
প্রতিভা সরকার
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের প্রাক্কালে আমার একান্ত আশা ভণ্ড সমাজের গালে চপেটাঘাত করে যৌনকর্মীরা শ্রমিকের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাক, যতটুকু আলো পেলে মানুষ-গাছ শত বিরূপতার মধ্যেও বেঁচে থাকার আনন্দ খোঁজে, অন্তত ততটুকুর নাগাল তারা নিজের শক্তিতেই পেয়ে যাবে!
তার নাম ছিল হীরা। চাকচিক্যহীন মাঝবয়সী এক মহিলা, প্রসাধন নেই বলে মুখের ভাঁজে বয়স আরও প্রকট। সত্যি কথা বলতে কী, তাকে আমার একটুও আকর্ষণীয় লাগেনি, তার শরীর কারও কাছে কাম্য হতে পারে, এটা একেবারেই মনে হয়নি। মেচেতার দাগে ভর্তি মুখ আর বুড়িয়ে যাওয়া এক শরীর!
আমি বরং চমকে উঠেছিলাম তার ডায়েরি দেখে, মুক্তাক্ষরে লেখা নিজের জীবনকাহিনি, বানান অনেক ভুল, কিন্তু লেখার বাঁধুনি চমৎকার, আর হস্তাক্ষর এতটাই সুন্দর যেন এইবার তার নামের সার্থকতা আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হলাম।
পাতার পর পাতায় আমি পড়ে যাচ্ছিলাম, কীভাবে মৃত স্বামীর এক বন্ধু হীরার সঙ্গে জোর জবরদস্তি করত। সেলাইমেশিন চালিয়ে পেটও ভরে না, ওদিকে সদ্য গোঁফ-গজানো ছেলে মা-কেই দোষী ঠাউরে গৃহত্যাগী হল। হীরা ভাবল, বিনে পয়সার এই নিত্যকার সওদার থেকে সে পালাবেই পালাবে। ট্রেনে চেপে সোজা কলকাতার সোনাগাছি।
আরও কিছু নিশ্চয়ই বলত সে, কিন্তু তখনই একজন এসে খবর দিল, হীরার বাঁধা কাস্টমার এসেছে। তখন করোনার ভয়ে শুকিয়ে মরার দিন, মুহূর্তের মধ্যে হীরা আমার হাত থেকে ডায়েরি টেনে একছুটে ধাঁ। যেটুকু সময় পেয়েছিলাম তাতে একটি লাইন আজও ভুলিনি,
আমাদের গাছের পাতার মতো জীবন। কাল হলুদ হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিলে কত নিষ্ঠুর জুতো আমাদের পিষে দিয়ে যাবে!
তারপর দু-একদিন ও-পাড়ায় গেলেও হীরার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। যৌনকর্মীদের সন্তানের জন্য আপনে আপের পাঠশালা তখন প্রায় উঠি উঠি। বেবি হালদার শুকনো মুখে অন্য কাজের খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। প্রিয় বন্ধু টিঙ্কু খান্না আমাকে বাচ্চাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য বেবির সঙ্গেই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। সেই বেবিই কোনও কাজ না পেয়ে দিল্লিতে ফিরে গেল। অনেক পরে যখন সে ফিরে এল, তখন বেবি খুবই অসুস্থ। স্কুলও আর খুলেছে বলে খবর পাইনি।
ডঃ স্মরজিৎ জানা বেঁচে থাকতে দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে যাওয়া, যৌনকর্মীদের মিছিলে হাঁটা, সেমিনার ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়া, অর্থ তোলা, সব কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম, এমনকি সেই সূত্রে বারুইপুরে জবালার কোলে জন্ম নেওয়া সত্যকামদের জন্য আবাসিক স্কুল রাহুল বিদ্যাপীঠেও গিয়ে সব দেখে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল সপ্তাহে একদিন ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের ক্লাস নেব। