Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নিহত ফুলের দিন

নিবেদিতা আইচ

 

কাছিমপুর রেলস্টেশনে ভোর নামতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। শেষ রাতের অন্ধকারটা বড় বেশি নিরেট আজ। অনন্ত আঁধার বুকে নিয়ে সময়টা থেমে গেছে এখানে। হোসেন মিয়া সহসা ঘুম ভেঙে সেই সময়টাকে ঠাহর করতে পারে না। বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়।

অন্ধকারটা ফিকে হয়ে এলে বাতাসে প্রহর বদলে যাওয়ার ঘ্রাণ ভেসে বেড়ায়। টুপটাপ শিশিরের আবছায়া জলতরঙ্গ আর হিম হিম হাওয়া ঘুমন্ত জনপদের শরীরে বিলি কেটে দিয়ে যায়। এসময় জেগে ওঠা যেন শুধু শরীরের জেগে ওঠা। মন তখনও আড়মোড়া দেয়। কেমন রহস্যময় আর অপার্থিব লাগে সব কিছু।

হোসেনেরও এইমাত্র শরীর জেগেছে। মাথার ভেতর ভোঁতা অনুভূতিটা এখনও নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়নি। শিশিরের শব্দ কান অব্দি পৌঁছায় না তার। একটু দূরেই গাছগাছালির সারি। এদিক ওদিক সদ্য ঘুমভাঙা পাখিদের ওড়াওড়ি চলছে। তাদের চঞ্চল গান শুনতে পায় না হোসেন। যেন সমস্ত পৃথিবী মূক হয়ে গেছে। সবকিছু চলছে আগের নিয়মে শুধু সেই চিরচেনা কলরবটা নেই।

হোসেন বুঝতে পারছে না সে কোথায় এসে পড়েছে। শরীরটাকে টেনে তুলতে রীতিমতো বেগ পেতে হল। মাথার ভেতরে তীব্র ব্যথা। প্ল্যাটফর্মের দিকে এগুতে গিয়ে পায়ের ব্যথাটাও টের পেল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে চলল সে। কাছিমপুর স্টেশন। হলদে রাত বাতির আলোয় নামফলকটা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। এই নামটা সে কোথাও শুনেছে। আরেকটু ভাবলে হয়তো মনে পড়বে। কিন্তু ভাবার মতো অবস্থায় নেই এখন। বরং একটু স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারলে হত।

বড় বেশি নিরিবিলি জায়গায়টা। ওয়েটিং রুমের সামনে গিয়ে টের পেল কেউ ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে রেখেছে। বেশ কয়েকবার টোকা দিয়েও সাড়া পেল না হোসেন। অগত্যা ফিরে এসে ময়লা বেঞ্চিতেই শুয়ে পড়ল সে।

হোসেন মিয়ার গায়ে ফুটপাত থেকে কেনা সস্তা রঙচটা শার্ট। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি দিচ্ছে শরীর। বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে অন্যকিছু ভাবার চেষ্টা করে সে। হয়তো গভীর ভাবনা এলে শীতের তীব্রতা খানিকটা ভুলে থাকা যাবে। কাছিমপুর স্টেশনের রেল লাইন ধরে দূরে দৃষ্টি মেলে দেয় সে।

অঘ্রাণের সংক্রান্তি আসন্ন। কুয়াশার চাদরটা পুরু হবার সময় আসেনি এখনও। তবু কেমন ঘোলাটে ধোঁয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশ।

হোসেন মিয়ার মানসিক অবস্থাটাও ঠিক তেমনই। কাছিমপুরে সে কী করে এল, কেনই বা রাতের ট্রেনে চেপে বসেছিল সে— এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। মাথার বাঁদিকে পেছনটায় বেশ ব্যথা পেয়েছে, ফুলে আছে জায়গাটা। ওর কি তবে স্মৃতি লোপ পেয়েছে? হাতের কনুইতে জ্বালা করছে, অনেকটা অংশ ছড়ে গেছে। তবে পায়ের গোড়ালিতে যন্ত্রণাটা সবচেয়ে বেশি৷ হোসেন মিয়া কি ট্রেন থেকে লাফ দিয়েছিল? না না… এমন সর্বনাশা কাজ কেন করতে যাবে সে!

