সঙ্ঘীদের সামনে এখন কঠিন পথ

অরবিন্দু দাশগুপ্ত

 



অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী

 

 

 

 

গত ১৪ নভেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রধান অজিত ডোভালো হায়দ্রাবাদের এক পুলিশ অ্যাকাডেমিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “দেশের নাগরিক সমাজই জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় বিপদ। নাগরিক সমাজই এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।” এই বক্তব্য দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ২৬ জানুয়ারি কিংবা ১৫ আগস্ট যে নাগরিকরা পতাকা তুলে ধরেন, প্রজাতন্ত্র কিংবা স্বাধীনতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন অথবা সভায় বক্তৃতা শোনেন তাঁরা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় বিপদ! যদিও ডোভালো সাহেব বলেননি দেশের কোন ধরনের নাগরিকদের কথা তিনি বলতে চেয়েছিলেন। আচ্ছা তিনি কি দেশ থেকে পলাতক ব্যবসায়ীদের কথা বলতে ছেয়েছিলেন? কিংবা যে সমস্ত ব্যবসায়ীর সম্পদ ৯ শতাংশ বেড়ে ৭.১৮ ট্রিলিয়ন টাকা হয়েছে অথবা যে ব্যবসায়ীর সম্পদ ৫.০৫ ট্রিলিয়ন হয়েছে, যা এক বছরে বেড়েছে ২০১ শতাংশ অথবা ১৪০ জন বিলিয়নিওর হয়েছেন তাঁদের কথা বলেছেন? নাহ, তাঁদের কথা তিনি নিশ্চিতভাবে বলছেন না। সম্ভবত তিনি দেশের সেই সব নাগরিকদের কথা বলতে চেয়েছিলেন যাঁরা দেশের নাগরিক হওয়ার সরকারি নতুন মাপকাঠির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, যাঁরা আদিবাসী আন্দোলনের দ্বিশতবর্ষ স্মরণে সভা করেছিলেন, কিংবা এক বছরের ওপর কৃষিতে নতুন আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে লাগাতার অবস্থান আন্দোলন চালিয়ে গেছেন এবং সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। এঁরাই হলেন দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় বিপদ। বিপদ দেশের ছাত্রসমাজ যাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রে গেরুয়া হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, রুখে দাঁড়াচ্ছেন। যেমন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি কলেজ, জেএনইউ, হায়দ্রাবাদ হিন্দু ইউনিভার্সিটি, মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি… ইত্যাদির ছাত্রছাত্রীরা। আসলে সঙ্ঘীরা মহা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই সঙ্কট বুঝতে কেন্দ্রের মোদি সরকারের গত সাড়ে সাত বছরের রিপোর্ট কার্ড দেখা ভীষণ জরুরি। এই আলোচনায় যাওয়ার আগে সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত সাম্প্রতিক কয়েক মাসে দলের অভ্যন্তরীণ সভায় যে বক্তব্যগুলি পেশ করেছেন সেগুলি দেখব। এখানে দল বলতে বিজেপি নয়, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মধ্যেকার সভা বুঝতে হবে।

তিনি বলেছেন, “যদি কোনও হিন্দু বলেন যে এ দেশ থেকে মুসলমানদের চলে যাওয়া উচিত নয় তবে সেই ব্যক্তি হিন্দু নয়।”[1] শুধু এখানেই তিনি থামেননি। জানিয়েছেন, ওটিটি-র ওপর সরকারের কঠিন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তার কারণ এই ওটিটি মাধ্যম সঙ্ঘ পরিবার বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে যেভাবে হিন্দু আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে গোটা দেশ জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে তাকে উদ্ঘাটিত করছে। এটা সঙ্ঘীরা কোনও মতে মেনে নিতে পারছে না।

বিজেপি এবং আরএসএস কঠিন চাপে পড়ে গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাধ্য হয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার করার কথা বলা। ইংল্যান্ডের লেবার পার্টি এবং আমেরিকার ডেমোক্রাট পার্টি কৃষি আইন প্রত্যাহারকে কৃষকদের জয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে গত দুমাস আগে তাদের সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল কৃষি আন্দোলন, সিএএ এবং দলিতদের ওপর হিন্দুত্বের আক্রমণ মোদি সরকারকে দুর্বল করেছে। আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ পাঞ্জাব সহ যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন হবে সেখানে বিজেপির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। সংবাদমাধ্যমগুলির সমীক্ষা অনুযায়ী এই রাজ্য বিধানসভাগুলিতে যদি নির্বাচন ফল ভালো না হয় তবে তার প্রভাব আগামী ২০২৪ লোকসভায় পড়বে। কেন্দ্র এবং বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে একের পর এক পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে শুধু দেশের জনগণই নয়, বিভিন্ন রাজ্যের হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করেছে এবং তাদের কোনও কোনও সিদ্ধান্ত সরকারকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে।