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর করোনার কালো ছায়া সে শুভ সঙ্কল্পকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। তবে কিছু মানুষ চেনা গেছে এই সূত্রে। মনে পড়ে, আমার কাছে সব শুনে বন্ধু মিতুল দত্ত এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও দু-চারজন দুর্বারকে করোনাকালে অর্থসাহায্য করেছিল। আবার অনেকে পত্রপাঠ বিদায় করেছে এই বলে, ওরা তো বিদেশি ফান্ড থেকে প্রচুর টাকা পায়। মুশকিল হচ্ছে আমাদের দেশের ধনাঢ্যরা বেওসায় লাভ করলে মন্দির তৈরি করে (সবাই নন), বিলিতি বড়লোকেরা তাও তো সামাজিক কল্যাণে কিছু অর্থ খরচ করেন।
অবশ্য যৌনকর্মীদের দুঃসহ অবস্থা কাটাবার জন্য কিছু করাকে সামাজিক কল্যাণ বলা যাবে কিনা, এই নিয়েই বিস্তর তর্ক। সে যাই হোক, কে কোথা থেকে টাকা পায়, এ আমার জানবার কথা নয়, জানবার চেষ্টাও করিনি। তবে এনজিওগুলোর ফান্ড ক্রমশ শুকিয়ে আসছে, তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান সিংহাসনে বসেই জনহিতকারী বরাদ্দ ছাঁটাই করলেন, এইসব খবর পেলেই আমার এই মেয়েদের কথা মনে হয়। বিশ্বরাজনীতির যা ঘোরালো অবস্থা তাতে আরও পাঁকে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া এদের আর কোনও উপায় নেই।
টাকা এরা নিজেরা যথেষ্ট উপার্জন করলেও, সে টাকা ফুরিয়ে যেতেও সময় লাগে না। নিজের ঘরভাড়া, খাবার, পোশাক এবং মেকআপ ছাড়াও লাগে গন্ডা গন্ডা ওষুধ এবং নেশার দ্রব্য। মল বা নর্দমা পরিষ্কার করে যারা, তারা যেমন নেশার ঘোর থাকতে থাকতেই কাজগুলো সেরে ফেলে, এরাও তেমন নেশা না করলে, মুঠো মুঠো ব্যথার ওষুধ না খেলে দিনে গড়ে জনা বিশেক খদ্দেরের আঁচড় কামড় সইবে কী করে! এ ছাড়া আছে গ্রামে নিজের সংসার প্রতিপালন, মা ভাই, সন্তান। নেহাত দায়ে না পড়লে সন্তানকে নিজের কাছে কেউ রাখে না, যাতে না রাখতে হয় সেজন্য রাহুল বিদ্যাপীঠকে অনেক প্রসারিত করার পরিকল্পনা ছিল ডঃ স্মরজিৎ জানার। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, বেশির ভাগ মেয়ে এই পেশায় “বাবু” রাখে। বাবু তার প্রেমিক, স্বামী, সন্তানের পিতা, বাউন্সার, অগতির গতি! বাবুর যাবতীয় খরচই শুধু নয়, অনেক সময় বাবুর সংসারের খরচও মেয়েটিকেই টানতে হয়। ধনী পুরুষ রক্ষিতা রাখে পয়সা খরচ করে কাম চরিতার্থ করবার জন্য, যৌনকর্মী বাবু রাখে নিরাপত্তা ও ভালবাসা নামে এক অদ্ভুত রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য। মর্ষকামী বিকারগ্রস্ত খদ্দের তাকে মেরে ফেলতে চেষ্টা করলে, কাছাকাছি থাকা বাবু-ই উদ্ধারকর্তা হয়, আবার সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময় বাবুর নাম বসে পিতৃপরিচয়ের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়। বাবু যৌনকর্মীকে ঠকিয়ে সর্বস্ব নিয়ে চম্পট দিয়েছে, এরকম কেস প্রচুর। এ এক অদ্ভুত জায়গা, যেখানে কোনও নীতি বা আদর্শের স্থান নেই, হয় মারো নয় মরো, এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ সকলেই। তবু তারই মধ্যে স্বপ্না নামে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে দেখেছি উলুঝুলু হয়ে কাঁদতে, কারণ তার বাবু কয়েকদিনের জন্য নিজের বাড়িতে গেছে। এই ক্ষণিক বিরহও তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে, যদি সত্যভামার বাহুবন্ধনেই তার শ্যাম থেকে যায়! যদি আর সে নাই-ই ফেরে!
