Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সাফাইকর্মীদের পদসেবা : বর্ণবাদী মোদির নির্মম মস্করা

সাফাইকর্মীদের পদসেবা নাটক

মলয় তিওয়ারি

 

এই স্বচ্ছ ভারতে প্রতি পাঁচ দিনে একজন সাফাইকর্মীর মৃত্যু হয় নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে। গত এক-দেড় দশকে এরকম ১৮৭০টি কেস নথিভুক্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’-এর ন্যাশনাল কনভেনর বেজওয়াদা উইলসন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেদিন কুম্ভমেলার কয়েকজন সাফাইকর্মীদের চেয়ারে বসিয়ে নিজে তাঁদের পদতলে বসে পা ধুইয়ে দেয়ার ফটোশুট করলেন তার ঠিক দুদিন আগে বেনারসে নর্দমা পরিষ্কার করতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে দম আটকে মারা গেছেন এরকমই দুইজন সাফাই কর্মী। কেন এমন বিপজ্জনক করেন তাঁরা? মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল জেনেও নর্দমায় তাঁদের নামায় কারা?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই প্রসঙ্গে কী বলেছেন তা পড়ে নিতে পারি আমরা। ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘কর্মযোগ’ নামক কিতাবে তিনি লিখছেন “আমি বিশ্বাস করি না যে ওরা কেবলমাত্র জীবনধারণের জন্য এই কাজ করে আসছে। যদি তাই হত, তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই ধরনের কাজ চালিয়ে যেত না। সময়রেখার কোনও এক পর্বে নিশ্চয় কারও কারও মধ্যে এই আলোকপ্রাপ্তি ঘটেছিল যে সমগ্র সমাজের সুখশান্তি ও ঈশ্বরের জন্য এটা তাদের (বাল্মিকীদের) কর্তব্যকর্ম, তাদের ওপর ঈশ্বরপ্রদত্ত এই কর্ম তাদের করে যেতে হবে এবং নোংরা পরিষ্কার করার এই কাজ তাদের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চালিয়ে যেতে হবে নিজেদের অন্তরের আধ্যাত্মিক ক্রিয়া হিসেবে।” বাল্মিকী ও মেথর সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে বইটি অবশ্য মার্কেট থেকে তুলে নিতে হয় এবং সাত বছর পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই লোকটি স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নামে মহাত্মা গান্ধির চশমা টেনে তাঁর মন-কি-আসলি-বাত আড়াল করতে সমর্থ হন। কুম্ভমেলায় সাফাইকর্মীদের পা ধোয়ানোর ফটোশুটে তাঁর পাপী মনের লুকোনো কথা আবার সামনে চলে এসেছে। প্রতিদিন ভোরে বেরিয়ে অন্যের পায়খানা সাফ করার কাজে কেমন “আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা” হয়? ম্যানহোল খুলে বিষাক্ত নর্দমায় গলা অব্দি ডুবে যেতে যেতে কেমন “আলোকপ্রাপ্তি” ঘটে?

আমি প্রতিদিন ২০টি বাড়িতে টয়লেট সাফ করি। আমি একটুকরো টিনের প্লেট ও ঝাড়ুর সাহায্যে টয়লেটে জমা মল ঝুড়িতে তুলি ও তারপর দূরে গিয়ে ফেলে আসি। এই কাজ এত বীভৎস, আমার খেতে ইচ্ছা করে না।

