![ashok](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/11/ashok-1.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর সম্পাদক
প্রায় এক বছর আগে, ২০ ডিসেম্বর ২০২০, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এই লিখেছিলাম,
দিল্লির কৃষক বিক্ষোভ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ঠিক কোথায় আঘাত করলে তার কোমর ভেঙে যেতে পারে, তা দেখিয়ে দিল। লোকসভায় ৩৮০টা আসন থাকতে পারে নরেন মোদির দলের। তারা তাতে ভেবে যাচ্ছিল, তারা এখন যা খুশি করতে পারে। বারো লক্ষ কৃষকের জমায়েত এবং প্রতিবাদ দেখিয়ে দিচ্ছে, তা আর করা যাবে না। কৃষি বিল তাকে বদলাতে হবেই। আম্বানি আদানির স্বার্থে চাষের জমি আর জমির ফসল লুটের বাতাসায় পরিণত করা আপাতত যাবে না। কর্পোরেট স্বার্থে ফ্যাসিবাদের শ্রেণির চাহিদা পরিপূরক একটা জরুরি নীতি লোকসভায় গৃহীত হলেও রাস্তার বৃহত্তর লোক-সভায় তা বাতিল হয়ে যেতে বসেছে।
দিল্লির কৃষক বিক্ষোভের এটাই সবচাইতে বড় গুরুত্ব। আমাদের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় পাওনা। দলাদলির ভোটশক্তির তুলনায় জনগণের জোটশক্তি যে শেষ পর্যন্ত অনেক বড় এবং অনেক বেশি ক্ষমতা ধারণ করে, গ্রন্থমধ্যে গ্রন্থিবদ্ধ এই সত্যকে অনেক দিন পর সে আমাদের ব্যালটীয় ছানি পড়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
আমার সেদিনের সেই দৃঢ়বিশ্বাস-ভিত্তিক দাবির পেছনে ছিল দিল্লি হরিয়ানা রাজস্থান থেকে আমাদের কিছু কমরেডের নিয়মিত পাঠানো বার্তা— ব্যক্তিগত সংলাপে, অনলাইন সভায়, এবং সোশাল মিডিয়ায় প্রদত্ত পোস্টে।
জানুয়ারি মাসে এপিডিআর-এর সোনারপুর শাখার দুজন কমরেডের দিল্লি ও পাঞ্জাব সফর, বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী চাষিদের অনেকের সঙ্গে আলাপ ও সাক্ষাৎকার, তার ভিত্তিতে তাঁদের রিপোর্ট একই সঙ্কেত দিয়েছিল।
রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে ১০ মার্চ কলকাতায় ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপি বিরোধী বাংলা গণমঞ্চের ডাকে যে বিশাল গণজমায়েত হয় সেখানে আগত, পরেও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন গণ সংগঠনের আহূত ছোটবড় জনসভা ও পথসভায় দিল্লি হরিয়ানা থেকে আগত দিল্লির গণ-অবস্থানের বিভিন্ন কৃষক প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁদের ভাষণে এই ভরসার আওয়াজই বারবার শুনিয়ে গেছেন।
আজ বলা যায়, আমাদের সেই ধারণা, প্রত্যাশা এবং চাহিদা এক ধাপ পূরণ হতে চলেছে।
এক ধাপ কেন? পুরোটা কেন বলা যাবে না?
