Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সেল

শুভ্র মৈত্র

 

–নতুন বান্ডিল ঢালবেন না?

মঞ্জুর কথা শুনে ভুরু কুঁচকে একবার তাকাল দোকানের ছেলেটা। মুখে কিছু বলল না, ভাবখানা এমন, ‘এর মধ্যেই বেছে নাও’। বড় দোকানের কর্মচারী। দাপট তো একটু হবেই। তাও আবার এই ‘সেল’-এর সময়ে। করুণার চোখে দ্যাখে মঞ্জুদের। মঞ্জুরা যারা বছরের এই সময়টাতেই দোকানে ভিড় করে সস্তায় চাদর, ব্লাউজ বা শাড়ির আশায়। তাচ্ছিল্যের সাথে মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেল কাপড়ের বান্ডিল। আর হুড়োহুড়ি পরে যায় খদ্দেরদের মধ্যে।

দুপুরের এই সময়টাই মঞ্জুদের সময়। রিপনের বাবা অটো নিয়ে বেড়িয়ে যায়, ইস্কুলের ডিউটি করে, দুটো ট্রিপ মেরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। রিপনও ইস্কুল থেকে বিকালের আগে ফেরে না। তারপর আবার প্রাইভেট আছে। রিপনের ঠাকুমাকে ভাত বেড়ে দিয়ে নিজে দুটো নাকে মুখে গুঁজে এই সময়টাই মিনতি বৌদির সাথে দোকান বেড়ানোর সময়। টাউনে এখন অনেক দোকান হয়েছে, আবার কী যেন বলে, মল না কি… ওগুলিও আছে। ওখানে নাকি ভিতরে ঠান্ডা, মাঙনায় ঠান্ডা জল পাওয়া যায়। আর মেয়েমানুষ দোকানদার।

মঞ্জু অবশ্য যায়নি কোনওদিন। দেখেছে দূর থেকে। দরজায় দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকে। মঞ্জুর ভয় ভয় করে। ওদের এই দুর্গা বস্ত্রালয়ই ভালো। বেশ অনেক শাড়ি ব্লাউজের মধ্যে বেছে নেওয়া যায়, দরদাম করা যায়, ছোঁ মেরে তুলে নেওয়া যায় অন্যের পছন্দ করা বিছানার চাদর। মিনতি বউদিও এসব ব্যাপারে চৌখশ। বলে “কোনায় সেঁধিয়ে থাকলে কিছু পাবি? গতর খাটিয়ে কেড়ে নিতে হবে!”

–গতর খাটানোর মানে বোঝে মঞ্জু। সকাল থেকে রিপনের, ওর বাবার, ঠাকুমার হাজারটা কাজে গতর খাটায়। গতরেই বেঁধে রাখে সংসার সারাদিন, রাতে রিপন ঘুমিয়ে পরলে ওর বাবার সাথেও গতর খাটাতে হয়। আবার মাঝে মাঝে গতরেই সহ্য করতে হয় মারধোর, অত্যাচার।

শাড়ি সায়া ব্লাউজে ভিড় বেশি। অনেক ফর্সা ফর্সা মেয়েছেলেও ভিড় করে। গায়ের থেকে কি সুন্দর গন্ধ বেরোয়। মঞ্জুর ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে ওদের পাশে।

আজকে অবশ্য সায়া ব্লাউজের দিকে যায় না মঞ্জু। কয়দিন ধরেই ঠিক করে রেখেছে কোথায় দাঁড়াবে। ঐ যে কোণটায়। বাচ্চাদের জামা, প্যান্ট, গেঞ্জি— সব দুশো। হ্যাঁ ওখানেই এসে উঁকি মারছিল, তখনই মিনতি বৌদির কথাটা কানে এলো, ‘গতর খাটাতে হবে…’

টুকটুকে লাল জামাটা নজরে পড়েছিল বান্ডিলের ভিতর থেকেই। গিঁট খোলার আগেই চোখ টেনে নিয়েছিল। আর কেউ দ্যাখেনি তো!

ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মঞ্জু। ওটাই চাই। হ্যাঁ, ধরেছে। ভিড়ের মধ্যে আরও অনেকগুলি হাত ছিল, কিন্তু মঞ্জুর রগ ওঠা শুকনো হাত টাই পৌঁছল সবার আগে। মনে হচ্ছিল সবাই যেন ঐ জামাটাই ধরতে চায়। পেরেছে মঞ্জু। খুলে ধরল চোখের সামনে, হ্যাঁ, মাপটা ঠিকই হবে। নাকি একটু বড়? না না এটাই ঠিক।

কাউন্টারে লাইনটা অনেক লম্বা। হোক গে, মঞ্জুর গায়ে লাগে না। ওর হাতে তো ধরাই আছে প্যাকেটটা। কেউ তো আর কাড়তে পারবে না! ওর জয়ের স্মারক। লাইনে দাঁড়িয়েই একবার ব্লাউজের উপর দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নিল খসখসে শব্দটা। হ্যাঁ টাকাটা আছে।

মিনতি বৌদিকে দেখছে না, হয়তো আছে কোথাও, কোনও কাউন্টারে। বউদি নিজে কিছু নেয় না। শুধু ছোঁক ছোঁক শাড়ি, চাদরের ভিড়গুলোয়। মঞ্জুকেও টেনে নিয়ে যেতে চায়, দেখাতে চায় শাড়ি। মঞ্জুর ভাল্লাগে না। নেবে না, শুধু শুধু দাঁড়িয়ে দেখবে, লজ্জা লাগে ওর।

বুকের ভিতর থেকে ঘামে ভেজা দুটো একশো টাকার নোট দেওয়ার আগে আরেকবার টিপে দেখে নেয়। আর ওপাশে বসা লোকটা যেন পাত্তাই দেয় না। খোলা ড্রয়ারেই ফেলে রাখল।

দোকানের বাইরে যখন পা রাখল ওরা, তখনও রোদের তাপ আছে। কিন্তু মঞ্জুকে ছোঁবে তার সাধ্য কোথায়? ওর মেচেতা পরা গালে তখন সূর্যের রংটুকুই শুধু লাগে, তাপ নয়।

রাস্তায় লোকটা ঐ গনগনে আগুনের পাশে দাঁড়িয়েই ঘুগনি তৈরি করছিল। মিনতি বৌদি গিয়ে দাঁড়াল, “কত করে প্লেট?”

–দশটাকা
–কেন, ফুলবাড়ি মোড়ে তো আটটাকাই নিচ্ছে…

শেষমেশ আট টাকাতেই রফা হল। মঞ্জু কুঁকড়ে আছে একপাশে। ও জানে, বৌদিই টাকা দেবে। লেবু চিপে, পেঁয়াজের সাদা টুকরো ছড়িয়ে প্লেটটা যখন এগিয়ে দিল দোকানি, তখনও ওর থেকে ধোঁয়া উঠছে। আর কি সুন্দর গন্ধ। রিপনের মুখটা ভেসে উঠল। ঝালটা একটু বেশি ছিল। বউদি তো আবার ‘এক্সট্রা’ও আদায় করল ঘুগনিওয়ালার কাছ থেকে।

বাড়ি ফেরার পথটুকুতে বৌদি যথারীতি খুলে বসল পাড়ার ঝাঁপি। হারানের বউয়ের সাথে দাশুর বউয়ের তুমুল ঝগড়া, উজ্জ্বলের মেয়েকে বেপাড়ার কোন ছেলের বাইকে দেখেছে পাড়ার লোক, উমার শ্বশুরের এখন তখন অবস্থা— সব কাহিনি আছে, বৌদির আঁচলের গিটে। মঞ্জু অর্ধেক শোনে, অর্ধেক শোনে না। ওর হাতের প্যাকেটটাতেই মন। নতুন প্যাকেট। প্লাস্টিকের খরখরে শব্দ। নতুন প্যাকেটটা নিয়ে কি করবে, সেই ভাবনাও সারা। রেখে দেবে। কাউকে কিছু দিতে হলে ঐ প্যাকেটটাই দেবে। রাস্তার ধারে বিভিন্ন দোকানে ঝুলছে, ‘চৈত্র সেল’। আর মঞ্জুর নজর কাড়ে না, ওর কাজ হয়ে গেছে।

মনে আছে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে চৈত্র মাস অশুভ, ভালো কাজ হয় না। কিন্তু বছরের এই শেষ মাসই তো রিপনকে দিয়েছে। কী গরম ছিল সেদিনও, হসপিটালের বিছানার পাশে বসে মা পাখা নিয়ে হাওয়া করছিল মনে আছে। কতদিন হয়ে গেল, এখনও ছবিটা স্পষ্ট। আর এখন তো বছরের শেষ মাসটার দিকেই তাকিয়ে থাকে মঞ্জুরা। পুজোর সময় দোকানগুলিতে তো আর ওদের কোনও ঠাই নেই। ছুঁতেই পারে না।

