আকাশপ্রদীপ— ফনেস

আকাশপ্রদীপ— ফনেস | স্বপনকুমার ঠাকুর

স্বপনকুমার ঠাকুর

 

হিম হিম কার্তিক। ঘাসের শরীর জুড়ে চকচকে শিশিরের জাল। এখনও রাতের আঁধার কাটেনি। ঘুম জাগানিয়া ভোর। দূর থেকে ভেসে আসে টহলের গান… রাই জাগো রাই জাগো শুক শারি বলে…। খঞ্জনির বিলম্বিত ধ্বনি। ছড়িয়ে পড়ে ভোরের মাঠে-ঘাটে। কী এক অপূর্ব ভাল লাগা! লেগে থাকে সারাটা দিন। আবার সাঁঝ নামতেই ব্যস্ততা। আকাশপ্রদীপ বা ফনেস টাঙানোর ছেলেপুলের আবেগ-উদ্যোগ। তুলসীতলা আলোকিত হয়ে ওঠে মায়ের দেওয়া মাটির ডেলুইয়ে বা মোমবাতির নরম আলোয়। এদিকে উঠোনে পোঁতা হয়েছে একটা ঝাড়ালো বাঁশ। প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট লম্বা। ভিতরে দীপ জ্বেলে বাঁশের ডগায় তোলা হত গোধূলির মায়াবি আকাশে সেই আকাশপ্রদীপ।

অনেকেই বলেন আকাশপ্রদীপ দান আসলে বৈষ্ণব চাতুর্মাস্য ব্রতের এক অন্যতম অঙ্গ। অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণু বা নারায়ণকে আলোক দান করার জন্য আকাশদীপ দেখানো। কোনও কোনও প্রাচীন গ্রন্থে আকাশদীপ উত্তোলন করার সময় একটি মন্ত্রপাঠের উল্লেখ রয়েছে… “আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ”, অর্থাৎ আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে যে বিষ্ণু বিরাজ করছেন তাঁকে উদ্দেশ্য করেই এই দীপ দেওয়া হল। কেউ আবার বলেছেন আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বর্গে যাওয়ার জন্য পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে এই আকাশপ্রদীপ জ্বালানো।

মহালয়া অমাবস্যায় আমাদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মারা প্রেতলোক থেকে মর্ত্যলোকে নেমে আসেন। আবার তাঁরা ফিরে যান নিজেদের গন্তব্য পথে। তাঁদের পথ দেখানোর জন্য এই আকাশপ্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয় সারা কার্তিক মাস জুড়ে। যাওরা বাস্তববাদী তাঁরা বলেন আকাশদীপের মুখ্য উদ্দেশ্য হল ফসল পাকার সময়ে যাতে পোকামাকড়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় তার জন্য বাড়িতে এই আলো টাঙানো। এর ফলে মাঠের পোকামাকড়ের উপদ্রব কমবে। বলাই বাহুল্য এটা অবাস্তব কষ্টকল্পনামাত্র।

গ্রামাঞ্চলে আকাশপ্রদীপকে ফানুস বা ফনেস বলে। পণ্ডিতদের মতে ফনেস শব্দটির আদি উৎস গ্রিক শব্দভান্ডার। এর অর্থ মোমবাতি। মিশর দেশে ফানুস নামক বাতি জ্বেলে অভিবাদন করার প্রথা ছিল।তারও আগে ফারাওরা সাইরিয়াস নামে নক্ষত্রের উদয়কালে যে উৎসব পালন করতেন সেই উৎসবে যে মশাল ব্যবহৃত হত সেখান থেকেই নাকি ফানুস বা ফনেসের উদ্ভব হয়েছে। শুধু হিন্দু ধর্মে নয়; বৌদ্ধধর্মে ফানুস ওড়ানো বা আকাশদীপ দেখানো এক জনপ্রিয় উৎসব। গৌতম সিদ্ধার্থ আষাঢ় পুর্ণিমা তিথিতে সংসার পরিত্যাগ করেছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ছন্দক। তাঁরা অনোমো নদীর তীরে পৌঁছালেন। এখানেই রাজ-আভরণ খুলে ফেললেন। সিদ্ধার্থ তলোয়ার দিয়ে নিজের চুল কাটলেন। তারপর সেই কেশ আকাশে করলেন নিক্ষেপ। স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র সেই চুলগুলি সংগ্রহ করে একটি সোনার ঝুড়িতে ঢেকে রাখলেন। এই সংরক্ষিত চুলের স্মরণেই বৌদ্ধরা ফানুস বা আকাশপ্রদীপ দেখান।

আকাশপ্রদীপ বানাতে চাই বাঁশের কাবারি, সরু তার বা সুতো। পাতলা ফানুসের রঙিন কাগজ, আঠা, সুতলি দড়ি, একটা লোহার এস, আর খাড়াই বাঁশ। প্রথমে বাঁশ ফাটিয়ে দেড় ফুট মাপের চারটে সরু গোলাকার দণ্ড কেটে বার করতে হবে। বাকি ছয় ও আট ইঞ্চি মাপের সরু কাঠি বার করতে হবে বত্রিশটি। এরপর সেগুলি নির্দিষ্ট প্রণালী অনুসারে বেঁধে রঙিন কাগজ দিয়ে মুড়ে দিতে হবে আঠা দিয়ে। আকাশপ্রদীপ ঝোলানোর জন্য মাথায় দড়ির সঙ্গে একটা লোহার এসের সাহায্য চাই। ভিতরে থাকে বাতি বা প্রদীপ দেওয়ার স্ট্যান্ড। ফনেস তোলার সময় লক্ষ রাখতে হয় যাতে কাত না হয় কিংবা জোরে যেন বাতাস না বয়। তাহলে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। আগে স্থানীয় মালাকাররা ফনেস বানাতেন। এখন ফনেস টাঙানো প্রায় অবলুপ্তির পথে। এখন আকাশদীপের পরিবর্তে নানা ধরনের বৈদ্যুতিক আলোকমালায় বাড়ি সাজানো হয় কার্তিকমাস জুড়ে।

গ্রামবাংলায় আকাশপ্রদীপ নিভু নিভু হলেও বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশে আজও উজ্জ্বল। নিশ্চয় মনে পড়বে লতা মঙ্গেশকরের সেই বিখ্যাত গান… আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে, আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহে/ব্যথার বাদলে যায় ছেয়ে। কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অসামান্য গান… ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না…। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার ‘কতদিন সন্ধ্যার আকাশে’ কবিতায় ভোলা যায় না হেমন্তের পল্লিবাংলার সেই অনবদ্য ছবি যেখানে স্থান পেয়েছে ওই আকাশপ্রদীপ…

কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দুজনে;
আকাশপ্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস

সাজায়েছে,—

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...