথ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। যে কোনও চিন্তাশীল বা সৃষ্টিশীল লেখককেই লেখা বা সৃষ্টির জন্য ভিন্নভাবে সময় সাজিয়ে নিতে হয়, কিন্তু সেই লেখা বা সৃষ্টি থেকে যদি জীবিকার সংস্থান না হয়, তাহলে সংকট বা আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব প্রায় অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমার ক্ষেত্রেও তা কিছুটা অনুভব করি সে সময়ে। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম স্বাধীনভাবে লেখার মাধ্যমে, কিন্তু পারিবারিক দায়িত্ব আমাকে নিরন্তর দুর্বল করে দেয় মানসিকভাবে।”
সেই বিদগ্ধ আড্ডা, সেই বিপক্ষে প্রকাশের স্মৃতি, সেই লেখক হওয়ার স্বপ্ন, সেই বন্ধুদের কলরব— একাকী প্রবাসজীবনে যেন মধ্যরাতে প্রাণে বাজে ফইয়াজ খাঁয়ের সঙ্গীতের মতো।
২০২১ সালে লেখা ‘আমার বই পড়ার স্মৃতি’ প্রবন্ধটিও একটি আত্মজৈবনিক রচনা। শৈশব থেকেই পরিবারের সদস্যরা কীভাবে তাঁর পাঠাভ্যাসের ভিত তৈরি করেছেন, তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। মাকে দেখেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা পড়তে। গ্রামীণ যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন তিনি। অসুস্থ হলে, মাথার কাছে শুয়ে যখন কোনও দুঃখের বই পড়তে শোনাতেন ‘শামসু বুজান’, চোখে জল জমত তাঁর। বাবা পড়তেন টেলস ফ্রম শেক্সপিয়ার এবং শহর থেকে নিয়ে আসতেন বিশিষ্টজনদের জীবনী। বিশেষভাবে মনে পড়ে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মজীবনীর কথা। মেরুন রঙের রেক্সিনে বাঁধানো সেই বই বহু বছর নিজের সঙ্গে রেখেছেন তিনি। সেই বই থেকে জীবনদর্শন নিয়েছেন: “আমি সারাজীবন আচার্য রায়ের জীবনের দু-একটি বিষয় অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি; একটি হল আহার ও পোশাকের ব্যাপারে খুব মিতব্যয়ী হওয়া এবং সব ধরনের বই পড়ে সময় কাটানো।”
বাবা তাঁকে শিখিয়েছেন ইংরেজি বই পাঠের কৌশল। আত্মীয় শের আলী কাকা ও অন্যান্যরাও বই দিতেন তাঁকে। লিখেছেন, স্কুলে মহিউদ্দিন স্যার কীভাবে ক্লাসের পড়ার বাইরে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করে কৌতূহল বাড়িয়েছিলেন। স্কুলে সিনিয়রদের কাছ থেকেও বই নিতেন। তখন পড়তেন দেশ, সিনেমার জগৎ, উল্টোরথ, প্রসাদ পত্রিকা।
গ্রাম ছেড়ে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পড়তে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর বই পড়ার জগৎ বিস্তৃত হয়। হোস্টেল জীবনে বই পড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক বদরুদদোহা খান, মোহাম্মদ আলী এবং স্কুলের প্রাক্তন সিনিয়র আবদুল কাইউম মুকুল ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন। এ-সময়ে রুশ সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হন। স্কুলের শিক্ষকরা ক্লাসরুমে গর্বের সঙ্গে প্রাক্তন ছাত্র বুদ্ধদেব বসুর নাম বলতেন; ফলে লাইব্রেরি থেকে তাঁর লেখা সমস্ত বই পড়ে ফেলেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী থাকা সময়ে শওকত ওসমান তাঁকে দর্শনের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। বন্ধু মনিরুল ইসলামের কাছে পেয়েছেন সমাজবিজ্ঞানের বইপত্তরের খোঁজ। জার্মান কালচারাল সেন্টারে পড়েছেন কাফকা, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দিয়েছেন মিলান কুন্ডেরার খোঁজ। মনজুরে মওলা, সৈয়দ আকরম হোসেন রবীন্দ্রনাথ পড়তে উৎসাহী করেছেন। বিদেশ থেকে বই এনে দিয়েছেন বন্ধুরা, বিশেষভাবে বন্ধু রাশিদা দাহদওয়ালের নাম কৃতজ্ঞতায় বারবার উচ্চারণ করেছেন তিনি।
