Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দেশের মেয়েরা, মেয়েদের দেশ

সাম্য

 

 

কেন? গবেষণা, উচ্চশিক্ষা, কর্পোরেট কিংবা অভিনয়জগতে— সবখানেই মেয়েদের একটা অতিরিক্ত বিনিময়মূল্য চোকাতে হয়। কেন? মেধাবী, বিদুষী, শিল্পী, গুণী, প্রতিভাধর— এভাবে কাউকে বলতে গেলে আগে তাকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হয়। কিন্তু মনন আর উচ্চতা পাঁচ ইঞ্চিতে আটকে থাকা পুরুষের চোখে নারী কেবলই এক দেহ— একটা যোনি আর দুটি স্তন। এর বাইরে আর কিছু নেই, স্রেফ নেই। মেধা, যোগ্যতা, সম্ভাবনা— সবই অদৃশ্য থেকে যায় সেই পাঁচ ইঞ্চির চোখের দৃষ্টিপথে

 

সবাই ভাবে আমরা শিল্পী, নিজেদের জগতেই থাকি। বাইরের জগতের কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছায় না। তা সত্য নয়। একদিকে আমাদের দেশে নারীকে পূজা করা হয়, আর অন্যদিকে সেই নারীর মুখে অ্যাসিড ছোড়া হয়, পণের জন্য পুড়িয়ে মারা হয়, গণধর্ষণ করা হয়। বলবেন, এগুলো সব দেশেই হয়— তা হয়। কিন্তু আর কোথাও দেবীজ্ঞানে নারীর পূজা হয় না; ভারতে হয়।

নজরুল মঞ্চে, বালিগঞ্জ কালচারাল ক্লাব আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছিলেন ওস্তাদ আমজাদ আলি খান। সেদিন তিলোত্তমা হত্যার রায় বেরিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টে। “দুর্গা যখন কাঁদে কেমন লাগে সেটা আজ আপনাদের শোনাব,” বলে ধরেছিলেন রাগ দুর্গা। কয়েকটা তার আর তার ওপর আঙুলের চলাচল— এ থেকে জন্ম হওয়া ধ্বনি বেজেছিল বুকে এসে। মুচড়ে গেল। মর্দ-কো-দর্দ-নেহি-হোতা সমাজে বেড়ে ওঠা পুরুষ বলে চোখ বেয়ে জল নামেনি, কিন্তু সুরের অভিঘাত মস্তিষ্ক বেয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। প্রায় অবশ অবস্থায় ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, এভাবেও অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়! যা চেয়েছিলেন, তাই তো পেলেন। ঘটিয়ে ছাড়লেন যন্ত্রণার সংক্রমণ। এভাবেও করা যায় অন্যের শরীরে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা! শুভ বোধের দ্বারা চালিত হলে মানুষ নিজেকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে! আবার আশ্চর্য— এই হাত, এই আঙুলেরই অন্য ব্যবহার দেখা যায় অস্ত্রধারণে, নারীধর্ষণে।

স্বাধীনতার আগে নারী-অধিকার নিয়ে লড়া মানুষগুলি অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, নিজেদের মানুষের গড়া প্রশাসন লিঙ্গ-সাম্য আনবে, মেয়েদের অবস্থার উন্নতি হবে। বাস্তবে যে তা হয়নি, তা ভারতে নারীর অবস্থান কমিটির ১৯৭৫ সালের টুওয়ার্ডস ইক্যুয়ালিটি’ নামের রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট হয়। ১৯৭৫ থেকে দীর্ঘ পাঁচ দশকে আমরা চাঁদে অশোকস্তম্ভের ছাপ ফেলেছি, কিন্তু লিঙ্গ-সাম্য? না, তা এখনও আসেনি। বরং হিংসা নেমে এসেছে তাঁদের উপর নিত্যনতুন প্রকারে। নারী-নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান থেকেই তা পরিষ্কার। কিছু কিছু রাজ্যে পুলিশ প্রশাসন একে বরং নিজেদের সাফল্য হিসেবে ধরছেন— ভয় ভেঙে মানুষ থানায় আসছে, সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, জনসংখ্যাও তো বেশি ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে। সংখ্যা ও অজুহাতের তলা থেকে উঁকি মারে একটাই প্রশ্ন— বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির দেশে কতটা নিরাপদ তার মেয়েরা?

