Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলাদেশ কি হেরে যাবে? একটা স্বপ্নের মৃত্যু কি অবশ্যম্ভাবী?

শারিফুস সালেকিন শাহান

 

একটা দেশ বহু রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হল কিন্তু ধর্মের নামে সেই স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা বহাল তবিয়তে রইল। ৪ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানির বিচার হল না, তার আগেই ইতিহাসকে উল্টো পথে হাঁটতে বাধ্য করা হল।

ওদিকে স্বাধীনতার সৈনিকদের অজস্র বিতর্কিত কাজ মানুষকে বিভ্রান্ত করল।

একদল উগ্র আধুনিকতাবাদী মুক্তিযুদ্ধের পর পুরনো সব কিছুই ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইলেন কিন্তু পুরনো প্রথা, আচার, ঐতিহ্যের পরিবর্তে নতুন কোনও বিকল্প জোগান দিতে ব্যর্থ হলেন।

ফলাফল মুক্তিযুদ্ধের দগদগে ক্ষত নিয়ে মানুষ নীরবে দেখল তার মনোজগত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।

তারপর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে এল ৭৫ পরবর্তী সরকারের সহযোগী ওয়াহাবিজম।

৯/১১ পরবর্তীকালে বিশ্বের মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট তীব্র হলে ওয়াহাবি সালাফি ইসলামই প্রবলভাবে সামনে উপস্থিত হল— মানুষ এটাকেই তার আশ্রয় হিসেবে বেছে নিল।

২০০১ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক গতিশীলতার সাথে নৈতিক শিক্ষাবিহীন একটা প্রজন্মের উত্থান, তথ্য প্রবাহের বিপুল আয়োজন, ভারতের আগ্রাসী মনোভাব এবং ভারতে হিন্দু উগ্রবাদের প্রচণ্ডতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইসলামি উগ্রবাদ।

এদেশের জামাতের সাথে ভারতের বিজেপির সখ্যতা— দুজনের জন্যই লাভজনক।

তারপর ২১শে আগস্ট, বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন পর্বের শুরু।

এই পর্বে যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় যেতে এবং ক্ষমতায় আসীন থাকতে সব রাজনৈতিক দলগুলির উলঙ্গ প্রতিযোগিতা, বাম নেতাদের চরম স্খলন, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক নেতা কর্মীদের নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ ঘটেছে।

বস্তুত বাংলাদেশে এখন বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর চরম আকাল।

ফলে ৩০০ জন সংসদ সদস্যের প্রায় সবাই লুটেরা বাটপাড়, এরা ক্ষমতার জন্য কালো টাকা দিয়ে মসজিদ মাদ্রাসা বানায়, সেই মাদ্রাসা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি জমি দখল করে গড়া।

তারপর সেই মাদ্রাসার আয়ের জন্য মার্কেট, হুজুরের পকেট ভরানোর জন্য ওয়াজ, ওয়াজের জন্য চাঁদা, হুজুররা সংগঠিত হয়ে শক্তিশালী হেফাজতে ইসলামি প্রতিষ্ঠা।

শাপলা চত্বরের ঘটনার পর হুজুরদের দমিয়ে দেওয়া সহজ ছিল, আওয়ামী লিগ তখন ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জরুরি সংস্কার করতে পারত।

কিন্তু ক্ষমতার খেলায় তারা হেফাজতকে সঙ্গী করতে যেয়ে বিএনপি, জামাতের বিরুদ্ধে নতুন জোট করেছে।

হেফাজত নামের এই গোষ্ঠী বিএনপি-জামাতেরই সন্তান।

ওদিকে দেশজুড়ে ভয়াবহ লুটপাট, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা হরণ আর নির্বাচন ব্যবস্থার মৃত্যু— দেশকে এক অবশ্যম্ভাবী সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে।

দৈনিক গড়ে ৩ জন ধর্ষিত হচ্ছে, বিগত সময়ের অন্তত ১০০০০ ধর্ষণের ঘটনায় বিচার হয়েছে মাত্র ৩%, ১ জনেরও ফাঁসি হয়নি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ ক্ষমতাবান ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়ায়।

ইন্টারনেটের প্রসারের প্রায় সমার্থক হয়েছে নীল ছবির জনপ্রিয়তা।

নৈতিক, যৌন শিক্ষাহীন অন্তত দুই প্রজন্ম নীল ছবির সাথে মুম্বাইয়ের সফট পর্নোতে আসক্ত, বেড়েছে মাদকের ব্যবহার।

অন্যদিকে হুজুরদের বেতন ভাতা অতি সামান্য, স্ত্রী নিয়ে কর্মস্থলে বাস করা অসম্ভব।

এই যখন দেশের অবস্থা, তখন ধর্ষণ, বলাতকার অবশ্যম্ভাবী।

সেটিই ঘটছে।

এর পরে কী?

