রাজধানীর বুকে আরও কিছু ঠোস বাতচিত

অশোক মুখোপাধ্যায়

 




প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত

 

 

 

সারা উত্তর ভারতে এখন শৈত্য প্রবাহ বইছে। দিল্লিতে এখন ভয়াবহ ঠান্ডা। শেষ রাতের দিকে তাপমাত্রা ২/৩ সেলসিয়াসে নেমে আসছে। সেই ভয়ঙ্কর শীতের রাতে যখন ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে তিনটে করে রেজাই/কম্বল চাপিয়ে কক্ষোষ্ণদ যন্ত্র চালিয়ে শরীর সেঁকে ঘুমনোর কথা, তখন বারো লক্ষ চাষি ঘরবাড়ি ছেড়ে এসে দিল্লির ধারে খোলা আকাশের নীচে ধর্নায় অনড় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে আছেন। কৃষি আইন বাতিল করিয়ে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন— এরকমই তাঁদের সঙ্কল্প। গেরুয়া শিবিরের বিভিন্ন মহল থেকে এই আন্দোলনকে “খালিস্তানি দেশদ্রোহ” বলে চালানোর চেষ্টা করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। উলটে সুপ্রিম কোর্ট এক পিটিশনের সাপেক্ষে ঘোষণা করেছে, আন্দোলনের অধিকার একটা সাংবিধানিক অধিকার। সরকারি সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতেই পারে। শাসক-দল-কাজী অবস্থান থেকে আদালত যে আবার সুপ্রিম কোর্ট হয়ে উঠতে পেরেছে, এটাও এই আন্দোলনের এক অন্যতম সাফল্য। প্রবল ঠান্ডায় বাইশ জনের আত্মাহুতির বিনিময়ে এই কৃষক বিক্ষোভ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা নিতে চলেছে।

এ নিয়ে কিছু কথা কয়েকদিন আগে বলেছিলাম। সেই সুত্র ধরেই আরও কিছু কথা।

দিল্লির বুকে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দুদিক থেকে দুরকম গুরুগম্ভীর কিছু তাত্ত্বিক প্রশ্ন উঠেছে। সে সম্পর্কে এখানে কিছু কথা বলা দরকার। যদিও তাত্ত্বিক প্রশ্ন উঠলে বা তুললে বামপন্থীদের বড় অংশের মধ্যে কেমন যেন একটা নাকসিঁটকানো ভাব দেখা যায়। সাধারণ মানুষ রাস্তায় এই প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে লড়াই করছে আর আপনি এখন গরম চাদর মুড়ি দিয়ে মার্ক্সবাদ এবং শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্ব কপ্‌চাবেন? অমন তত্ত্বের ক্যাঁথায় আগুন! পারলে মশাই সংগ্রামের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, চাষিদের সঙ্গে থাকুন, ওদের সঙ্গেই সুখদুঃখের গল্প করুন, খান দান, ওরা কী চাইছেন বোঝার চেষ্টা করুন। এত কাল যত কেতাব পড়েছেন ওদের সঙ্গে রাত কাটালে দু তিন রাতেই সংগ্রামের আগুন থেকে তার চাইতে অনেক বেশি জ্ঞান সংগ্রহ করে ফেলতে পারবেন। আর একদল সত্যি সত্যিই তত্ত্বচর্চার নামে এমন সব মুদ্দা তুলে আনেন যে সে আর কহতব্য নয়। সেই আলোচনায় আপনি একবার ঢুকলে ইতিহাসের অনেক অধ্যায় দেখবেন আপনার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে, কিন্তু আপনার পক্ষে বর্তমান কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এবারের চাষি আন্দোলনের সমর্থনে আর নামা হবে না। আমাদের এই দু-দল সম্পর্কেই সাবধান হয়ে এগোতে হবে।

তাত্ত্বিক প্রশ্নেও আমাদের যুক্ত হতে হবে। আবার মিছিলেও। যারা অন্তত পারবেন। বয়স এবং সামর্থ্য যাদের ব্যস্তানুপাতে এখনও মিছিলবান্ধব। সকলের তো আর আমার মতো অথর্ব দশা নয়। কিন্তু প্রবন্ধে তো মিছিল করা যায় না। তাই এখানে আপাতত তত্ত্বগত সমস্যা নিয়েই কিছু সংলাপ রচনা করা যাক।

