Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সংসার সুখের হয় মুনাফার গুণে

মধুময় পাল

 

সকাল থেকে দুপুর, এমনকি সন্ধে-পেরোনো রাতে যিনি আমাকে দারুণ চেনেন, আমার বাড়ির সদস্যদের চেনেন,  আমাদের পরিবারের কিছু কিছু খবরও রাখেন— যেমন আমার ভাই কোথায় চাকরি করে এবং কোন ট্রেন ধরে, যেমন আমার ভাইপো কোন কলেজে পড়ে এবং কাদের সঙ্গে মেশে, যেমন আমার মা কোন হাসপাতালে কতদিন ছিলেন এবং এখন কেমন আছেন— সেই তিনি আমাকে চিনতে পারেন না। চিনতেই পারেন না। হঠাৎ বা একদিন দুদিনের ব্যাপার নয়, প্রায় রোজ। একজন দুজন নয়, বহুজন, আমাকে, আমাকেই বলছি, কারণ এটা আমার অভিজ্ঞতা, অচেনা করে দেন। রাত দশটা কি সাড়ে দশটা গড়ালে এই চিনতে না পারার সময় আসে। এটা তাদের কাছে কামানোর সময়, দাঁও মারার সময়, মুনাফার সময়। শ্রমজীবী মানুষও মুনাফার অঙ্ক বেশ ভালো বোঝে। মানবিক সম্পর্ক ইত্যাদি যেসব কথা ভাষার নিপুণ বুননে ও তত্ত্বের প্রচ্ছদে আমরা বলে থাকি, সেসব মৃত মুদ্রিত অক্ষর হয়ে যায়। বলে রাখা দরকার, এটা আমার অভিজ্ঞতা, বহু বছরের। কেউ বলতে পারেন, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা। বিতর্কে যাব না।

এমন একটা জায়গায় চাকরি করতাম, ফিরতে রাত হত, কোনওদিন এগারোটা, কোনওদিন বারোটা বা সাড়ে বারোটা। সাইকেল চালাতে জানি না। টোটো তখনও আসেনি। অটো ছিল, কিন্ত ওরা বড় রাস্তায় নামিয়ে দেয়, বাই-লেনে ঢোকে না। অগত্যা সাইকেল রিকশাই ভরসা। অত রাতে মেরে-কেটে পাঁচ-সাতজন রিকশাচালক থাকতেন। প্ল্যাটফর্ম থেকে দ্রুত পায়ে ওঁদের কাছে পৌঁছতে চাইতাম। কারণ দেরি হলে একজনকেও হয়তো পাবই না। কলোনি-প্রধান এলাকা। কিন্তু কলোনির সেই চেহারা হারিয়ে গিয়েছে। উদ্বাস্তুরা হয়তো আর কয়েক বছরের মধ্যে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। হিন্দি বলয় থেকে রোজ ঢুকছে গাদা গাদা। এই অনুপ্রবেশ জনবিন্যাস পালটে দিচ্ছে, অর্থনীতির এতদিনকার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বাজার চড়িয়ে দিচ্ছে। ওদের দেওয়া বাড়তি দাম গুণতে হয় আমাদেরও। নিম্নআয়ের মানুষের হাতের বাইরে চলে যায় বাজার। দূর গ্রাম থেকে ঝাঁকা নিয়ে আসা গরিব বিক্রেতা এখন আর গরিব ক্রেতা পছন্দ করেন না। তিনি খাতির করেন ধনী ক্রেতাকে। উচ্চ আয়ের সরস খদ্দেরকে। জীবন সুখের হয় মুনাফার গুণে। তাই দৌড়ে আসতাম রিকশা ধরতে, যেন একজনকে অন্তত পাই, যেন চেনা সহৃদয় হয়, যেন এত রাতে হেঁটে ফিরতে না হয়। ওঁরা গম্ভীর মুখে বসে থাকতেন। মনে মনে হয়তো ভাবতেন, সারাদিন তোমাদের ডেকেছি, এবার তোমরা আমাদের ডাকো। ওঁরা সবাই যে মদে না নেশায় থাকতেন, তা নয়। সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম৷ যাবেন কিনা জিজ্ঞেস করতাম। ওঁরা কেউ বলতেন, কোথায় যাবেন? জায়গা বলতাম। কেউ ফট করে বলে দিতেন, যাব না। অর্থাৎ খদ্দের হিসেবে আমি পছন্দ নই। কেউ বলতেন, কত নম্বর পল্লী? বলতাম। ভেতরে? ওদিকে তো অনেক কুকুর। কেউ উল্টোদিকের রাস্তার নাম বলতেন। মোট কথা, ওঁরা কেউ আমাকে চেনেন না? আজই প্রথম দেখছেন। কেউ জানতে চাইলেন, লাইব্রেরি রোড দিয়ে ঢুকব কিনা। ইনিই আজ দুপুরে আমাকে গল্প করতে করতে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছেন৷ দেশের নেতারা কী খারাপ সে-কথাও বলেছেন। আজকালকার ছেলেরা মা-বাপকে দেখে না বলে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। এই যে না-চেনা বা চিনতে অস্বীকার করা, এটা প্রত্যাখ্যান। ন্যায্য ভাড়াকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান৷ জীবন সুখের হয় মুনাফার গুণে। মানছি, বাড়তি ভাড়া স্বচ্ছলতা দেয়। অত রাতে বসে থাকা কয়েকটা বেশি টাকার জন্য। না, ঘটনা সেরকম নয়। ভাড়া দু-আড়াইগুণ বেশি হয়ে গেলে সেটা যে যাত্রীর সাধ্যের বাইরে চলে যায়। সেটা কি ভাবব না? মধ্যরাতে সমস্যায়-পড়া মানুষকে চাপ দিয়ে বেশি টাকা আদায় করা হবে? বলতে সঙ্কোচ নেই, বহুদিন প্রায় মধ্যরাতের মফস্বলে একা একা হেঁটে ফিরেছি অত্যধিক বাড়তির চাপ মানতে না পেরে।

