যে গন্ধগুলি কেড়ে নেয় করোনা

শুভ্র মৈত্র

 


লেখক সাংবাদিক, শিক্ষক, গল্পকার

 

 

 

 

 

কীরে বাবা, গায়ের ওপর এসে পড়বে নাকি? এদের জ্বালায় একটু হাঁটার উপায় নেই!— শিবেন আর একটু কুঁকড়ে যায়। এগিয়ে এসেছিল কখন খেয়াল করেনি। কে বলল, সেটা বোঝার চেষ্টা করল না। লাভ নেই, এমনিতেই এই দিদি-বৌদিদের সব একরকম দেখতে হয়, আর এখন তো অনেকেরই আবার মুখ ঢাকা। কী হবে দেখে? শিবেন দেখেছে পুজোর সময় দোকানে বসে শাড়ি বাছাই করার সময় যত আবদারের আর আহ্লাদের মুখ থাকুক না কেন রাস্তায় বেরিয়েই একটা বিরক্তির মুখোশ পরে নেয় ওরা। এই ফুটপাথ, এই ভিড়, এই হকার— সব যেন বিরক্তির পসরা সাজিয়ে বসেছে।

ঠেলাটা নিয়ে খানিক সরে আসে শিবেন। ব্রজেনদা রেগে গেলে আবার উঠে যেতে হবে। একটু সরে আসে। তবে বেশি নয়, তাহলে তো কেউ দেখতেই পাবে না।

লকডাউনের শুরুতে বেশ খানিক মজাই লাগছিল। বাড়িতে বসে থাকবে। মেয়েরও ইস্কুল নেই। যেদিন ইচ্ছে হবে সুরমাকে বলবে, ‘ছাড়ো, আমিই রান্না করব।’ তখন তো আর জানত না, কতদিন। আসলে বোঝেইনি, ব্যাপারটা কী। ভেবেছিল, এই কয়েকদিনের ছুটি, যত পারি মজা করে নিই। মাস পড়লে তো ব্রজেনদা টাকাও ধরিয়ে দিয়েছিল হাতে। এখনও মনে আছে, সেদিন দাদা বলেছিল, “শুন রাজু, অনেক লস খেলাম এই মাসে, পরের মাসে তুলে দিতে হবে,” শিবেনকে বলেনি ঠিকই, তবে ও নিজেও বুঝেছিল। সত্যিই তো, মঙ্গলা হাট থেকে যে গাঁটরিগুলো এসেছে ওগুলো তো খোলাই হলো না। শিবেন বুঝেছিল দাদার ব্যথা, তার উপর সামনে চৈত্র সেল। নাইটি-সায়া-ব্লাউজের বিক্রি এ সময় বাড়ে।

এ শহরে শ্রীগুরু বস্ত্রালয়ের নাম আছে। এ শহরের পুরনো দোকান। বাপদাদার আমল থেকে চলছে। নামটা আদ্যিকালের হলেও রীতিমত পাল্লা দিচ্ছে এখনকার চকলেট নামওয়ালা বুটিকদের সাথে। পুরানো মালিক মরে যাওয়ার পর ছেলে ব্রজেনদা দায়িত্ব নিয়েছে। ভেতরটায় এসি লাগিয়েছে। এখন দোকানে কাস্টমার এলে বসে থাকতে চায়, ওঠেই না। আর শিবেনদেরও দেখাতে সুবিধে হয়— ‘কাতানটা পছন্দ হচ্ছে না, আচ্ছা এই সিল্কটা দেখুন!’ ‘বৌদি, এই জামদানিটা আপনার জন্যেই’ ‘এই নীল রংটা আপনাকে খুব মানাবে’। দূরে কাউন্টারে বসে থাকা ব্রজেনদার চোখে প্রশংসার ছাপ দেখত। সঙ্গে আরও কত টিপস শিখে নিয়েছিল, ‘দিদি, এই দামটা বাইরে গিয়ে বলবেন না প্লিজ, এটা শুধু আপনাকেই…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

