Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সিনেমার শেষ, ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু

সত্যব্রত ঘোষ

 

আমেরিকায় অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আয়োজিত ৯১তম অস্কার পুরস্কারের মনোনয়ন নিয়ে এবার একটি বিতর্ক দানা বাঁধে। শ্রেষ্ঠ ছবির তালিকায় যে ছবিগুলি ছিল, তাদের একটির অন্তর্ভুক্তি নিয়েই যত শোরগোল। নেটফ্লিক্স প্রযোজিত ‘রোমা’ ছবিটিকে ঐ তালিকায় রাখার জন্য অ্যাকাডেমির সমালোচনা করেছেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। তাঁর যুক্তি, ছবিটি প্রেক্ষাগৃহের জন্য নয়, ভিডিও স্ট্রিমিং-এর জন্য নির্মিত। নেটফ্লিক্স জানিয়েছে, সিনেমার কথা আমরাও ভাবি। যেসব অঞ্চলে প্রেক্ষাগৃহের অভাব, সেখানকার মানুষও যাতে সিনেমার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্যই নেটফ্লিক্সের এই উদ্যোগ। টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকারে স্পিলবার্গ বলেন, “টেলিভিশন ফরম্যাটে কাজ করলে যে টিভি মুভি তৈরি হয়, তা এম্মি অ্যাওয়ার্ড-এর জন্য বিবেচ্য হতে পারে, অস্কারের জন্য নয়। কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে সপ্তাহখানেক দেখালেই ছবিটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হতে পারে না।” এই বিতর্কে দাঁড়ি টানতে অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচারের এক সদস্য, স্টু জাকিমের বক্তব্য, “আমি স্টিভেনকে শ্রদ্ধা করি, তাঁর সিনেমাগুলির প্রতি আমার সম্ভ্রম আছে। কিন্তু তিনি হাওয়ার চলন বুঝতে পারছেন না। যে জাহাজে তিনি সওয়ার ছিলেন, তা ইতিমধ্যেই ভেসে গিয়েছে।” অ্যাকাডেমির আরেক সদস্য জো বার্লিঙ্গারেরও এই মতটিতে সমর্থন রয়েছে, “আজকাল স্বাধীনভাবে ছবি বানানো অত্যন্ত কঠিন। হন্যে হয়ে ঘুরে টাকা জোগাড় করে ছবি বানিয়ে ডিস্ট্রিবিউটারের কাছে পৌঁছাতে যে কী দশা হয়, তা আমি জানি। সেদিক থেকে দেখলে, চলচ্চিত্রকারদের যথেষ্ট উপকারই করছে নেটফ্লিক্স।”

***

একুশ শতকে পৌঁছে আমরা সবাই এখন আগ্রাসী উপভোক্তা। বিনোদনের সব মাধ্যমগুলিকেই আমরা ইতিমধ্যে আত্মস্থ করে নিয়েছি। এই আগ্রাসী আত্মীকরণে পৃথিবী জুড়ে ভিডিও স্ট্রিমিং-এর প্রসারণ গুণোত্তর প্রগতিতে বাড়ছে। এতে প্রেক্ষিতটা দ্রুত বদলাতে বাধ্য। প্রচলিত অর্থে হলিউড যে ব্লকবাস্টার ছবি এবং কমিক বুক সিক্যুয়েলগুলি থেকে বিগত কয়েক দশকে প্রভূত আয় করেছে, ইদানিং তাতে মন্দা। অবস্থা এতই করুণ যে, পরবর্তীকালে হয়তো ঐ ধরনের ছবি তৈরিই হবে না। এই পরিস্থিতিতে হলিউডে অর্থ বিনিয়োগে অন্যতম উৎস হয়ে উঠছে নেটফ্লিক্স। তুলনামূলকভাবে স্বল্প খরচে নিজেদের ছবি ও ধারাবাহিকগুলি প্রযোজনাতেই তাদের মনোযোগ। শুধুমাত্র কনটেন্ট জোগাড়েই যারা ২০১৮ সালে প্রায় তের বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তাদের উৎসাহ এবং উদ্দীপনায় আমেরিকার ম্রিয়মাণ ফিল্ম স্টুডিওগুলি তাই নতুনভাবে আজ সক্রিয়। এই উদ্যোগকে কি সিনেমার মর্যাদা দেওয়া উচিৎ? অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচারস কিন্তু জরুরি এই প্রশ্নটি তোলেনি। তাই সিনেমা এবং ভিডিও স্ট্রিমিং-এর বিভাজন নির্ণয়ে কোনও গাইডলাইনও তৈরি হয়নি।

