
স্বাতী ভট্টাচার্য
পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে (কিংবা কর্পোরেট-সরকার স্যাঙাৎতন্ত্রের বিরুদ্ধে, অস্বচ্ছ প্রশাসনের বিরুদ্ধে) নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়তে হবে। তা বলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা ‘আসল’ থেকে ‘এলেবেলে’ হয়ে যায় না। ‘শোষণ কেবল মেয়েদেরই হচ্ছে না, পুরুষদেরও হচ্ছে, তাই ব্যাপারটা মেয়ে-পুরুষের নয়’ এ কথা বলার সময় পুরুষরা ধরেই নিচ্ছেন যে কাজের শর্ত, কাজের সময়, ছুটি, ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন পরিবেশ, এমন নানা বিষয়ে মেয়েদের অভিজ্ঞতা পুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা নয়। মেয়েদের প্রতি যে সব অন্যায় হচ্ছে, তার কোনও বাড়তি মাত্রা নেই
যে মেয়েরা লেখালিখি করেন, তাঁদের নিয়ে একবার একটা ‘রিট্রিট’ হয়েছিল। গঙ্গার পাশে একটা ছোট রিসর্ট, সেখানে আলোচনা, খাওয়াদাওয়া, হইচই। তো তার একটা সেশনে নবনীতা দেবসেন (তখন টপ ফর্মে) গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন। “সে বার তো দীঘায় একটা কবিতা সম্মেলন হল। তার কিছু দিন পরে কলকাতায় মহাশ্বেতাদির সঙ্গে দেখা। মহাশ্বেতাদি আমায় ডেকে বললেন, ‘নবনীতা শোনো, তুমি নাকি— দীঘার বিচে— অমুকের সঙ্গে— অ্যাঁ?’” সেই “অ্যাঁ” এমন উচ্চারণ করেছিলেন নবনীতাদি, যে ঘরশুদ্ধু মেয়ে হেসে লুটিয়ে পড়েছিল।
যারা বলে নারীবাদীরা নাকি সর্বদা চটিতং, কেবল রেগে রেগে, তেড়ে তেড়ে ওঠে, তারা কিস্যু জানে না। নারীবাদী মেয়েদের হাসি থামেই না। “স্বাধীনতার একটা লিমিট আছে,” শুনে খিক খিক করে হাসে। “আমি তো বউকে কাজ করতে অ্যালাউ করেছি,” শুনে ফিক ফিক করে হাসে। তবে একেবারে হা হা করে অট্টহাসি হাসে যখন শোনে, পুরুষতন্ত্রটা ‘আসল’ সমস্যা নয়। ‘আসল’ ব্যাপারটা কী, মেয়েরা ধরতেই পারেনি।
যেমন, এ-বছর নারী দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত একটা পোস্টারে লেখা হয়েছিল, মেয়েরা কেন কল-কারখানায় আট-দশ বছর কাজ করেও স্থায়ী কর্মীর পদ পাচ্ছেন না? তাতে একজন সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করেছন, মালিকশ্রেণির নয়া কৌশল, পুরুষদের বিরুদ্ধে কথা বলতে প্ররোচিত করা, এমনভাবে বিষয়টা উপস্থাপিত করা যাতে শোষণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা মানুষ ভুলে যায়, নারীরা পুরুষতন্ত্রকে দায়ী করে। তাতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিকশ্রেণির উদ্দেশ্য সফল হবে। আর একজন লিখেছেন, “নারীমুক্তির যথার্থতা লুকিয়ে আছে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদের মধ্যেই।”
এ-কথাগুলো একটুও মজার নয়, বরং একশো বছরের বাসি হওয়ায় কানের ভিতর ঢুকলে নাকে কেমন হেজা-মজা গন্ধ ধাক্কা মারে। আদ্যন্ত মজার হল এই বুঝিয়ে বলার চেষ্টাকে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ম্যানস্প্লেনিং’। পুরুষতন্ত্র ব্যাপারটা এক মস্ত ধাপ্পা, বোকাসোকা মেয়েদের (তার মধ্যে কয়েকটা আবার উল্টো-বোঝা নারীবাদী!) কাছে তা ব্যাখ্যা আর কে করবে, পুরুষ ছাড়া! ব্যাখ্যা করার ঝোঁকে বেচারিরা খেয়াল করল