Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৃত্যুর চার দশক পর ঘরে ফিরল বিনোদবিহারীর কাজ

সুমিতা মুখার্জি

 

নন্দলাল না থাকলে আমার আঙ্গিকের শিক্ষা হত না, লাইব্রেরি না থাকলে আমার জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হত না, আর প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি উপলব্ধি না করলে আমার ছবি আঁকা হত না।

[চিত্রকর : বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়]

একেই বোধহয় বলে ‘ঘরে ফেরা’। গত শতকের ত্রিশের দশকে শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাজে শান্তিনিকেতন-সংলগ্ন প্রকৃতি এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছিল। সে-সময় শিল্পী দূরপ্রাচ্যের শিল্পপ্রভাবে কিছু স্ক্রোল এঁকেছিলেন। তার মধ্যে দুটি অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত হয়েছিল। একটি বড় স্ক্রোলে ধরা দিয়েছিল খোয়াইয়ের রুক্ষ, তরঙ্গায়িত, জলধারা-খোদিত লালমাটি এবং দিগন্তবিস্তৃত নির্জন শূন্যতার রূপ। অন্যটিতে ধরা পড়েছিল প্রকৃতির বিস্তীর্ণ প্রসারের মাঝে তরুছায়ানিবিড় গ্রামজীবনের স্নিগ্ধ ছবিখানি। শিল্পীর জীবনাবসানের প্রায় চল্লিশ বছর পরে এই স্ক্রোল দুটি এবং তাঁর আরও প্রায় ৫০০ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্প্রতি বিশ্বভারতীর কলাভবনে ফিরে এল।

এখন ভাবলে আশ্চর্য বোধ হয়, কিন্তু জীবনের অধিকাংশ সময় ক্ষুদ্র শিল্পীগোষ্ঠীর বাইরে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রায় অজানাই থেকে গিয়েছিলেন। ১৯৭২-এ সত্যজিৎ রায়ের তথ্যচিত্র ‘The Inner Eye’ যখন এই প্রচারবিমুখ, অন্তর্মুখী শিল্পীর শিল্পপ্রতিভা এবং অসামান্য শিল্পকর্মগুলি জনসমক্ষে নিয়ে আসে, ততদিনে তাঁর শিল্পীজীবন অস্তগামী।

‘The Inner Eye’-এর শুটিং চলাকালে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে বিনোদবিহারী; শান্তিনিকেতন ১৯৭১। ছবি : নিমাই ঘোষ। সৌজন্য : ১x১ আর্ট স্পেস, দুবাই।

জন্মাবধি ক্ষীণদৃষ্টি, ভগ্নস্বাস্থ্য বিনোদবিহারীর ইস্কুলে পড়া হয়নি, কিন্তু পারিবারিক সংস্কৃতি ও সহজাত মেধার সম্মিলনে তাঁর পড়াশোনা ইস্কুলের পাঠক্রমের গণ্ডী বহুদূর অতিক্রম করে গিয়েছিল। ১৯১৭ সালে ১৩ বছর বয়সে বিনোদবিহারী যখন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে পড়তে এলেন, তখনই তাঁর পাঠের ব্যাপ্তি দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এবং নন্দলাল এর শিষ্যত্বে বিনোদবিহারীর শিল্প ও সাহিত্যপ্রতিভার স্ফুরণ হয়েছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। শিল্পতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর মৌলিক অবদান ভারতের শিল্পচিন্তার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৯১৯ সালে যখন কলাভবন প্রতিষ্ঠিত হয়, প্রথম ছাত্রদের একজন ছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন দেববর্মন, মণীন্দ্ৰভূষণ গুপ্ত, বিনায়ক রাও মাসোজি, প্রভাতমোহন বন্দোপাধ্যায় এবং কিছু পরে যোগ দেন রামকিঙ্কর বেজ, সুধীর খাস্তগীর। কলাভবনের পাঠ শেষ হওয়ার অল্প পরে ১৯২৫ সালে বিনোদবিহারী কলাভবনে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর ছাত্র শিল্পী কেজি সুব্রহ্মণ্যন স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, বিনোদবিহারী প্রত্যেক ছাত্রকে তার প্রয়োজনমতো আলাদা নির্দেশ দিতেন। ক্রমে শিক্ষক হিসেবেও তিনি কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন।

