ইন্দ্রনীল মজুমদার
তাঁর 'দুর্গা' সেই মূলগত শক্তি, তাঁর 'বহুরূপী' বস্তু পেরিয়ে ভিতর দিকে দেখা। যাই দেখছেন তাই দৃশ্যের পিছনের অদৃশ্যকে দেখা। এই রূপের পিছনে বহুরূপের খোঁজই তাঁর পরিণত পর্যায়ের সৃষ্টি। মডার্নিজম মানেই অগ্রগতির রথযাত্রা নয়, অতীতকে ঝেড়ে ফেলাও নয়। রিয়ালিটি বলে কিছু নেই। সবটাই ভিতরপানে দেখার ভঙ্গিমা
তিনি এমন একজন শিল্পী ছিলেন যাঁর কাছে শিল্পী ও কারিগরের বিভাজন গ্রাহ্য নয়। কেরলের মন্দির ও রথ, কালীঘাট ও ওডিশার পট, বাংলার মন্দির টেরাকোটা, কাঠের পুতুল— এই সবকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়েই তিনি খুঁজেছিলেন বিষয়ের রূপ ও বিন্যাস। তিনি এটাকে বলতেন object making to performance. পুতুলনাচ যেমন। আবার সেটা private musing to public statement-ও বটে। কত শব্দ, কত নাম। Representation, construction, collage, combine, expression, experiment, improvisation, virtual reality. এগুলো ক্রিটিকদের লেবেলমাত্র, আসলে খোঁজার তফাত। বলেছেন যুগ, প্রগতি, একটার পরে একটা এরকম কোনও টাইমলাইন হয় না। সব একসঙ্গেই আসে, ক্রিটিকরাই ভাগ করতে চান কালানুক্রমিক-ক্লাসিকাল-মডার্ন, কলোনিয়াল-পোস্ট কলোনিয়াল, লোকাল-গ্লোবাল। সব আসে একসঙ্গেই, একটা মুছে আর একটা— এই ক্রমে নয়। নতুন-পুরনো ভাগ হয় না, একসঙ্গেই থাকে। প্রোগ্রেস নামক কালানুক্রম তিনি বিশ্বাস করতেন না। পুরনো নতুন একসঙ্গেই থাকে, একটা মুছে আর একটা আসে না। বলেছিলেন Old sibyls and the new oracles. একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন অনেক গভীর কথা। ব্যক্তিশিল্পী হয় না। শিল্পী উঠে আসে একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকেই। তাতে ধর্মও মিশে থাকে। ব্যক্তিশিল্পী নিয়ে হইচই শুরু হল বিলিতি আর্ট স্কুল আসার পরে। ফটোগ্রাফিক রিয়ালিজম, প্রিন্ট, লিথো, কমার্শিয়াল আর্ট ভুলিয়ে দিল ওই স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠার আসল উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল দেশজ শিল্পের ধারা পুনরাবিষ্কার। কারিগরি ও শিল্পের টানাটানি শুরু হল এর পরে, মাধ্যমের রদবদল হতে থাকল। সুব্রমনিয়ান নিজেও এইভাবেই খুঁজে চলেছিলেন জীবনভর। কলাভবনের সাদাকালো মুরাল, রিভার্স ইমেজ, দেশজুড়ে আরও অনেক প্রবাদপ্রতিম মুরাল— এটুকুর মধ্যেই শুধু তিনি নেই। টেরাকোটা, গ্লাস পেন্টিং, ছাপাই ছবি, ভিত্তিচিত্র, সেরামিক, এনামেল, সরা, মুখোশ, পুতুল ও খেলনা, কাঠ খোদাই— তাঁর মাধ্যমের ব্যাপ্তি বিস্ময়কর। লিখতেনও খুব ভাল— শিল্প-সাহিত্য, কবিতা, চিঠি। তাঁর কয়েকটি কবিতা সঙ্কলিত হয়েছিল সিগাল বুকস ও নবীন কিশোর প্রকাশিত একটি বইয়ে, The Creative circuit; The Living Tradition: Letters and poems of K G Subramaniyan. তাঁর আরও কিছু লেখা আর কথোপকথন ওই নবীন কিশোরই প্রকাশ করেছিলেন আশির দশকে। আমেদাবাদে একটি বিল্ডিঙের মুরাল করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি গুজরাত সরকারকে লিখেছিলেন মুরাল আঁকানোর আগে তাঁরা যেন বিল্ডিংটি পরিষ্কার ও গঠন রুচিসম্মত করে দেন।
বিশ্বভারতী কলাভবনের এমেরিটাস প্রফেসর থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, অনেক সান্মানিক পদ পেয়েছিলেন। পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ, অবনীন্দ্র-গগন পুরস্কার পেয়েছেন জাতীয় স্তরে। দেশে বিদেশে বারবার প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর একক শিল্পকর্ম। অগণিত প্রকাশনা তাঁর নামে। ললিত কলা অ্যাকাডেমির ফেলো, অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ডের সহ অধ্যক্ষ (ডিজাইন) ছিলেন। কলকাতায় সিমা গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনী হয় ১৯৯৪ সালে। ছিল তাঁর ‘বহুরূপী’ পর্যায়ের ছবি ও রিভার্স পেন্টিং অন প্লাস্টিক। পরিচিতি অ্যালবামের ভূমিকায় তিনি বললেন নিজের কথা—
In my scheme of things, abstraction and reality are not antagonistic entities. So I find whatever I see entrancing— faces, figures, landscapes, objects, groups. With advancing years I see them miraculously transformed, even heightened in value. I can now see the truth of some of these descriptions of nature in traditional narratives.