নিজেকে জেরা করতে ভাল লাগে না তার। মাথার ভেতরে ব্যথাটা ঘাই দিয়ে ওঠে৷ শুধু মনে পড়ছে একটা নোংরা হোটেলে বসে গরুর মাংস দিয়ে পরোটা খেয়েছিল হোসেন। ঘটনাটা হয়তো গতকাল বা তার আগেরদিন সন্ধ্যাবেলার। সময়টা ঠিক করে মনে না পড়লেও মাংসের স্বাদটা যেন জিভে লেগে আছে। ঘন ঝোলের ভেতর মাংসের টুকরো দু’টো আধডোবা হয়ে ভাসছিল।

হোসেন মিয়া তড়াক করে উঠে বসে বেঞ্চিতে। গা গুলিয়ে বমি আসে তার। খিদে আর শরীরের ব্যথা, সব মিলিয়ে নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হয় হোসেন মিয়ার। পকেট হাতড়ে টাকা পয়সা বা মুঠোফোন কিছুই পাওয়া গেল না। না, এভাবে কিছু হবে না, আশেপাশে কারও কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে তাকে।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল হোসেন। ভোরটা এখন মৃতপ্রায়। প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো নিভে গেছে সেই কখন। দুয়েকজন লোক এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। চায়ের দোকানি জেগে উঠে উনুন ধরিয়েছে। হোসেন মিয়াকে দেখে লোকটা খুব একটা পাত্তা দিল না। তবু তার কাছেই সাহায্য চায় সে।

পরের ট্রেন কয়টায় ভাই?
আজকা সব লেইট…
কেন!
খবর শোনেন নাই? সামনে লাইন নষ্ট হইছে।

এক ঝলক ওকে দেখে নিয়ে নিজের কাছে ব্যস্ত হয়ে পড়ে লোকটা। হোসেন মিয়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না কিছুই।

এফএম রেডিওতে খবর চলছে। হোসেন মিয়াও একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে কান পাতে। দমদানা স্টেশনে পৌঁছুনোর আগে বোমা হামলায় নীলপুর এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা শত ছাড়িয়ে গেছে।

‘নীলপুর এক্সপ্রেস’ নামটা কানে যেতেই হোসেন মিয়া চমকে উঠল। সে কি এই ট্রেনেরই যাত্রী ছিল? নামটা শুনে চেনা চেনা লাগছে তার। যদি তাই হয় তবে তো সে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। কী হয়েছিল জানার জন্য ভেতরটা ছটফট লাগে তার। চায়ের দোকানি ততক্ষণে ঝাঁপি বন্ধ করে বেরিয়ে পড়েছে। হোসেন মিয়া তার পিছু নিল। দমদানা স্টেশনে যেতে চায় সে। কখনও এমন ঘটনা নিজের চোখে দেখেনি। এবার দেখবে হোসেন মিয়া।

 

দুই।।

তামাডাঙা গ্রামের ছেলে মতির বয়স আঠারো ছুঁই ছুঁই। বয়সের দোষেই হয়তো তামাডাঙা নামটা নিয়ে তার এত আক্ষেপ। যার বুক জুড়ে শুধু গোলাপের সুঘ্রাণ তার নাম কেন এমন খটমট হবে? মতি মনে মনে গ্রামের নাম দেয় তাজমহলপুর। লোকে নাম শুনেই জানতে পারবে এই গ্রামে ‘তাজমহল’-এর বাগান আছে। জীবনে কখনও মতি নিজে বড় কিছু হয়ে গেলে গ্রামের নাম সে বদলে দেবেই। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে গোলাপক্ষেতের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এসব ভাবে।