তিরিশের দশকে তাঁর স্ক্রোলের কাজগুলির কথা আগেই বলেছি। এই দশকের আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ১৯৩৭ সালে তাঁর জাপান ভ্রমণ। নন্দলাল বসুর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে জাপান-প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে কলাভবনের ছাত্র পাঠাবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই রাসবিহারী বসুর সহায়তায় বিনোদবিহারী জাপানে শিল্প ও শিল্পী সান্নিধ্যে কাটালেন প্রায় এক বৎসরব্যাপী সময়। প্রাচ্য শিল্পের একটি বিশিষ্ট ধারার এই পরিক্রমণ তাঁর শিল্পীজীবনের মূল প্রভাবগুলির অন্যতম। শিল্পী বিনোদবিহারীর কর্মজীবনে চল্লিশের দশকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়েই তিনি শান্তিনিকেতনে তাঁর অসামান্য মিউরালগুলি করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রথম কাজ বীরভূমের গ্রামদৃশ্য (Birbhum Landscape), ১৯৪০ সালে কলাভবনের আমতলা ছাত্রাবাসের ছাদে। এখন অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত এই কাজের পুরনো ছবিতে দেখা যায় জমি (space) এবং দৃষ্টিকোণ (perspective) ভেঙে কীভাবে একটি জটিল বিষয়বিন্যাসকে (composition) আপাত সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এর পরের মিউরাল ১৯৪২ এর আশ্ৰম দৃশ্য (Campus Life), চীনাভবনের দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে। পরিসরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জমি ভাগ করেছেন দূরপ্রাচ্যের স্ক্রিন পেইন্টিং এর ধরনে।

খোয়াই (স্ক্রোল)। প্রথম ছবি দুটি অংশ ১ এবং ২। শেষেরটি পূর্ণ। নেপালি কাগজে টেম্পেরা। ৩৯x৩১৩ সেমি। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি।

মুরাল : বীরভূম ল্যান্ডস্কেপ। সিলিং-এ এগ টেম্পেরা। ১৯৪০। ২৫৩x৬০৬ সেমি। কলাভবন কমপ্লেক্স, শান্তিনিকেতন। ফটো : মুথুস্বামী। সৌজন্য : কলাভবন, শান্তিনিকেতন।

মুরাল : লাইফ অন ক্যাম্পাস, ১৯৪২। এগ টেম্পেরা। ২১৮x১৯৭ সেমি। চিনা ভবন, শান্তিনিকেতন।

এরপর ১৯৪৬-এ শুরু করলেন হিন্দিভবনের তিনটি দেওয়াল জুড়ে তাঁর প্রসিদ্ধতম কাজ মধ্যযুগীয় সন্তজীবন (Life of the Medieval Saints)। যে পাঁচজন সন্তকে তুলে ধরেছেন – রামানুজ, কবীর, সুরদাস, গোবিন্দ সিং এবং তুলসিদাস – তাঁরা প্রত্যেকেই সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। যে সময় বহু শিল্পীর দৃষ্টি নিবদ্ধ পৌরাণিক গল্প বা দেবদেবীর আখ্যান-ভিত্তিক কাজে, সেই সময় বিনোদবিহারীর বিষয় নির্বাচনের স্বতন্ত্রতা তাঁর অন্যতর শিল্পচিন্তার নিদর্শন। ভিজে প্লাস্টারের দেওয়ালে কোনও প্রস্তুতিচিত্র ছাড়াই true fresco বা Buon Fresco পদ্ধতিতে কাজ। এই ইউরোপীয় পদ্ধতিটি প্রতিমা দেবী শিখেছিলেন প্যারিসে – তাঁর মাধ্যমেই শান্তিনিকেতনে এর সূত্রপাত। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অংশে ভিজে দেওয়ালের উপর একটানা কাজ। কিন্তু বিনোদবিহারীর দৃষ্টি ক্ষীণ – দূর থেকে সমগ্র কাজের বিন্যাস তিনি দেখতে পান না – শুধু জমি বিভাজনের ছন্দোবদ্ধতা মাথায় রেখে এক-একটি অংশ আঁকছেন। প্রতিকূলতার মধ্যেই ব্যবহার করছেন নানা দৃশ্যকোণ, নানাভাবে জমি বিভাজন – এবং আশ্চর্যভাবে সামগ্রিক চিত্রে কোথাও যোগসূত্রের অভাব হচ্ছে না। নূতন চিন্তায়, নূতন পদ্ধতি ব্যবহারে, দেশকে সন্তকবিদের ভূমিবীক্ষণে যে একসূত্রের সন্ধান করেছেন তা শুধু আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শনই নয়, আজকের নানা বিভাজনের দিনেও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।

সৈয়দ মুজতবা আলি ও বিনোদবিহারী, ১৯৫৭। নেপালি কাগজে টেম্পেরা। ২৫x৩৭.৮ সেমি।

বীরভূম সামার ল্যান্ডস্কেপ, ১৯২১। কাপড়ের ওপর টেম্পেরা। ২৫.৫x৩৬ সেমি। ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট (এনজিএমএ)-এর সংগ্রহ থেকে।