দেশের সমাজের ক্ষুদ্রতম একক বা প্রতিনিধি হল বাড়ি। জাতীয় অপরাধপঞ্জি ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি হিংসা ও যৌননির্যাতনের শিকার হন নিজের বাড়িতেই। এরপর কর্মক্ষেত্রে। পুরুষের সমান হতে গেলে মেয়েদের হতে হয় দ্বিগুণ, আর দিতে হয় আরও কিছু অতিরিক্ত পরীক্ষা। সেখানে মেয়েরা কখনও টিকে থাকার জন্য, কখনও বেঁচে থাকার জন্য, কখনও কাজ হাসিল করার জন্য আপস করেন। যোনি নিয়ে জন্মানো নারী ঘরে-বাইরে সর্বত্রই ঝুঁকিপূর্ণ। আর সুযোগ নেওয়া মানুষগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত— কাছের মানুষ।

পেশানির্বিশেষে, পুরুষ যখন ক্ষমতার ধারক হন, তার কাছ থেকে কার্য উদ্ধার করতে হলে মেয়েদের অনেক সময় এক ধরনের বিনিময়মূল্য চোকাতে হয়— যা ছেলেদের ক্ষেত্রে লাগে না। প্রশ্ন আসা উচিত, কেন? আপাতত সেই প্রশ্নটা মূলতুবি রেখে চলুন এর সমাধানের দিকে তাকাই।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৈরি হওয়া ‘বিশাখা গাইডলাইনস’ বর্তমানে ভারত সরকার প্রস্তাবিত কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিবারণ, প্রতিকার) আইন, ২০১৩-তে রূপান্তরিত হয়েছে, বেশ কিছু বদল নিয়ে। এই আইন অনুযায়ী, দশজনের বেশি কর্মী থাকা অফিসে অন্তত চার সদস্যের— যার মধ্যে একজন এনজিও-কর্মী বাধ্যতামূলক— একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ-সমিতি তৈরি করতে হবে, যার অর্ধেক সদস্য মহিলা হবেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বা কর্মীসংখ্যা দশের কম হলে, কিংবা নিয়োগকর্তা নিজেই অভিযুক্ত হলে জেলাশাসক-পরিচালিত স্থানীয় অভিযোগ-সমিতিতে অভিযোগ জানাতে হবে।

ইতিহাসে এখনও চাপা পড়ে যায়নি সেই ঘটনাটি, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নিজের বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির মামলা নিজে শুনে নিজেই খারিজ করে দিয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, এই সব সমিতি পড়ে থাকে একপাশে, আর ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে যায় নাগালের বাইরে। তাই বেশিরভাগ সময় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, কিছুদিন সহ্য করে নেওয়া— অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায় মানিয়ে নেওয়াকেই অগ্রাধিকার দেন মেয়েরা। যাঁরা পারেন না, সেই গুটিকয়েক অভিযোগ গিয়ে পৌঁছায় অভ্যন্তরীণ অভিযোগ-কমিটিতে বা অন্য পরিসরে, থানায়। ফলে পরিসংখ্যানে যা উঠে আসে, তা আসলে এক প্রকাণ্ড হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

