অপেক্ষাপর্ব, আর শেষ কিছু প্রশ্ন

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 

রবিনসন স্ট্রিটের পার্থ দে তাঁর দিদির মৃত্যুর পর ছ মাস প্রথমে দিদির পচাগলা দেহ, তার পর তাঁর কঙ্কালের সঙ্গে দিন কাটিয়েছিলেন। রাতও। কটুগন্ধে পার্থবাবুর কোনও অসুবিধা হত না।

মাংস পচলে বদগন্ধ বেরোয়। কোষ পচলে নাকে রুমাল দিতে হয়। না হলে বমি পায়। দোষ পচলেও সমাজ তাঁর নাকে রুমাল দেয়। অকুস্থল এড়িয়ে চলে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দোষ বের করে যাঁরা নাওয়াখাওয়া ভুলেছিলেন এতদিন, তাঁরা পার্থ দে-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিয়েছিলেন। অজান্তে।

পাতালরেলে একটা কথা উড়ে এসেছিল কানে। ‘এগারো লাখ সাইড না করে পরীক্ষায় বসতে গিয়েছিলি কেন? মুরোদ নেই, সরকারি চাকরির শখ!’ পাশের জন বলে উঠেছিলেন, ‘আগে সাড়ে ছয়-সাতে কাজ হয়ে যেত। এখন তো এগারো লাগবেই। জিনিসপত্রের দাম কি কম বাড়ছে নাকি?’

উত্তর কলকাতার এক মোটামুটি বিখ্যাত সরকারি স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে দিনকয়েক আগে নাগেরবাজার মোড়ে দেখা। সকাল দশটা নাগাদ। তিনি কবিও বটে। দেখা হতেই বলেছিলেন, ‘অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজবে এখন।’ হাতে কম করে পাঁচটা খবরের কাগজ। সেদিকে আমার চোখ পড়তেই সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো কথাগুলো বেরিয়ে এসেছিল, ‘ফাইভ থেকে টেন— টেনেটুনে দুশটা স্টুডেন্ট। পাঁচটা কাগজ তিন ঘণ্টাতেই পড়া শেষ হয়ে যায়, শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনসহ। বাকি সময়টা কী করব বুঝতে পারি না ভাই।’

সমীক্ষা বলে, রাজ্যের বহু সরকারি স্কুলের ক্লাস নাইনের ছেলেকে ছয়ের নামতা বলতে বললে তোতলায়। ইংরিজিতে কলেজ বানান লিখতে বললে কে দিয়ে শুরু করে।

মাধ্যমিকের খাতার ভাঁজে দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে লেখে, দয়া করে পাশ করাইয়া দিবেন।

চারশ জন লোক ছাব্বিশ দিন অনশন করার পরে নদীর ওপারের অফিস থেকে বলা হয়, ওরা ঠিক কী দাবিতে অনশন করছে, আমাদের একটা রিপোর্ট দিন তো।

ছাব্বিশ দিনে চারশটার মধ্যে কটা উইকেট পড়ল? মাত্র ঊনআশি?

চৌতিরিশ এক্কে চৌতিরিশ। চৌতিরিশ দুগুণে আটষট্টি। আগে তিন চৌতিরিশ হোক।

সব কিছুতে বাড়াবাড়ি।

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাআআণে। গান, আরে গান। আই সে, গান।

শঙ্খবাবু, আপনি ওই কাগজ কলমেই উন্নয়নের খড়্গ বানান। সৌমিত্রবাবু, আপনার চিঠি আমার জাঙ্কবক্সে। স্প্যাম।

নুসরত-মিমি-মুনমুনকে দেখুন। অর্জুন যেভাবে মাছের চোখ দেখেছিল, সেভাবে দেখুন।

ওয়েটিং লিস্ট? ভ্যানিশ।

হি হি।

আপনার সরকার আপনার পাশে।

অনশন শুরু হওয়ার আঠাশ দিন পরে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ থেকে শোনা যায়, ‘সকলকে নিজের বলে মনে করি। তাই আপনাদের আবেদনে ছুটে এসেছি।’

শাহরুখ খানের সঙ্গে তার আগের দিনই ফ্রেমবন্দি হওয়ার সময় মুখে যে দৈব হাসি দেখা গিয়েছিল, তার সিকিভাগও যদি দেখা যেত মেয়ো রোডে!

পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়

অনশন করলেন যাঁরা, তাঁরা সারসত্যটা বুঝলেন না কেন এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাঁরা দাবি করেছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে নাকি ঠিকঠাক করে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাটাই হয়নি। হয়েছে যা, তারও ঠিকঠাক মেরিট লিস্ট বেরোয়নি। আরও দাবি, ওয়েটিং লিস্টে শুধু র‍্যাঙ্ক জানালে হবে না, ঠিকঠাক জানাতে হবে তাঁরা কত নম্বর পেয়েছেন। ‘ঠিকঠাক’ বলতে কী বোঝায়? স্বচ্ছ? বুড়বুড়িকাটা একটা পচা খালের জলকে কতবার রিভার্স অসমোসিস করলে শুদ্ধ হয়? বিরোধীপক্ষের অভিযোগ, ‘চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে টাকার লেনদেন হয়েছে। এই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের খুঁজে বার করতে হবে।’ এসব কানে গেলে হয়ত ভিন রাজ্যে বসে প্রথমে মুচকি হাসবেন স্যামুয়েল ম্যাথু। দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। পেনড্রাইভগুলোকে আঁকড়ে ধরবেন আরও। আর তখন সততার প্রতীক দুটো ফুল খিলখিলিয়ে পাপড়ি দুলিয়ে বলবে, দেখো হাসছি মোরা আহ্লাদি।

অনুপ্রেরণাদাত্রী সম্প্রতি এক মন্দিরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে কোনও চেয়ারের জন্য ডাকবেন না। আমি মাটির মেয়ে হিসেবে ঘরের মেয়ের মতোই থাকতে চাই।’ মাটির মেয়ে অনশনকারীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলেন তাঁর ভুবনবিদিত অনশনের রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার পরে। দেখা করার প্রয়োজন বোধ করেননি হয়তো। রাজ্যের আনাচে কানাচে মন্ত্রী-সান্ত্রীদের সঙ্গে, ক্যামেরার সামনে হাতে ভি দেখিয়ে পোজ দিয়েছেন। ভোট বড় বালাই। ওখানে আগেভাগেই দশ মিনিট সময় খরচ করলে ভোটবাক্সের উন্নতি হত না।

অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী দেখা করতে এসেছিলেন অনশনকারীদের সঙ্গে। ২৭শে মার্চ, বুধবার। বলেছেন, নির্বাচনী বিধিনিষেধ চালু হয়ে যাওয়ার ফলে এই মুহূর্তে তিনি যদি কোনও প্রতিশ্রুতি দেন, তা বিধিভঙ্গ বলে গৃহীত হবে। নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন অনশনকারীদের। জুনের প্রথম সপ্তাহে কিছু একটা হতে পারে এমন ইঙ্গিতও মিলেছে।

২৯ দিন ধরে যাঁরা অনশন করলেন, তাঁরা এই বাণী পেয়ে অনশন তুলে নিলেন তার পরের দিনই, বৃহস্পতিবার। জুনের প্রথম সপ্তাহ মানে তো আরও সত্তর-পঁচাত্তর দিনের ধাক্কা। আঠাশের সঙ্গে সত্তর আরও যোগ করা হলে মানুষ বাঁচে না।

তুলে নিলেন বিশ্বাসে। হয়ত তুলে নিতে বাধ্য হলেন। বিশ্বাস করা ছাড়া তাঁদের হাতে তখন আর কোনও উপায়ও ছিল না।

মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর হুমকিকে আর কী করে অগ্রাহ্য করে কয়েকটা অশক্ত শরীর?