সময়ের হিসেবে এ গ্রন্থের সবচেয়ে পুরনো প্রবন্ধ রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি এবং ড. খান সারওয়ার মুরশিদ। ১৯৮৬ সালে লেখা তথ্যসমৃদ্ধ এ প্রবন্ধটি ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আর্কাইভের মতোই ভূমিকা রাখে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহলের ‘দ্বিধাদীর্ণ’ চিত্রের প্রমাণসাপেক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন আবেদীন কাদের। তিনি লিখেছেন:
প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিকমনা বুদ্ধিজীবীগণ মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ সকল বাঙালির, হোক সে পূর্ব পাকিস্তানি বা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী, তাদের সকলের জীবনের এবং অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্য একদল বুদ্ধিজীবী, যারা ইসলামপন্থী পাকিস্তানের তমুদ্দনে বিশ্বাস করতেন, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ছিল ইসলামবিরোধী এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শের পরিপন্থী।
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে প্রবন্ধে। শিক্ষার্থীদের সেই কর্মতৎপরতায় পরামর্শক ছিলেন ড. খান সারওয়ার মুরশিদ। পরে যখন কমিটি গঠিত হয়, সাধারণ সম্পাদক হন তিনি, আর সভাপতি ছিলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুরশেদ। জানা যায়, শ্রাবণ পত্রিকার জন্য ড. খান সারওয়ার মুরশিদের একটি সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে প্রাবন্ধিক গোটা রবীন্দ্র রচনাবলি পড়ার চেষ্টা করেছিলেন।
এই প্রবন্ধটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশে রবীন্দ্র-বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অপতৎপরতা এবং আজাদ পত্রিকার ভূমিকা বিষয়ে ছয় পৃষ্ঠা ব্যাপী (পৃ. ১২৪–১৩০) তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন প্রাবন্ধিক। তিনি লেখেন:
৬১ সালে এই রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনে বড় অভিঘাত সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথকে প্রতীক করে এটি ছিল বাঙালিদের পাকিস্তান শাসক-শ্রেণির বিরুদ্ধে বড় প্রতিবাদ।
১৯৬১ থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে ১৯৬৯ পর্যন্ত নানান তৎপরতার উল্লেখযোগ্য তথ্য প্রবন্ধে পাওয়া যায়। ছায়ানটের ভূমিকা, মাওলানা ভাসানির বিবৃতি, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদিন, মুনীর চৌধুরী, আবুল ফজল, আল মাহমুদ, কামাল লোহানী, আবদুল গাফফার চৌধুরী-সহ প্রমুখের বিবৃতি সংবাদে প্রকাশিত হত। এমনকি ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্পর্কেও উল্লেখ আছে। ১৯৮৬ সালে লেখা প্রবন্ধের শেষের দিকে আবেদীন কাদের লিখেছেন:
আমাদের সমাজ-রাজনীতির ইতিহাসে আজ কয়েক দশক যাবৎ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বা ইসলামিক আদর্শের দল ক্ষমতায় এলেই আক্রমণের প্রথম শিকার হন রবীন্দ্রনাথ।
এত বছর পরেও, ২০২৪-পরবর্তী বাংলাদেশেও এ বাক্যটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