একটা প্রশ্ন হচ্ছে সরাসরি কৃষক বিক্ষোভের চরিত্র সম্পর্কে। আর একটা হচ্ছে এর সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কিত। অনেকেরই মনে হচ্ছে, যে কৃষকরা দিল্লিতে এসেছেন তাঁরা সবাই ধনী কৃষক। তাঁদের ট্র্যাক্টর আছে এবং তাঁরা বাড়ি থেকে অনেক দিনের খাদ্যবস্তুর সঞ্চয় নিতে এসেছেন। তার মানে, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, পাঞ্জাব হরিয়ানার ধনী কৃষকদের (অনেকে রুশ বিপ্লবের সঙ্গে সংহতি রেখে কুলাক শব্দটা ব্যবহার করছেন) আন্দোলন এটা। বর্তমান কৃষি আইনের ধারাগুলো এদের স্বার্থকে আঘাত করছে বলে ওঁরা এসেছেন। গরিব ও মধ্য চাষি, সর্বহারা ক্ষেতমজুর বা বর্গাদারদের আন্দোলন এটা নয়। তাহলে এই আন্দোলনে মার্ক্সবাদী বামপন্থীদের কি সমর্থন করা উচিত?

কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন, এই জন্যই পশ্চিম বাংলা বিহার ওডিশা থেকে চাষিদের দিল্লির দিকে যাওয়ার কোনও আগ্রহ বা উদ্যোগ নেই।

অর্থাৎ, ধনী চাষি বনাম কর্পোরেট সংঘাতে আমরা কেন পক্ষ নেব? আমরা কেন পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখব না?

অন্য প্রশ্নটা হচ্ছে, যে আন্দোলন ফাসিস্ত শক্তিকে আঘাত করছে, তাকে আমাদের সমর্থন করাটা নৈতিক দায়ের মধ্যে পড়ে কিনা। এই প্রশ্নটা থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে।

মোদি সরকারের কৃষি আইন কেন এবং কাদের স্বার্থে— এ নিয়ে বাম মহল্লায় বোধ করি খুব একটা মতভেদ কোথাও নেই। আর সম্প্রতি যখন জানা গেছে যে আম্বানি এবং আদানি গ্রুপ বছর তিনেক আগে থেকেই দেশ জুড়ে বিশাল বিশাল কৃষি পণ্যের আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ গুদামঘর বানিয়ে ফেলেছে, তখন আর এ নিয়ে তর্ক করারও তেমন জায়গা নেই। মোদিভক্তদের কথা আলাদা। তারা যুক্তি তথ্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। যা বললে তাদের চাকরি থাকবে, তারা সেই অনুযায়ী প্রচার করে চলে।

বামপন্থীদের সবাই না হলেও একটা বড় সচেতন ও সক্রিয় অংশ মনে করে যে বিজেপি-র ফাসিস্ত শাসন ভোটের মাধ্যমে গরিষ্ঠতা অর্জন করে উঠে এলেও তাকে সেই ভোটেরই মাধ্যমে উৎখাত করা যাবে না। বৃহৎ বামেরা এটা ভাবতে পারে না বা ভাবতে চায়ও না, কেন না, তাহলে (১) কর্পোরেট বসেদের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা (যা তারা সরকারে থাকার কালে দীর্ঘ দিন ধরে খুব যত্নের সঙ্গে নির্মাণ ও অর্জন করেছিল) আর কখনই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না; (২) তাদের যাবতীয় নির্বাচনী কলাকৌশল, যা ক্ষমতাচ্যুত বনেদি ভয়ঙ্কর ফাসিস্ত কংগ্রেসের হাত ধরে ক্ষমতাসীন উঠতি ভয়ঙ্করতর ফাসিস্ত বিজেপি-র সঙ্গে ভোটে লড়তে চায়, এবং তাকে হারাতে চায়, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।

যারা এই দুই লক্ষ্যকে কাজের কাজ বলে মনে করে না, সেই সব ক্ষুদ্রতর বাম শক্তি (এরা খণ্ডে খণ্ডে ক্ষুদ্র, কিন্তু কোনও দুর্দৈবে একত্র হতে পারলে বেশ বড় তাকত হিসাবে সামনে এসে যেতে পারে) মনে করে এবং আশা করে, ফাসিস্ত শক্তিকে পরাস্ত করার একমাত্র উপায় (আক্ষরিক অর্থে) রাস্তায় নেমে প্রবল গণ আন্দোলন করে তার কালা জনশত্রু নীতি ও ফর্মানগুলোকে প্রতিহত করা।