রিকশাচালকরা গরিব। একটু আধটু সুবিধে নিতেই পারে। তেমন করে বলবার কিছু নেই। জনপ্রিয় রাজনীতির উচ্চকণ্ঠ যুক্তিতে রিকশাচালকদের এই আচরণ সমর্থন করা হয়ে থাকে। একই যুক্তি অটোচালকদের ক্ষেত্রেও। তাঁরা রুট ভাঙেন, আইন ভাঙেন, যাত্রীদের মানুষ ভাবেন না, প্রতিবাদের জায়গা নেই। মানুষকে অসুবিধেয় ফেলে তাঁরা রোজগার বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেন। সমস্যায় পড়া মানুষ, অসুবিধেয় পড়া মানুষ তাঁদের বাড়তি রোজগারের মৃগয়াক্ষেত্র। মানবতা বলে কিছু কাজ করে না। একটা মন্ত্রেই এঁরা উদ্দীপিত— মুনাফা। যাদবপুর থানার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছি, রাত সাড়ে দশটার পর সব অটো বাঘাযতীন পর্যন্ত। ওদিকে যাবে না। কারণ? যাবে না। ওটা তো রুট। নেমে যান। বিলা করবেন না। যেতে পারে, এক্সট্রা দিতে হবে। অটোচালক গরিব। আমিও কাছাকাছি। মুনাফা আমার ঘাড় ভেঙে। আইন ভেঙে।

