Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চুপ করে বসে থাকলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না

সৌরভ প্রকৃতিবাদী

 


২০১০ থেকে FSI বলছিল— পাহাড় চেনার জন্য ঢাল দেখো, কমপক্ষে ৩ ডিগ্রি হলে আরাবল্লি। পরে টেকনিক্যাল কমিটি বলল ৪.৫৭ ডিগ্রি আর ন্যূনতম ৩০ মিটার উঁচু হলেই চলবে। তাতে আরাবল্লির প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা সুরক্ষা পেত। কিন্তু এখন সরকার বলছে, “না না, ১০০ মিটারের নিচে কিচ্ছু না।” এটা তেমন কথা যেন বা— ৫ ফুট উচ্চতার নিচে যারা আছে আজ থেকে তারা আর মানুষ না! এই ১০০ মিটারের হিসেবটা নিজেই ফাঁকি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা আর স্থানীয় উচ্চতা— দুটোকে গুলিয়ে দিয়েছে। একে বলে “height distortion”। এটা ইচ্ছেকৃত ফাঁকি, যাতে খনি আর রিয়েল এস্টেটের লোকেরা হাততালি দেয়

 

আরাবল্লির ৯০ শতাংশ পাহাড় এখন ‘অদৃশ্য’। ১০০ মিটারের ফর্মুলা, খনি লবি আর…

২০ নভেম্বর ২০২৫, সুপ্রিম কোর্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের রিপোর্ট গ্রহণ করেছে— যেটা থেকে মনে হচ্ছে যেন কেউ আরাবল্লির গলায় ছুরি চালিয়ে দিল। বলা হচ্ছে, এবার থেকে যে পাহাড় ১০০ মিটারের কম উঁচু, সেটা আর ‘আরাবল্লি’ বলে গণ্য হবে না।

মানে? মানে ১২ হাজারের ওপর টিলার মধ্যে মোটে ১০৪৮টা বেঁচে থাকবে, বাকি ৯১ শতাংশ পাহাড় হঠাৎ ‘পাহাড় নয়’ হয়ে যাবে! ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া (FSI) নিজেই বলেছিল এটা বিপজ্জনক, কিন্তু কে শোনে? থর মরুভূমির ধুলো আটকে দেওয়ার শেষ বাধা আরাবল্লির এই ছোট ছোট টিলাগুলো। এখন ওগুলোই চলে গেলে? দিল্লি-গুরুগ্রাম-ফরিদাবাদের আকাশ আরও কালো হবে, আমাদের বাচ্চারা আরও বেশি হাঁপাবে। আর খনি-মাফিয়ারা?

 

আগে কী ছিল?

২০১০ থেকে FSI বলছিল— পাহাড় চেনার জন্য ঢাল দেখো, কমপক্ষে ৩ ডিগ্রি হলে আরাবল্লি। পরে টেকনিক্যাল কমিটি বলল ৪.৫৭ ডিগ্রি আর ন্যূনতম ৩০ মিটার উঁচু হলেই চলবে। তাতে আরাবল্লির প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকা সুরক্ষা পেত। কিন্তু এখন সরকার বলছে, “না না, ১০০ মিটারের নিচে কিচ্ছু না।” এটা তেমন কথা যেন বা— ৫ ফুট উচ্চতার নিচে যারা আছে আজ থেকে তারা আর মানুষ না! এই ১০০ মিটারের হিসেবটা নিজেই ফাঁকি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড় উচ্চতা আর স্থানীয় উচ্চতা— দুটোকে গুলিয়ে দিয়েছে। মানে, একটা টিলা যদি সমুদ্র থেকে ১৯০ মিটার উঁচু হয় আর তার আশেপাশে সমতল থাকে ১০০ মিটার উঁচু, তাহলে ওটা আরাবল্লি নয়— কারণ নিজের জায়গা থেকে উঁচু মাত্র ৯০ মিটার! একে বলে “height distortion”। এটা ইচ্ছেকৃত ফাঁকি, যাতে খনি আর রিয়েল এস্টেটের লোকেরা হাততালি দেয়।

 

বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল খতম

গুরুগ্রামের ৯৫ শতাংশ আর ফরিদাবাদের ৯০ শতাংশ আরাবল্লি এখন আর ‘আরাবল্লি’ থাকছে না। ওই যে গুরুগ্রামের পেছনে যে ছোট ছোট টিলা দেখতে পাও, যেগুলোর ওপর বিল্ডাররা লোভের চোখে তাকিয়ে আছে দশ বছর ধরে— এবার ওগুলো ফ্রি। বালি, পাথর, মার্বেল, গ্রানাইট— সব বেরোবে। আর দিল্লির ধুলো? ওটা তো বোনাস।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক (MoEF&CC) সম্প্রতি একটা কম্পেন্ডিয়ামে রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাত আর দিল্লির ৩৪টা জেলাকে আরাবল্লি ল্যান্ডস্কেপের অংশ বলে চিহ্নিত করেছে— যেখানে বিশেষ ইকোলজিক্যাল আর ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আছে, সেগুলোকে রেস্টোর করার জন্য। যে জেলাগুলো বাদ পড়েছে তাদের মধ্যে অনেক জেলায় আরাবল্লির স্পষ্ট ভূতত্ত্ব, রিজ আর পাহাড় আছে, তবু বাদ দেওয়া হয়েছে। যেমন— চিতোরগড় (রাজস্থান): এখানে আরাবল্লির বিরাট বিরাট আউটক্রপ আছে, ইউনেস্কোর তালিকায় থাকা চিতোরগড় দুর্গটা ৩০০-৬০০ মিটার উঁচু প্রাচীন পাহাড়ের ওপর। সাওয়াই মাধোপুরের রণথম্ভোর টাইগার রিজার্ভ, আরাবল্লি-বিন্ধ্যের মিলনস্থল— ভূ-আকৃতির দিক থেকে পুরোপুরি আরাবল্লি— তবু বাদ।

 

ধুলোয় ঢাকা আকাশ?

ইতিমধ্যে ২০১৮ সালে ৩১টা টিলা উবে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে থরের বালি সোজা দিল্লিতে ঢুকছে। এখন আরও হাজার হাজার টিলা চলে গেলে? দিল্লির AQI ৫০০ পার হওয়া নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যাবে। আর আমরা কলকাতায় বসে ভাবব— আহা দিল্লির দোষ!

 

জন্তু-জানোয়ার আর আবাসস্থলের বিপদ

নতুন নিয়মে খনি চললে বাঘ, চিতা, হায়না, পাখি (গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মতো)-দের করিডর টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। স্থানীয় ঝোপঝাড় যেখানে সাপ-টিকটিকি থাকে, সব শেষ। নিচু রিজগুলোই তো সবকিছু জুড়ে রাখে— সেগুলো গেলে বায়োডাইভার্সিটি আরও ধ্বংস হবে। হরিয়ানার আরাবল্লিতে ২০০১-২০১৬র মধ্যে বন ৩৭ শতাংশ কমে গেছে।

 

সরিষ্কার বাঘেরও বিপদ

সরিষ্কা টাইগার রিজার্ভের চারপাশের ছোট টিলাগুলোই বাঘের করিডর। বাঘ-চিতা-হরিণ যাতায়াত করে। এখন ওই এলাকার বড় অংশই ১০০ মিটারের নিচে। আর শোনো, ২০২৫-এই সরিষ্কার বাউন্ডারি “র‍্যাশনালাইজ” করার নামে ৪৮-৪৯ বর্গ কিমি পাহাড় কেটে বাদ দেওয়ার প্ল্যান চলছে। পুরনো মার্বেল খনি ফের চালু হবে। বাঘের বদলে বুলডোজার ঢুকবে।

 

জলের সুরক্ষায় ধাক্কা

আরাবল্লি পাহাড়গুলো ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জের বড় জায়গা। বর্ষায় পাথরের ফাটল দিয়ে হেক্টরপিছু বছরে ২০ লক্ষ লিটার পর্যন্ত জল ঢোকে। খনি হলে জলের স্তর নামবে, কুয়ো শুকিয়ে যাবে। গুরুগ্রাম-ফরিদাবাদে আগে খনির জন্য ১৯৯৬-২০০৩-এ ১৭ মিটার জল নেমে গিয়েছিল, পরে কিছু খনি বন্ধ হওয়ায় কিছুটা ফিরেছে।