বিজেপির গত সাড়ে সাত বছরে কেন্দ্রীয় শাসনে থাকার রিপোর্ট কার্ড কী বলছে দেখা যাক।

আয়ারল্যান্ডের কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং জার্মানির ওয়েস্টহাঙ্গার হিলফে সংস্থা যৌথভাবে ২০২১ বিশ্ব ক্ষুধার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে ভারতের অবস্থান প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে শুধুমাত্র আফগানিস্তানের ওপরে। পৃথিবীর ১১৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১তম।[2] ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে গুজরাট ও বিহারে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৪০ শতাংশ বয়সের তুলনায় কম ওজনের। এই সত্য অনান্য অনেক রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। লকডাউনের সময় দেশ জুড়ে যখন সব কিছু বন্ধ ছিল তখন সবচেয়ে গরিবেরা ভয়ঙ্কর খাদ্য সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে গেছে।[3] নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি সমগ্র দেশবাসীকে নিদারুণ কঠিন যন্ত্রণাকর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। রিজার্ভ বাঙ্কের ২৭ মে ২০২১ সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের জিডিপি ডিসেম্বর ২০১৬ থেকে মার্চ ২০২১ নিম্নমুখী। ২০১৬-১৭ যা ছিল ৮ শতাংশ সেটা কমে হয়েছে ৪ শতাংশ।[4] ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-তে দেশে চাকরি কমেছে ৯০ লক্ষ। গত লোকসভা নির্বাচনের পর সরকার স্বীকার করে নিয়েছে দেশে বেকারত্ব ৪৫ বছরে সর্বাধিক ৬.১ শতাংশ। নোটবন্দি ও জিএসটি চালু করে অসংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে এবং শ্রমিকদের চাকরির সর্বনাশ ঘটেছে।[5]

কোভিডে দেশে মৃত্যুসংখ্যা সরকারিভাবে প্রায় পাঁচ লক্ষ হলেও বেসরকারি মতে এর কয়েক গুণ। উত্তরপ্রদেশ থেকে গঙ্গায় মৃতদেহ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেশের কোণায় কোণায় পৌঁছে গেছে সংবাদমাধ্যমের মারফত। তা নিয়ে গুজরাটের একজন কবিতা লিখেছিল বলে তাকে দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন তখন মার্কিন ডলারের দাম ছিল ৫৯ টাকা, যা সাত বছরে বেড়ে হয়েছে ৭৩ টাকা।[6] ২০১৪-তে দেশের স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ৩ শতাংশের ওপর। ২০২১-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৫ শতাংশের কাছাকাছি।[7]

দেশে মোট বিলিওনিয়ারের সংখ্যা ১৪০ জন, অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ওপর। অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী অতিমারিতে মুকেশ আম্বানির আয় বেড়েছে ৪০ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকের সমান। মার্চ ২০২০ থেকে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিদের পুজি বেড়েছে ১৩ লক্ষ কোটি টাকা।[8] আজিম প্রেমজি ইন্সটিটিউট-এর সমীক্ষা অনুযায়ী গত বছর অতিমারির ফলে সব ধরনের শ্রমিকদের মাসিক আয় কমেছে। যেমন ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের ১৩ শতাংশ, স্বনির্ভর শ্রমিকদের ১৮ শতাংশ, টেম্পোরারি বেতন পান এমন কর্মচারীদের আয় কমেছে ১৭ শতাংশ, স্থায়ী শ্রমিকদের মাইনে কমেছে ৫ শতাংশ। লকডাউনের সময় অতিরিক্ত ২৩০ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে। কোভিড অতিমারিতে মানসিক রুগীর সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে। গত ১৭ নভেম্বর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে শ্রম সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার ৪০.৫ শতাংশ হলেন ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণ, ২৩.৭ শতাংশ এসসি, ৮.৩ শতাংশ এসটি এবং ২৭.৪ শতাংশ সাধারণ সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০১১ সেনসাসে ওবিসি জনসংখ্যাকে ধরা হয়নি। NSSO সমীক্ষা বলছে ওবিসি জনগণের সংখ্যা দেশের জনগণের ৪০.৯ শতাংশ। এই সব সমীক্ষা সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাই আগামী সালে পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন যে ভয়ঙ্কর কঠিন পথের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তা সঙ্ঘীরা বুঝতে পারছে।


[1] Times of India. ৫ জুলাই ২০২১।
[2] চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। ১০ নভেম্বর ২০২১।
[3] উর্বা চৌধুরী। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। ১০ নভেম্বর ২০২১।
[4] T N Ninan. The Print. ১৩ নভেম্বর ২০২১।
[5] Indian Express. ৩ জুন ২০২১।
[6] BBC News. ২১ জুন ২০২১।
[7] Financial Express. ২৫ জানুয়ারি ২০২১।
[8] The Wire ৬ মে ২০২১।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...