ইদের ঠিক আগে যখন দোকানে আবার ঝাড়-ঝাঁটা পড়ল, আবার গণেশের মুখের সামনে উঠে এল ধূপকাঠি, তখনই আভাস পেয়েছিল ওরা। এ মাসের বেতন আগেই বেশ কিছুটা কমিয়েছে ব্রজেনদা। সবারই। শিবেনের আট হাজার কমে ছয় হয়েছে। কিছু বলার নেই, দোকান বন্ধ ছিল। হেবি লস। কিন্তু তা বলে দোকানে এসিটাও চলবে না? ইসস, ওই ঠান্ডা বাতাস! কতদিন খায়নি। শিবেন তো দূরের কথা, দাদার বাড়িতে বাজার করে দেওয়া রাজুও ভাবেনি। আর শালা কাস্টমারগুলোও তেমন ঢ্যামনা। একে তো এইমুখো হলই না, তাও যারা এল কেউ বলল না এসি চালানোর কথা!

দুপুরে তো ভিড় হয় সস্তার শাড়ির, কিন্তু গ্রাম থেকে তো কেউ আসতেই পারছে না, গাড়ি নেই। তাই দোকান খুলেও ওদের শুধু বসেই থাকা। আর শিবেন দেখেছিল ওরা নিজেরাও সবাই সিল্ক, বালুচরির আলোচনা ছেড়ে মেতে উঠেছিল অন্য কথায়, ‘আরে ওই রায়পাড়ার অর্জুন রে, চিনিস না? ওর তো হয়েছে! পরশুও দেখলাম পাড়ায় ঘুরছে, আর আজকে ভোরে হসপিটাল থেকে এসে নিয়ে গেল।’ দাদা বেশিরভাগ সময়ে দোকানে থাকতই না, ওদের হাতেই ছিল বেচাকেনা। আর ব্যবসার আলোচনা ছেড়ে সবাই বলছে, কত সুরক্ষা নিয়েছে সবাই। মানুষ কখন যেন নিজে সুরক্ষাসচেতন হয়ে যায়। নইলে এন্তাজ যে বলল, ‘আবে পোটেকশন কী বচ্চন কম লিয়েছিল? অরও তো হল!’ মিথ্যে বলবে না, শিবেন নিজেও সেদিন চমকে উঠেছিল— বচ্চন, মানে ওর ছোটবেলার গুরু! ওরও করোনা হয়েছে?” শাড়ির গাঁটরি খুলতে খুলতে শিবেন একবার জহরা মাকে ডেকেছিল সেদিন, ‘গুরুকে সারিয়ে দাও মা!’

সুরমা তো কবে থেকেই চুপ, মেয়েটাও আবদার করা ছেড়ে দিয়েছে। আর বাড়ি থেকে বাজার যাওয়ার পথে ওই যে নেড়িটা ওকে দেখেই লেজ নাড়াত, শিবেন বিস্কুট ছুঁড়ে দিত— এখন রোজ দেখা হয় না। দেখলেও লেজ নাড়িয়ে একবার জানান দেয় শুধু। দৌড়ে এসে হ্যাংলামো করে না। কীভাবে যেন সবাই বুঝে গেছে, শিবেনের রোজগার কমেছে। রেশনের চাল আবার কবে দেবে তার খোঁজ নিচ্ছে এখন নিয়মিত। দোকানের টাইম কমে গেছে, রোজ না গেলেও চলে। তবু শিবেন যায়, শুধু শিবেন কেন, সবাই যায়। কেউ কামাই করে না। আসলে ওর মতোই বোধহয় বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল সবার। ‘কাজে যাওয়ার’ বাহানা খোঁজে।

দাদা নিজে দোকানে প্রায় আসেই না। ওদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছে। ঠিকই তো, এলে তো শুধু মন খারাপ ছাড়া আর কিছু নেই। খদ্দের নেই, বিক্রি নেই। মানুষজন রাস্তাতেই বেরোয় না তো শাড়ি কিনবে! যাও টুকটাক হয়, সেটার জন্য আবার প্রচুর দরদাম। ইদের বাজার এমন মার খেল!