 

আমজনতার জীবন ও জীবিকা

নন টিম্বার ফরেস্ট প্রোডিউস থেকে রাজস্থান-হরিয়ানার আদিবাসী, অ-আদিবাসী মানুষের ঘরে ২০-৪০ শতাংশ বেঁচে থাকার সম্বল আসে— খাবার, ওষুধ, গোখাদ্যের জন্য। আলোয়ারে মধু কেজি ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি করে কোঅপারেটিভগুলো। মহুয়াফুল, কেন্দুপাতা— এসব থেকে ওষধি গাছের শিকড়-পাতা থেকে ওষুধ বানিয়ে চলে রোজকার জীবনযাত্রা। পশুপালকরা ছাগল-গরু-উট চরায় ঝোপজঙ্গলে। দুধ-ঘি গোসম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্বল, যা হারাবেন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ।

আলোয়ার, উদয়পুরের মতো জেলায় মিনা (রাজস্থানের সবচেয়ে বড় আদিবাসী গোষ্ঠী, প্রায় ৪০ লক্ষ), ভিল (২৮ লক্ষ)-দের লক্ষ লক্ষ পরিবার এই জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে। মধু, ওষধি গাছ, বুনো ফল সংগ্রহ করে রোজগার করে, যে বছর ফসল ভালো না হয়, এটাই বাঁচিয়ে রাখে। রাইকারা উট-ছাগল চরায়, দুধ-পশমনির্ভর জীবিকা করেন।

 

আর পুরাণের আরাবল্লি?

সরস্বতী নদীর উৎস, পাণ্ডবদের বনবাস, পাণ্ডুপোলের হনুমান, গুরুশিখরের দত্তাত্রেয়— এসব তো শুধু পাহাড় নয়, স্মৃতি। ওগুলো কেটে ফেললে আমাদের ইতিহাসের একটা অংশও কেটে যাবে।

 

কিন্তু খনি লবির জন্য তো দীপাবলি!

আরাবল্লিতে তামা, লেড-জিঙ্ক, মার্বেল, চুনাপাথর, ডলোমাইট, কোয়ার্টাজাইট— এত খনিজ যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বেশিরভাগই ছোট ছোট পাহাড় আর উপত্যকায়। এখন ৯০ শতাংশ পাহাড় ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেলে কী হবে? নতুন করে লিজ লাগবে না, পুরনো অবৈধ খনিগুলোকেও বৈধ করে দেবে। গুরুগ্রামের বাড়ি বানানোর বালি, রাজস্থানের মার্বেল— সব সস্তা হবে। আর দাম দেব আমরা— ধুলো খেয়ে, পানযোগ্য জল হারিয়ে।

 

কী করা উচিত?

শুধু উচ্চতা দেখে পাহাড় চেনা বন্ধ করো। পুরো ল্যান্ডস্কেপ দেখো— ঢাল, গাছপালা, জন্তু-জানোয়ারের পথ, জলের প্রবাহ, গ্রামের লোকের ব্যবহার— সব মিলিয়ে সুরক্ষা দাও। FSI-র পুরনো ৩০ মিটার + ৩ ডিগ্রি ঢালের ফর্মুলায় ফিরে যাও। অবৈধ খনির হিসেব করো, যেখানে ক্ষতি হয়েছে সেখানে গাছ লাগানোর ফান্ড করো, আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার টেবিলে গ্রামের লোক আর সাধারণ নাগরিকদের বসাও।

 

নইলে?

আর কয়েক বছর পর দিল্লি থেকে গুরুগ্রাম যাওয়ার সময় দুপাশে শুধু খাদ আর ধুলো দেখা যাবে। বাঘের গর্জনের বদলে শুধু বুলডোজারের আওয়াজ শুনতে পাবে। আর আমরা চুপ করে বসে থাকলে ইতিহাস লিখবে— একদিন আমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ফুসফুস কেটে ফেলেছিলাম।