বড় কিছু সে কবে হবে? স্কুলের পরীক্ষায় পাশ করতে পারছে না বলে বয়স বেড়েই যাচ্ছে ওর। সেই মতি এমন বিদ্যে নিয়ে কী করে নামী দামি লোক হবে! এই গোলাপবাগানের গোলাপ বিক্রি করে ওদের সংসার চলে। এই করে কখনও লাখপতি হওয়া যায়? হলে কিন্তু বেশ হবে, প্রথমেই তামাডাঙার নাম বদলে দেবে মতি।

দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে দুটো নাকে মুখে খেয়ে গোলাপক্ষেতে যায় মতি। বড় ভাই হাসান মিয়ার সাথে ঝুড়ি ভরে গোলাপ তোলে। তাজমহলের বড় বড় পাঁপড়ির টুকটুকে লাল রঙ ওর চোখে ধাঁধাঁ লাগায়। মতি বুক ভরে সুঘ্রাণ নেয়৷ ওর হাবভাব দেখে সবাই হাসাহাসি করে।

হাসান মিয়ার শ্যালক মাহফুজ বোনের বাড়িতে বেড়াতে এলেও ক্ষেতে নেমে কাজে সাহায্য করে ওদের। সমবয়সী বলে মতির সাথে তার বেশ ঠাট্টার সম্পর্ক। মতি যখন একমুঠো পাঁপড়ি আলগোছে বুকপকেটে ভরে নেয় মাহফুজ তখন হৈহৈ করে ওঠে। মতি লাজুক মুখে সরে পড়ে অন্যদিকে।

তাজমহলের ক্ষেতের ধার ঘেঁষে সরু স্রোতে আদুরি নদী বয়ে যায়। মতি প্রায়ই উদাস মুখে নদীর ধারে গিয়ে বসে। জীবনটাকে নিস্তরঙ্গ পানসে বলে মনে হয়। যেন কোনও এক গন্তব্যহীন যাত্রার পথিক সে। কোনও লক্ষ্য নেই, উদ্দীপনা নেই কিছুতে। মাহফুজ ওর পাশে গিয়ে বসে। নিজের জীবনদর্শন নিয়ে কথা বলে। ইহকাল, পরকাল, স্বর্গ নরকের বিধান নিয়ে অনেক অনেক জ্ঞানের কথা শোনায় মাহফুজ। শুনে শুনে মনটা যেন শান্ত হয়ে আসে মতির। এসব কথা কেন কেউ আগে বলেনি? মাহফুজের সঙ্গ মতিকে জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এই যে এত অস্থির সময় নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে, মানুষগুলো কেবল খেয়ে, পরে আর সন্তান জন্ম দিয়ে একদিন মরে যাচ্ছে— জীবন মানে কি শুধু এই? কোনও উদ্দেশ্যে থাকবে না মানবজন্মের! পরকালের চিন্তা তবে কবে হবে?

এসব কথা আবার মতিকে অশান্ত করে তোলে৷ মনে মনে প্রস্তুত হয় সে। একটা কিছু করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করবে সেটাই ভেবে পায় না। মতির আগ্রহ দেখে মাহফুজ বেশ কিছু বই পড়তে দেয় ওকে। সেসব পড়ে চিন্তাভাবনায় বদলে যেতে থাকে ছেলেটা।

তাজমহলের সুঘ্রাণে আজকাল তাই শিহরিত হয় না মতি। তামাডাঙা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়া আসার সময় বুকটা আর কারও দেখা পাবার জন্য ধুকপুক করে না। মতি বুঝতে পেরেছে এই মিথ্যে পৃথিবীতে পদে পদে কেবল অহেতুক মায়াজাল ছড়িয়ে আছে। মতি সেই জালে আর জড়াতে চায় না।