শীতকালের মতো কৃপণ নয় বিকেলগুলি। বাড়ি ফেরার পরেও রোদ লেগে ভ্যাপসা কার্নিশে, দত্তদের বাড়ির ছাদে। ঘরে ঢুকেই আগে চকির উপর তেলচিটে তোশকটা তুলে তার নিচে যত্ন করে রেখে দিল প্যাকেটটা। টানটান করে। যেন ভাঁজ না পড়ে।

নিয়মমাফিক চলছিল আজকের সন্ধ্যাটাও। টিনের বাক্স খুলে রিপনের বই খাতার সংসারের মাঝেই মায়ের দেওয়া মুড়ির বাটি, ওর ঠাকুমার পিঠে মঞ্জুর রোগা হাতে তেল মালিশ, এর মাঝেই অটোর শব্দটা এসে থামল দরজায়। মালিকের গ্যারেজে নয়, আজকে বাড়ির দরজায় থাকবে অটো। রিপনের আনন্দ হয় এই দিনগুলিতে। নিজে গিয়ে বসে থাকে অটোর ভেতর, ঘর ঘর খেলে, মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং-এ বসে বাবা হয়, চীৎকার করে ‘মঙ্গলবাড়ি, গৌড় রোড, রথবাড়ি, মার্কেট…’। জোর করে মঞ্জুকেও বসিয়েছে অনেকদিন।

মঞ্জু অবশ্য সুযোগ পেলেই ন্যাকড়া হাতে সামনের কাচটা একটু মুছে দেয়। স্টিয়ারিং-এর সামনের পকেট সাইজের মা কালির ছবিটাকে মুছে রাখে, কপালে হাত ঠেকিয়ে সামনে রাখে একটা জবাফুল। নাই বা হল নিজের, এই অটোতেই তো টানছে চারটে মানুষের পেট।

আজকেও এ সবই করছে মঞ্জু, এমনকি ওর বাবা যখন চাটাই পেতে বোতল খুলে দাওয়ায় বসলো রোজকার মতো বয়াম থেকে চানাচুরও বের করে দিল, কিন্তু গজগজ না করেই। এই ছাইপাঁশ নিয়ে রোজকার বিরক্তিও প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না আজ।

বরং আড়চোখে বিছানাটা দেখে শুধু। সেই তেলচিটে চাদর ফ্যাকাশে বালিশ– ওর নিচেই তো প্যাকেটটা। মঞ্জু তাকায়। একবার ঘুরেও আসে বিছানার কাছ থেকে। গন্ধ পায় যেন নতুন জামাটার। হাত দিয়ে টিপে দেখে খচরমচর শব্দটা।

“হারামজাদি, ফের টাকা নিয়েছিস?”– জড়ানো গলায় শব্দটা কানে আসার আগেই আছড়ে পড়ল অটোর স্টিয়ারিং ধরা শক্ত হাতটা। রিপনের ভাতটা সবে মাখতে বসেছিল মঞ্জু। এখনও কোলে বসে খাইয়ে দেওয়ার আবদার করে ধারি ছেলেটা। চুলটা ধরে পেছন থেকে টেনে ধরেছিল একটা হাত। অন্য হাতটা নেমে আসছিল গালে, বুকে, পিঠে। ডান হাতটা এঁটো ছিল, তাই বোধহয় রক্ষা, বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে, “বল শালি, কোন নাগরকে দিস টাকা…” মঞ্জুর গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না।

এই সময়গুলিকে চেনে রিপন। অটোটা থাকলে ওর ভিতরে বা ঠাকুমার লালঝোল মাখা কাঁথাটায় সেঁধিয়ে থাকার থাকার সময়। আজকেও যেমন।