–মনীষা
মইনপুরি জেলা, উত্তরপ্রদেশ, জানুয়ারি, ২০১৪।

বস্তুত, পায়খানা পরিষ্কার করার এই কাজের কর্মীদলের প্রায় পুরোটাই মহিলা। আর একেকটি বাড়িতে এই কাজ তাদের করতে হয় দুইটি রুটির বিনিময়ে। শহরে একেকটি বাড়ি থেকে মেলে মাসে ২০ থেকে ৪০ টাকা, কতজনের ত্যাগ করা মল জমা আছে ল্যাট্রিনে সেই হিসেবে। ২০১৪ সালে ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত ‘ক্লিনিং হিউম্যান ওয়েস্ট : “ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং”, কাস্ট, অ্যান্ড ডিস্ক্রিমিনেশন ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক রিপোর্টে পরিস্থিতির এইসব বর্ণনা আছে। গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে ২০১৩-১৪ সালে করা সার্ভে রিপোর্ট এটি। ১৯৯৩-এর নিষেধাজ্ঞা, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার নিয়মিত সচেতনতা অভিযান ও দলিত অস্মিতার ক্রমপ্রসারতার পরিস্থিতিতে ২০০০ সালের পর থেকে অনেকেই এই কাজ ছেড়ে দিতে থাকেন। কিন্তু কাজ ছেড়ে দিতে গিয়ে ‘উচ্চবর্ণের’ লোকেদের দ্বারা তারা কীরকম হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের গ্রামছাড়া করা হয়েছে, গ্রামের যৌথ সম্পত্তি বা পশুচারণ ক্ষেত্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে, লাগাতার একবছর দুবছর ধরে প্রতিদিন বাড়িতে এসে হুমকির শিকার হতে হয়েছে– ইত্যাদির সাক্ষ্য তুলে ধরেছে এই রিপোর্ট। গ্রামসভাগুলি এই আক্রমণগুলিকে সমর্থন যোগায়। পঞ্চায়েত বা অন্যান্য সরকারি সংস্থা কীভাবে নির্দিষ্ট জাতের লোকেদের জন্য এই ধরনের কাজ নির্দিষ্ট করে রাখে, কীভাবে মাইনে ছাড়াই কেবলমাত্র খাদ্যের বিনিময়ে অথবা সামান্য মজুরি ও খাদ্যের বিনিময়ে এই কাজ করায়, কীভাবে ‘উঁচু’ জাতের লোকেদের সরকারি মাইনে দিয়ে সুইপার পদে নিয়োগ করেও আসল কাজ ওই বাল্মিকী বা মেথর সম্প্রদায়কে দিয়েই করানো হয়, সরকারি প্রকল্পে পুনর্বাসন পেয়ে ক্ষেতমজুরি বা অন্য কাজে যেতে চাইলে কীভাবে পঞ্চায়েত থেকেই বাড়িছাড়া করার হুমকি আসে, সেইসব এমনকি কয়েকটি মিউনিসিপালিটিতেও অনুরূপ ঘটনার বয়ান তুলে ধরা আছে এই রিপোর্টে।

আপনি ভাবছেন খালি হাতে কাঁচা পায়খানা সাফ করার কাজ বা মাথায় করে মল বহনের কাজ আজকের দিনে আর কতজনকেই বা করতে হয়! জেলা কালেক্টর বা মিউনিসিপালিটিও এ বিষয়ে আপনাকে প্রকৃত তথ্য দিতে চাইবে না। কোলকাতা কর্পোরেশন হয়তো আপনাকে সরাসরি বলেই দেবে যে মেথরের কাজ/পদ তো বিলোপ করে দেয়া হয়েছে! তাছাড়া ১৯৯৩ সালে আইন তৈরি হওয়ার পর আজ পর্যন্ত এই আইনে কেউ শাস্তি পেয়েছে বলেও তো জানা নাই! কিন্তু বাস্তব তথ্য আপনাকে চমকে দিতে পারে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে ভারতে ৭৪০০৭৮ (সাত লক্ষ চল্লিশ হাজার আটাত্তর)টি বাড়ি বা হাউসহোল্ড আছে যেখানকার শুখা-পায়খানা থেকে মল সাফ করে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জাররা। এর ওপর আছে সেপ্টিক ট্যাঙ্ক, নালা-নর্দমা এবং রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম। বস্তুত, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় এম এস আইনভঙ্গকারী। ২০১১-র ‘কাস্ট সেন্সাস’ থেকে জানা যায় যে ভারতে মোট ১৮২৫০৫ (এক লক্ষ বিরাশি হাজার পাঁচ শ পাঁচ)টি বাড়ি বা হাউসহোল্ডের সদস্যেরা ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর কাজ করেন। এই সংখ্যাটা কেবল গ্রামীণ বাড়ির হিসাব। হয়তো ভাবছেন এসবই অন্য রাজ্যে, বাঙালিরা তো অনেক এগিয়ে থাকা জাতি। কিন্তু পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এই কাজ করা গ্রামীণ হাউসহোল্ড বা পরিবারের সংখ্যা ২৫২৬ (দুই হাজার পাঁচশ ছাব্বিশ)। এটা গ্রামের হিসেব। শহরে? ২০১১র জনগণনার হিসেব থেকে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবাংলার ১৫৬টি শহরে (কর্পোরেশন ও মিউনিসিপালিটি মিলিয়ে) মোট ৬৪৬৫টি (ছয় হাজার চারশ পঁয়ষট্টি) বাড়ি থেকে নিয়মিত ম্যানুয়ালি মল সাফ করাতে হয় এবং ১৪০৯৭টি বাড়ির মলমূত্র সরাসরি নর্দমায় গিয়ে পড়ে। কোলকাতা কর্পোরেশনে সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ৫৯৮ ও ১৯৬১। আসানসোলে ১১৭৭ ও ৬৩৯। বারাসাতে ১০৬ ও ৬৬। রাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব মিউনিসিপাল অ্যাফেয়ার্সের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট খুঁজলে এই ১৫৬টি শহরের প্রতিটির ওয়ার্ডভিত্তিক হিসেব পেয়ে যাবেন। ‘সাফাই কর্মচারী আন্দোলন’-এর ম্যাগস্যাসে পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্মী বেজওয়াদা উইলসনের হিসেবে দেশে অন্তত সাত লক্ষ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার আছেন। সর্বশেষ, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশের কথা উপরে উল্লিখিত হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে সারা দেশে গ্রাম শহর মিলিয়ে মোট ছিয়ানব্বই লক্ষ (৯৬০০০০০) ড্রাই ল্যাট্রিন আছে যেগুলোকে ম্যানুয়ালি পরিষ্কার করতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী নীতি আয়োগ টাস্ক ফোর্স গঠন করে সাফাইকর্মীদের নাম নথিভুক্তকরণের কাজ শুরু করে। কিন্তু ২০১৭ সালে মোদির সরকার সংখ্যাটা দেখায় মাত্র ১৩০০০ (তের হাজার)।

