Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোদির ফাঁদে পা দেওয়া নয়, বিকল্প ইতিবাচক ভাষ্য গড়ে তুলুন বিরোধীরা

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ভারতের সাধারণ নির্বাচন হল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা সারা বিশ্বের চোখে অভিনব। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে নির্বাচনপদ্ধতির জটিলতা নিয়ে চর্চা চলে সর্বত্রই। প্রতিটি নির্বাচনের এক-একটি ইস্যু থাকে, যা গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনে তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু না-থাকার জন্য আপাতভাবে মনে হচ্ছে যে, নির্বাচনটি মোদির পক্ষে বা বিপক্ষে হতে পারে। অর্থাৎ যাঁরা মোদিকে সমর্থন করেন আর যাঁরা বিরোধিতা, তাঁদের মধ্যে একটা যুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলা প্রয়োজন এবং তা হল এই যে, বিভিন্ন স্বার্থের দ্বন্দ্বই এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তার মধ্যে শ্রেণিস্বার্থ নিভৃতে থাকলেও তা প্রচারে আসছে না। কিন্তু তা অবশ্যই আছে।

অনেকেই মনে করছেন যে, এই নির্বাচনে যে বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে যে উপাদানগুলি তাৎপর্যমণ্ডিত, সেগুলো নিয়ে আলোচনা। যেমন নতুন ভোটারদের সক্রিয়তা, এবং বিশেষত, মহিলা ভোটারদের ভূমিকা। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহিলা ভোটাররা গত নির্বাচন থেকেই ভোটে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক মহিলা ভোটার অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মতামত, বা তার একটা বড় অংশ, মনে করা হচ্ছে যে, মোদির দিকেই গিয়েছিল। এবারও মোদিভক্তরা মনে করছেন, তাঁদের সমর্থন বর্তমান সরকারের দিকেই আসবে। এর একটা কারণ যদি হয় তিন তালাক বিল, অন্য কারণ হল কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প যা গ্রামীণ মহিলাদের স্বাচ্ছন্দের কথা ভেবে নেওয়া হয়েছে। যেমন বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও যোজনা, উজ্জ্বলা যোজনা, সুকন্যা সমৃদ্ধি এবং ম্যাটারনিটি বেনিফিট অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৬ ইত্যাদি। কেউ কেউ বলছেন যে, এই উন্নয়নমুলক কর্মসূচিগুলোই মোদিকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনবে।

কিন্তু সম্প্রতি একটি ওয়েব পোর্টালে অধ্যাপক জেমস ম্যানর লিখেছেন, আপাতভাবে যদিও মনে করা হচ্ছে যে, মোদি আবার ফিরে আসবেন তাঁর ব্যক্তিগত মহিমা দিয়ে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পৃথক। এর জন্য তিনি কতগুলো ‘স্লিপার’কে দায়ী করছেন। এই স্লিপারগুলি মূলত এমনই, যা সাধারণ চোখে প্রতীয়মান হয় না, কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে মনে হয় যে, সরকার পড়ে যাবে; কিন্তু এই স্লিপারগুলি সরকারকে রক্ষা করে। আবার সরকার অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও দু’চারটি স্লিপারের ধাক্কায় ভূপতিত হওয়া অসম্ভব নয়। অধ্যাপক ম্যানর মনে করেছেন যে, মোদি সরকারের প্রধান অন্তরায় হল এক শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ জনমত তাঁর বিপক্ষে যাচ্ছে। এই বিপক্ষে যাওয়া জনমত কতগুলি উপাদানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এগুলি হল স্লিপার।

প্রথমটি হল ‘বিমুদ্রাকরণ’। এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। কালো টাকা উদ্ধার হয়নি। সন্ত্রাস নির্মূল হয়নি। নকল টাকা উদ্ধার হয়নি। হয়েছে সাধারণ মানুষের অকথ্য হয়রানি। ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিমুদ্রাকরণের প্রভাব ছিল অপ্রতিরোধ্য। সাধারণ গরিব মানুষ ভেবেছিলেন, নিশ্চয়ই এর প্রভাবে একটা বড় কিছু ঘটবে। কিন্তু তেমন বড় কিছু প্রভাব, অন্তত ভোটের বাজারে সেভাবে পড়তে দেখা যায়নি। উপরন্তু আমাদের অর্থনীতির উপর একটি স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, যা এখনও সবটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী মানুষ, সাধারণ অসংগঠিত শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এই ক্ষতি অপূরণীয়। জিডিপি কতটা বাড়ল বা কমল সেটা পরের কথা, কিন্তু সাধারণ চোখে যেটা সবচেয়ে খারাপ লেগেছে, সেটা হল এই ক্ষতির জন্য কোনও দায় নরেন্দ্র মোদি নিলেন না। তার চেয়েও বড় কথা, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনও বিশেষ উদ্যোগ দেখা গেল না পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য। উত্তরপ্রদেশের জনসাধারণ দেখলেন, কীভাবে গোটা পরিস্থিতিকে হাতের বাইরে চলে যেতে দেওয়া হল। যোগী আদিত্যনাথের শাসনে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা খুব খারাপ। পুলিশরাজ চলছে। দলিত, সংখ্যালঘুর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এই জায়গা থেকে যদি অখিলেশ-মায়াবতী জোট ঠিকমতো ক্রিয়াশীল হয় তো উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসন কমতে বাধ্য।

