Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নির্বাচনের প্রথম ধাপ : গণতন্ত্রের উৎসব শুরু

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

অবশেষে শুরু হল গণতন্ত্রের উৎসব। শাসক ও বিরোধী শিবিরের যাবতীয় রাজনৈতিক তর্জা ও জল্পনার প্রহর কাটিয়ে ১১ এপ্রিল দেশজুড়ে আরও একবার কোটি কোটি মানুষ লাইন করে দাঁড়ালেন। সরকার গঠনের প্রথম ও চূড়ান্ত ধাপ অর্থাৎ মতদান পর্বে সামিল হতে। ২০১৪-র পর পাঁচ বছরের ব্যবধানে আবারও ভোটদান পার্বণ। এই পাঁচ বছরে সারাদেশে পরিবর্তন এসেছে বহুল পরিমাণে। ২০১৪ সালে যে বিরাট দু’কূল ছাপানো জনাদেশ পেয়ে দিল্লির তখত দখল করেছিলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি, সেই তিনি আরও একবার নিজের প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে আগুয়ান। অন্যদিকে, মোদি জমানায় দেশব্যাপী অসহিষ্ণুতার ঢেউ কাছাকাছি নিয়ে এসেছে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবিরকে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে মহাজোট। শুরু হয়েছে ভারতের অখণ্ডতা ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদ রক্ষার নয়া লড়াই। আর এর মাঝেই বিউগলে ফুঁ দিলেন জাতীয় নির্বাচন কমিশন। ১০ই মার্চ, রবিবার, দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে ঘোষণা হয়েছিল নির্বাচনী নির্ঘণ্ট। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা ঘোষণা করেছিলেন এবারে দেশজুড়ে সাত দফায় নির্বাচন। ২০১৪-রই ঘটল পুনরাবৃত্তি। জারি হয়ে গেল নির্বাচনী আচরণবিধি যা এমসিসি বা মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট নামে পরিচিত। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। প্রায় দেড়মাস ধরে সাতদফা এই ভোট যুদ্ধ নির্ধারিত হল ১১, ১৮, ২৩ ও ২৯ এপ্রিল এবং ৬, ১২ ও ১৯ মে। পশ্চিমবঙ্গেও সাত দফা পার্বণ। ভোট গণনা হবে ২৩ মে। ভোট নির্ঘণ্ট জারির পর শুরু হল যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি। শুরু হল প্রচারের ঢক্কানিনাদ। আর এর মধ্যেই নানা অভিযোগের সম্মুখীন মোদি সরকার। ট্রেনের টিকিট হোক বা চায়ের কাপ, খাবারের প্যাকেট বা বায়োপিক, ওয়েব সিরিজ এমনকি প্রচারের মাধ্যমরূপে গড়ে উঠেছে ‘নমো টিভি’— যেসব নিয়ে তুমুল জল্পনা ও বিতর্ক। শত শত জনসভা, প্রচার ও পালটা প্রচারের হিড়িকে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক অবস্থান বদল। এরই মাঝে সারাদেশব্যাপী কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে গত ১১ এপ্রিল সুসম্পন্ন হল প্রথম দফার ভোট। এবং তা বহুলাংশেই শান্তিপূর্ণভাবে। সে’ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে লেটার মার্কস পেয়েছে কমিশন।

১১ এপ্রিল সম্পন্ন হল প্রথম দফার মতদান। এই পর্বে বাংলা সহ ১০টিরও বেশি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৯১টি কেন্দ্রে পড়ল ভোট। অংশ নিলেন প্রায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষ। প্রায় কয়েকশ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হল এদিন। বাংলার দুটি নির্বাচনী কেন্দ্র— কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে হয় ভোট। ভোর ছটা থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া সুরক্ষার মধ্যে ভোট পড়ল সারাদিন। কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোট চলল রাত আটটা পর্যন্ত। দিনের শেষে মতদানের হার ৬৯.৪৩%। গতবারের ৭০.০৬%র তুলনায় সামান্য কম। ৭২.১২% পুরুষদের পাশে ৭১.৯৩% মহিলারা দিলেন ভোট। পিছিয়ে ছিলেন না তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও। ১৭.৯৪% এই বিশেষ শ্রেণিভুক্ত মানুষরা দিলেন তাদের রায়। প্রথম পর্বের ভোটদানের শেষে তেলেঙ্গানায় ৬২.৬৯%, অন্ধ্রে ৭৮.১৪%, মহারাষ্ট্রে ৬৩.০৪%, ইউপি’তে ৬৩.৮৮%, উত্তরাখন্ডে ৫৯.৮৯%, ওড়িশাতে ৭৩.৭৬%, অসমে ৭৮.২২%, মনিপুরে ৮২.৮২%, ত্রিপুরায় ৮৩.২৬%, অরুণাচলে ৬৭.০৮%, মেঘালয়ে ৭১.৪১%, মিজোরামে ৬৩.০২%, নাগাল্যান্ডে ৮৩.১২%, জম্মু-কাশ্মীরে ৫৭.৩৫%, সিকিমে ৭৮.১৯%, ছত্তিসগড়ে ৬৫.০৮%, লাক্ষাদ্বীপে ৮৪.৯৬%, আন্দামান-নিকোবরে ৬৪.৮৫%, বিহারে ৫৩.৪৭% ও পশ্চিমবঙ্গে ৮৩.৭৯% বহাল রইল মতদানের হার। নজির গড়লেন অরুণাচলের মহিলারা। পুরুষদের (৬৫.১৯%) চাইতে ভোটদানে অনেকটাই এগিয়ে রইলেন তারা (৬৮.৯২%)।