তবু নানা প্রশ্ন তো উঠতেই থাকে, তথাকথিত বিলিতি সাহায্যের পর আসে নীতির প্রশ্ন, অনেকে নাক সিঁটকান, এই ঘৃণ্য কাজ মেয়েরা জেনেবুঝেই তো করে। না করলেই পারে। এ যেন বাড়িতে ভিক্ষে চাইতে আসা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষটিকে বলা, খেটে খেতে পারো না?
ও-পাড়ায় যত মেয়েদের দেখেছি, প্রত্যেকের জীবনে একটি কাহিনি আছে। সেটি মূলত দারিদ্র্যের এবং প্রতারণার কাহিনি। তার মধ্যে মিশে আছে নিজের একটি ঘর বাঁধার দুস্তর আশা, প্রেমকে একমাত্র বিনোদন এবং সর্বসুখের আকর হিসেবে দেখা, এবং এই দুই কারণে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর ফাঁদে পড়া। এ-কথা বলার মানে এই নয় যে কেউ স্বেচ্ছায় এ পেশা বেছে নেয় না। অবশ্যই নেয়, নাহলে পুজোর সময় সোনাগাছিতে যৌনকর্মী এবং কাস্টমারের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায় কেন! সুদূর নেপাল থেকেও মেয়েরা আসে কামুকের শারদীয় উৎসব সার্থক করতে। কিন্তু স্ব-ইচ্ছায় এ কাজ বেছে নেবে এইরকম প্রবণতা খুবই বিরল। তাদের সংখ্যা এই কাজে যুক্ত মোট মেয়েদের দুই পার্সেন্ট হবে কিনা সন্দেহ। তবে ইচ্ছেয় আসুক বা অনিচ্ছেয়, এই গলিঘুঁজিতে ঢুকে পড়লে পরে ফেরার পথ থাকে না কারওই। অতএব যে দ্বন্দ্ব চিরকালই আছে এবং থাকবে, তা হল এদের সামাজিক স্বীকৃতি। একদল বলেন, যৌনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া উচিত আর একদল মাথা নাড়েন, এইভাবে রোমান্টিসাইজ করে এই পেশা গ্রহণের জন্য নারীদের পরোক্ষে উৎসাহিত করা এবং সমাজের প্রত্যক্ষ সর্বনাশ করা উচিত নয়। মাঝখান থেকে সোনাগাছি এবং কালীঘাটের মেয়েরা এবং জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে নির্দিষ্ট মহল্লায় বাস করা এইসব মেয়েরা থেকে যায় যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই। পুনর্বাসনের নামে তাদের সামনে যে সমস্ত প্রকল্প রাখা হয়, তাদের অবস্থা অতি করুণ। বিনে পয়সায় সেলাই মেশিন দেওয়া হল হয়তো, কিংবা কোনও সরকারি প্রজেক্টের অংশ করে নেওয়া হল, যেমন ধরা যাক সেন্সাসের কাজ। বা বাড়িতে বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী খোঁজার কাজ। এইসব করে তার যা মাসিক আয় হবে, সোনাগাছিতে একদিনেই তার ডবলের অনেক বেশি ইনকাম অসম্ভব নয়। আর এখন তো সবই কন্ট্রাকচুয়াল কর্মী, নিশ্চিত মাইনের ভরসা কারই বা আছে। কাঁচা পয়সার ঝনঝন, তার বিশেষ গন্ধ, ক্রয়ক্ষমতা, সব কেড়ে নিয়ে তাকে নীতিকথা শোনালে মেয়েটি শুনবে?
