Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইস্টার্ন ফ্রন্টে যখন কিছুই নিস্তব্ধ নয়

দেবব্রত শ্যামরায়

 

আমার বাবার এক প্রচ্ছন্ন গর্বের জায়গা— তিনি আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে দিল্লিতে গোরক্ষা আন্দোলনে তরুণ লালকৃষ্ণ আদবানির পাশে হেঁটেছিলেন। বাবা, ওপার বাংলা থেকে তাড়া খাওয়া উদ্বাস্তু পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান, ব্যারাকপুরে সদরবাজারে থাকাকালীন নিয়মিত শাখায় যেতেন, শরীরচর্চা করতেন, নানা কর্মসূচিতে যোগ দিতেন। হিন্দুদের সবল শক্তিশালী ও সংগঠিত হওয়ার তত্ত্ব নিশ্চয়ই তাঁর মনে ধরেছিল। অনেক পরে, আমার ছোটবেলায় দেখেছি, বাবার সঙ্গে দেখা করতে নৃপেনজেঠু আসতেন, প্রতি মাসে অথবা এক-দু মাস অন্তর। চা খেতে খেতে নানা বিষয়ে এটা ওটা আলোচনা হত, বাবা কী যেন একটা চাঁদা দিতেন। আমি তখনও আরএসএস নামটা শুনিনি। বা তখন শুনলেও তা মনে থাকার কথা নয়।

তা হঠাৎ এই নিতান্ত ব্যক্তিগত ও প্রাচীন প্রসঙ্গের অবতারণা কেন? না, অন্য কিছু নয়, ২০১৯-এ এসে কেন্দ্রের দক্ষিণপন্থী শাসকদলটি বাংলার মাটিকে যে আর দুর্জয় ঘাঁটি বলে মেনে নিচ্ছে না, বরং লাস্ট ফ্রন্টিয়ার ভেবে নিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনের ময়দানে নেমেছে, এই ঘটনা বা দুর্ঘটনার শেকড় খোঁজার চেষ্টা করছিলাম মাত্র।

সত্যি, ভারত প্রজাতন্ত্রের সত্তর বছরের ইতিহাসে অন্য কোনও সাধারণ নির্বাচনেই পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের মনোযোগ ও বিতর্কের কেন্দ্রে এভাবে থাকেনি, এইবার যেমনটি রইল। অন্য রাজ্যের বিরোধী রাজনীতিকদের ভেতর রাজ ঠাকরেও এবার যথেষ্ট বেগ দিচ্ছেন বিজেপিকে। কিন্তু ২০১৯-র সাধারণ নির্বাচনে মোদি বনাম মমতার লড়াই নজিরবিহীন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও একটি অঙ্গরাজ্যের প্রধানের মধ্যে বাচিক দ্বৈরথের তীব্রতা আগে কখনও এমন বিষাক্ত মাত্রায় পৌঁছয়নি। সে ভাষায় যুক্তির শাসন কম, তারল্য বেশি, জরুরি নির্বাচনী ইস্যুর জায়গা নিয়েছে পরস্পরের ব্যক্তি আক্রমণ। মোদির অস্ত্র সস্তা রেটরিক তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাচনভঙ্গি চূড়ান্ত অসংসদীয়। রাজ্যের নানা জায়গায় হাতাহাতি-মারামারিতে রক্তাক্ত হয়েছেন দুই দলের সাধারণ কর্মীরা। অভিযোগ, বিজেপির গুণ্ডাবাহিনীর হাতে মুণ্ডচ্ছেদ হয়েছে স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। সব মিলিয়ে, এবারের নির্বাচনে গোটা দেশের নজর এই পুবের রাজ্যটিতে।

বাংলা হঠাৎ এত জরুরি হয়ে পড়ল কেন বিজেপির কাছে? স্বাধীনতার সময় থেকে ২০১৯-এর আগে অবধি অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারের জন্য এতবার করে বাংলায় এসেছেন কি? কী এমন রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা, যার জন্য বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী বা দলের সর্বভারতীয় সভাপতিকে দিল্লি থেকে উড়ে এলেন প্রতি সপ্তাহে দুদিন কি তিনদিন, উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ চষে বেড়ালেন, মোদি একাধিকবার একইদিনে তিন-তিনটি সভা করলেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলায়? একটু খতিয়ে দেখা যাক।