***

ভারতে প্রায় চল্লিশ বছর আগে দূরদর্শনে সিনেমা দেখানো শুরু হয়। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের অভ্যাস তাই দীর্ঘদিনের। কারণ, ‘বোকা বাক্সে’র সূত্রে ক্রমশ এমন বাংলা, হিন্দি এবং অন্যান্য ভাষার সিনেমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, প্রেক্ষাগৃহে যাদের পুনর্মুক্তি ঘটবে না। অর্থাৎ, প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে সিনেমার যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তা শিথিল হতে শুরু হয় তখন থেকেই। অন্যদিকে হোর্ডিং, ব্যানার, সংবাদপত্রের মতো প্রিন্ট মিডিয়াগুলি ব্যবহারের প্রচলন ছেড়ে ভোগ্যপণ্য উৎপাদক সংস্থাগুলি তাদের বিজ্ঞাপন খাতে বার্ষিক বরাদ্দ অর্থের সিংহভাগই টেলিভিশনে নিজেদের পণ্য প্রচারে বিনিয়োগ করে। অবকাশ যাপন এবং মনোরঞ্জনকে পণ্য করে তোলাবার এই আক্রমণাত্মক প্রয়াস বৃদ্ধি পায় বিশ্বায়নে। একের পর এক বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা স্যাটেলাইটের ব্যান্ডওয়েভ ভাড়া করে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রসারণের অনুমতি পায়। জনশিক্ষা এবং সচেতনতার উদ্দেশ্য ভুলে টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলির রূপরেখাই তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছন্দ প্রচারের জন্য। বাণিজ্যকেন্দ্রিক এই চ্যানেলগুলির প্রভাবে সরকার পরিচালিত দূরদর্শন দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। এবং দর্শকরাও ক্রমশ প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে যাওয়ার পরিবর্তে টেলিভিশনের অন্তরঙ্গ জালে জড়িয়ে পড়ে। বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন আর ভিডিও প্লেয়ার সংযোগে সিনেমা মাধ্যমটি নতুন এক পণ্যে পরিণত হয়। ভিডিও ক্যাসেট। উত্তরোত্তর চাহিদা বাড়তে থাকে তার। ক্যাসেটের পর আসে ভিসিডি এবং তারপরে ডিভিডি। সিনেমার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত মানুষদের মনে মোক্ষম প্রশ্নটি জাগে : সিনেমা বলতে এতকাল মানুষ যা বুঝেছে, তার অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কি?

গত শতকের পাঁচের দশকেও ইউরোপে এই প্রশ্নটি উঠেছিল। যখন টেলিভিশন সেখানকার প্রায় প্রতি ঘরে পৌঁছে যায়। সেই সময়ে চলচ্চিত্রনির্মাতারা দর্শকের কাছে সিনেমা দেখবার অভিজ্ঞতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রচলিত সিনেমার উত্তরণ ঘটিয়ে একের পর এক নতুন ভাবধারার জন্ম দিতে থাকে। স্বকীয় চিন্তা, কারিগরি দক্ষতা এবং গভীর জীবনবোধের পরিচয়ে সিনেমা নতুন করে সম্ভ্রম আদায় করে নেয় অধিকাংশ শিক্ষিত দর্শকদের। সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষরাও যাতে সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তার জন্য নিয়মিত সিনেমাগুলির প্রদর্শন এবং তা নিয়ে লেখালেখি এবং ব্যাপক স্তরে আলোচনার আয়োজিত হয়। সেই সম্মিলিত উদ্যোগে সিনেমার নবজন্ম ঘটে সারা বিশ্বে।