সবচেয়ে বড় কথা স্বাধীনতা। আমরা তাকে স্বৈরিণী বলতেই পারি, কিন্তু যে স্বাধীনতা সে ভোগ করে, বেশিরভাগ নারীর তা অধরা। নিজেকে ধ্বস্ত করে সে ইচ্ছেমতো উপার্জন করতেই পারে, সেই টাকা খরচও করতে পারে নিজের ইচ্ছেমতো। তাছাড়া পুনর্বাসিত জীবনে তাকে যে আবার হেনস্থা হতে হবে না, এই গ্যারান্টিই বা তাকে কে দেবে। “লাইনের মেয়ে” পুনর্বাসিত হলেও সুযোগ নিতে চাইবে না লম্পটেরা? যে পেশা সে পরিত্যাগ করতে চেয়েছে, তার পারিশ্রমিকহীন পুনরাবৃত্তি সে মেনে নিতে পারবে? এইসব কারণেই বোধহয় সোনাগাছির মেয়েদের পুনর্বাসনের কথা বললে বিগতযৌবনা বসে যাওয়া মেয়েরা ছাড়া আর কেউ ভাল করে শোনেও না। তারা ভাল করেই জানে অলীক স্বপ্নের পেছনে দৌড়ে লাভ নেই।
অথচ মেধা, বুদ্ধি, শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতার অভাব নেই। দুর্বারের তিল তিল করে গড়ে ওঠা সাংগঠনিক ব্যবস্থায় সোনাগাছির প্রতিটি মেয়ে জানে এইডস বা অন্যান্য যৌন রোগ আটকাবার জন্য কী করতে হবে। খদ্দেরকে কন্ডোম ব্যবহারে বাধ্য করতে শিখিয়েছিল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, নিয়মিত রক্তপরীক্ষার উপকারিতার কথা প্রত্যেক মেয়ে জানে, পুলিশ ও রাজনৈতিক অত্যাচার অনেক কমে এসেছিল আর বন্ধ হয়েছিল সোনাগাছিতে নাবালিকাকে জোর করে এই পেশায় নামানোর মতো ঘৃণ্য কাজ। খবর পেলেই দুর্বার মহিলা সমন্বয়ের মেয়েরা চলে গিয়ে নাবালিকাকে উদ্ধার করে তার নিজের ইচ্ছা জানতে চাইত। যদি মেয়েটি বাড়িতে ফিরে যেতে অসম্মত হয়, তাহলে সে প্রাপ্তবয়স্ক না-হওয়া অবধি দুর্বার তার সুরক্ষার ভার নিত আর সম্মত হলে সঙ্গে করে বাড়ি পৌঁছে দিত। অতীতকালের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করছি এই কারণে যে এখন দুর্বারে এই ব্যবস্থাগুলো রয়েছে কিনা আমার সঠিক জানা নেই। ডঃ জানার পরবর্তী সময়ে বহুবার আমন্ত্রণ পেয়েও যেতে পারিনি, সে আমার ব্যক্তিগত অপারগতা। কিন্তু একসময় মেয়েরা কত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে সে নিজের চোখেই দেখেছি। মনে পড়ে যাচ্ছে কমলাদির কথা। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা দুই নাবালিকাকে শেল্টারে দেখভাল করার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছিল। সেই বাচ্চা মেয়েদুটি ঘুমের মধ্যেই কমলাদির মাথা পিষে দেয় মশলা বাটবার নোড়া দিয়ে, তারপর পালিয়ে যায়। পরে অবশ্য তারা শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে ধরা পড়ে।
এই কমলা, হীরা, স্বপ্না, এই নামগুলি একটিও আসল কিনা আমি জানি না। কারণ এখানে গোপনীয়তার কারণে ছদ্মনাম নেওয়াটাই রেওয়াজ। এই করতে গিয়ে নাম-ঠিকানা সবই হারিয়ে যায়, তারপর ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়। ওদের তো নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের কোনও রাস্তা নেই। জন্ম বা স্কুলের সার্টিফিকেট থেকে থাকলেও তার সঙ্গে বর্তমান নাম-ঠিকানা কোনওটাই মিলবে না। বিয়ের আইনি কাগজ এবং তজ্জনিত সার্থকতা থাকলে সে এ-পাড়ায় থাকত না। বর্তমান নাম এবং ঠিকানায় আধার বা প্যান কার্ড আগে ভুজুংভাজুং দিয়ে করা সম্ভব হলেও দিনে দিনে নিয়মকানুনের ফাঁস গলায় এঁটে বসছে। সরকার বাহাদুর বেশি ইনকামে ট্যাক্স বসাতে দুবার ভাববে না, কিন্তু এদের অস্তিত্ব প্রমাণের সহায়ক কিছু করবে, সে দায় তার নেই। এইজন্য সিটিজেনশিপ প্রমাণ করা একজন যৌনকর্মীর পক্ষে দারুণ কঠিন কাজ। দুর্বারের নেতৃত্বে ওই সময় দলে দলে সোনাগাছির মেয়েরা আদালতে গিয়ে এফিডেভিট করছিল। স্রোতের বিরুদ্ধে খড়কুটো যা পাওয়া যায় তাই আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা। এই ঐক্যবদ্ধতাই ২০১৯ সালে করোনা শুরুর ঠিক আগে, আটই মার্চের সন্ধ্যায় কলকাতা শহরে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট থেকে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক অবধি যৌনকর্মীদের বিরাট মিছিল চলেছিল, এই বান্দাও সেই মিছিলে ছিল। তাদের গণসঙ্গীত, কোরাস নাচ, স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা শুনতে রাস্তার দুপাশে বিপুল জনতা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ছিল বারবার, “এসেছে সে একদিন/লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে/ না রাখে কাহারও ঋণ!”