মাহফুজ মাঝেমাঝে কয়েকদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। ফোনটাও বন্ধ থাকে ওর। ফিরে এলে মতি তাকে জেরা করে। তখন মাহফুজ পরের বার মতিকে সাথে নেবে বলে কথা দেয়। নিজের চোখে মতি দেখবে ওদের মতো কত শত তরতাজা যুবক পৃথিবী বদলে দেয়ার যুদ্ধে নেমেছে৷ এমন অদ্ভুত কথা শুনে মতি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সেও যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি নেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। পৃথিবীর বুক থেকে বিপথগামীদের সংখ্যা কমাতে প্রয়োজনে রক্তে হাত রঞ্জিত হবে ওর।

তারপর একদিন সকালে তাজমহলের বাগানে মতিকে আর খুঁজে পায় না কেউ। কাউকে কিছু না বলে নিখোঁজ হয়ে যায় ছেলেটা। তামাডাঙার সেই সদ্য আঠারো পেরুনো আলাভোলা ছেলে হোসেন মিয়া ওরফে মতি যুদ্ধে যাবে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশে।

 

তিন।।

রক্তের কি ঘ্রাণ থাকে? হাওয়ায় রক্ত মিশে যেতে পারে? হয়তো পারে! খুব কাছে কোথাও রক্তের স্রোত বয়ে চলেছে। কান পাতলেই যেন তার শব্দ শোনা যাবে। কাছিমপুর থেকে দমদানার দিকে ছুটে চলেছে ওরা। হোসেন মিয়া উদভ্রান্তের মতো অনুসরণ করছে সামনের লোকটাকে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ছুটে চলেছে বলে নয়, বাতাসে কিছু একটা আছে। কী সেটা? বারুদের ঘ্রাণ? রক্তের স্রোত? জানে না সে।

দু’পাশে ভাঁটফুল আর হাতিশুঁড়ের ঝোপ। হোসেন মিয়া চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে, হাঁ করে বুক ভরে শ্বাস নেয়। তারপর দ্বিগুণ গতিতে হেঁটে চলে। সামনে ছুটতে থাকা লোকটার উপর যেন অশরীরী কেউ ভর করেছে। হোসেন তাল মেলাতে পারে না তার গতির সাথে।

অদ্ভুত এক বিষণ্ণ সুর ভেসে আসে বাতাসের সাথে। হোসেন ঠিক করে বুঝতে পারে না, এ কি মানুষের কান্না নাকি লু হাওয়ার শব্দ? এই পড়ন্ত অঘ্রাণ দিনে লু হাওয়া কোথা থেকে এল? হোঁচট খেতে খেতে সামলে নেয় হোসেন মিয়া। মাথার ভেতরের প্রগাঢ় কুয়াশা এবার ফিকে হয়ে আসে। ধীরে ধীরে ওর ভেতরে সকাল হয়। মনে পড়ে ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় শুধু সে একা নয়, আরও একজন সদ্য পরিচিত যুবক পাশাপাশি বসে পরোটা মাংস খেয়েছে। তারপর মুঠোফোনে দরকারি আর সংক্ষিপ্ত আলাপ সেরে পুরনো সিমগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ময়লার ঢিবিতে। নীলপুর এক্সপ্রেস তখন মাত্র প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় সাথেসাথেই দু’টো আলাদা বগিতে গিয়ে বসে পড়েছে দু’জন। কাছিমপুর স্টেশনে পৌঁছুনোর ঠিক আগে আরেকবার দেখা হয় ওদের। ইশারায় কথা বলে আবার চলন্ত ট্রেনের ভেতর হারিয়ে যায় যুবকটা।

সেই যুবকটি কোথায় এখন? হোসেন মিয়া ঠিক করে জানেও না তার নাম পরিচয়, যেমনটা সেই যুবকও জানে না ওর ব্যাপারে। তবে একে একে সব ছবির মতো ভেসে ওঠে। ঘড়িতে সময় দেখেছিল হোসেন মিয়া। রাত তখন সাড়ে তিনটা, যাত্রীরা ঘুমে আচ্ছন্ন। হোসেন কাঁধের ব্যাকপ্যাকটা খুলে কোলের উপর রাখে। সতর্ক চোখে ভেতরটা আরেকবার দেখে নিয়ে টয়লেটের দিকে হেঁটে যায় সে। জিনিসটা ঠিকমতো সেট করে রেখে আসতে বড়জোর ছয় কি সাত মিনিট লাগে ওর। তারপর বেরিয়ে এসে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় হোসেন। গলা বাড়ালেই কাছিমপুর প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো দেখতে পাওয়া যায়। হোসেন মিয়া দরজার হাতল শক্ত করে ধরে পরের কয়েকটা মুহূর্তের জন্য চাপা উত্তেজনায় অপেক্ষা করতে থাকে।