এখানে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত, দৈনন্দিন জীবনযাপনের চেনা সুখ-দুঃখগুলির সঙ্গে নতুন পরিচিতি, সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির ব্যাপ্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাধারার শ্লেষাত্মক প্রতিফলন— সিনেমা থেকে আহৃত মনোরঞ্জনে এই মানবিক চাহিদাগুলিও যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ক্রমশ সচেতন হতে শুরু করল দর্শকসমাজ। সিনেমার এন্ড-ইউজার যারা— অর্থাৎ, সেই দর্শকদের রুচি, শিক্ষা এবং তাঁদের সংস্কৃতিবোধকে সমৃদ্ধ করবার প্রতি মনোযোগী হয় পুনর্জাত এই সিনেমাগুলি। যা হলিউডে সেই যুগে প্রচলিত জনপ্রিয় সিনেমার ছকগুলিকে ভাঙতে সাহায্য করে। এবং ইউরোপীয় চিত্রনির্মাতাদের কদর বাড়ে হলিউডে। দ্বিতীয়ত, সিনেমা এবং টেলিভিশনের সহাবস্থান সূচিত হয়, যা পরবর্তীকালে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে বললে ভুল হবে না। ঘরে বসে টেলিভিশন দেখবার অভ্যাস তৈরি হলেও নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহে নতুন সিনেমাগুলির প্রাণচাঞ্চল্যে শরিক হওয়ার মধ্যে অধিকাংশ মানুষ তখনও স্বচ্ছন্দ। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকারেরা টেলিভিশনের দর্শকদের জন্য তাঁদের শৈল্পিক স্বতন্ত্রতায় ধারাবাহিক নির্মাণ করেছেন, এমন উদাহরণও কম নেই। যাদের মধ্যে সুইডিশ টেলিভিশনের জন্য ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘সিক্স সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ’ (১৯৭৩), পোলিশ টেলিভিশনের জন্য ক্রিস্তভ কিয়েসলস্কির ‘ডেকালগ’ (১৯৮৮) এবং ভারতীয় দূরদর্শনের জন্য গোবিন্দ নিহালনির ‘তমস’ (১৯৮৮) উল্লেখযোগ্য।

টেলিভিশন এবং সিনেমা— দর্শকদের জন্য এই দুটি দৃশ্যমাধ্যমের তারতম্য প্রধানত মাপের। শব্দ-নিরোধক প্রেক্ষাগৃহের বিশাল পর্দায় যে চলমান দৃশ্যরাজি ফুটে ওঠে নাটকীয় শব্দ-সংযোজনের প্রয়োগে, দর্শকদের তাতে বিহ্বল করাটাই প্রাথমিক উদ্দেশ্য। ছবিটি দেখে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বার হওয়ার পর সমগ্র ছবিটি এক বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েই দর্শকদের স্মৃতিতে রয়ে যাওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা। অন্যদিকে, টেলিভিশনের ক্ষেত্রটি সীমিত। এখানে তাৎক্ষণিকতার উপর গুরুত্ব সর্বাধিক। দৈনন্দিন সংবাদ এবং তথ্য সচেতনতার পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে পুরনো সিনেমার গানে গুনগুন করে ওঠা, নাটকীয় দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠলে হাতের কাজ ফেলে পর্দায় চোখ রেখে অতীতকে ক্ষণকালের জন্য ফিরিয়ে আনার মাধ্যম হল টেলিভিশন।