‘আমেরিকান বাঙালি মন: একজন সাহিত্যিকের অন্বেষণে কিছু সমাজবিজ্ঞানের সমস্যা’ প্রবন্ধটিও বেশ দীর্ঘ। এটি মূলত প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহারের লেখা আমেরিকান বাঙালি মন গ্রন্থের আলোচনা বলে মনে হলেও প্রচলিত অর্থে বুক রিভিউ নয়। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে তাত্ত্বিক জ্ঞানকাণ্ড দিয়ে একজন সাহিত্যিকের পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে প্রবন্ধে। তিনি জানান:
…পুঁজির গোলোকায়নের পর যেহেতু অর্থনৈতিক নতুন উপনিবেশের উদ্ভব হয়েছে, আর এর ফলে এই নতুন উপনিবেশের সংস্কৃতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে…
তাই তিনি তাঁর প্রিয় তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়ামস এবং স্টুয়ার্ড হলের ‘সংস্কৃতি চিন্তা বা অভিবাসীদের জীবনে সেটা কেমন করে কাজ করে তাদের সংস্কৃতির পরিবর্তন ও বিবর্তন’ বিষয় নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখতে চান। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করেন।
আহমাদ মাযহারের লেখা আমেরিকান বাঙালি মন মূলত “বাঙালিদের যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার পর তাদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য যে পরিবর্তন ঘটে, তার বাহ্যিক এবং মনোজগতে প্রভাব” নিয়ে লেখা একটি অসাধারণ বই। ‘বাংলাদেশ থেকে আনা সাংস্কৃতিক সত্তা বা সৃজনশীল সত্তা বিভূঁয়ের জীবন-বাস্তবতার কারণে সংকটে পড়ে’ কীভাবে ‘চেতনার গতিপথ থেকে খসে’ পড়ে এবং কীভাবে তা ঘটে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। এই বইয়ের ছয়টি অধ্যায় ও উপ-অধ্যায় নিয়ে আবেদীন কাদের কেবল আলোচনাই করেননি, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণও করেছেন। অনন্যা থেকে প্রকাশিত এ বইয়ে ‘আমেরিকার বাঙালি জীবন’; ‘ডায়াস্পোরা, প্রবাসী নাকি অন্য বাংলাবোধের সাহিত্য?’; ‘বাংলার বাইরে বাংলার বইমেলা’; ‘বাংলাদেশের বাইরে বাঙালিসংস্কৃতি’; ‘থিয়েটারে আমাদের জনসমাজ ও অন্যান্য’; ‘সাহিত্য পত্রিকা ও শিল্পকলার চর্চা’; এবং পরিশিষ্টে ‘আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা সাহিত্য চর্চা’ বিষয়ক প্রবন্ধাবলিতে অভিবাসী জীবন ও সংস্কৃতির নতুন এক প্রামাণ্যচিত্রই যেন বর্ণনাকারে প্রকাশ পায়। ফলে, আবেদীন কাদেরের প্রতিটি অধ্যায়ভিত্তিক সযত্নে আলোচনা পাঠ শেষে যে-কোনও কৌতূহলী পাঠক মূল বইটি পড়ার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে উঠবেন।
২০২২ সালে লেখা ‘আমাদের বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রবণতা’ প্রবন্ধটি আয়তনে ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এর শিরোনাম বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। প্রাবন্ধিক লেখেন:
আসলে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বা ‘বুদ্ধিজীবী’ যে অর্থে পশ্চিমা সমাজ আমাদের শেখায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রের দুরাচারের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ মেরুদণ্ড সোজা রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সেই মানুষটি কেমন এবং কে? আমরা গত পঞ্চাশ বছরে তেমন মানুষ কম পেয়েছি।