অতএব, আরও আড়াই মাসের প্রতীক্ষা। তাঁদের কাছে এই মুহূর্তে, এই প্রতীক্ষা অনন্ত।

এবারে কয়েকটা সহজ প্রশ্ন। জুনের প্রথম সপ্তাহে আলোচনা করে কী রফা করবে সরকার? নতুন করে যদি মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং তা যদি আগের মেধা তালিকার সঙ্গে না মেলে, ওয়েটিং লিস্টে অপেক্ষার সিঁড়ির ধাপগুলো যদি এলোমেলো করে নতুন করে সাজাতে হয় আবার, তা হলে তো দিনের আলোয় প্রমাণিত হয় আগের হিসেবে ভুল ছিল। এই ভুল স্বীকার সরকার করবে কি? স্কুল সার্ভিস কমিশনের অকর্মণ্যতা কি সরকারিভাবে ঘোষণা করা সম্ভব সরকারের পক্ষে? তা হলেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এ নিয়োগ যদি ভুল হয়, আগের নিয়োগ নির্ভুল তার প্রমাণ কই? বেমক্কা প্রশ্ন উঠবে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের মতো রাজ্য সরকারের অন্য সার্ভিস কমিশনগুলোও একই পথের পথিক নয় তো? বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার ফাটলটা যে তাতে আরও গভীর হবে না, তা জোর দিয়ে কীভাবে বলা যায়? জুন মাসে যে আলোচনা হবে, শীর্ষমন্ত্রীর কথামতো, তাতে থাকবেন অনশনকারীদের প্রতিনিধিরাও। তাঁরা কিন্তু দাবি করেছেন, মেধা তালিকায় পরের দিকে নাম থেকেও নিয়োগপত্র আগে হাতে চলে এসেছে, উধোর হকের চাকরি, ঘামের চাকরি বুধো পেয়েছে, এমন প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে। এই নথির জোর যদি অকাট্য হয়, তাহলে এর সদুত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকবে তো কমিশনের? শিক্ষামন্ত্রক অবলীলায় এই পুরো অনশনকাণ্ডকে লঘু চোখে দেখে এসেছে এত দিন। বিরোধী শিবিরের লোকজন মেয়ো রোডে এ কদিন একটু বেশি ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে বিষয়টা সরকারের কাছে প্রাথমিকভাবে লঘু থেকে লঘুতর হয়েছে, ব্যঙ্গেরও, উপেক্ষারও। এখন জাঁতাকলে পরে কমিশনের শেষরক্ষা হয় কিনা তা দেখার জন্যে আর কদিন বসে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনও উপায় নেই।

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

মুখ্যমন্ত্রী আবার প্রমাণ করে দিলেন, সব কিছুরই শেষ কথা তিনি। প্রমাণ হল, দপ্তরগুলো আসলে পুতুল নাচই দেখায়। সূর্যের করুণা-আলো না মাখলে জোছনা আড়ি করে।

এ বারে কিছু অপ্রিয় কথা। এতদিন ধরে যাঁরা অবিচারের বিরুদ্ধে অনশন করলেন, তাঁদের কয়েকটা প্রশ্ন করি সোজাসুজি। আপনাদের নীতি নিয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার মানসিকতা নিয়ে, আপস না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করার স্পর্ধা আমার নেই। কখনও কখনও ফোঁস না করলে কর্তাদের টনক নড়ে না। কিন্তু আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বিস্ময় হয়, সরকারি চাকরির উপরে এত মোহ কেন? ধরে নিলাম, হিসেবে ভুল ছিল। ধরে নিলাম, মেধা তালিকায় লেপ্টে আছে কাদা। কিন্তু ধুত্তেরি বলে, এই চাকরিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বিকল্প কোনও জীবিকার ব্যবস্থা করলে কি নিজের সঙ্গেও সুবিচার করা হত না? বেসরকারি চাকরিতে খাটনি বেশি। চাকরির নিশ্চয়তা কম। বারবার নিজেকে প্রমাণ করার দরকার পড়ে, এটাই কি মোহের কারণ? নাকি একবার কোনও একটা সরকারি স্কুলে ঢুকে গেলে সারা জীবনটাই আরামের— এটাই মস্ত মায়াজাল?

যে পথে আমরা চলেছি, রাজ্যের বহু সরকারি স্কুলে এখন সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা হল তালা। যাঁরা অনশন করলেন চাকরির জন্য, চাকরি পেয়ে যাওয়ার পরে নিজেদের স্কুলগুলোতে যেন ছাত্রভর্তির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়, তার জন্য তাঁরা একই রকম জেদ দেখাবেন তো? পরের ছেলে পরমানন্দ অষ্টোত্তর সুরে আওড়ানো যায়। সমাজ তার হিসেব বোঝে।

এই জেদের সিকিভাগ দেখালেও অবস্থা পাল্টাবে। আপনি আমি যা ভাবছি, তার চেয়ে অনেক বেশি।

আপনাদের জয় হোক।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...