আইন প্রয়োগের শৈথিল্য মানুষকে বাধ্য করে আইন-প্রণেতাদের দিকে তাকাতে। বিলকিস বানোর এগারো ধর্ষককে ক্ষমতার অপপ্রয়োগে ও অনৈতিকভাবে গুজরাত হাইকোর্ট শুধু মুক্তই করেনি, কারাগার থেকে বেরোনোর পর ফুল-মালা দিয়ে তাঁদের সংবর্ধনাও জানানো হয়েছিল। হারেম খুলে বসা ‘সন্ত’ রাম রহিম শাস্তির মেয়াদের বেশিরভাগ সময়ই প্যারোলে থাকে, যেখানে বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও পরিবেশকর্মী সোনম ওয়াংচুক, গবেষক উমর খালিদ বিনা বিচারে বন্দি থাকেন। হাথরস, উন্নাও, বঁদায়ুঁ-এর বর্বর ও ভয়ঙ্করতম ধর্ষণেও দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসক আশ্চর্যরকম নীরব থাকেন। মণিপুরে নারীকে নগ্ন করে ঘোরানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেও তিনি স্বভাবসিদ্ধভাবে মৌন থাকেন। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও বিজ্ঞাপন নয়, মুখোশ হয়ে যায়। আড়ালের মৌনতা দেখিয়ে দেয় আসল চেহারাটা। রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসকের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ, মুখোশহীন। ফলে “সাজানো ঘটনা”, “ছোট ছোট ছেলেরা দুষ্টুমি করে ফেলেছে”, “বয়ফ্রেন্ড ছিল— প্রেগন্যান্ট হতে পারে”, “রাত করে মেয়েদের বাইরে যেতে দেওয়া উচিত নয়”— এই কথামৃতে তাঁর অবস্থানটা বুঝে নিতে কোনও অসুবিধেই হয় না। অথচ ক্ষমতায় ওঠার সিঁড়িতে পুলিশভ্যানে ধর্ষিতা মূক-বধির মেয়েটাও ছিল। ক্ষমতার স্বাদ মুখে লাগলে লিঙ্গচেতনা, নারী হিসেবে সমানুভূতি বর্জিত হয় কুখাদ্যের মতো। দিদির রাজ্যে দুষ্টু ভাইদেরই রাজত্ব— সরকারি প্রশাসনের সমান্তরাল দলীয় প্রশাসনের স্তম্ভস্বরূপ তারাই। সেই কাঠামোতেই কলেজ-না-পাশ করা ছাত্র অস্থায়ী কর্মী হয়ে থেকে যেতে পারে সহজেই। কতটা বরাভয় থাকলে, স্পর্ধা কতদূর বাড়লে, ছাত্রনেতা— থুড়ি, চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী শিক্ষা-কর্মী— কলেজ (আইন) প্রাঙ্গণের মধ্যেই ধর্ষণ করবার সাহস পেতে পারে? নৈরাজ্য কোন পর্যায়ে গেলে সরকারি হোমগার্ড (শাসকদল-ঘনিষ্ঠ) সরকারি চিকিৎসককে প্রহার করে ধর্ষণের হুমকি দিতে পারে? এ দুঃসাহস একদিনে আসে না।

 

এই মে মাসেই মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া জেলায় এক পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী আদিবাসী নারী ধর্ষিতা হন তাঁরই অর্ধেক বয়সী দুই প্রতিবেশীর দ্বারা। পাড়ারই এক মেয়েকে এগিয়ে দিতে গিয়ে যাদের একজনের বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। ধর্ষকের মা সকালে তাঁকে যখন আবিষ্কার করেন, তিনি নিস্তেজ— তাঁর অন্ত্র বেরিয়ে এসেছে যোনির বাইরে। সেই সময় তাঁকে হাসপাতালে নয়, নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে, যেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

হাঁসখালিতে ধর্ষিতা কিশোরীটি রক্তে ভেসে গেলেও তার মা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি; বরকেই বলেননি, ‘লজ্জায়’। খবরের কাগজে না ওঠা উত্তরপ্রদেশের এক ঘটনায়, একটি মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে বিষ খেলে তার বাপের বাড়ির লোকেরা বাড়ি নিয়ে আসার পথে তার মৃত্যু হয়। বাড়ির বদলে ‘দেহ’ তখন যায় শ্মশানে। দায়িত্ব শেষ।