অবশ্য এর মাঝেই বাড়ছে অসুখ। এখন আর দূরে নয়, নিজের পাড়াতেও দেখা যাচ্ছে করোনা। কেউ হসপিটাল যায়, কারও বাড়িতে লাল দাগ পড়ে। এতদিনে শিবেন বুঝে গেছে, এ অসুখ বড়লোকেদের। ওরা টেস্ট করায়, অসুখ ধরা পড়ে। আর শিবেনরা টেস্ট করায় না, অসুখ আসে চলে যায়। কলোনির সুফলের বাপের মতো কেউ কেউ মারা যায়। তা মরেই তো, ওদের তো মরার অভ্যেস আছেই। শুধু মেয়েটাকে বলেছে শিবেন, মুখ ঢেকে রাখবি, বাইরে বেরোবি না— মানে যা যা টিভিতে বলে আর কী!

“মগের মুলুক নাকি? যা ইচ্ছা তাই করবে? হামাদের গতর খাটার দাম নাই?”— পাশের দোকান ‘প্রভা স্টাইল’-এ কাজ করে ইমরান। ছেলেছোকরাদের গেঞ্জি-জিন্স এসব বেচে ওরা। ওদের দোকানেরও একই অবস্থা। ড্রেসগুলো চকচকে দেখানোর জন্য বড় আলো জ্বালিয়ে রাখে, কিন্তু তাতেও অন্ধকার কাটে না। মালিক এ মাসে ইমরানকে তিন হাজার হাতে ধরিয়েছে। ফুঁসছে ইমরান। দলে টানতে চাইছে শিবেন, রাজু, এন্তাজ— সবাইকে। কিন্তু এতগুলো গলা মিলেও স্বর ফুটছে না। এন্তাজ বলে উঠলো, “নসিব নসিব…”। –ক্যানে, নসিব ক্যানে? ইউনিয়ন নাই? হামি যেছি ইউনিয়নে। মালিকের বিক্রি নাই তো কী হামাদের দোষ? মালিক হামাদের পেট্যে লাথ্যি মারব্যে ক্যানে?

শিবেন যায়নি ইমরানের সাথে। তবে কেউ কেউ গেছিল। কী হয়েছিল জানে না। তবে পরদিন আবার ইমরানই দোকান খুলেছিল দেখেছে। পরে এন্তাজ বলেছে, ইউনিয়নের নেতা অমরদার গলাটা নাকি মালিকের মতো হয়ে গেছে, ‘বিক্রিবাটা নেই, কী করবে মালিক বল! ওরা বেঁচে থাকলেই তো আমাদের কাজ’— আরও কী কী সব বলেছিল অমরদা। আর ওই যে লেবার অফিস? যেখানে আগে যেতে হত ইউনিয়নের নেতাদের সাথে, ওখানে নাকি এখন কেউ বসে না। অনেকদিন। আগে যে মালিকের কাছে ফোন আসত মাঝে মাঝে অফিস থেকে, জানতে চাইত কতজন কাজ করে, কত বয়স, কত বেতন— এই সব— এখন আর আসে না। ফোন করার লোকটা চলে গেছে, ওই চেয়ারে নতুন কেউ আসেওনি।