মুরাল : মধ্যযুগীয় সন্তজীবন ১-৪, ১৯৪৬-৪৭। হিন্দিভবন, শান্তিনিকেতন।

১৯৪৭ সালে হিন্দিভবনে ‘মধ্যযুগীয় সন্তজীবন’ কাজটি শেষ হওয়ার দু’বছর পরে নানা মতানৈক্যের কারণে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতন ছেড়ে যান। যোগ দেন নেপালের সরকারি মিউজিয়ামের কিউরেটর পদে। তিন বছর পরে নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই কাজ ছেড়ে রাজস্থানে গেলেন। এরপর নানা জায়গায় কাজ করেছেন, কিন্তু স্থায়ী কর্মভূমি পাননি। তবে যাযাবর জীবন প্রতিনিয়ত নুতন অভিজ্ঞতায় তাঁর শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে।

১৯৫৮ সালে বিনোদবিহারী যখন কলাভবনে ফিরলেন, তার আগেই চোখে অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়েছেন। তবে দৃষ্টিহীনতা তাঁর শিল্পসত্তাকে পরাজিত করতে পারেনি। তেতাল্লিশ বছর আগে রচিত গুরুদেবের গান ধ্বনিত হল তাঁর জীবনে…

চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে।

ছবির বদলে এবার কাগজ কেটে কোলাজ, কাগজ ভাঁজ করে অবয়বের রূপকল্প এবং মোম, প্লাস্টিসিন বা মাটির ভাস্কর্য। কাগজ ভাঁজ করে যে কাজ করেছিলেন সেগুলির ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে কলাভবন চত্বরে সেরামিক টাইলের মিউরাল তাঁর শেষ বড় কাজ। আর আত্মবীক্ষার গভীরে ডুবে লিখতে শুরু করলেন। পরে ‘চিত্রকর’ বইতে প্রকাশিত সেই লেখাগুলি, বিশেষত ‘চিত্রকর’ অংশে তাঁর শিল্পীজীবনের দিদৃক্ষা এবং ‘কত্তামশাই’ অংশে অন্ধকার জগতের গভীরে তাঁর মর্মস্পর্শী আকার-সন্ধান বাংলা সাহিত্যে এক অভিনব মাত্রা যোগ করে।

শরবন। কাগজে জলরং। ১৫/৫/১৯৩৮। কলাভবন, শান্তিনিকেতনের সংগ্রহ থেকে।

গ্রামের দৃশ্য (স্ক্রোল)। অংশ ও সম্পূর্ণ। কাগজে জলরং। ১৫.৪x১৯৮ সেমি। ১৯৩৮-৩৯।

আত্মপ্রতিকৃতি। কাগজে জলরং। ১২.৮x১৭.৫ সেমি। ১৭/১১/১৯৪৬।

পরশুরামের ‘জাবালি’ গল্পের শেষে ব্রহ্মা জাবালিকে উদ্দেশ করে বলছেন, “হে স্বাবলম্বী মুক্তমতি যশোবিমুখ তপস্বী, তুমি আর দুর্গম অরণ্যে আত্মগোপন করিও না, লোকসমাজে তোমার মন্ত্র প্রচার কর।” শিল্পতপস্বী বিনোদবিহারীর জীবনের শেষ দশকে যেন এই বাক্য প্রতিফলিত হল। এতদিন ক্ষুদ্র শিল্পীগোষ্ঠীর বাইরে তাঁর শিল্প এবং চিন্তা প্রায় অজানা ছিল। ১৯৭২-এ সত্যজিৎ রায়ের পূর্বোল্লিখিত তথ্যচিত্র ‘The Inner Eye’ তাঁকে জাতীয় জনসমক্ষে নিয়ে এল। ১৯৭৪-এ ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ সম্মান দিলেন। ১৯৭২-এ শান্তিনিকেতন থেকে বিদায়ের পরবর্তীকালে যখন দিল্লিতে বসবাস করছেন, তখন তিনি ভারতবিখ্যাত শিল্পী। ১৯৭৭ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম সম্মান দিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘চিত্রকর’ বইটি সম্মানিত হল ১৯৮০ সালে ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কারে ও ১৯৮১ সালে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে।

এই বছর ২০১৯-এ, কলাভবনের শতবর্ষে, শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের পাঁচশোরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ কলাভবনের সংগ্রহে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি স্ক্রোল এবং প্রতি পাতায় শান্তিনিকেতনের দৃশ্য আঁকা চাইনিজ স্কেচবুক। এই স্কেচবুক এবং একটি স্ক্রোল তিনি পত্নি লীলাকে বিবাহে উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে তাঁর কন্যা ভাস্কর মৃণালিনী মুখার্জির তত্ত্বাবধানে কাজগুলি ছিল – অর্থাভাব সত্ত্বেও এই অমূল্য সম্পদ তিনি সযত্নে রক্ষা করেছেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃণালিনী মুখার্জির মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছানুসারে মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশন থেকে মুল সংগ্রহের প্রায় এক হাজার কাজের মধ্যে পাঁচশোরও বেশি কাজ কলাভবনকে দেওয়া হয়। তাঁর জীবনে শান্তিনিকেতনের অবদানের কথা বিনোদবিহারী সর্বদাই স্মরণ করেছেন, তাঁর কন্যাও সেই কথার অনুসরণে তাঁর কাজগুলি শান্তিনিকেতনে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।