নির্বাচনে ফাসিস্ত শক্তির ক্ষমতাসীন একটা দল হেরে গেলেও ফ্যাসিজমো পরাজিত হয় না জ্বলন্ত উদাহরণ হাতের সামনেই মজুত আছে। ২০০৪ সালেও বিজেপি ভোটে হেরেছিল। মনমোহন সিং-এর রাজত্বকালে তাই বলে এনআরসি, এনআরপি, সিএএ ইত্যাদি চূড়ান্ত স্বৈরশাহি আইন ও প্রকল্পসমূহ বাতিল হয়নি। অথবা, নাগরিকদের পরিচয়পত্র প্রদানের কোনও পাকা ব্যবস্থার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। যা করলে সেদিনই এই প্রশ্নে বিজেপি-র পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়া যেত। পরিবর্তে আধার কার্ড করানো এবং যাবতীয় সরকারি লেনদেনের সঙ্গে সেই কার্ডকে সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করে তোলার জবরদস্তি প্রচেষ্টা ছিল। অন্য দিকে, টাডা আফস্পা ইউএপিএ-র মতো দানবিক আইন এনে, বিশ্ববাণিজ্য সঙ্ঘের ফরমান মেনে কৃষি থেকে ধাপে ধাপে ভর্তুকি তুলে দিয়ে, খুচরো ব্যবসায় মনোপলি ঢোকার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, কৃষিতে জাতীয় আন্তর্জাতিক কর্পোরেট হাঙরদের (সমুদ্রের হাঙরদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী) প্রবেশ অবাধ করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেসরকারিকরণ শুরু করে, বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে তাকে সাম্প্রতিক ভোটের রাজনীতির ময়দানে টেনে নামিয়ে এবং সারা দেশে সাম্প্রদায়িক তীব্রতর মেরুবিভাজন ঘটিয়ে— এক কথায় বিজেপি এখন যা কিছু করছে তিরিশ বছর ধরে সামগ্রিকভাবে তার প্রাথমিক জমি তৈরি করে দিয়ে ফাসিস্ত কারবার যে কংগ্রেস শুরু করেছিল, সে শতাব্দ শেষে এবং ইউপিএ জমানা শেষে দুবার পরাজিত হয়েছে। নীতিগুলি পরাস্ত বা প্রত্যাহৃত হয়নি। ফ্যাসিবাদ দলান্তরের পরোয়া না করে এগিয়ে চলেছে। অর্থাৎ, দিল্লির কুর্সিতে কংগ্রেস না বিজেপি— তার উপর ফ্যাসিজমের শরীর স্বাস্থ্য নির্ভর করেনি।

গত তিরিশ বছরে দেশে আন্দোলন ধর্মঘট কম হয়নি। কিন্তু এমন একটাও আন্দোলন হয়নি যা কোনও সরকারের গৃহীত একটা আইন বা নীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সংশোধন বা বাতিল করিয়ে দিতে পারে। যারা সেই সব আন্দোলন ধর্মঘট সংগঠিত করেছে, তাদেরও মনে কী ছিল জানি না, ঘোষিত অন্তিম লক্ষ্য ছিল অস্তিমান সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা করে সামনের ভোটে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করা। তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ হলেও ফ্যাসিবাদের গায়ে আঁচড়টিও পড়েনি।

সে মুচকি মুচকি হেসেছে কিনা নিশ্চিত বলতে পারছি না।

মাস ছয়েক আগে অন্য একটা লেখায় আমি বলেছিলাম, ফ্যাসিবাদকে দলের নিরিখে নয়, শ্রেণি ও রাষ্ট্রের নিরিখে দেখতে হবে, চিনতে হবে। কথাটা আদতে আমার নয়। মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের এটাই মৌল শিক্ষা। আমি শুধু বামপন্থী কর্মীদেরকে সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম এই জন্য যে যারা কংগ্রেসকে সঙ্গী করে বিজেপি-র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে, তারা আসলে ফ্যাসিবাদকে আশ্রয় দিয়ে এবং ফ্যাসিবাদের কোলে আশ্রয় নিয়ে ভাবছে, ফ্যাসিবাদকে রুখবে।