না যে, এই ‘ম্যানস্প্লেনিং’ কিন্তু পুরুষতন্ত্রের টিপসই। মহিলাশ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের জন্য পুরুষতন্ত্র দায়ী হতেও পারে, সে সম্ভাবনাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব কেউ দেননি। মেয়েদের প্রতি কোনও প্রশ্নও নেই তাঁদের— কেন আপনারা পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে না লড়ে পুরুষতন্ত্রের কথা তুলছেন? প্রতিটি মন্তব্য দ্বিধাহীন— ‘আপনারা ভুল বুঝেছেন। আসল ব্যাপারটা হল…’
এই ‘আসল’ কথা আবার বদলে বদলে যায়। যেমন, শ্রেণিমুক্ত সমাজ এলে সবাই সমান হবে, তার আগে পুরুষ-মহিলা সাম্য নিয়ে খিটিমিটি করে লাভ নেই, কমিউনিস্টদের এ ছিল বাঁধা বুলি। নেহরু-গান্ধি বলতেন, স্বাধীনতার যুদ্ধে পুরুষ-নারী এক হয়ে লড়তে হবে, তার আগে মেয়েদের অধিকার দাবি করা মানে আন্দোলনে চিড় ঘটানো। আরও সম্প্রতি উন্নয়ন অর্থনীতির পান্ডারা বলেন, দারিদ্র্য কমাও, অপুষ্টি কমাও, প্রসূতিমৃত্যু কমাও, মেয়েদের রোজগারে যুক্ত করো, পুরুষতন্ত্র টিকটিকির ন্যাজের মতো খসে পড়বে।
মেয়েরা নিজেদের জীবন দিয়ে জানে, অসাম্য অমনি ঘোচে না। ধনী-গরিব যতটা ‘আসল’ বিভাজন, ততটাই ‘আসল’ পুরুষ-নারী বিভাজন। এ কেবল দেহের ভিন্নতা নয়, এ হল ক্ষমতার তারতম্য। যেমন শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ব্রাহ্মণ-দলিত। কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা দলিতদের মধ্যে দারিদ্র্য বেশি, তাদের উপর অপরাধের হার বেশি, আবার তারাই অপরাধী হয়ে জেল খাটে বেশি। এ সব কালোদের, দলিতদের চরিত্রের দোষগুণের জন্য নয়। তারা কালো বলে, দলিত বলে। পুরুষ-মহিলা বৈষম্যও তেমনই মৌলিক, মানবসভ্যতার সমান তার বয়স। ‘মাতৃতন্ত্র’ একটা মিথ, কোনও কোনও সমাজে মায়ের সূত্রে সম্পত্তির হয়তো মেলে। কিন্তু সম্পদের নিয়ন্ত্রণ থাকে দাদু আর মামাদের হাতেই। পুরুষ-নারী বৈষম্যকে অপর কোনও বিভাজনে, বৈষম্যে ভেঙে মিশিয়ে দেওয়া যায় না। পুঁজিতন্ত্রের চাইতে ঢের প্রাচীন পুরুষতন্ত্র। যার আরও যথার্থ নাম, নারীবিদ্বেষতন্ত্র।
এই নারীবিদ্বেষ বা ‘মিসোজিনি’-র তিনটি স্তর রয়েছে, বলছেন দার্শনিক শেফালি মৈত্র, তাঁর ‘ফেমিনিস্ট থিয়োরি: সাম কনটেমপোরারি ডিবেটস’ (নারীবাদী তত্ত্ব: কয়েকটি সমসাময়িক বিতর্ক) বইটিতে। সম্প্রতি-প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি বলছেন, নারীবিদ্বেষের তিনটি স্তর রয়েছে। এর প্রথমটি ‘সেক্সিজ়ম’— এমন কথা বা আচরণ যেখানে মেয়েদের ছোট করে দেখা হয়, পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্কুলবেলার এক মেয়ে বন্ধু দুঃখ করত, তার দাদার পাতেই মা সব ভাল ভাল খাবার দিত। মেয়েটির পাতে পড়ত কী? “দইয়ের তলা আর মুরগির গলা।” সন্ধের মধ্যে মেয়েদের বাড়ি ফিরতে বলা, জোরে কথা বলা বারণ করা, এমন আপাত-সাধারণ আচরণও ‘সেক্সিজ়ম’— লিঙ্গবৈষম্যে দুষ্ট।
দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে পিতৃতন্ত্র (প্যাট্রিয়ার্কি)— দেশের রীতিনীতি, প্রথা, প্রতিষ্ঠান, সবই যখন পুরুষের আধিপত্যকে সমর্থন করে। তাতে মেয়েদের অধীনতা ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে। জামাইষষ্ঠী থেকে ভাইফোঁটা, মেয়েরাই উপোস করে পুরুষদের ভুরিভোজ করায়, তাতে কারও খটকা লাগে না। যৌন হয়রানির নালিশ করতে গেলে মেয়েটির নিজের মা থেকে থানার পুলিশ কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। কারণ পুরুষের কথার ওজন বেশি। মেয়েদের ‘না’-এর আবার কী দাম? মেয়েটি কে, তার ধ্যান-ধারণা, পছন্দ-অপছন্দ কেমন, সে সব প্রশ্নই ওঠে না। সে মেয়ে, সেই অনুসারেই তার স্থান, তার প্রতি প্রত্যাশিত ব্যবহার নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। পিতৃতন্ত্র পুরুষকেও বাধ্য করে আধিপত্যকারী, এমনকি অত্যাচারীর ভূমিকা নিতে। পুরুষ-নারীর পার্থক্যকে আচার-বিচার, রীতি-রেওয়াজ দিয়ে একেবারে গেঁথে দেয় পিতৃতন্ত্র।
তারও পরে, অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে, বিমূর্ত ধারণার স্তরে যা কাজ করে, তা হল পুরুষ-কেন্দ্রিকতা (অ্যান্ডোসেন্ট্রিজ়ম)। পুরুষ বুদ্ধিচালিত, আর মেয়েরা আবেগচালিত, পুরুষ শক্তি প্রয়োগের কাজ ভাল পারে আর মেয়েরা পরিচর্যার কাজ ভাল পারে, পুরুষ কঠোর-স্বভাব আর মেয়েরা কোমল-স্বভাব, এই ধরনের পার্থক্যের নির্মাণ হয়। নানা সংস্কৃতিতে এই গুণগুলো হয়তো বদলে বদলে যায়, কিন্তু সর্বত্রই প্রথম বিকল্পটি, অর্থাৎ পুরুষের চারিত্রিক গুণটি উৎকৃষ্টতর বলে গণ্য হয়।
অনেকে প্রশ্ন করেন, কেন সব সময়ে এই দ্বৈতে আটকে পড়তে হবে? শরীরে নারী-পুরুষ যা-ই হোক, সমাজ-আরোপিত লিঙ্গপরিচয় যা-ই হোক, তারও পরে তো রয়েছে একটা মানবসত্তা। আমরা কি লিঙ্গ-নির্বিশেষে নিজেদের ‘মানুষ’ বলতে পারি না? মনুষ্যত্বের ‘নির্যাস’-কে (এসেন্স) প্রাধান্য দিতে পারি না?
নারীবাদীরা প্রশ্ন করেন, ‘মানুষ’ নির্ধারণ হয় যে গুণগুলো দিয়ে, সেগুলো কি সত্যই জেন্ডার-নিরপেক্ষ? অ্যারিস্টটল মানুষকে ‘বৌদ্ধিক জীব’ (র্যাশনাল অ্যানিমাল) বলেছিলেন, এই বুদ্ধিমত্তাই নাকি মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর থেকে পৃথক করে। তারপর থেকে এই সংজ্ঞাই সর্বাধিক ব্যবহৃত। কিন্তু অ্যারিস্টটলের ‘বুদ্ধি’ হল আবেগের বিপরীত। ফলে মেয়েদের জীবনবোধের অনেকখানিই বাদ পড়ে যায় মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা থেকে। অ্যারিস্টটল মেয়েদের ‘বিকৃত পুরুষ’ মনে করতেন, এবং দাস ও শিশুদের সঙ্গে মেয়েদেরও নাগরিকত্বের অধিকার খারিজ করেছিলেন। পিতৃতন্ত্র যখন মনুষ্যত্বের এমন একটা সংজ্ঞাকে স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ ‘সত্য’ বলে তুলে ধরে, তখন তা আসলে চেপে যায়, বা এড়িয়ে যায়, এই কথাটা যে ওই ‘সত্য’ ক্ষমতা-নিরপেক্ষ নয়। তাকে নির্মাণ করেছে ক্ষমতা, যা আছে পুরুষের হাতে। বিমূর্ত ধারণা, এবং তা দিয়ে গঠিত তত্ত্বের গভীরেও অনুসূত হয়ে রয়েছে বৈষম্যের ভূত। ইদানীং ভারতে যেমন হিন্দুত্ববাদীরা ‘ইউনিভার্সাল সিভিল কোড’ দিয়ে হিন্দুদের পারিবারিক আইন সব ধর্মের উপর চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, তেমনই পুরুষতন্ত্র ‘পুরুষালি’ বৈশিষ্ট্যগুলো ‘মানব’ বৈশিষ্ট্য বলে চালাতে চায়।