তবে এই সহাবস্থা্নে টেলিভিশন সমৃদ্ধ হলেও, সিনেমার বাণিজ্য তখন থেকেই বিপন্ন। তাই চমৎকারিত্ব আনতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে মনোযোগী হয় হলিউড। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের প্রাধান্য বাড়তে থাকে সিনেমায়। এবং একটা সময়ে প্রচলিত সেলুলয়েড ফিল্মে গৃহীত অ্যানালগ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে আনা হয় ডিজিটাল ফিল্মের প্রযুক্তি। টেলিভিশনকে খাটো করতে গিয়ে সিনেমা নিজের মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেকে প্রায় টেলিভিশনের সমগোত্রীয় করে ফেলে। সামগ্রিকভাবে কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই সিনেমা এখন সেলুলয়েডে নয়, ভিডিও টেকনলজির উপর নির্ভরশীল। এ নিয়ে হাজার একটা প্রশ্ন থাকলেও চলচ্চিত্রকারদের এই নতুন ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে হয়েছে। কারণ, ভিডিও চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা প্রযুক্তি এবং শব্দসংযোজনের আয়োজন ব্যবহার না করলে আর ছবি বানানো যাবে না। কোডাক এবং ফুজির সেলুলয়েড ফিল্মের উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে তালা পড়েছে। প্রেক্ষাগৃহগুলিতেও তাই প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল হয়ে ডিজিটাল প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা হয়েছে। (নন্দন এবং অন্যান্য শহরের হাতে গোনা কিছু প্রেক্ষাগৃহে অবশ্য সেলুলয়েড ছবি দেখানোর জন্য প্রজেক্টর মেশিনগুলি এখনও আছে।)

রাতারাতি না হলেও অতি দ্রুত টেলিভিশনের পর্দাতেও প্রয়োজনমাফিক বদল আনছিলেন উৎপাদকেরা। সিনেমার অভিজ্ঞতাকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে টেলিভিশনের চৌকো পর্দা ক্রমশ আয়তক্ষেত্রে পরিণত হয়। টেলিভিশন উৎপাদক, চ্যানেলগুলির মালিক, অনুষ্ঠান কার্যকর্তা এবং প্রযুক্তিবিদরা একযোগে এই বাহ্যিক পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করেন। এরপরে শুরু হয় স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং ল্যাপটপের স্ক্রিনগুলির অনুপাতগত মাপগুলিকেও স্ট্যান্ডার্ডাইজ করবার পালা। সিনেমার পর্দা থেকে টেলিভিশন, কম্পিউটার স্ক্রিন, ল্যাপটপ এবং স্মার্টফোনকে ভিডিও স্ট্রিমিং-এর উপযুক্ত করে তোলা হয়েছে বলেই নেটফ্লিক্স-এর চিফ কনটেন্ট অফিসার টেড সারান্দোজ এখন প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখার অভ্যাসকে ‘অতীত’ বলতে ইতস্তত করেন না। স্বাভাবিকভাবেই সিনেমা প্রদর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিভিন্ন দেশের ত্রস্ত ব্যবসায়ী মহল এই ঘোষণায় নতুনভাবে তৎপর। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবিগুলিকে এখন আইনানুগভাবে নব্বুই দিনের মধ্যেই ভিডিও স্ট্রিমিং করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। প্রেক্ষাগৃহে ছবি প্রদর্শন যে আর লাভদায়ক নয়, তার শিক্ষা গত এক বছরে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি থেকে তাঁদের হয়েছে। এর ফলে প্রযোজিত ছবিগুলির স্যাটেলাইট রাইটস-এর পাশাপাশি ভিডিও স্ট্রিমিং রাইটসও বিক্রি করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির আগেই বিনিয়োগের একটি মোটা অংশের অঙ্ক তাঁরা তড়িঘড়ি ফিরিয়ে আনছেন ঘরে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের দিকে একবার নজর দেওয়া যাক।