প্রথম দফা ভোটদান সম্পন্ন হয় নির্বিঘ্নেই। মাওবাদী ও নকশাল অধ্যুষিত অঞ্চলে শোনা যায়নি কোন অস্থিরতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা। ছত্তিসগড়ের অন্যতম উপদ্রুত অঞ্চল রূপে পরিচিত বস্তারে পড়ল ৬৫.৮% ভোট। গতবারের ৫৯.৩২%-এর তুলনায় যা অনেকটাই বেশি। নকশাল অধ্যুষিত মালকানগিরি অঞ্চল থেকেও নির্বিঘ্নে ফিরতে পেরেছেন পোলিং অফিসারেরা। সমস্ত কেন্দ্রেই ছিল নিরাপত্তার নিবিড় ঘেরাটোপ। তবু বেশ কিছু জায়গায় উঠে এসেছে বিচ্ছিন্ন হিংসা ও সংঘর্ষের ঘটনা। প্রথম পর্বেই উঠে এসেছে বেশ কিছু ইভিএমে কারচুপির অভিযোগ। বেশ কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইভিএম। কোচবিহারের শীতলকুচি তার অন্যতম নমুনা। গোটা দেশজুড়ে ১৫টি ইভিএমে গরমিলের ঘটনা উঠে এসেছে। অন্ধ্রে ৬টি, অরুণাচলে ৫টি, উত্তরপ্রদেশে ২টি, বিহারে ও পশ্চিমবঙ্গে একটি করে ইভিএম বিপর্যয়ের কথা নথিভুক্ত হয়েছে কমিশনে। কমিশনের দাবী, সব দিক খতিয়ে তবেই নেওয়া হবে পুনঃনির্বাচনের সিদ্ধান্ত। কমিশনের জালে ধরা পড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি অবৈধ টাকা, মদ্য ও অস্ত্রশস্ত্র। এর অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে। বাংলা থেকেই ৭৩০৯টি জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে। নির্বাচনকে মাথায় রেখে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতেও কমিশন রেখেছিল নজর। কমিশনের জালে ধরা পড়েছে একাধিক ‘পেড নিউজ’। তাদের বিরুদ্ধে আইনি বন্দোবস্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কমিশন। এছাড়া ৫০০’র বেশি ফেসবুক পেজ, ২টি টুইটার ও ১টি হোয়াটস আপ অ্যাকাউন্ট ‘সিজ’ করেছে কমিশন। সাম্প্রদায়িক উস্কানী ও অসাংবিধানিক কথার জন্য উত্তরপ্রদেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী মায়াবতীকে নোটিশ ধরায় কমিশন। বালাকোট নিয়ে লাতুর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য নিয়েও রিপোর্ট তলব করেছে কমিশন। তবে দিনের শেষে রয়েছে একটি মর্মান্তিক ঘটনাও। অরুণাচলে ভোট চলাকালীন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এক পোলিং অফিসার। মৃতের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।

সবদিক খতিয়ে দেখলে মোটের উপর প্রথমদফা যথেষ্টই শান্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক। প্রথম দফায় লাভবান হবেন কে— নরেন্দ্র মোদি না বিরোধীপক্ষ তা নিয়ে তর্জা শুরু হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে এত শীঘ্রই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। পরবর্তী মতদান আগামী ১৮ এপ্রিল। রাজ্যে ৩টি নির্বাচনী কেন্দ্র— দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও রায়গঞ্জে হবে ভোট। শুরু হয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতি। প্রথম দফার মত শান্তিপূর্ণ হয় কিনা এই দ্বিতীয় পর্ব তাই দেখার অপেক্ষা।

শেষ পাতে যে কথাটি না বললেই নয়। ২০১৯’র নির্বাচনে কমিশনের ‘ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ হয়েছেন এক বঙ্গললনা। সমাজসেবী জিজা ঘোষ যিনি নিজে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা শুনিয়ে এসেছেন নিজের কাজ ও জীবনদর্শনের মধ্যে দিয়ে, এবার সেই ‘অনন্যা’কেই কমিশনের তরফে সারাদেশের মানুষদের কাছে ভোটদানের অধিকার ও মানবিক দৃষ্টান্ত স্বরূপ তুলে ধরার প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে কুর্নিশযোগ্য।