আর নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রণনীতি রণকৌশল ঠিক করলে এবং সেই অনুসারে জোট করলে জোটসঙ্গীর শ্রেণিচরিত্র এবং রাষ্ট্রের সাপেক্ষে তার ভূমিকার প্রশ্ন গৌণ হয়ে যেতে বাধ্য। বিপরীতপক্ষে, সেই রাজনীতি কখনই, তার রণনীতি ও রণকৌশলগত কারণেই, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র এবং তার শ্রেণিকর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়তে চাইবে না। সে এই রাষ্ট্রের চণ্ডীমণ্ডপে, বিধানসভা লোকসভায়, লোক পাল্টাপাল্টির কথাই ভাববে এবং বলবে; নিজেও সেখানেই কুর্সি— কুর্সি না হলে অন্তত সতরঞ্চিতে—বসার কোণ একটা খুঁজবে। সময় এবং সুযোগমতো সেও যে কর্পোরেটের সেবকের ভূমিকা নিতে পারে, টাটা কিংবা অন্য কারও “কেশাগ্র রক্ষা”-র দায়িত্ব বহন করতে পারে— সেটা জানান দিতে থাকবে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির ঘরানায় এই চিত্র এখন সুস্পষ্ট।

এর ঠিক বিপরীতে, দিল্লির কৃষক বিক্ষোভ ফাসিস্ত শক্তিকে ঠিক কোথায় আঘাত করলে তার কোমর ভেঙে যেতে পারে, তা দেখিয়ে দিল। লোকসভায় ৩৮০টা আসন থাকতে পারে নরেন মোদীর দলের। তারা তাতে ভেবে যাচ্ছিল, তারা এখন যা খুশি করতে পারে। বারো লক্ষ কৃষকের জমায়েত এবং প্রতিবাদ দেখিয়ে দিচ্ছে, তা আর করা যাবে না। কৃষি বিল তাকে বদলাতে হবেই। আম্বানি আদানির স্বার্থে চাষের জমি আর জমির ফসল লুটের বাতাসায় পরিণত করা আপাতত যাবে না। কর্পোরেট স্বার্থে ফ্যাসিবাদের শ্রেণির চাহিদা পরিপূরক একটা জরুরি নীতি লোকসভায় গৃহীত হলেও রাস্তার বৃহত্তর লোক-সভায় তা বাতিল হয়ে যেতে বসেছে।

দিল্লির কৃষক বিক্ষোভের এটাই সবচাইতে বড় গুরুত্ব। আমাদের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় পাওনা। দলাদলির ভোটশক্তির তুলনায় জনগণের জোটশক্তি যে শেষ পর্যন্ত অনেক বড় এবং অনেক বেশি ক্ষমতা ধারণ করে, গ্রন্থমধ্যে গ্রন্থিবদ্ধ এই সত্যকে অনেক দিন পর সে আমাদের ব্যালটীয় ছানি পড়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

এতটাই জোরের সঙ্গে যে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত চাষিদের মামলার শুনানিতে বলতে বাধ্য হয়েছে, আন্দোলন ও প্রতিবাদ করার অধিকারকে মান্যতা দিতে হবে। সরকারের দালালি নীতি না মানলেই সে দেশদ্রোহী— এই বয়ান সংবিধান অনুযায়ী গ্রাহ্য নয়। কৃষি আইন যখন কৃষকরাই নিতে চাইছে না, তা আপাতত স্থগিত রেখে একটা কমিটি করে আলোচনা কর। যে সর্বোচ্চ আদালত গত দু বছর ধরে— রাফায়েল দলিল থেকে শুরু করে কাশ্মির এনার্সি হয়ে রাম মন্দিরের প্রশ্নে— প্রতিটি ব্যাপারে নাগপুরের ইচ্ছাকেই রায়ে অনুবাদ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এই প্রথম তা থেকে সরে এসে ন্যায়ালয়-সুলভ রায় দিল। কাফিল খানের মামলার প্রসঙ্গে উত্তর প্রদেশ সরকারের শয়তানি আবেদনকেও পাত্তাই দিল না। গত তিরিশ বছরে ভোট দিয়ে সরকার বদল করে যা এত কাল করা যায়নি, বাইশ দিনের আন্দোলনের চাপে, বাইশ জন কৃষক শহিদের আত্মদানের বিনিময়ে সেই কাজ করা গেল। বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে তার নগ্ন স্বৈরগাত্র আর একবার অন্তত ছেঁড়া ময়লা হলেও গণতন্ত্রের একটা পাতলা পরিচ্ছদ দিয়ে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করতে হল।