কঠোর-কোমল, দৃঢ়-নমনীয়, যুক্তিপ্রবণ-আবেগপ্রবণ, এই সব দ্বৈতকে পিতৃতন্ত্র কখনও দেখে দ্বন্দ্ব বলে, কখনও আবার পরস্পর পরিপূরক বলে। উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের পরে প্রথম কয়েক দশক মেয়েদের শিক্ষা, উত্তরাধিকার, নাবালিকা বিবাহ রদ, বহুবিবাহ রদ প্রভৃতির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের চেষ্টা কমে এল। তখন ঝোঁক এল ভারতের মহত্ত্বকে, হিন্দুর প্রাচীন গৌরবের বহমান ধারাকে গৃহের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করার (যেহেতু বাইরের জগতে তার বিশেষ চিহ্ন নেই, পাশ্চাত্যেরই আধিপত্য)। আর সেই গৌরবের ‘কাস্টডিয়ান’ বা রক্ষাকারিণী হিসাবে নির্দিষ্ট করা ‘গৃহলক্ষ্মী’-কে। এই নির্মাণ যেমন ভারতের রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তেমন নারীমুক্তির আন্দোলনকেও, কারণ এর মূল প্রোথিত রয়েছে ‘ভিন্ন কিন্তু পরিপূরক’-এর ধারণায়— নারী-পুরুষের চরিত্রে ও স্বাভাবিক ক্ষমতায় পার্থক্য রয়েছে, তাই সমাজে তাদের ভূমিকা আলাদা, এই ধারণায়। এতে এক ধরনের বেড়া বাঁধা হয় সমাজ-সংসারে— পুরুষের কাজের ক্ষেত্রে, প্রভাবের ক্ষেত্রে মেয়েদের ঢোকার কথাই নয়, এমনই একটা অনুশাসন তৈরি করা হয়। মেয়েরা বাইরে বেরোতে পারে, তবে ‘মেয়েদের উপযুক্ত’ কাজগুলোই করবে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় একে বলেছেন ‘নব্য পুরুষতন্ত্র’ যা সাবেকি হিন্দু সমাজব্যবস্থার মতো মেয়েদের অক্ষর-পরিচয়হীন, অন্তঃপুরে-আবদ্ধ পশুবৎ জীবন পালনে বাধ্য করে না। আবার পুরুষদের সমান স্থানও দেয় না। নারীকে পরিপূরক বা ‘কমপ্লিমেন্টারি’ করে মুখে ভদ্রতা বজায় রাখে, কিন্তু মেয়েদের সমানতা, স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করতে বললে চটে চতুর্ভুজ হয়ে ওঠে।
তাই সরলা দেবী চৌধুরাণী যখন কংগ্রেসের অধিবেশনের পাশাপাশি ন্যাশনাল সোশ্যাল কংগ্রেসে মেয়েদের নিজস্ব একটি সংগঠন তৈরির প্রস্তাব রাখেন (১৯১০), তখন কংগ্রেস নেতারা নখে-দাঁতে বিরোধিতা করেছিলেন। “দেখা যাচ্ছে, সমাজ সংস্কারকদের মধ্যেও পুরনো প্রথা সহজে মরে না,” লিখছেন সরলা। “তাই মনুর ছায়া যদি তাঁদের ঘাড়ে চেপে বসে থাকে, আর তার ফলে মেয়েদের ক্ষমতায় বিশ্বাস করার শক্তি তাঁরা কিছুতেই না জোটাতে পারেন, এবং মেয়েদের (স্বাধীনভাবে) গড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ রাখতে চান নিজেদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে, তা হলে তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ কী?” (মডার্ন রিভিউ, ১৯১১)
নারীর স্বতন্ত্র আন্দোলন নয়, যৌথ লড়াই— এমন প্রস্তাবে তাই প্রশ্ন জাগে, এ কি সত্যিই মেয়েদের অনুভূত সঙ্কটগুলির স্বীকৃতি, নাকি মেয়েদের আন্দোলনের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারানোর ইচ্ছা? রাতদখল আন্দোলনে যত পুরুষ নেমেছিলেন রাস্তায়, তাঁরা কতজন ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে এসেছিলেন, আর কতজন প্রতিবাদে আগ্রহী স্ত্রী-মেয়েকে আগলাতে এসেছিলেন, সে-প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। কেবল খটকা লাগে, ওই বিপুল সংখ্যক পুরুষ যদি নারীদেহে নারীর স্বাধিকারের প্রতি সম্ভ্রম-নম্র হত, তা হলে এই শহরটার চেহারাটা কি অন্যরকম হত না?