মানুষের দুর্দশা, মানুষের বিপর্যয় মুনাফাখোরদের কত আদরের জায়গা হতে পারে, সে আদর লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ পঞ্চাশের মন্বন্তর। পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ না-খেয়ে পথে পথে মারা গেল। শিশুবৃদ্ধপুরুষনারীহিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে গরিব মানুষ। মৃত্যু পিছু হাজার টাকা মুনাফা লুটল জোতদার আড়তদার ব্যবসায়ীরা। বাংলা লেখালেখি পঁয়ত্রিশ লক্ষ বাঙালির মর্মন্তুদ মৃত্যু বিষয়ে একরকম নীরবই থাকল। ভুলিয়ে দেবার ছলে? ভবিষ্যতে অস্বীকারের দরজা খোলা রাখার গোপন অভিপ্রায়ে? এদেশে অস্বীকারের পাটোয়ারি ব্যবস্থা কায়েম আছে দীর্ঘকাল। হালের কথা বলা যেতে পারে। এভাবে ও ভাষায় অস্বীকার করা হচ্ছে, সত্তর দশকে কোনও সন্ত্রাস হয়নি। কিছু ভুলভাল মানুষের অপপ্রচার। মরিচঝাঁপিতে কিচ্ছুটি হয়নি। কংগ্রেস কংশাল আর এক শ্রেণির মিডিয়ার অপপ্রচার। গোধরায় কিছু হয়নি তো! হাবিজাবি লোকজন রটাচ্ছে। লম্বা তালিকা দেওয়া যায়। যা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। এরকম বক্তব্য হয়তো একদিন পেশ করা হতে পারে, পঞ্চাশের মন্বন্তরে তেমন কিছু হয়নি। চার্চিল তো বলেই দিয়েছেন, ওরা খরগোশের মতো জন্মায় আর মরে। এরপর আর কথা চলে? ফিরে আসি মূল কথায়। মানুষের সমস্যা, মানুষের দুর্দশা কাজে লাগিয়ে মুনাফা করা। গরিব গরিবের মতো করে, ধনীরা তাদের কায়দায়। একটা অন্যরকম ছবি দেখেছিলাম আটাত্তরের বন্যায়। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। সাধ্যমতো দীর্ঘস্থায়ী ত্রাণে ঝাঁপিয়েছিল। অবশ্য সেদিনের বাংলা পার্টি-শাসিত বিজ্ঞাপন-চালিত লুম্পেন-নিয়ন্ত্রিত ছিল না। ছিল না এতটা স্বার্থপর, ভোগবাদী। মানুষের গুণগুলো মানুষের মধ্যে ছিল।

এসব কথা মনে এল সাম্প্রতিক ঘটনা ফণী তাণ্ডব নিয়ে মিডিয়ার গলা-ফোলানো চিল্লানি দেখে ও শুনে। ফণী একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এই ঝড়ের শক্তি, গতিবেগ, গতিপথ ইত্যাদি বলছেন সম্ভাব্যতার প্রেক্ষিতে। বিজ্ঞানীরা এভাবেই বলবেন। মিডিয়া, বিশেষ করে কয়েকটি বাংলা মিডিয়া, চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সেটাই অবশ্যম্ভাবী করে তুলল। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কের মাত্রা বাড়াতে লাগল। বোকা বোকা প্রশ্ন নিয়ে দিকে দিকে পাঠাল সাংবাদিক নামধারী বেতনভোগী কর্মচারীদের। আপনারা কি ভয় পাচ্ছেন? খুব ভয় পাচ্ছেন? আপনাদের বেড়াতে আসা পণ্ড হয়ে গেল? নিশ্চয় বাড়ির কথা মনে হচ্ছে? আপনারা কি মনে করছেন নদী ঘরে ঘরে ঢুকে যেতে পারে? চটকদার শিরোনামে ফণী-প্যাকেজ তৈরি হল। পাঁচ মিনিটের ফণী-চিল্লানি আর দশ মিনিটের বিজ্ঞাপন বিরতি। বিজ্ঞাপনে আছড়ে পড়তে থাকল রড আর সিমেন্ট কোম্পানির অলীক প্রতিশ্রুতি। ভূমিকম্পেও অটুট দাঁড়িয়ে থাকার বরাভয়! সব কিছুতেই বেওসা হয়। ফণীতেও মুনাফা হয়। বেওসা সুখের হয় মুনাফার গুণে।

ফণীর আগের রাতে বন্ধুর ফোন এল সন্তোষপুর থেকে: আমাদের এলাকায় কোনও দোকানে মোম, পাউরুটি, ডিম নেই। সব উধাও। এক পরিচিত দোকানি বলেছেন, ভয়ে সবাই বেশি বেশি করে কিনে রেখেছে। আর-এক দোকানি বলেছেন, আপনি আমার বরাবরের কাস্টমার। এই অসময়ে আপনাকে দেখা আমাদের কর্তব্য। একটু বেশি দাম পড়বে কিন্তু। আমাকেও বেশি দামে কিনতে হল। তাছাড়া, জানেনই তো, চাঁদার জুলুম যেভাবে বাড়ছে। এই দোকানি ভদ্রলোক কথা বলেন ভালো। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে ও দেশপ্রিয় পার্কে কোটি টাকার পুজোর সপক্ষে বলতে পারেন। সন্তোষপুরের বন্ধু আরও কিছু বলেছিলেন।

ভাবি, আমরা সবাই মুনাফার হাতে অসহায় বন্দি এখন।