মানুষ যদি নারী হয়, মূল্যে সে এতটাই খাটো যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অধিকার সিলেবাসের বাইরেই থেকে যায়। গ্রাম পেরিয়ে শহরে ঢুকলেও ছবিটা তেমন বদলায় না। তাঁর শ্রমের মূল্য কম, কিংবা স্রেফ নেই— সেজন্য তাঁরও মূল্য কম, কিংবা স্রেফ নেই। দেহ তাঁর গুরুত্ব পায় অন্যভাবে। ৫৮-র প্রৌঢ় যখন ১৮-র স্তন জরিপ করেন ২৮-এর সামনে, বলেন— “সব মেয়েই কারও না কারও মেয়ে, আমার তো নয়”— তখন প্রবাহিত হয় দর্শন ও সংস্কার, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। অথচ স্তনের উপাস্য হওয়ার কথা ছিল, জীবনরসের উৎস যা, তার হওয়ার কথা ছিল শ্রদ্ধার্হ। নদী যেখানে মা, স্তন সেখানে শুধুই যৌন খেলনা। সৃষ্টিতে পার্বতীদের যোগদান পঁচানব্বই শতাংশ হলেও পূজিত হয় শুধু একা শিবলিঙ্গ। কিন্তু তার ধারক পার্বতী-যোনি থেকে যায় অনুল্লেখিত— স্রেফ নেই।

এবার আসা যাক মুলতবি রাখা প্রশ্নটিতে— কেন? গবেষণা, উচ্চশিক্ষা, কর্পোরেট কিংবা অভিনয়জগতে— সবখানেই মেয়েদের একটা অতিরিক্ত বিনিময়মূল্য চোকাতে হয়। কেন? মেধাবী, বিদুষী, শিল্পী, গুণী, প্রতিভাধর— এভাবে কাউকে বলতে গেলে আগে তাকে মানুষ হিসেবে ভাবতে হয়। কিন্তু মনন আর উচ্চতা পাঁচ ইঞ্চিতে আটকে থাকা পুরুষের চোখে নারী কেবলই এক দেহ— একটা যোনি আর দুটি স্তন। এর বাইরে আর কিছু নেই, স্রেফ নেই। মেধা, যোগ্যতা, সম্ভাবনা— সবই অদৃশ্য থেকে যায় সেই পাঁচ ইঞ্চির চোখের দৃষ্টিপথে।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়— বছর তিনেক আগে, এই কলকাতা শহরের তিলজলায় সাত বছরের একটি মেয়েকে প্রতিবেশী নিজের সমস্যার সুরাহার জন্য তান্ত্রিকের পরামর্শে বলি দিতে গিয়েছিল। বলি দেওয়ার আগে অবশ্য একটু ধর্ষণ করে নিয়েছিল। সে গল্পটা সবাই জানে— যেটায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আঙুল কেটে গিয়েছিল দেখে গোপাল ভাঁড় “ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন” বলায় রাজামশাই খেপচুরিয়াস হয়ে গোপাল ভাঁড়কে জেলে পোরেন। তারপর নিজে জঙ্গলে মৃগয়া করতে গিয়ে ডাকাতের হাতে ধরা পড়েন। মহারাজের নধর স্বাস্থ্য দেখে দস্যুরা বেজায় খুশি হয়ে তাঁকে দেবীর সামনে বলি দিতে যায়। কিন্তু বলি দেওয়া গেল না— কারণ ওই কাটা আঙুল। খুঁতো আইটেম দেবীর শ্রীচরণে উৎসর্গ করা যায় না। তান্ত্রিক রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান থাকবার প্রয়োজন নেই; ছোটবেলায় গোপাল ভাঁড়ের এই গল্পটা যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা ভেবে দেখলে বুঝতে পারতেন তন্ত্রসাধনার গল্পটা এখানে কতটা হাস্যকর রকমের অসাড়। সাত বছরের কচি বাচ্চার অগঠিত যৌনাঙ্গ উপযুক্ত নয় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের যৌনাঙ্গ ধারণ করবার। রক্তপাত হবেই, ক্ষত হবেই। আর খুঁতো আইটেম দেবীর সামনে বলি দেওয়া যায় না। সে-সময় মানুষের মনে, তথা ফেসবুকে, আলোড়ন ফেলেছিল খাস কলকাতার বুকে এমন তান্ত্রিক আচরণ পালনের খবর। সৃজনশীল মানুষের প্রতিক্রিয়াশীল কলম ক্ষোভ ঝরিয়েছিল সামাজিক মানুষের ওই পেছনপানে হাঁটা নিয়ে। তীক্ষ্ণ ব্যথা একসময় যেমন ভোঁতা হয়ে যায়, প্রতিদিনের যন্ত্রণা একসময় যেমন সয়ে নেওয়া যায়, তেমনিই কি কাগজে নিত্যনৈমিত্তিক ধর্ষণের খবর মানুষের মনে আর কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করে না? সাত বছরের শিশুকেও যখন ধর্ষণ করা হয়, তাতেও না? ছোট্ট শরীরে বিভীষিকা চালিয়ে তাকে দু-হাতে গলা টিপে মারলেও না?