যৌথতা নিয়ে প্রশ্ন সম্প্রতি উঠেছিল, যখন নারী দিবস উপলক্ষে কয়েকটি নারী সংগঠন একত্রে একটি মিছিল বার করার সিদ্ধান্ত নেয় পয়লা মার্চ, ২০২৫। কেবল মহিলা আর ট্রান্স-কুইয়র মানুষরা হাঁটবেন মিছিলে, শুনে অনেকে (তাঁদের মধ্যে মেয়েরাও ছিলেন) প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন? সাম্যময় সমাজ কি কেবল মেয়েরা গড়বে? পুরুষরা মেয়েদের মিছিলের পিছনে হাঁটলে ক্ষতি কী? এ প্রশ্ন করলে মনে পড়ে বেচারি জেব্রার সেই প্রশ্ন— আমি কি সাদা ডোরা-আঁকা কালো প্রাণী? নাকি কালো ডোরা-আঁকা সাদা প্রাণী? পুরুষের মিছিলে কি মেয়েরা হাঁটছে? নাকি মেয়েদের মিছিলে পুরুষরা? মেয়েদের স্বতন্ত্র উদ্যোগকে সমর্থন করাও কি যৌথতার একটা প্রকাশ হতে পারে না?
পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে (কিংবা কর্পোরেট-সরকার স্যাঙাৎতন্ত্রের বিরুদ্ধে, অস্বচ্ছ প্রশাসনের বিরুদ্ধে) নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই লড়তে হবে। তা বলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা ‘আসল’ থেকে ‘এলেবেলে’ হয়ে যায় না। ‘শোষণ কেবল মেয়েদেরই হচ্ছে না, পুরুষদেরও হচ্ছে, তাই ব্যাপারটা মেয়ে-পুরুষের নয়’ এ কথা বলার সময় পুরুষরা ধরেই নিচ্ছেন যে কাজের শর্ত, কাজের সময়, ছুটি, ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন পরিবেশ, এমন নানা বিষয়ে মেয়েদের অভিজ্ঞতা পুরুষদের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা নয়। মেয়েদের প্রতি যে সব অন্যায় হচ্ছে, তার কোনও বাড়তি মাত্রা নেই। শেফালি মৈত্র বলছেন, এ-ও পুরুষ-কেন্দ্রিকতার একটা বৈশিষ্ট্য। ধরে নেওয়া হয়, পুরুষ রয়েছে কেন্দ্রে, বাকিরা প্রান্তে। কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত, তাই কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণই বৈধ। প্রান্তিক যারা, তারা যদি কেন্দ্রের কথার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেয় তো ভাল, অন্য কিছু বললে তা ‘এলোমেলো’ কথা, ‘এলেবেলে’ কথা বলে মনে হয়। এই কারণেই ট্রেড ইউনিয়নের কথার কেন্দ্রে বরাবর রয়েছে পুরুষদের দাবি— বেতনবৃদ্ধি, পিএফ-পেনশন। মেয়েদের দাবি— ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার, মাতৃত্বের ছুটি, যৌনহয়রানি থেকে মুক্তি, এগুলো কোনও দিন তেমন পাত্তা পায়নি। একবার তো চটকলের মেয়ে শ্রমিকদের যৌন হয়রানি বিষয়ক আলোচনায় যোগ দিতে সাত-আটটা ট্রেড ইউনিয়ন থেকে এসেছিলেন সাত-আটজন সাদা-মাথা, টাক-মাথা পুরুষ। এর মধ্যে হাসির ব্যাপারটাও কেউ খেয়াল করেননি, গোটাকতক নারীবাদী ছাড়া।
শেফালি মৈত্রের বইখানি নারীবাদী দর্শন ও রাজনীতির একটি বহুস্তরীয়, গভীর কিন্তু ঝরঝরে, স্বচ্ছন্দ-পাঠ বই। এই লেখায় তার প্রাথমিক ক-টা সূত্র ব্যবহার করা হল কেবল। এটুকু বোঝাতে যে, পুরুষ-মেয়ে একই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ালেও পুরুষ-মেয়ের সমস্যা এক না-ও হতে পারে। মানে, একটা চান্স তো থেকেই যায় যে মেয়েরা নিজেদের মতো করে দেখে, ভেবে, কিছু একটা বলার মতো কথা খুঁজে পেয়েছে। পুরুষতন্ত্র কি পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে পারে না নাকি, অ্যাঁ? তাই বলি কি, ‘আপনি আসল কথাটা ধরতে পারেননি’ না বলে, একবার ওই কর্মক্লান্ত, সতত-প্রতারিত, নিত্য-লাঞ্ছিত শ্রমিক মেয়েটিকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করুন না, ‘দিদি, আসল কথাটা কী?’ এমন খোলা-মন কিছু প্রশ্নই হোক নারী দিবসের উপহার।