কেন না, পুরো জয় আসেনি।
ভালো নোট বাতিল করা দিয়ে জনসাধারণ ও দেশের অর্থনীতিকে আঘাত করতে শুরু করেছিল নরেন মোদির সরকার। আচমকা লকডাউন ঘোষণা করে অসংগঠিত ও প্রাইভেট ক্ষেত্রের শ্রমিকদের রোজগারের পথ ভেঙে দিয়ে আর একটা বড় আঘাত হেনেছিল। ২৯ জন ব্যবসায়ী জাতীয় ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুট করে বিদেশে পালাল মোদি সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। ২২টি কর্পোরেট গ্রুপ জাতীয় ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছে না। গভীর নিম্নমুখী ঋণাত্মক জিডিপি নিয়ে দেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার মুখে। বেকারত্ব সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষুধার সূচকে ভারত আজ পাকিস্তান বাংলাদেশেরও নিচে চলে গেছে। দুর্নীতিতেও তাই। এদিকে পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম দুর্দান্ত বেগে উপরে উঠছে! রান্নার তেলের দামও লম্বভাবে ঊর্ধ্বমুখী।
সেই সঙ্গেই এল ত্রিমুখী আক্রমণ:
- গরিব প্রান্তিক ও সীমান্তবর্তী জনগণের উপর এনআরসি;
- শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শ্রম কোড বিল; এবং
- কৃষি ও কৃষকদের বিরুদ্ধে কৃষি বিল।
ভীমা কোরেগাঁও মামলায় দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও নির্ভীক কলমগুলিকে ইউএপিএ আইনে জেলে ভরে এনআইএ-কে দিয়ে জামিনের বিরোধিতা করে এবং বিচারপ্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে বন্ধ রেখে হিটলারের পদক্ষেপগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বিচারকদের একটা অংশকে কিনে অথবা ভীতসন্ত্রস্ত করে মোদির সরকার দেশের গণতন্ত্রের বুকের উপর দিয়ে স্বৈর-শাসনের স্টিম রোলার চালিয়ে যাচ্ছিল।
করোনা সংক্রমণের সুযোগ নিয়ে এক আজব অতিমারি নিয়ন্ত্রণ আইনের সাহায্যে গণসমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল বন্ধ করে দিয়ে এক তরফা রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির কর্পোরেট-ভৃত্যগিরি চালাচ্ছিল প্রায় নিশ্চিন্ত মনে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল যে জনমানসে মোদি সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা এবং তা বাতিল করানো অসম্ভব— এরকম একটা মিথ লেখার স্ক্রিপ্ট বড় মাধ্যমগুলি তৈরি করে ফেলেছিল।
দূরদর্শনের আসরে বসা তোতাদের দেখে অতুলপ্রসাদ হয়ত লিখে ফেলতেন:
নানা ভাষা নানা মুখ নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ সবই হনুমান!
বাধ সাধলেন সেই বারো চোদ্দ লক্ষ কৃষক। শীত গ্রীষ্ম বর্ষায় খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী আস্তানা বানিয়ে রাস্তায় তৈরি ডাল রুটি খেয়ে ৭ শতাধিক শহিদের প্রাণের মূল্য চুকিয়েও তাঁরা রাস্তা থেকে নড়েননি। এক বছর হতে চলেছে তাঁদের অবস্থান। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, সরকার কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তাঁরা অবস্থান থেকে ঘরে ফিরে যাবেন না।
তাঁরা তাঁদের সেই ঘোষণায় অঙ্গীকারে ছিলেন অটল।
উত্তরপ্রদেশ লখিমপুর বর্ডারে চাষি জমায়েতে বিজেপি বিধায়ক অজয় মিশ্র এবং গুণধর পুত্র আশিস মিশ্র গাড়ি চালিয়ে দিয়ে আটজন চাষিকে হত্যা করেছিল। ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে জমায়েত ভাঙবে।
ভয় দেখালেও যাদের ভয় দেখাচ্ছি তারা ভয় পাচ্ছে না— ভয়-দেখারুদের কাছে এ যে কী সাংঘাতিক ভয়ের কথা, বিজেপি এত দিনে বুঝতে শুরু করেছে। আর এক জায়গায় ভয় কাটতে শুরু করলে, অন্য জায়গায়ও তা কাটতে থাকবে— এটা বুঝতে এমপি মন্ত্রী বা মুনিঋষি হতে লাগে না। উত্তরপ্রদেশের হাল যে ভালো নয়, প্রাকনির্বাচনী প্রচারে কলকাতার ফ্লাইওভার ভাড়া করে তাকেই বেনারসের ছবি বলে চালিয়ে আদিত্য প্রমাণ করে দিয়েছে। রামের প্রদেশ যে এখন ধর্ষণের পক্ষে নিরাপদ মঞ্চ হয়ে উঠেছে— তা অসংখ্য নারীর মর্যাদাহানির মূল্যে দেশের মানুষ আজ বুঝেছে। উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপি-র প্রার্থীরা জমা টাকাও ফেরত আনতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গে গত মার্চ এপ্রিলে বিজেপি-র দিকে দৌড়ঝাঁপের যে চিত্রনাট্য ফুটেছিল, বিগত তিন মাসে এখন তার উলটো ছবি দেখা যাচ্ছে। পদ্মমধুর চাইতে ঘাসমধুর আকর্ষণ বাড়তে শুরু করেছে। সুশাসন-প্রত্যাশী জনগণের এতে কোনও বিশেষ লাভ বা ক্ষতি না হলেও বিজেপি-র যে নিতান্ত হাভাতে দশা— তা আর কাউকে বুঝিয়ে বলতে হচ্ছে না।