যে সমাজে শিশুর ধর্ষণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কুসংস্কার, সে সমাজে এমনটা তো হওয়ারই কথা—বারবার হওয়ার কথা। বানতলা গণধর্ষণের ঘটনায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঠিক এই কথাই বলেছিলেন— “এমনটা তো হয়েই থাকে।” সেই অসংবেদনশীলতার পুনরাবৃত্তি পরবর্তীকালেও দেখা গিয়েছে বারবার। এই ঘটনা তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কোনও কোনও ঘটনা যখন বীভৎসতায় বিশেষ হয়ে ওঠে, তখন নাগরিকের হাতে হাতে মোমবাতি জ্বলে ওঠে— বারাসাত থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত গড়ে ওঠে মানবশৃঙ্খল। বাকি ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা, অবিশেষ সাধারণ নির্যাতনের বেলায় খবরের কাগজের পাতা উল্টে যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যুতে র‍্যাগিং নিয়ে আলোচনা, ধিক্কার হয় সারা দেশ জুড়ে; কিন্তু পেছনে পড়ে থাকে তার সঙ্গে লাগাতার হয়ে চলা যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলি। ১৪০ কোটির দেশে যৌনতা নিয়েই যখন অস্বস্তি, তখন যৌন হিংসা আলোচনার পরিসরের বাইরেই থেকে যায়। পুরুষের প্রতি হলে দ্বিগুণ ঘা লাগে পুংজাত্যাভিমানে— তাই বোধহয় সেখানে অপার নৈঃশব্দ্য।

কেন পুরুষ (ক্ষেত্রবিশেষে নারী) ধর্ষণ করে, সেটা হয়তো মনোবিদ বা সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার ক্ষেত্র। এটা মনে করা যেতে পারে, উল্টোদিকের মানুষটির মতামত বা অনিচ্ছেকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলেই সে মনে করে না— বলেই করে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ আর অন্য মানুষটিকে, কখনও বা একটা গোটা শ্রেণিকেই, তুচ্ছ জ্ঞান করার শিক্ষা মানুষ রাতারাতি পায় না।

দশ বছর বয়সী ফুলমণি দাসীর মৃত্যু হয়েছিল ফুলশয্যার রাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জেরে। সে অবশ্য ছিল ১৮৯৮ সাল। এখন মেয়েদের বিয়ের বয়স বড্ড বেড়ে গিয়েছে। কাজেই এমনটা তো হতেই পারে! সামাজিক দর্শন কেমন হলে চোখ শিশুর মুখের স্নিগ্ধতা পেরিয়ে যোনির গভীরতা খোঁজে! নারীকে তার ধী, প্রজ্ঞা, বিদ্যা, ব্যক্তিত্ব বাদ দিয়ে শুধু দৈহিক সৌন্দর্য দিয়ে মাপা— ‘প্রকৃত সুন্দরী’, ‘ফর্সা’, ‘ঘরোয়া’— নারীর এই পণ্যায়ন একদিনের নয়। এ যুগযুগান্তের প্রাচীন এমন এক শিক্ষা, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে বাহিত হয়ে আসছে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে। আর তার শরিক মেয়েরাও। রূপ নিয়ে তাঁদের সচেতনতা, উদ্বেগ— কতটা তাঁদের নিজের, আর কতটা সমাজের গড়ে দেওয়া, তা কোনও ফর্মুলায় ফেলে মাপা যাবে না। দ্বিতীয়টা থেকেই প্রথমটার জন্ম।