লোকসভার আসনের বিচারে বাংলা দেশের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য (৪২টি আসন)। প্রথম উত্তরপ্রদেশ (৮০টি আসন) এবং দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র (৪৮টি আসন)। এবার উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির মধ্যে আসন সমঝোতার পর বিজেপির গতবারের রেকর্ড জয় (২০১৪-এ ৮০-র মধ্যে ৭১টাই পেয়েছিল বিজেপি) পুনরাবৃত্তির আর কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোট অটুট আছে বটে, তবে নাসিক-বিদর্ভ থেকে শহর মুম্বইয়ের ওপর ধেয়ে আসা একের পর এক কৃষক অসন্তোষের ঢেউ গ্রামীণ ভোটভিত্তি নিয়ে কিছুটা হলেও সন্দিহান করে তুলেছে তাঁদের। প্রধানত এই দুই রাজ্যের আসন সংখ্যার আংশিক খামতিপূরণে বাংলাকে ‘পাখির চোখ’ করেছে বিজেপি। মূলত তিনটি কারণে বিজেপির মনে হয়েছে এবার পশ্চিমবঙ্গে ভালো ফল করা যেতে পারে৷

এক— পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হিন্দু জনসংখ্যার প্রাচুর্য। এই জনগোষ্ঠী সর্বকালে বিজেপির টার্গেট ভোটব্যাঙ্ক কারণ  এরাই বিজেপির ঘৃণা-রাজনীতির প্রথম সহজ শিকার। এই বক্তব্যে অবশ্য একটা সরলীকরণের ফাঁদ আছে। কারণ একথাও ভুললে চলবে না যে ওপার বাংলা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ উদ্বাস্তু একসময় পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক ও তাদের উত্থানের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিলেন (এপার বাংলায় এখনও এমন ডজনখানেক উদ্বাস্তু কলোনি খুঁজে পাওয়া যাবে, যার নাম লেনিনগড়)। একটা সময় ছিল, গোবলয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তির রমরমা শুরু হয়ে গেলেও, বাম জমানায় সরকারের অসাম্প্রদায়িক নীতির কারণে তা পশ্চিমবঙ্গে বিন্দুমাত্র দাঁত ফোটাতে পারেনি। অবশ্য দেশ হারানোর ক্ষত ও মুসলিমবিদ্বেষ হিন্দু বাঙালির মনের একটা স্তরে যে রয়েই গেছিল, তার প্রমাণ আমার পিতৃদেব, নৃপেনজেঠুর মতো মানুষেরা। আজ ‘অনুকূল’ পরিবেশে সেই অসূয়া আড়াল ভেঙে সামনে চলে এসেছে।

দুই— তৃণমূলের অপশাসন। মাত্র আট বছর আগে শাসনক্ষমতায় এসে সারদা-নারদার মতো মোটা অঙ্কের দুর্নীতিতে ফেঁসে ইতিমধ্যেই ‘সততার প্রতীক’ হিসেবে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক থেকে শুরু করে একের পর এক ছোটবড়মাঝারি নেতানেত্রীরা অন-ক্যামেরা ঘুষ নিচ্ছেন, এ দৃশ্য বঙ্গবাসীর শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন ম্যাথিউ স্যামুয়েল। গ্রামেগঞ্জে পরিকাঠামোগত উন্নতি, কিছু যথার্থ কল্যাণমূলক প্রকল্প যেমন কন্যাশ্রী, কৃষকবান্ধব নীতি, সস্তায় রেশন ইত্যাদির বাস্তবায়ন সত্ত্বেও বাংলার গ্রামেগঞ্জে মফস্বলে কায়েম হয়েছে একধরনের তোলাবাজি লেঠেল সংস্কৃতি, শহরাঞ্চলে যা নাম বদলে সিন্ডিকেটরাজ৷ পাশাপাশি, তৃণমূলের খোলাখুলি সংখ্যালঘু তোষণের দেখনদারি রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের একসময়ের অসাম্প্রদায়িক পরিসরের ক্ষতি করেছে। ইমামভাতা, মুসলিমদের জন্য পৃথক বাজার, হাসপাতাল, ব্লাডব্যাঙ্কের ঘোষণা আদতে পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের বিন্দুমাত্র সুবিধে তো করেইনি, বরং মুসলিম শিক্ষিত যুবসমাজের বিরক্তি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি এইসব পদক্ষেপ বিজেপির হাতে প্রোপাগান্ডার অস্ত্র তুলে দিয়েছে, যার সাহায্য উপরে উল্লিখিত হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে কাছে টানতে পেরেছে বিজেপি। অবশ্য সমালোচনার মুখে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ (যেমন— দুর্গাপূজা কমিটিকে অনুদান প্রদান, বিজেপিকে টক্কর দিয়ে আরও বেশি করে রামনবমীর উদযাপন ইত্যাদি) তাঁকে আরও হাস্যকর করেছে, সেকুলার রাজনীতিক হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে দিতে পারেনি। বলে রাখা দরকার, শুধুমাত্র উদ্বাস্তু হিন্দুদের দিকে আঙুল তোলাটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। দক্ষিণপন্থী রোগটা বর্তমানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সর্বজনীন। আজকাল ট্রেনে-বাসে, সান্ধ্যভ্রমণের দলে, কর্পোরেট পার্টিতে, পাড়ার চায়ের দোকানে, ফেসবুকের পাতায়, সাম্প্রদায়িক হিন্দুমনের উপস্থিতি চোখ-কান খোলা রাখলেই অনুভব করা যায়, যা প্রকারান্তরে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকেই পুষ্ট করে। একসময়ের তথাকথিত সেকুলার, শ্রেণিসচেতন ও বামমনস্ক পশ্চিমবঙ্গকে দেখে চেনা যায় না ইদানিং।