২০১০ সালে ভারতে ছিল মোট ১,০১৬৭টি সিনেমা হল। শেষ হিসেব অনুযায়ী (২০১৬) সংখ্যাটি এসে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার এবং ২,১০০টি মালিপ্লেক্সে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ৩৩০ থেকে কমে হয়েছে ২৪৬। কলকাতায় সিঙ্গল স্ক্রিনের সংখ্যা তিরিশের আশেপাশে। সিনেমা হলগুলির বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ, ভিডিও পাইরেসিকে আপামর ভারতীয় কোনও অপরাধ হিসেবে দেখেন না। এটি একটি অধিকার বিশেষ। আইনানুগ ব্যবস্থার পরেও যে মনোভাবে বিশেষ তারতম্য ঘটেনি। ঘটবেই বা কী করে? প্রযোজকরা সার্টিফিকেশন বোর্ডে প্রিভিউ-এর জন্য ফিল্মের যে প্রিন্ট বা কপি পাঠান, তা থেকেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাজার হাজার ডিভিডি তৈরি করে খোলা বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয় স্বল্পমূল্যে। এছাড়াও, আধুনিকতম প্রযুক্তির সাহায্যে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন অপরাধী চক্র নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি চোরাগোপ্তা কপি বানিয়ে প্রকাশ্যে ঢেলে বিক্রি করে প্রশাসনকে তোয়াক্কা না করে। পাইরেসি বিরোধী আইন তৈরি হওয়ার পরে তা কার্যকর করবার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৎপরতার অভাবে বিক্রেতা এবং গ্রাহকদের মনোভাব ও বিপণন ব্যবস্থায় বিশেষ তারতম্য ঘটেনি। (ইদানিং ডিভিডি’র ঝামেলা এড়িয়ে ফাইলগুলি ক্লাউডে স্টোর করে অনলাইনে লেনদেনের চল শুরু হয়েছে।) অন্যদিকে চক্রাবর্তে, প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের আগমন কম হওয়ার আরেকটি কারণ, টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। মন্দার বাজারে যা হলগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মালিকদের প্রয়োজন। মনোরঞ্জন কর হিসেবে যার সর্বমোট ১৮% জিএসটি আদায় করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার।

সুতরাং, ভারতের সাধারণ মানুষ যে ভিডিও স্ট্রিমিংকে উদ্বাহু হয়ে স্বাগতম জানাবে এবং যে সংস্থা এখানে যত সস্তায় ভিডিও স্ট্রিমিং-এর সুবিধা দেবে, সে যে ততই জনপ্রিয় হবে, তা বলাই বাহুল্য। কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চ-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ভারতের বৃহত্তম ভিডিও স্ট্রিমিং সার্ভিস হল হটস্টার (সাড়ে ৭ কোটি সাবস্ক্রাইবার)। এরপর ভায়াকম-এর ভুট (২ কোটি ২০ লক্ষ), অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও (১ কোটি ১০ লক্ষ)। তাই এই দেশে ওভার-দ্য-টপ (OTT) প্ল্যাটফর্মগুলির মধ্যে নেটফ্লিক্স আপাতত রয়েছে পঞ্চম স্থানে (৫০ লক্ষ)। এবং এদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশই পয়সা দিয়ে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রাইবার। বাকিরা ৩০ দিনের ফ্রি ট্রায়াল পিরিয়ডের পর নেটফ্লিক্স দেখা ছেড়ে দিয়েছে। তার প্রধান কারণ, নেটফ্লিক্সে ভারতীয় কনটেন্ট-এর একান্ত অভাব। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের সাম্প্রতিক সংবাদ অনুযায়ী, নেটফ্লিক্সের অন্যতম প্রতিযোগী হিসেবে ‘অ্যাপেল’ তার OTT প্ল্যাটফর্ম নিয়ে বাজারে অবতীর্ণ হলে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে ভিডিও স্ট্রিমিং-এর বিন্যাসে নতুন এক মাত্রা যোগ হবে।