বাংলাদেশ কি হেরে যাবে? একটা স্বপ্নের মৃত্যু কি অবশ্যম্ভাবী?

না!

নুসরাত আত্মহত্যা করতে পারত, প্রতি বছর অনেক কিশোরী তরুণী তাই করে।

নুসরাত লড়াই করতে চেয়েছে।

শরীরের ৮০% পুড়ে গেছে, ফুসফুসে সংক্রমণ, তবু সে বলে গেছে “আমি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এই অন্যায়ের বিচার চাইব।”

নুসরাতের মা সদ্যমৃত কন্যার গালে চুমু দিয়ে বলেছেন “নুসরাতের গোসল যেন হাসপাতালেই হয়, সোনাগাজিতে যেন গোসল না দেয়।”

মা চাননি তার কন্যার বেআব্রু, বীভৎস দেহটি সোনাগাজিতে গোসল করিয়ে আরও একবার কন্যাকে হত্যার সুযোগ দেওয়া হোক।

পিতা, নুসরাতের সেই মাদ্রাসারই শিক্ষক। নিজ কন্যার জানাজার নামাজ পড়িয়েছেন, কন্যা হত্যার বিচার চেয়েছেন।

অগুনতি মানুষ সেই জানাজায় শরিক হয়েছে, কেঁদেছে।

এই কান্না ছুঁয়েছে বাংলাদেশের হৃদয়, প্রতিদিন প্রতিবাদ হচ্ছে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ, নীতিহীন রাজনৈতিক দল আর ভেঙে পড়া বিচারব্যবস্থার কারণে হয়ত নুসরাতের খুনিরা ফাঁসির হাত থেকে রেহাই পাবে।

কিন্তু এই ঘটনা মানুষের মনে যে তীব্র আঘাত করেছে তার প্রকাশ দেখা দিচ্ছে এখনই।

মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য যে সহানুভূতি ছিল, সেটি লুপ্ত হয়েছে। প্রকাশ্যেই মানুষ মাদ্রাসার সমস্যা নিয়ে আলাপ করছে।

হয়ত নুসরাতের মৃত্যু এই দেশকে এমন এক গভীর বেদনার ভার দিয়ে গেছে যার আঘাতে এদেশের জমে যাওয়া বিবেক গলতে শুরু করবে।

এই সময়ের জন্য প্রয়োজন সুস্থ নেতৃত্ব। ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়, সাথে নিয়েই চলতে হবে তবে মাথায় নিয়ে নয়। সুফিবাদের মৃত শাখাটিকে সঞ্জীবিত করতে হবে— ওয়াহাবিজমের কাউন্টার ন্যারেটিভ হিসেবে।

কিন্তু আরব বিশ্বের চলমান অবস্থা, ভারতের বিজেপির চরম হিন্দুবাদী নীতির বিপরীতে এদেশে চরম ইসলামি মতবাদ, চিনকে ঠেকাতে মার্কিন-ভারত পরিকল্পনায় রোহিঙ্গা নিয়ে জটিল পরিকল্পনা এবং দেশের ভেতরে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব— এসবের সামষ্টিক যোগফল হয়ত শেখ হাসিনা পরবর্তী মোল্লাতন্ত্রের সূচনাই দেখাবে।

আমরা কি হতাশ?

আজ সকালে টং দোকানে চা খাচ্ছি, সামনেই বিরাট মাদ্রাসা। আমার পাশে সব পুলিশ সদস্য।

৪-৫টা মাদ্রাসার ছাত্র, ১২-১৪ বছরের, হেঁটে যাচ্ছে। এক বয়স্ক পুলিশ সদস্য বললেন— এরা প্রত্যেকেই ভার্সিটির ছাত্রদের তুলনায় নারীদেহ সম্পর্কে পিএইচডি ডিগ্রিধারী।

এটা মানুষের মনে জমে থাকা জমাট বাঁধা ক্ষোভের প্রকাশ।

মাদ্রাসায় ছাত্রসংখ্যা বেশি দেখিয়ে সরকারি অনুদানের টাকা লুঠ বন্ধ হলে হয়ত আরও আশ্চর্যজনক কিছু জানা যাবে।

এতসব ঘটছে মুক্তিযুদ্ধের একক গৌরবের দাবীদারদের শাসনকালে।

সবটাই হয়ত একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র!