কাব্যে যে পরিমাণ শব্দ ব্যয় হয় নারীর রূপ, তার কেশ, তার বেশ নিয়ে— তার সিকিভাগও বরাদ্দ হয় না পুরুষের রূপ বা রং নিয়ে। তার কোমর, বক্ষ, পশ্চাৎদেশের সৌন্দর্য নিয়ে যে নিত্য আরাধনা, সেখানে পুংলিঙ্গের সৌন্দর্য নিয়ে কালি খরচ বিশেষ চোখে পড়ে না। পুরুষদের বর্ণনা যা পাওয়া যায়, তা সবই তার ফিটনেস, স্ট্যামিনা— এক কথায় বল প্রকাশ করে। ‘অবলা নারী’ শব্দযুগল যেখানে একে অপরের পরিপূরক, ‘নির্বল পুরুষ’ শুনলেই কেমন হাসি পায়— যদি না তা বিশেষ কোনও জাতি বা শ্রেণি নির্দেশ করে। কারণ বল— দৈহিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক— যে রূপেই আসুক না কেন, তা পুরুষেরই করায়ত্ত থেকেছে চিরকাল। ইহাই পিতৃতন্ত্র।

এই তন্ত্রে পুরুষের থাকবে শৌর্য, বীর্য, দর্প, ক্ষমতা; নারীর থাকবে লজ্জা, কমনীয়তা, বিনম্রতা, অসহায়তা। পুরুষের হবে অধিকার, নারীর হবে সমর্পণ। নারীর ভূমিকা এখানে সুনির্দিষ্ট— বংশবিস্তারের মাধ্যম, বংশপ্রদীপগণের পালক, পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতির বাহক।

জাতককথায় আমরা পাই, দাসী, গরু, স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও সুন্দরী রমণী উপঢৌকন হিসেবে দান করা হচ্ছে। দাসী ও রমণী আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ তাঁদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও ব্যবহারভূমি। রমণ করেন যিনি, তিনিই রমণী। উল্টো প্রতিশব্দ বাংলায় খুঁজে পাওয়া যায় না। পুরুষের সে ভূমিকা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। রমণীকে হতে হয় আকর্ষক, সুন্দরী। সময়ের সারণি বেয়ে এ ধারণা ক্রোমোজোমের গভীরে এমন সেঁধিয়েছে যে বৈষম্য বলে একে চেনা দায়। প্রবাদে, কথকতায়, ছড়ায়, মিমে যুগে যুগে মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তিকে, সত্তাকে খাটো করা হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে— দৈনন্দিন জীবনের সেক্সিজমে অন্য এক তন্ত্রধারায়। পিতৃতন্ত্র— যার প্রচ্ছন্ন শরিক কমবেশি সকলেই।

মানুষ পুরুষ বা নারী হয়ে জন্মায় না— গড়ে ওঠে। যে-পরিসরে মানুষের বেড়ে ওঠা, প্রতিনিয়ত শেখা, বদল প্রয়োজন সেই পরিসরেই। আর সে পাঠ শুরু করতে হবে একেবারে শুরু থেকেই— প্রাথমিক স্তর থেকে। মেয়েদের শেখাতে হবে নিজেদের মূল্য বুঝতে, অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হতে, না পেলে আদায় করে নিতে। ছেলেদের শেখাতে হবে— যাঁরা তাঁদের পালন করেন আজীবন নানা রূপে, প্রয়োজনে শুধু তাঁদের পাশে থেকে, সমব্যথী সঙ্গী হতে। এটুকু হলেই, মেয়েদের ‘রক্ষা করার’ প্রয়োজন একদিন ফুরিয়ে যাবে।


*ভেতরের ছবি লেখকের আঁকা