তিনি এর ঐতিহাসিক কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন। বিগত পঞ্চাশ বছরে, তাঁর বিবেচনায় অধ্যাপক বদরুদ্দীন উমর বা আহমদ শরীফ ছাড়া ‘কাউকেই খুব বেশি শ্রদ্ধা করা যায় না তাঁদের ব্যক্তিগত ও নৈতিক স্খলের জন্য।’ এছাড়া, আহমদ ছফাকে নিয়ে তাঁর অবস্থান সংক্ষেপে কিন্তু সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন। লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিজীবীর মধ্যে আছেন, তাঁর মতে, এই দুর্বিপাকের সময়ে:
…সৃজনশীলতার উৎকৃষ্টতার চেয়ে জরুরি আমাদের নৈতিক অবস্থানের শ্রেষ্ঠতা।
যদিও প্রবন্ধটি ২০২২ সালে লেখা, ‘নৈতিক অবস্থানের শ্রেষ্ঠতা’ প্রমাণে বাংলাদেশ এখন সত্যিকারের সংকটেই আবর্তিত।
এ বইয়ে একজন ব্যক্তিকে নিয়ে দুইটি প্রবন্ধ রয়েছে। একই ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা হলেও দুটো প্রবন্ধই স্বতন্ত্র এবং ভিন্ন মাত্রা বহন করে। ‘চলে গেলেন বিদগ্ধ সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত’ এবং ‘হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে: একটি সমাজের সাংস্কৃতিক জগতের রূপরেখা’ শীর্ষক প্রবন্ধ দুটি যথাক্রমে ব্যক্তিগতভাবে চেনা আবুল হাসনাত এবং অন্যটি তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা।
২০২১ সালে কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাতের মৃত্যুর পর প্রাবন্ধিক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরের চেনাজানা তাঁদের। একজন বিদগ্ধ সম্পাদক কীভাবে লেখক তৈরি করার মন্ত্র জানেন, সে সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন প্রাবন্ধিক। একজন ‘অখ্যাত তরুণ’ লেখক হিসেবে সত্যিকারের মর্যাদা তিনি পেয়েছিলেন আবুল হাসনাতের কাছ থেকে। সংবাদ-এ দিনের পর দিন তিনি গ্রন্থ সমালোচনা লিখেছেন। বইয়ের তালিকা করা এবং সংগ্রহে সাহায্য করার কাজও করেছেন সম্পাদক নিজেই। এমনকি, সবাইকে বিস্মিত করে, সেই তরুণ বয়সে তাঁর লেখা কিস্তিতেও সংবাদ-এ প্রকাশিত হয়েছে। ‘স্বল্পভাষী’ ও আপাত ‘গম্ভীর’ হিসেবে পরিচিত আবুল হাসনাতের প্রতি ভয় কীভাবে ভক্তিতে পরিণত হল এবং কীভাবে তিনি আপনজন হয়ে উঠলেন, তা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন প্রাবন্ধিক। লিখেছেন:
তিনি শুধু অমায়িক স্বভাবের মৃদুভাষী মানুষই নন, সাহিত্যের জগতে একেবারে অন্য ধরনের মানুষ, যাঁর কাছে একটি শব্দও আমি জীবনে পরনিন্দা শুনিনি।
সংবাদ থেকে কালি ও কলম পত্রিকায় যাওয়া পর্যন্ত তাঁর এই অমায়িক স্বভাবের বদল ঘটেনি। কেবল নতুন করে সকলে জেনেছেন যে, তিনি চিত্রকলা বিষয়ে কতটা আগ্রহী। নিউইয়র্কে বেড়াতে গেলে আবুল হাসনাতকে সঙ্গে নিয়ে আর্ট গ্যালারি ও মিউজিয়ম ঘুরে দেখা, বইয়ের দোকান বা কফিশপে গল্প করা এবং ধীরে ধীরে পারিবারিকভাবে বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার দিনগুলোর স্মৃতি প্রাবন্ধিককে আবেগতাড়িত করেছে। এমন ‘উষ্ণ বুকের উত্তাপ ভরা মানুষ’ তিনি জীবনে কম দেখেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্যের অভিযাত্রায় আবুল হাসনাত ‘ধাত্রীর ভূমিকায়’ অবতীর্ণ ছিলেন।
নিজের সৃষ্টিকে ন্যূন মূল্য দিয়ে তিনি সামনে তুলে ধরতে চাইলেন আমাদের শক্তিশালী সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের কাজকে। আমাদের বিজীর্ণ হেজে যাওয়া সমাজে এটা করতে যে আত্মস্বার্থবোধহীন মানুষের প্রয়োজন, তা দিনে দিনে প্রায় শেষ হয়ে গেছে; এর শেষ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।