মঞ্জু দাঁত চেপে থাকে। বহুদিন আগেই শিখেছে এই চুপ করে থাকার কৌশল। ঘাড়ে, মাথায়, মুখে যখন ভারী হাতটা আছড়ে পরছিল, একটা শব্দও বেরোয়নি ওর মুখ থেকে। রিপনের বাবার ঘুমের সুযোগ নিয়ে পকেট থেকে দীর্ঘদিন ধরে নেওয়া ময়লা নোট, টিপে টিপে সেটাই দোকানের লোকটাকে দেওয়া– একটা ছবিও মনে পড়ছে না। শুধু লাল, টুকটুকে লাল জামাটা দেখতে পাচ্ছিল চোখ বুঁজে। ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে আসছে যে সরু ধারা, তার চেয়েও লাল। রিপনের গায়ে কেমন মানাবে ভাবতে চাইছিল মঞ্জু, আর সেই ভাবনাতেই সয়ে নেয় সমস্ত যন্ত্রণা। একসময় নিয়ম মেনেই থেমে যায় অন্য পক্ষ।

রোজকার মতোই আলুথালু শাড়ি, খুলে যাওয়া চুল, ছড়িয়ে পড়া বাসনকোসন গুছিয়ে নিতে হয় মঞ্জুকে। মুখেও দিতে হয় জলের ঝাপটা। যে হাতটা এতক্ষণ ওকে শাসন করছিল, সে হাতেই তুলে দেয় ভাতের থালা।

–একটা কাঁচালঙ্কা দিস…

পালন করে মঞ্জু। ভাত মেখে ঘুমিয়ে পড়া রিপনকে খাওয়াতে বসে। কতটা ঘুমে, কতটা মাকে দেখতে না চাওয়ায় বোঝা যায় না। চোখ বন্ধই থাকে রিপনের। মঞ্জুর শাড়ির গন্ধেই ওর খাওয়া, মুখ খোলে, চিবোয়। একসময় মুখ ধুইয়ে বিছানায় শুইয়েও দেয় মা।

সব কাজ সেরে শুতে এল মঞ্জু, রিপনের পাশে। বিছানায়। মেঝেতে ওর বাবা। ঘরে ঢুকেই যে নাকের ডাকটা কানে এল তাতে স্পষ্ট, মঞ্জুকে আজ আর বিছানা থেকে নামতে হবে না। এখন রিপনকে ধরেই শুয়ে আছে ও। চোখের নিচ আর ঘাড়টা টনটন করছে ব্যাথায়। কিন্তু ওসব গায়ে মাখে না মঞ্জু। বিছানার উপর থেকেই অনুভব করে নিচের প্লাস্টিকের প্যাকেটটা। নতুন কাপড়ের গন্ধটা যেন ভ্যাপসা বিছানা ছাপিয়েও উঠে আসছে। লাল রংটা দিনের আলোয় কেমন লাগবে? জন্মদিনে পায়েস খেতে চেয়েছিল ছেলেটা…।

সকাল সকাল ওর বাবা বেরিয়ে যায়। চা-মুড়ি দিয়ে দিল মঞ্জু। কাল রাতের পশুটার কোনও চিহ্ন নেই। থাকেও না। অটোর জন্য ধুপকাঠিটাও মঞ্জুই এগিয়ে দেয়।

এবার রিপনকে ঘুম থেকে তুলতে হবে।

–বাবু ওঠ, বেলা হয়ে গেল যে! ইস্কুল যাবি না?

দুই একবার এদিক ওদিক পাশ ফিরে উঠে পড়ে রিপন। মুখ ধোওয়া হয়নি। কিন্তু মঞ্জুর যেন আর তর সয় না। বিছানার নিচ থেকে প্যাকেটটা বের করেছে। প্লাস্টিকের মোড়ক সরিয়ে মেলে ধরল জামাটা। রিপনের গায়ে পরে থাকা গেঞ্জিটার উপরেই পরিয়ে দিল। লাল, টুকটুকে… আহ, কি সুন্দর লাগছে!

রিপনকে চুমু খেতে যায় মঞ্জু। কিন্তু ঠেলে সরিয়ে দেয় রিপন, “সরো, সরো”। ফটফট করে বোতামগুলো খুলতে থাকে, “পরব না আমি। চুরির মাল… ফেলে দাও…”– বলে একছুটে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। চিৎকারটা কানে এল, “নাগরকে দিয়ে দাও…।”

আর এই প্রথম ঝাঁপিয়ে কান্না এল মঞ্জুর চোখে। কাল রাত থেকে যত্ন করে গুছিয়ে রাখা ব্যথাগুলো একসাথে আছড়ে পড়ল ওর শরীরে। টুকটুকে লাল জামাটার উপর জলের দাগ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে…।