দুজন বহুরূপীকে আসতে দেখতেন কলাভবনের পথে। দুটি গ্রামের ছেলে— রামরাবণ, শিব ও কালী সেজে।
Between these village boys and the mythical stereotypes a new reality is born. Mixing the normal with the hieratic. Mixing the worldly with the unworldly, or fact with fantasy. The familiar Durga image is one such bahurupee to me, an intriguing conglomerate. Bringing together earthiness and elemental power.
কুড়ি বছর বয়সে শিল্পশিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে এলেন, সাল ১৯৪৪। পেলেন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও রামকিঙ্কর বেজের মতো অগ্রণী পথপ্রদর্শকদের। প্রভাবিত হলেন গভীরভাবে— বিশেষভাবে শেষ দুজনের কাজে। বিনোদবিহারী ছিলেন তাঁর বিশেষ প্রেরণা। বিনোদবিহারীর শিল্পইতিহাস ও সাহিত্য ও শিল্পের সমান্তরাল পাঠ তাঁকেও অনুপ্রাণিত করেছিল। লিখেছেনও অনেক। সে-কথা বলা হয়েছে আগেই। শেষ বয়সে বরোদা ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর শান্তিনিকেতনের বাসভবন বিনোদবিহারী স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে দান করে গেলেন। বিনোদবিহারীর যাত্রা ছিল অভিব্যক্তিবাদ (expressionism), বিশ্লেষণমুখিনতা থেকে রং ও দৃশ্যবিন্যাসের দিকে, প্রকৃতি ও মানুষের দিকে। পৃথ্বীশ নিয়োগী লিখেছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে—
The sense of otherness of landscape and objects as prevailing over and against man, yields to an increasing concern with the reconciled human image that encompasses nature.
অনেকটা সেইভাবেই মানিদারও অভিমুখ ছিল অবজেক্ট থেকে সাবজেক্ট, বস্তুবিন্যাস থেকে মানুষ— দেশীয় ভাবনাকে সঙ্গে নিয়েই। এটাকে কলা সমালোচক আর শিবকুমার সুন্দরভাবে বলেছেন— metamorphosis from fact to image.
তাঁর ‘দুর্গা’ সেই মূলগত শক্তি, তাঁর ‘বহুরূপী’ বস্তু পেরিয়ে ভিতর দিকে দেখা। যাই দেখছেন তাই দৃশ্যের পিছনের অদৃশ্যকে দেখা। এই রূপের পিছনে বহুরূপের খোঁজই তাঁর পরিণত পর্যায়ের সৃষ্টি। মডার্নিজম মানেই অগ্রগতির রথযাত্রা নয়, অতীতকে ঝেড়ে ফেলাও নয়। আর শিবকুমার আরও পরিষ্কার করে বলেছেন তাঁকে নিয়ে:
He, unlike many modern artists but much like Picasso and Hockney, embraces a very wide spectrum of traditional and modern art-antecedents.
রিয়ালিটি বলে কিছু নেই। সবটাই ভিতরপানে দেখার ভঙ্গিমা। মাদ্রাজ থেকে শান্তিনিকেতন, কলাভবন থেকে বরোদা— তিনি সেই অন্তরসন্ধানী।