আর একটা পুলওয়ামা কাণ্ড করা যাচ্ছে না। সেনা-আধাসেনাদের মধ্যেও ক্ষোভ গুঞ্জরিত হচ্ছে। বিরাট কোহলি মহম্মদ শামির পাশে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ব্যাটেবলেও বিদ্বেষ ছড়াতে গেলে ঝামেলা আছে! বাজারে একটা কার্টুন খুব ঘুরছে: মোদি কোহলিকে জিগ্যেস করেছেন, “কাপ কহাঁ?” কোহলির বিরাট হাসি সহ জবাব, “আপ কা অচ্ছে দিন কহাঁ?” পিঁপড়ে যখন হাতিকে আওয়াজ দেয়, বুঝতে হবে, হাতির তাকত আর আগের মতো নেই। জুমে প্লাস করে পর্দায় যাকে বাঘের মুখ বলে দেখানো হচ্ছিল, জুম সরাতেই তার মেনি মুখ বেরিয়ে এসেছে।
খাদের কিনারায় দাঁড়ানো পতনোন্মুখ বিজেপি-র অন্দরে এখন জোরালো আওয়াজ— “কুছ তো করো, জলদি হি কুছ করো।”
অতএব গ্যাসের দাম কমেছে। দুশো টাকা বাড়িয়ে ১২ টাকা কমাল। অতএব পেট্রল ডিজেলের দাম কমেছে। গত ছমাসে ৪২ টাকা বাড়িয়ে গত সপ্তাহে পাঁচ টাকা কমিয়েছে। অতএব… সেই পথ ধরেই কৃষি আইন প্রত্যাহারের ইঙ্গিত।
হ্যাঁ, এখনও ইঙ্গিতের বেশি নয়। প্রধানমন্ত্রী গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় বলেছেন: “দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে, সৎ মন এবং পবিত্র হৃদয়ে বলতে চাই যে, হয়ত আমার তপস্যায় কোনও খামতি রয়ে গিয়েছিল। যে কারণে প্রদীপের আলোর মতো সত্য কিছু কৃষক ভাইকে আমরা বোঝাতে পারিনি।”
এই যে ‘কৃষি আইনের সুফল বোঝাতে পারিনি’— এই কথাটায় প্যাঁচ আছে। সময় নিয়ে আবার বোঝাতে বসব— এরকম একটা স্ক্রিপ্টের আভাস আছে। প্রত্যাহারের ভাব দেখিয়ে আন্দোলন আর অবস্থান বন্ধ করে দিতে পারলে আবার যে অন্য মূর্তিতে কৃষির উপর কর্পোরেটি আক্রমণ নামিয়ে আনবে না— এরকম গ্যারান্টি নেই। ওদের এক একজন মনীষী আন্দোলনকারী কৃষকদের সম্পর্কে যা বলেছিল, সেই বাণীমালা এখানে সাজিয়ে নিয়ে আরও একবার পড়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এদের সবই মুখোশের আড়ালের বচন!
সুতরাং সেই মুখের বচনে বিশ্বাস না করে, অবস্থান না তুলে, লোকসভায় বিল প্রত্যাহারের ঘোষণা আগে করিয়ে নিতে হবে। টিকায়েত অবশ্য সেরকম ঘোষণাই করেছেন। আগামী পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন পেরিয়ে গেলে পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম যেমন আবার নরেন হবে, এই প্রত্যাহারের কথামালাও যে সেরকমই হবে না— তার নিশ্চয়তা নেই।
তবুও জয়। গণ আন্দোলনের সাফল্য। একটা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারকে কড়কে দিতে হলে যে ধরনের এবং যে তাকতের আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার, উত্তর ভারতের চাষিরা তা পেরেছেন। তার ভিত্তিতেই এই সাফল্য এল। একে ধরে রাখতে হবে। একে আরও পাকাপোক্ত করতে হবে। দিল্লিকে ঘিরে রেখেই। অন্তত আরও কিছু দিন।
২০২৪ সালের ভোটে বিজেপি-কে হারাতে হবে। তার আগেই কিংবা একই সঙ্গে মোদি সরকারের জনবিধ্বংসী নীতি ও পদক্ষেপগুলিকে একে একে পরাস্ত করতে হবে। বিজেপি-র নির্বাচনী বিকল্প হিসাবে যারা উঠে আসবে তাদের দিয়েও সমস্ত মোদিনীতি প্রত্যাহারের সশব্দ প্রতিশ্রুতি পেতে হবে। নিঃশর্ত। না, মানে, তবে, সব দিক ভেবে, একটু, ব্যাপারটা হচ্ছে, পরিস্থিতি— ইত্যাদি পলায়নী শব্দ বা বাক্য হইতে সাবধান!
নজরুলের কণ্ঠ ধার করে আজ বলার সময় এসেছে:
তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়,
সেই ভয়ের টুঁটি ধরব টিপে করব তারে জয়!