চোখের সামনে বনবাদাড়ির দৃশ্য ফিকে হয়ে আসে। হোসেনের গতিও শ্লথ হয়ে যায়। অসংখ্য মানুষের চেঁচামেচি হোসেনকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। ভিড় ঠেলে সামনে এগোয় সে। নীলপুর এক্সপ্রেসের শরীরে আগুনের শিখা তখনও রয়ে গেছে। এদিন ওদিক এলোপাথাড়ি পড়ে আছে শত শত যাত্রী। কেউ নিষ্প্রাণ, কেউ দুলছে জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝিতে।

কারও কব্জি উড়ে গেছে, চোখমুখ পুড়ে গেছে। কারও উরুসন্ধির নিচে আর কিছু নেই, গলগল করে রক্তধারা বয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। হোসেনের শরীরে যেন সহস্র ভোল্টের তড়িত প্রবাহিত করে দিল কেউ। এমন ধ্বংসযজ্ঞের শিল্পী সে? এতগুলো জীবনঘড়ি বিকল হয়ে গেল ওর আঙুলের একটা মাত্র তুড়িতেই?

হোসেনরা তো এটাই চেয়েছিল! রক্তের স্রোত ছাড়া যুদ্ধে জয় কিছুতেই আসবে না, অপারেশনের প্রস্তুতিতে ওদের এমন দীক্ষাই দেয়া হয়েছিল। পৃথিবীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমন দুর্বল হলে তো চলে না। হোসেন মিয়া তো হারতে আসেনি! তবু কেন এমন বুকভাঙা হাহাকার গলার কাছে দলা পাকাচ্ছে ওর?

দিশেহারা দৃষ্টি মেলে চারদিকে তাকায় সে। কচি দুর্বাঘাসের বুকে ছোপ ছোপ রক্ত, ঝোপের পাতায় পাতায় রক্ত, আকাশে বাতাসে রক্ত! হোসেন মিয়ার বড্ড ধাঁধাঁ লাগে। তাজমহলের বাগানটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যেন শত শত গোলাপ লাল টুকটুকে পাঁপড়ি মেলে আছে বাগান জুড়ে।

ঝরে পড়া পাঁপড়ি বুকপকেটে তুলে নিতে গিয়ে বিভ্রম কাটে হোসেনের। ছিটকে সরে আসে সেখান থেকে। একপাশে বসে বমি করে উগলে দিতে চায় সব। কিছু বেরিয়ে আসে না বলে কষ্টটা দ্বিগুণ হয়। অসাড় লাগে পুরো শরীর। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে কানে তালা লেগে যায়। সরকারি গাড়ির বহরও আসছে একে একে। এত হট্টগোলের মাঝে হোসেন মিয়া সতর্ক হয় মনে মনে, তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে উল্টোদিকে। ভেতরে ভেতরে একটা আতঙ্ক তাকে পাগলের মতো তাড়া কর‍তে শুরু করে। সেই চিরচেনা গোলাপের গ্রামে ফিরে যাবে বলে একসময় প্রাণপণে ছুটতে থাকে হোসেন মিয়া।

বুকপকেট থেকে শুকনো ফুলের পাঁপড়ি উড়ে গিয়ে নোনা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। হোসেন মিয়ার মনে হয় সে অনন্তকাল ধরে ছুটে চলেছে। সেই তাজমহলপুরে কখনও ফেরা হবে না ওর।