চাইনিজ স্কেচবুকের তিনটি পাতা। কাগজে কালি এবং জলরং। ১৯৪২।

উডকাট। বাঁদিকে, প্রিন্ট মেকার। ২০x১২.৫ সেমি। ২/৫/১৯৪৪। এবং ডানদিকে, সিটেড ফিগার। ১৫.৩x৯.৬ সেমি। ৯/৪/১৯৪৪।

নেপাল (মন্দির এবং পুণ্যার্থীরা)। কাগজে কালিকলম এবং জলরং। ৩৪.৩x২৩ সেমি। ১৯৪৯।

কলাভবনের অধ্যাপক, বিশিষ্ট শিল্প-ঐতিহাসিক এবং মৃণালিনী মুখার্জি ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের সদস্য শ্রী আর শিবকুমার জানিয়েছেন, শিল্পী বিনোদবিহারীর জীবনে এবং কাজে শান্তিনিকেতনের গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে সর্বসম্মতিক্রমে কাজগুলি কলাভবনকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নিউ ইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত মেট্রোপলিটান মিউজিয়ম অফ আর্ট একটি স্ক্রোল কিনে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু শান্তিনিকেতনের সঙ্গে বিনোদবিহারীর নিবিড় যোগের কথা মনে রেখে এবং তাঁর কাজগুলি যাতে একত্রে থাকে সেই ভাবনায় ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট রাজি হননি। কাজগুলি প্রদর্শনের জন্য কলাভবনের বর্তমান মিউজিয়ামটি সম্প্রসারণে সরকারি সম্মতি পাওয়া গেছে। সম্প্রসারণ সমাপ্ত হলে শিল্পী বিনোদবিহারীর কাজগুলি প্রদর্শনের একটি স্থায়ী ব্যবস্থা হবে। অবশ্য তার আগেই শিল্পীর কিছু কাজ অস্থায়ী ভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থা হয়েছে। এইবছর মার্চ মাসের ১২ থেকে ২৮ পর্যন্ত ৭৫টি কাজ – উপরিউক্ত স্ক্রোলদ্বয় এবং স্কেচবুক সহ – কলাভবনের নন্দনে প্রদর্শিত হয়েছে।

শ্রী আর শিবকুমার আরও জানিয়েছেন, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র প্রখ্যাত শিল্পী কেজি সুব্রহ্মণ্যন (১৯২৪-২০১৬) তাঁর শান্তিনিকেতনের (পূর্বপল্লী) বাসভবনটি কলাভবনকে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় আর্কাইভ ও গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবার জন্য দান করেছেন। এতদিন বিশ্বভারতীতে স্থায়ী উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে এই কাজ শুরু হয়নি। সম্প্রতি স্থায়ী উপাচার্য যোগ দিয়েছেন, ফলে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এই কেন্দ্রটি বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের শিল্প ও শিল্পতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণায় নূতন দিক নির্ণয় করবে।

স্থলপদ্ম। নেপালি কাগজে টেম্পেরা। ৩৫x২৯ সেমি। ১৯৪৩।

শিমুল। তেলরং। ৫২x৬৫ সেমি। ১৯২৩।

লেডি উইথ ফ্রুট। পেপার কাট। ২৬x২৮.৫ সেমি। ২১/৬/৫৭।

কর্মজীবনে কলাভবনের সঙ্গে বিনোদবিহারীর সম্পর্ক সর্বদা সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল না। এক সময় তিনি কলাভবন ছেড়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। ন’বছর পরে আবার যখন ফিরে এলেন, কলাভবন তাঁকে লেকচারার পদে নিযুক্ত করে। কর্মজীবনের শুধু শেষ দু’বছর ১৯৬৮-৭০ তিনি ‘প্রফেসর’ পদে উন্নীত হন। তবে শান্তিনিকেতনের আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি তাঁর কাজ, তাঁর চেতনা জুড়ে ছিল। ‘কত্তামশাই’-এর প্রতিটি ছত্র যে চেতনায় উদ্ভাসিত।

এতদিন পরে তাঁর শিল্পসম্ভার আজ কলাভবনে ফিরে এসেছে। আশা করা যায় পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর কাজ এবং চিন্তার বিশ্লেষণে তাঁর শিল্পের যথাযোগ্য স্থান নির্ণয় করবে।

তথ্যসূত্র  

চিত্রসূত্র