তা বলে কী পুজো হবে না? সবই তো চালু হল। একমাস আগেই নাকি মহালয়া এবার। এখন তো গাঁয়ের লোক টাউনেও আসছে। পুজো মানে তো বাজার। শিবেনদের দুটো পয়সা দেখার মুখ। অবশ্য খাটনিও পরে খুব। শিবেন তো এই সময়ে নিজেই মঙ্গলা হাট আর মেটিয়াবুরুজে যে কতবার যায় তার ঠিক নেই। সকালে নেমেই আবার রাতে বাসে উঠতে হয়। পরদিন ভোরবেলা বড়বাজার খোলার আগেই শিবেন হাজির। ওকে চিনে গেছে গদির লোকেরাও। প্রতিবার পুজোর ভিড় সামলাতে দাদা লোক নেয় দুই মাসের জন্য। নইলে এত কাস্টমার সামলানো যায়! বাচ্চা ছেলেগুলোই ঢোকে ডেলি হিসেবে। তারপর পুজো মিটতেই হুশ। এ লাইনে থাকার ইচ্ছে নেই ওদের, ফূর্তি করার কিছু টাকা জমিয়ে নেয় পুজোর সময়। রাজুই সেদিন বলেছিল, ‘এবারে আর ছেলে নিবে না লাগছে।’ শিবেনরা আপত্তি করার কিছু খুঁজে পায়নি। বরং একটু খুশিই হয়েছিল মনে মনে, ওভারটাইম পাওয়া যাবে।

বিশ্বকর্মা পুজো ছিল সেদিন। ভোরবেলা মহালয়া শোনেনি, এত আগে ছিল বলেই বুঝি মানুষ তেমন গা করেনি। – আব্বে, টোটোস্ট্যান্ডের ঠাকুরটা দেখল্যি? বিশ্বকর্মার মুখে মাস্ক লাগিয়েছে!— এন্তাজের কথায় খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে গিয়েই ওরা দেখতে পেল মাস্ক পরে ব্রজেনদা দোকানে ঢুকছে। –দাদা, চা নিয়ে আসি?— এসব তো রাজুরই দায়িত্ব। দাদা এলেই স্যানিটাইজারের বোতলটা বের করতে হয়।

দোকানে কোনও কাস্টমার নেই, তবু কী এক অস্বস্তিতে নিজেরা অকারণ শো-কেস সাফাই করতে লাগল সবাই। কেউ কেউ ভাঁজ খুলে নতুন করে ভাঁজ করছে শাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ কাঁচের ওপারে ক্যাশ কাউন্টারে বসেছিল দাদা। লেখাজোকা করছেন। শিবেনকে যখন ডেকে পাঠালেন তখন ওদের বাড়ি থেকে আনা টিফিন কৌটো খোলার সময়। তবু অমান্য করা যায় না— যাই দাদা!

আজকে আর মনে নেই, সেদিন ঠিক কী কী বলেছিল দাদা। শুধু মাসের টাকার পুরোটাই দিয়েছিল মনে আছে। ওর মধ্যে একটা দু হাজারের নোটও ছিল। যে নোটটা বেশ কয়েকদিন পরে দিয়েছিল মাস্কের পাইকারকে। ব্রজেনদাই বলেছিল এই দোকানের সামনে ফুটপাথে বসিস, ‘কিন্তু দেখিস বাবা কাস্টমার যেন কমপ্লেন না করে!’ সেজন্যেই গুটিয়ে থাকে শিবেন। নানান প্রিন্টের মাস্কগুলি ঠেলায় নিয়ে এগোতে থাকে।

এই নতুন পসরার স্বার্থেই নিজেকেও মুখে সেঁটে রাখতে হয় মাস্ক। তাতে অবশ্য সুবিধেও আছে, চিনতে পারে না চট করে কেউ। খানিক এগিয়ে পিছিয়ে টানতে হয় চোখ, ফাঁকি দিতে হয় পুলিশকে। দিন কয়েক আগেও বলেছিল— এই পাড়টা দেখুন, জমিন… একদম লেটেস্ট। এই রংটা আপনাকে খুব মানাবে দিদি। শব্দগুলো আর খুঁজে পায় না শিবেন। নতুন শাড়ির গন্ধটাও পায় না। শুনেছিল এই অসুখে নাকি গন্ধ পায় না মানুষ। ঠেলা নিয়ে এগিয়ে যায়, “পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা। এই যে এদিকে। একদম লেটেস্ট প্রিন্ট। এদিকে দেখবেন। এবার পুজোয় নতুন মাস্ক।”

শুধু কোন মাস্কটা কাকে মানাবে সেটা এখনও জানে না শিবেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...