এই স্বপ্ন যদি সফল হয়, তবে যৌনকর্মীদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর শপথ কিছুটা হলেও বাস্তবায়িত হবে।
কথায় বলে অকারণে পুলিশের মুখ খারাপ করার বদভ্যাসের টক্কর নিতে পারে একমাত্র যৌনকর্মীরাই। কথাটা সত্যি। অকারণে এবং অবলীলায় খিস্তি দিতে এদের সমকক্ষ আর কে! কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই জীবনের অসহ্য ক্লেদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এই তাদের এক অনায়াস ক্যাথারসিস। সবলের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে দুর্বলের জেহাদ।
এক ক্লেদজ কুসুমের কথা বলে শেষ করি। সে এক হিন্দিভাষী বালক। আপনে আপের স্কুলে এসে আমার কাছে কয়েকদিন ক্লাস করেছে। করোনার শুরুতে দুম করে মায়ের উপার্জন নেই হয়ে গেলে সে প্লাস্টিকের বালতি ফেরি করত এবং নানান পুলিশি অত্যাচারের কথা ক্লাসে এসে বলত। বার তের বছরের ছেলেটির এই অকাল অভিজ্ঞতা এবং ব্যাপক পরিশ্রমে দ্রব হওয়া ছাড়া আমার বা বেবির অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমি একদিন ভাবলাম, ওকে সাহায্য করার জন্য দুটি বালতি কিনে নিই। কিন্তু সে ছেলে আমার কাছ থেকে কিছুতেই পয়সা নেবে না, মিসের কাছ থেকে ছাত্র কী করে পয়সা নেয়! অনেক অনুরোধে সে মূল্য চোকাতে পারি। জানি না, বড় হয়ে সে ও-পাড়ার তরুণ যুবকদের অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য মেয়েদের দালালি করা শুরু করেছে কিনা। যদি নিরুপায় হয়ে করেও থাকে, জানি আজও যদি দেখা হয় সে তার মিসকে একইরকম সম্ভ্রম দেখাবে। আমিই তার জন্য কিছু করতে পারিনি, এই কষ্ট আমাকে আরও অনেক কিছুর মতোই কুরে কুরে খায়। এই ছেলের মা-কে আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু ছেলেকে এই ভদ্রতা, ভালবাসার শিক্ষা যে দিয়েছে তাকেও মনে মনে প্রশংসা না করে পারিনি। গলিগুলি নোংরা গালাগালি, কাদা, অর্ধনগ্ন নারীশরীর এবং লোলুপ পুরুষে পরিপূর্ণ। কিন্তু তার মধ্যেই কোথাও কোথাও লুকিয়ে আছে অপরিসীম মায়া, মমতা, মনুষ্যত্ব!
ইদানিং এই মেয়েদেরকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে দেখে আমি মর্মাহত। তাদের সংগঠন জোরালো হলে, ডঃ জানা বেঁচে থাকলে এরকমটা হতে পারত না, আমি নিশ্চিত। তাই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের প্রাক্কালে আমার একান্ত আশা ভণ্ড সমাজের গালে চপেটাঘাত করে যৌনকর্মীরা শ্রমিকের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাক, যতটুকু আলো পেলে মানুষ-গাছ শত বিরূপতার মধ্যেও বেঁচে থাকার আনন্দ খোঁজে, অন্তত ততটুকুর নাগাল তারা নিজের শক্তিতেই পেয়ে যাবে! গাছের পাতা প্রকৃতির নিয়মেই ঝরে যাবে, কিন্তু কোনও নিষ্ঠুর পা যেন তাদের পিষে দিয়ে যেতে না পারে।