অধ্যাপক ম্যানরের মতানুযায়ী দ্বিতীয় স্লিপারটি হল ‘মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার যোজনা’, যেখানে এই সরকার ভয়ানক নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে যথেষ্ট পরিমাণ সংস্থান তো দূরের কথা, উলটে অর্থের যোগান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারের চেয়ে প্রায় ২৩% অর্থের যোগান কমেছে। বিজেপি-পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলিও চাইছেন, এই অর্থের যোগান বাড়ুক। না হলে পঞ্চায়েত স্তরে যথেষ্ট পরিমাণ কাজের সুযোগ তৈরি করা যাচ্ছে না। ভুগতে হচ্ছে সাধারণ গ্রামীণ জনতাকে। এবং তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে পঞ্চায়েত সদস্যদের। অধ্যাপক ম্যানর মনে করেছেন, দলিত এবং আদিবাসীরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। এতে বিজেপির ভোট কমবে।

এর পরের গুরুত্বপূর্ণ স্লিপারটি হল সংশোধিত তফশিলি জাতি উপজাতি আইন। সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি এই বিষয়ে সরকারকে সচেতন করে সাংবিধানিক সীমার মধ্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু গুজরাতের উনা, উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অংশ, ভিমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনা বিজেপির দলিত সমর্থনের ওপর বড়সড় ধাক্কা দিতে চলেছে। শুধুমাত্র ভাষণ দিয়ে সম্ভবত আর এই সমর্থনের ভিত্তি জোড়া দেওয়া যাবে না।

শেষ পর্যন্ত অবশ্যই অর্থনীতি একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। অধ্যাপক ম্যানর দেখিয়েছেন, ‘পণ্য ও পরিষেবা কর’ কীভাবে ছোট ব্যবসায়ীদের সর্বনাশ করছে। মে ২০১৮-য় করা একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭৩% ছোট ব্যবসায়ী বলেছেন, এই করকাঠামোর ফলে তাঁদের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। এ-ছাড়া আধার কার্ড নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাও অত্যন্ত আপত্তিকর বলে মনে করেছেন সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ। যেখানে সুপ্রিম কোর্ট বারবার বলে দিচ্ছে যে, সামাজিক উন্নয়নমূলক পরিষেবার আওতায় আসতে আধার বাধ্যতামূলক নয় সেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আধার নম্বর চাওয়া একপ্রকার জুলুমে পরিণত হচ্ছে। এর ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ, মূলত গরিব, মধ্যবিত্তরা। এর ফল ভোগ করতে হবে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে।

মোদি প্রধানত একজন ভাল কমিউনিকেটর। অনেক ভুল সিদ্ধান্ত বা ‘জুমলা’ অনায়াসে নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন, শুধুমাত্র বক্তব্য পেশের চতুরতায়। এই ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই বিরোধীদের তুলনায় এগিয়ে আছেন। কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে তাঁর বা তাঁর দলের অবস্থান একান্তই বিভ্রান্তিকর। সাধারণত বিদেশনীতি আমাদের নির্বাচনে খুব বড় ভূমিকা পালন করে না। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা ক্ষেত্রেই বিদেশনীতি খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মোদির বিদেশভ্রমণ এবং তাঁর সরকারের আগ্রাসী কাশ্মির-নীতির ফলে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাস এবং ভারতীয় বায়ুসেনার তৎপরতার পরে দেশজুড়ে যে একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মোদি-বিরোধীরা যদি ওই একটি বিষয় নিয়েই আলোড়িত থাকেন এবং একটি বিকল্প রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করতে অপারগ হন, তবে মোদি তাঁর দুর্বলতাগুলিকে অনায়াসেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন। তাই সম্মিলিতভাবে বিরোধীদের উচিত এ-কথা প্রচার করা যে, বায়ুসেনার কৃতিত্বকে অস্বীকার না-করেই তার পাশাপাশি কৃষকদের সমস্যা, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার, অসংগঠিত ক্ষেত্রে ন্যূনতম আয় বেঁধে দেওয়ার মতো জরুরি ইস্যুগুলিকে আরও সোচ্চারে মানুষের দরবারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। সেই দাবিগুলিকে প্রতিষ্ঠা করার একটা মাধ্যম হল নির্বাচন। বিরোধীরা যত বেশি করে এই দাবিগুলিকে সামনে আনতে পারবেন, ততই মোদি ও বিজেপি-র পাল থেকে হাওয়া সরে যাবে।