রূপান্তরের পর্বটি চলাকালীন চলচ্চিত্র দর্শকদের যে অংশটি দীর্ঘ সময় ধরে Cable অথবা DTH টিভির প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, অনলাইন ভিডিও এবং স্ট্রিমিং সার্ভিসের সুবিধা গ্রহণে তাঁদের অনেকেরই দ্বিধা নেই। তুলনামূলকভাবে বয়স্ক দর্শকদের অধিকাংশ পে চ্যানেলগুলি নিয়মিত দেখলেও ৩২ থেকে ৪৮ বছরের অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগ ক্রমবর্ধমান মাসিক খরচ, চ্যানেল বান্ডলিং প্যাকেজ (এখানে যা Channel bouquet নামে পরিচিত)— তার বাছাবাছি এবং পারস্পরিক বিবাদে জড়িয়ে পড়া স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কগুলির পরিষেবায় অখুশি। OTT প্ল্যাটফর্মগুলি এই অংশের দর্শকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘কস্ট-এফেক্টিভ অল্টারনেটিভ’ হিসেবে। এই কারণে স্মার্ট টিভি এবং অ্যাডাপ্টারগুলির বাজার এখন তুঙ্গে। এছাড়া ইন্টারনেট টিভি অ্যাপগুলির ডেভেলপাররা নিত্য নতুন আপডেটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের যে চমকপ্রদ ভিডিও এক্সপিরিয়েন্সের সঙ্গে পরিচয় ঘটাচ্ছে তার তুলনায় প্রচলিত বীক্ষণব্যবস্থা শ্লথ এবং বিষয়বৈচিত্রেও দুর্বল বলে প্রমাণিত। সব মিলিয়ে দৃশ্যব্যবসা এখন মধুময়। সেই মধুর ভাগ পেতে তাই OTT প্ল্যাটফর্মগুলির সঙ্গে ইন্টারনেট টিভি, স্মার্টফোন অ্যাপ ডেভেলপার এবং স্যাটেলাইট টিভি পরিষেবা সংস্থাগুলির হাত মেলানোটা এবার অবশ্যম্ভাবী।

***

তবে টেড সারান্দোজ আপাতত এই মুহূর্তে নেটফ্লিক্স-এর প্রযোজিত ভিডিও স্ট্রিমিং কনটেন্ট-কে চলচ্চিত্র হিসেবে আন্তর্জাতিক মান্যতা দেওয়ার জন্য জলের মতো ডলার খরচ করে চলেছেন। এর ফলে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এবং স্মার্ট টিভিতে অভ্যস্ত দর্শকদের কাছে বিভিন্ন সচল দৃশ্যমাধ্যমগুলিতে অবাধ বিচরণ (ট্রান্সমিডিয়া ভিউইং)-এর অভিজ্ঞতাই এখন সিনেমার বিকল্প হয়ে উঠছে। প্রচলিত অর্থে যারা চলচ্চিত্রপিয়াসী বা সিনেফিল, তাদের অধিকাংশের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজার পরিচালিত এই অবিশ্বাস্য দৃশ্যজোয়ার আশীর্বাদ না বিড়ম্বনা— তা নির্ধারণ করা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে প্রতিদিন। এত রকমের অপশনের মাঝখানে সিনেমার চিহ্ন কোথায়? এই প্রশ্নে তাঁরাও দিশাহারা। অথচ স্বদেশ এবং বিদেশ— সর্বত্রই বহু চিত্রনির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলী তথা দর্শক ইতিমধ্যেই এই ভিডিও স্ট্রিমিং-এর মধ্যে সিনেমার বৈশিষ্ট্যগুলিকেও খুঁজে পাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পেশাদার বিশেষজ্ঞরা যে নীরবতায় এই পর্বান্তরের সাক্ষী হচ্ছেন তাতে এটুকুই বলা যায় যে, সেলুলয়েড ফিল্ম-এর অবর্তমানে সিনেমা পর্ব এবার শেষ, ভিডিও স্ট্রিমিং শুরু।