২০১৭ সালে তামিলনাড়ুর মাদুরায়ের কমরেড দিব্যা ভারতী কাক্কুস (Kakkoos) বা টয়লেট নামে দুই ঘণ্টার ডকুমেন্টারিটি ইউটিউবে ওপেন আছে। দেখলে আপনার রাতের ঘুম উবে যেতে পারে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাক্কুস বানানোর জন্য দিব্যাকে অনেক হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কয়েকটি মামলা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পুরনো সাধারণ কেস টেনে এনে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে তাঁকে। কারণ, তিনি প্রায় অদৃশ্য এই মানুষগুলোর জীবন ও কাজের দুঃসহ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে খালি হাতে খালি পায়ে মল পরিষ্কার করে থাকেন এইসব মহিলারা। এই কাজে মারা যাওয়া ২৭ জনের জীবন ও মরণের নিদারুণ তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছেন, উন্মোচিত করে দিয়েছেন সরকারি সংস্থাগুলির অমানবিক দ্বিচারিতা।

এই অপরাধমূলক দ্বিচারিতাকে গ্রহণযোগ্য করতেই মোদির কুম্ভ ফটোশুট। এই কাজ করে বাস্তবে দলিত সাফাইকর্মীদের প্রতি আরও বড় অপরাধ করলেন প্রধানমন্ত্রী। আরএসএসের কর্মযোগী ও একজন বর্ণবাদী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ভাবতেই পারেন যে “ঈশ্বরপ্রদত্ত এই কর্ম” নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে “আধ্যাত্মিক ক্রিয়া” হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চালিয়ে যেতে হবে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং পেশাটিরই অবসান ঘটানো। ১৯৯৩ সালে প্রথম আইন পাশ করে এই পেশাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নর্দমা পরিষ্কার করার কাজকেও ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে “দ্য প্রহিবিশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট ২০১৩” বা সংক্ষেপে ‘এম এস অ্যাক্ট’ পাস হয়, নির্দিষ্ট এমএস রুল তৈরি হয় এবং পরের বছর সুপ্রিম কোর্ট ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বিলোপ করার জন্য সরকারকে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়। এই পেশায় আটকে থাকা মানুষদের ভিন্ন জীবিকায় পুনর্বাসনের জন্য পরিবার পিছু দশ লক্ষ টাকা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সেসব কিছুই করেনি মোদি সরকার। স্বচ্ছ ভারত অভিযান প্রকল্পে এক পয়সাও খরচ করেনি এই খাতে। অথচ এই অভিযানে নিজের বিজ্ঞাপনেই খরচ করেছেন সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। এমনকি ২ লক্ষ কোটি টাকার স্বচ্ছ ভারত অভিযানে যে কোটি কোটি শৌচালয় বানানো হচ্ছে তাও বেআইনি। কারণ আইনে বলা আছে যে সেপ্টিক ট্যাঙ্ক ছাড়া শুখা পায়খানা (ড্রাই টয়লেট) বানানোও দণ্ডনীয় অপরাধ। স্বচ্ছ ভারতের শৌচালয়গুলির বেশিরভাগই সেরকম।

স্বচ্ছ ভারত অভিযানের দেখানোপনা আর বিজ্ঞাপনী জৌলুস ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার বা মল সাফাইকর্মীদের অমানবিক জীবনযাপনের প্রতি এক নির্লজ্জ পরিহাস। মোদির পা ধোয়ানোর ফটোশুট এই পরিহাসকেই আরেকবার সকলের চোখের সামনে উন্মুক্ত করে দিল।