এনাফ ইজ এনাফ, এবার আপনি আসুন মোদিজি

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 



প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

 

 

 

 

বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় এক গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। অরুন্ধতীর কথায়, হাজারে হাজারে দেশবাসী মারা যাচ্ছেন অথচ কোথাও সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। করোনা অতিমারি আজ এক ভয়ঙ্কর সঙ্কটে রূপান্তরিত। এই সঙ্কট নরেন্দ্র মোদির সৃষ্টি এবং তিনি ক্ষমতায় থাকলে এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এই সঙ্কটকালে প্রয়োজনে সর্বদলের সমন্বয়ে এবং চিকিৎসক, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এক জাতীয় সরকার গঠন করা যেতে পারে। আর তা যদি না করা হয় তাহলে এই মৃত্যুমিছিল, অতিমারি এক আন্তর্জাতিক সঙ্কটে রূপান্তরিত হতে পারে বলে তার আশঙ্কা।

এদেশের এক সাধারণ নাগরিক হিসাবে অরুন্ধতী রায়ের দাবিকে একশেো শতাংশ সমর্থন করে আমিও বলতে চাই এনাফ ইজ এনাফ, এবার আপনি আসুন মোদিজি। যারা বলেন সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যার পাটিগণিতই একমাত্র বিবেচ্য, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি রাজনীতিতে নৈতিকতারও প্রয়োজন আছে। মুক্তকণ্ঠে বলতে চাই স্বাধীন ভারতবর্ষে নরেন্দ্র মোদির মত অযোগ্য, অকর্মা, অসত্যভাষী, অসংবেদনশীল, বোধবুদ্ধিহীন, বিভেদকামী, আত্মগর্বী প্রধানমন্ত্রী আর কেউ আসেননি। ২০১৪ সালে মসনদে আসীন হওয়ার পর থেকে এই ৫৬ ইঞ্চি ছাতিবিশিষ্ট ছদ্ম দেশভক্তের সৌজন্যে সারা দেশ এক অনিবার্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। নোটবন্দির নামে দেশের অর্থনীতিকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়া হয়েছে, জিএসটির কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাজা ভেঙে গেছে, করদাতাদের টাকায় তৈরি একের পর এক লাভজনক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্পোরেট হাঙরদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’-র ধ্বজাধারীদের চোখের সামনে দেশকে লুঠ করে নিয়ে গেছে বিজয় মাল্য, নীরব মোদিদের দল। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেকারির হার— জনকল্যাণের সূচকে পৃথিবীর সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আমাদের স্থান সবার নিচে। এই সরকারের কর্পোরেটবান্ধব নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে কৃষক, শ্রমিক তথা শ্রমজীবী মানুষদের অস্তিত্ব বিপন্ন করার জন্য পাশ করা হয়েছে নয়া কৃষি আইন ও শ্রম কোড। এই মানুষমারা নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আজ আমাদের অন্নদাতারা দিল্লির রাজপথে। আর এই সঙ্কটের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ যাতে একজোট না হতে পারে তার জন্য আছে হিন্দুরাষ্ট্রের গল্প, লাভ জেহাদ, গোমাংস ও আরও নানান ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর নীল নকশা। নাগরিকত্ব বিলের নামে বস্তুত গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।

করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে দেশে যা ঘটছে তা অভাবনীয়, অভূতপূর্ব। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরোর বেহালা বাজানোর কথা। আর এই নয়া নিরোর সময়ে যখন উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে একটার পর একটা তাজা প্রাণ, তখন ৩৫,০০০ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও দিল্লির সৌন্দর্যায়নের কাজ চলছে। মহামান্য আদালত ঘোষণা করছেন অক্সিজেনের অভাবে রোগী মৃত্যু গণহত্যার সামিল আর অন্যদিকে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যবাসীকে হুমকি দিচ্ছেন অক্সিজেনের অভাবের কথা বললে দাঙ্গা আইনে জেলে পোরা হবে। মহারাষ্ট্র, দিল্লির মত অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যখন কোভিড মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাইছেন তখন নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের অলিতে-গলিতে ভোটভিক্ষায় ব্যস্ত। এই অযোগ্যতা, অপদার্থতার কারণ লুকিয়ে আছে গতবছরে করোনা অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের সময় সরকারের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। পৃথিবীর দীর্ঘ ভয়ঙ্করতম লকডাউন, টেস্ট না করা, সামান্য চিকিৎসা না থাকা, করোনা মোকাবিলার নামে থালাবাটি বাজানো ও দীপ জ্বালানোর নৌটঙ্কি, অভিবাসী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট দেশের স্বাস্থ্য ও আর্থিক পরিকাঠামোর কঙ্কালসার অবস্থাটাকে সামনে এনেছিল। সেই দুর্যোগের দিনগুলোতে বিনা পয়সায় রেশন ছাড়া ভারতরাষ্ট্র তার নাগরিকদের আর কিছুই দেয়নি। মানুষ বেঁচেছিল সহনাগরিকদের সহমর্মিতায় ও অরাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। ত্রাণপ্রকল্পের নামে দেশবাসীকে দেওয়া হয়েছিল ঋণপ্রকল্প। গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিল ভালো কৃষি ফলন ও গ্রামীণ একশো দিনের রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প যাকে মহামহিম প্রধানমন্ত্রী প্রায় নিয়ম করে ‘গর্ত খোঁড়ার প্রকল্প’ বলে ব্যঙ্গ করে গেছেন। কিন্তু তার থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি সরকার। বরং আত্মগর্বী প্রচারে দাবি করেছে ভারত নাকি বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা করোনাকে হেলায় পরাজিত করেছে এবং সারা পৃথিবীর নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বকে দেখে শেখা উচিত। এই বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ দুটি উদাহরণ উপস্থিত করতে চাই— প্রথমটি জানুয়ারি (২০২১) দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য। যেখানে তিনি বুক বাজিয়ে বলেছিলেন সারা পৃথিবী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল ভারতে ২০ লক্ষ লোক করোনাতে মারা যাবে, কিন্তু আত্মনির্ভর ভারত করোনাকে রুখে দিয়ে বিশ্বের কাছে এক অনুকরণযোগ্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। দ্বিতীয়টি ফেব্রুয়ারি (২০২১) বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সভায় গৃহীত প্রস্তাব যাতে বলা হয়— “it can be said with pride… India not only defeated covid under the able, sensible, committed and visionary leadership of prime minister Modi, but also infused in all its citizens the confidence to build an atmanirbhar Bharat.” নিজের ঢাক নিজে বাজানোর এবং অসত্য ভাষণের এর চেয়ে নির্লজ্জ উদাহরণ আর কী হতে পারে!

করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের যে তাণ্ডব আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা হঠাৎ করে আসেনি। সমস্ত তথ্য প্রমাণ থেকে এটা পরিষ্কার যে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সতর্কবাণী বছরের শুরুতেই সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবী বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট তার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে যে নরেন্দ্র মোদি সরকার অতিমারি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে টুইটার থেকে সরকারের সমালোচনামূলক পোস্ট মুছে দিতে বেশি আগ্রহী। ল্যান্সেট তার প্রতিবেদনে এটা পরিষ্কার বলেছে যে কোভিডের বিরুদ্ধে তাদের তথাকথিত জয় নিয়ে সরকার এতটাই আত্মসন্তুষ্ট ছিল যে কোভিডের নতুন স্ট্রেন যে ভারতের বুকে আছড়ে পড়তে চলেছে এ সম্পর্কিত জানুয়ারি মাসের (২০২১) সতর্কবার্তা সরকার গ্রাহ্যই করেনি। অথচ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ তার জানুয়ারি মাসের প্রতিবেদনে বলেছিল SARS-COV-2-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি মাত্র ২১ শতাংশ জনগণের শরীরে তৈরি হয়েছে। এই প্রস্তুতিহীনতার মধ্যেই কুম্ভমেলা ও নির্বাচনের মত ঘটনা ঘটেছে সরকারের অনুমতিতে। এই ঘটনাগুলো সুপারস্প্রেডারের কাজ করেছে। পরিস্থিতি আজ এতটাই খারাপ যে পত্রিকা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে আগস্ট মাসের মধ্যে ভারতে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। শুধু ল্যান্সেট নয় INSACOG (Indian SARS-COV-2 Genome sequencing consortium)-এর সদস্য ডাঃ রাকেশ মিশ্র দি ওয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন মার্চ মাসের শুরুতে তাদের পক্ষ থেকে বিপদবার্তা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রককে জানানো হয়। তাই একথা মনে করার কারণ নেই যে নরেন্দ্র মোদি বিপদ সম্পর্কে আগে থেকে অবহিত ছিলেন না।

একথা কারও অজানা নয় যে গতবছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে করোনা সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। আমরা যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম স্বাস্থ্যব্যবস্থার কিছু উন্নতি ঘটাতে। পি-এম কেয়ার্স ফান্ডে ৩০,০০০ কোটি টাকার বেশি মজুতও ছিল। কিন্তু সরকার নতুন করে একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট পর্যন্ত বসায়নি। হাসপাতালে বেড বৃদ্ধি, টেস্ট কিট, যে সমস্ত ওষুধগুলিকে কার্যকরী বলে চিকিৎসকরা মনে করছেন সেগুলির অধিক উৎপাদন— এই ধরনের সাধারণ কাজগুলিকে পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে বিশ্বের কাছে উলঙ্গ হয়ে গেছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, আরব আমিরশাহী, বাংলাদেশের কাছে ত্রাণের জন্য দাঁড়িয়ে আছে আত্মনির্ভর ভারত। সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে ভ্যাকসিন নিয়ে। ল্যান্সেট দেখিয়েছে এত ঢক্কানিনাদ ও টিকা উৎসবের পরেও ভারতের মাত্র তিন শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সম্ভব হয়েছে (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এব্যাপারে সরকারকে আগেই সতর্ক করেছিলেন)। গিমিকসর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন ১৮ বছর ঊর্ধ্ব যে কেউ টিকা নিতে পারবেন। কিন্তু জোগান না থাকায় টিকার জন্য হাহাকার করছে মানুষ। মুনাফাখোরদের এই স্বর্গরাজ্যে টিকার তিন ধরনের দাম আর সেই টিকার দাম আমেরিকা ও ব্রিটেনের চেয়েও বেশি। সব মিলিয়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় সরকারের প্রতিক্রিয়া শুধু অমানবিক নয়, এক নিদারুণ ঔদাসীন্য যা ঘৃণ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠান ও পদাধিকারীর দায়বদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই প্রধানমন্ত্রী গত ৭ বছরে একটা সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত করেননি। বশম্বদ মিডিয়া আজ মানুষের কথা বলে না, এখানে নাগরিকের জন্য অপেক্ষা করে থাকে মন কি বাতে। আমরা আজ অসহায়। দেশজোড়া জেগে থাকা শ্মশান ও কবরস্থানে মৃত্যুমিছিলের সামনে আর নতজানু হওয়া নয়, আসুন চিৎকার করে বলি এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলি মাননীয় ফকির, এবার আপনি আসুন!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...