আবুল হাসনাতের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে নিয়ে আলোচনা রয়েছে ২০২২-এ লেখা দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে। ১৯৭১ সালে আবুল হাসনাত ছিলেন সংবাদপত্রিকার কর্মী এবং একইসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি। প্রাবন্ধিক লক্ষ করেছেন:
…যে বিষয়টি সাধারণত আমাদের দেশের লেখকদের স্মৃতিকথায় দুর্লভ, সেটি হল নিজের সম্পর্কে, নিজের জীবন এবং অর্জন সম্পর্কে প্রায় কিছুই না বলা, বা সামান্য বললেও তা একেবারে ক্ষীণস্বরে বলার চেষ্টা করা, যা একজন উন্নত রুচি এবং শিল্পিত মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
ফলে, এই গ্রন্থকে আপাতভাবে স্মৃতিকথা বলা হলেও আবুল হাসনাতের ব্যক্তিগত জীবন প্রায় উহ্যই থেকে গেছে। এতে ‘আমাদের ইতিহাসের অনেক অজানা এবং স্বল্প জানা ঘটনা তিনি জানিয়েছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে এবং চলাকালীন ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা জানার জন্য এটি অসাধারণ একটি উৎস।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সংবাদ অফিসেই ছিলেন আবুল হাসনাত। পরের দিন ভোরে বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের অলিগলি পার হয়ে বাড়ি ফেরা, পার্টির নির্দেশে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যাওয়ার দিনে মায়ের বিষণ্ণ মুখ, সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছুতে অমানুষিক কষ্ট— এসব ভুলিয়ে দিয়েছে পথে পথে সাধারণ মানুষের উদার ও আন্তরিক সহযোগিতা। কলকাতায় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিঙে ছাত্র ইউনিয়নকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে ভারতের টালবাহানা, আগরতলায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবস্থা— এ সব অজানা রাজনৈতিক তথ্যে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থ।
ফলে, প্রাবন্ধিক যথার্থই লিখেছেন, এ গ্রন্থে ‘একটি সমাজের সাংস্কৃতিক জগতের রূপরেখা’ প্রকাশিত হয়েছে।
এই শ্রাবণের বুকের মাঝে–র তেরোটি প্রবন্ধের অনেকগুলোতেই প্রাসঙ্গিকভাবে কবি রফিক আজাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পরোক্ষভাবে আরও আছেন কবি অসীম সাহা ও অঞ্জলি সাহা। মূলত জীবন নামক বিশাল ক্যানভাসে বিশেষ কিছু মানুষ ও তাঁদের সান্নিধ্য যে বিচিত্র রঙের সমাহার সৃষ্টি করেছে বা করে চলেছে, নিয়ত তাঁদের কাছেই ঋণস্বীকার আর দায়শোধের গ্রন্থ এটি। তরুণ বয়সে যে শ্রাবণ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রাবন্ধিক, সেই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার স্লোগান ছিল: “এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে”। হয়তো সেই স্লোগানই অন্য রূপ নিয়ে এসেছে এই গ্রন্থের নাম হয়ে— এই শ্রাবণের বুকের মাঝে। পার্থক্য শুধু এটুকুই, এখানে আগুন নেই; আছে আগুনের আরেক রূপ— যাকে আমরা বলি উষ্ণতা। কারণ, তেরোটি প্রবন্ধ জুড়েই ছড়িয়ে আছে এই অমলিন মানবিক উষ্ণতা।
বিদ্যাপ্রকাশ এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে প্রুফ ও অন্যান্য সংশোধনে যত্নশীল হবে, এই প্রত্যাশা।
১৯ আগস্ট ২০২৫