এতেই ফাসিস্তশক্তি নিশ্চয়ই নির্মূল হয়ে গেল না। তার চৌষট্টিখানা বিষদাঁতের মধ্যে হয়ত একটা মাত্র দাঁত ভাঙা গেল। কিন্তু ভাঙার রাস্তাটা চেনা গেল। যারা আগামী দিনে সত্যিই বিজেপি-র ফ্যাসিবাদ রুখতে চাইবেন, তাদের এই রাস্তার কথা বুঝতে হবে, এই রাস্তাতেই চলার কর্মসূচি নিতে হবে। এরকম চলতে চলতে নির্বাচন যখন এসে যাচ্ছে, তাতেও এই কর্মসূচির পরিপূরক জোট বানাতে হবে। বামপন্থীদের বামপন্থী কর্মসূচিই নিতে হবে। শিল্প গড়ার নামে টাটা সালেম আম্বানি আদানি বেদান্তর কেশ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ বামপন্থার কাজ নয়। কৃষককে বন্দুকের মুখে উৎখাত করে রাতের আঁধারে জনসাধারণের চোখের আড়ালে কর্পোরেটকে গোপন চুক্তি করে, নাম মাত্র মূল্যে (আসলে বিনি পয়সায়) জমি দিয়ে, তিন পয়সা/ইউনিট বিদ্যুৎ দিয়ে, শিল্পবান্ধব হতে চাইলে তার জন্য সত্যিই কংগ্রেস আছে, বিজেপি আছে, কালে দিনে টিএমসিও এসে যাবে, কিন্তু বামপন্থীকে লাগবে না। আর বামপন্থা কোনও পৈতে পরা ব্রাহ্মণ্য পরম্পরা নয় যে লাল পতাকা হাতে রেখে কংগ্রেস বিজেপি টিএমসি-র নির্ধারিত কাজ করলেও তা চিরকাল বামপন্থাই থেকে যাবে। ফলে পশ্চিম বাংলায় অতীতে এরকম দক্ষিণপন্থী ভূমিকা নেবার জন্য ভুল স্বীকার করে নতুন দিশা গ্রহণ করে এগোতে হবে। অবশ্য সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের শিল্পায়ন কর্মসূচিকে মডেল বলে চালিয়ে এগোতে হলে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও তার সঙ্গে বিজেপি বিরোধিতা বা কৃষক বিক্ষোভ সমর্থনের কোনও সাযুজ্য থাকবে না।

বামপন্থীদের বামপন্থী জোট করে বামপন্থী কর্মসূচির ভিত্তিতেই নির্বাচনে লড়াই করতে হবে। রাজ্যের টিএমসি সরকারের বিরুদ্ধেও সেই সমস্ত মুদ্দা বেছে নিতে হবে যার আঘাত থেকে বিজেপি-ও বাদ যাবে না। যেমন গণতন্ত্রের প্রশ্ন, কলেজ স্ট্রিট ও এসপ্ল্যানেড এলাকায় মিটিং মিছিল করার অধিকার, জেলায় জেলায় বিরোধীদের সভা ও মিছিল করার উপর পুলিশি বাধা অপসারণ, বিনা বিচারে বন্দি রাজনৈতিক কয়েদিদের নিঃশর্তে মুক্তি প্রদান, লালগড় ও নন্দীগ্রাম থেকে বামফ্রন্ট আমলে মিথ্যামামলায় ধৃত সমস্ত রাজবন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি, জেলখানায় সমস্ত কয়েদীদের পূজা বা ঈদে নতুন জামাকাপড় প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, যত্রতত্র ইউএপিএ প্রয়োগের বিরোধিতা, ইত্যাদি। এই সব মুদ্দার সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে নিয়ে ভিমা কোরেগাও মামলার অভিযুক্তদের ও অন্যান্যদের বিনাবিচারে জামিন অস্বীকার করে জেলে কয়েদ করে রাখার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে প্রচার, জনমত গঠন এবং বিক্ষোভ গড়ে তোলাও দরকার।

আসুন, আমরা দিল্লির চলমান কৃষক আন্দোলন থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করি, বামপন্থীদের আবার রাজ্যের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায় কিনা, সেই অভিমুখে কিছু কাজের কাজ করা যায় কিনা ভেবে দেখি।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4243 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...