Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আঠাশ দিনের পাট

মিতুল দত্ত

 

আঠাশ দিন আজ। তিনি এলেন। বহু প্রতীক্ষিতা। একাধারে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং দলীয় ব্যাজ পরিহিতা তৃণমূল নেত্রী। প্রেস ক্লাবের সামনে ফুটপাথ জুড়ে তখন আলো, ঝিকিয়ে উঠছে ক্লিষ্ট মুখগুলোয়। অস্থায়ী, অনিশ্চিত ত্রিপলের নামমাত্র আশ্রয়ে আঠাশ দিন ধরে দিন গুনছে যারা। এই দিনটিই গুনছে আসলে। চাঁদিফাটা রোদ্দুর, বৃষ্টি হলেই নর্দমার জল উঠে আসছে ত্রিপলে। ডেঙ্গু, জ্বর, এই পরিবেশে আর যা যা হতে পারে, মেয়েদের গণহারে ইউটিআই। মাথার ত্রিপল খুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আবার টাঙানো হচ্ছে, এইসবই, আজ আঠাশ দিন ধরে। কিন্তু আজ, উবের থেকে নেমেই দেখি আলোড়ন। আনন্দ। দিদি আসছেন যে। কাল নিশ্চয়ই এই নরকবাসের ইতি। বাড়ি ফিরে যাবে সবাই, ভালো করে স্নান করবে, বহুদিন পর বাড়ির ভাত পেটে পড়বে। যা চেয়েছিল সবাই, একটা কথায়, একটা মাত্র আঁচড়ে সব শান্তি শান্তি।

পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়

কিন্তু গল্পটা কেমন যেন। এমনই কি হওয়ার কথা ছিল? দুর্জনে যদিও বলল, এ তো চেনা গল্প। এটা তো জানাই। আজ বিশ্ব নাট্য দিবস, জানো না? আমার যেহেতু চেনা লাগেনি গল্পটা, তাই একটা টিংটিঙে ছেলের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে, টঙে চড়িয়ে তাকে ফেসবুক লাইভ করতে বললাম। সে বেচারা কেটেই পড়ছিল, ব্যাজার মুখে মিনিট দুয়েক পরে টং থেকে নেমে আমার হাতে যেই না ধরিয়ে দিল মোবাইল, আমিও অমনি হুঁশোর মতো, অভিমন্যুর মতো মিডিয়া মাফিয়াদের চক্রব্যুহে ঢুকে পড়লুম। অ্যাদ্দিন যে মিডিয়ার টিকিটি দেখা যায়নি (দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া), তারা তখন যথারীতি হামলে পড়েছে। দিদি বলে চলেছেন, পাঁচজনের কমিটি করার কথা, যাদের কাছে এই অনশনকারী ছেলেমেয়েদের ডিম্যান্ডগুলো তুলে ধরা হবে। জুনের ফার্স্ট উইকে, ইলেকশনের রেজাল্ট বেরোনোর পরই, এদের সঙ্গে কথা বলতে বসবে রাজ্য সরকার। মেরিট লিস্টে যারা আছে, তারা তাদের সুযোগসুবিধে থেকে বঞ্চিত হবে না, ইত্যাদি। আশার কথা, নিঃসন্দেহে। তখনই চোখ গেল হঠাৎ, ডানদিকে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে মেয়েটা, “একবার আমাদের কাছে আসুন দিদি। আমাদের অবস্থা একটু দেখে যান।” রোগা, অনেকদিন না-খাওয়া গলার শির ফুলে ফুলে উঠছে। কানে গেল না, তাঁর। চলে গেলেন, মিডিয়া-পরিবৃতা। অনিতা বিশ্বাস নামের এক মেয়ে, হাউহাউ করে কাঁদছে তখন, “আমাদের সহানুভূতি জানাতে এসেছেন, অথচ আমরা তাঁর কাছে পৌঁছতে পারছি না, মিডিয়া এমনভাবে ঘিরে রেখেছে, আমাদের দিদির কাছে যেতে দিচ্ছে না। দিদি যদি না বোঝেন, তাহলে কে বুঝবে আমাদের কষ্ট? যে মিডিয়া আমাদের এই অবস্থার একটা কভারেজ করেনি, তারা আজ কী করতে এসেছে? এতদিন কোথায় ছিল মিডিয়া?” মিডিয়াকে বিশ্বাস করে না অনিতা, আবার ছুটে এল কোথা থেকে, “এতদিন অভুক্ত অবস্থায় পড়ে আছি, মাথায় ছাদ নেই, জলে-ঝড়ে কীভাবে পড়ে আছি আমরা, ত্রিপল হাতে ধরে সারারাত কাটাচ্ছি, আজ আমাদের সমস্ত কিছু নষ্ট হয়ে যাবে যদি আমরা এখান থেকে চলে যাই। আমরা বাড়ি যাব না, এখানেই মরব।” ওকে শান্ত করা যায় না। জুলেখা যদিও শান্ত। বলে, “দিদি আজ রাতে আমাদের কোর কমিটির মিটিং। দেখি কী সিদ্ধান্ত হয়।”

তন্ময়, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের, গত চারদিন ধরে সমানে বলে চলেছে ওদের, এক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে আন্দোলনটা। নাগরিক সমাজকে আন্দোলনে সামিল করতে হবে, আরও কত কী যে। সবাই চাইছে, একটা নিষ্পত্তি। কিন্তু সবাইকে ফের আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দিয়ে পুলিশ এসে গেছে, আরেকটু আগে, কাল সকাল সাতটার মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে হবে ত্রিপল। তুলে দিতে হবে, আঠাশ দিনের এই আত্মধ্বংসী অবস্থানের পাট।

বাকি রাতটুকু, কী আর বলব, ভালোয় ভালোয়…

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

পুনশ্চ : শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ওদের অনশন আপাতত আজই শেষ, তবে জুনের ফার্স্ট উইকের মধ্যে যদি কোনও সুরাহা না হয়, তাহলে এক সপ্তাহের মাথায় আবার অনশন শুরু করবে ওরা। আগেরবার শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধে ওরা অনশন তুলেছিল, কিন্তু ফল জিরো। এবার সেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসেছেন, একটা সমাধানের কথাও তুলেছেন। আরও একটা ভয় আছে, এরপর যদি ওরা স্বেচ্ছায় অনশন না তোলে, পুলিশ দিয়ে জোর করে তুলে দেওয়া হয় বা কোনও অঘটন ঘটে, মুখ্যমন্ত্রী হয়তো পুরো দায়টাই ঝেড়ে ফেলবেন এই বলে যে, “আমি তো বলেছিলাম দেখব, ওরা তো সুযোগই দিল না আমায়।” তাঁকে এসব কথা বলতে দিতে চায় না বলেই, আজ ২৯ দিনের মাথায়, বেলা বারোটা নাগাদ, প্রেস ডেকে অনশন ভাঙতে চলেছে আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েরা।