তিন— রাজ্যে বিরোধী-শূন্যতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাজ্যে বিরোধী নেত্রী ছিলেন, প্রশাসনের সামান্যতম বিচ্যুতিকে কাজে লাগিয়ে জনমত চালিত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর৷ বর্তমান বিরোধী দলের সে ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি ও সাংগঠনিক শক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে৷ মেডিকাল কলেজ ছাত্রদের হোস্টেল সমস্যাই হোক বা এসএসসি পদপ্রার্থীদের আন্দোলন কোথাও নিজেদের রাজনৈতিক উপস্থিতি জোরদার করতে পারেনি বামেরা, আন্দোলনকারীদের আস্থা অর্জন করে আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে তুলে নিতে পারেনি। রাজ্যে বিরোধী শূন্যতার সুযোগ নিয়ে জোর বাড়িয়েছে বিজেপি। যেমন, সেপ্টেম্বর ২০১৮-তে বীরভূমে সিপিআইএম-এর জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা প্রশাসনের নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেন। সে মিছিল বন্ধ করার জন্য তৃণমূল ও রাজ্য পুলিশ বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া শুরু করে। চাপের মুখে সিপিআইএম পিছিয়ে আসে। ঠিক এই সময়, বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় এই সুবর্ণসুযোগের সদ্ব্যবহার করে পালটা মিছিল ডাকেন ও চাপ অগ্রাহ্য করে প্রতিবাদ মিছিল করেন। এই মিছিলে বামসমর্থকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অসমর্থিত সূত্রের খবর, এই নির্বাচনে রাজ্যের একটা বড় সংখ্যক বাম কর্মী-সমর্থক বিজেপির সঙ্গে ভিড়ছেন, শুধুমাত্র তৃণমূলের বিরোধিতা করার তাগিদে। এঁদের মধ্যে সিপিআইএম-এর নিচুতলার কর্মী থেকে শুরু করে লোকাল কমিটির ও জোনাল কমিটির নেতারাও আছেন। এই গুঞ্জনে সত্যতা আছে কিনা জানা যাবে তেইশে মের পর, তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলীয় মুখপত্রে বাম কর্মী-সমর্থকদের সতর্ক করেছেন, তৃণমূলের ‘ফ্রাইং প্যান’ থেকে বাঁচতে তাঁরা যেন বিজেপির ‘আগুন’-এ গিয়ে না পড়েন। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, দক্ষিণপন্থী দলগুলির হাইভোল্টেজ প্রার্থীদের ভিড়ে দেশজুড়ে বাম প্রার্থীতালিকার দিকে তাকালেই একটু ভরসা হয় যে এঁদের সংসদে পাঠালে একমাত্র এঁরাই সাধারণ মানুষের অবস্থা ও দেশের বুনিয়াদি সমস্যার কথাগুলো ঠিকঠাক তুলে ধরতে পারবেন। বামেদের হারাবার কিছু নেই, এবং সংসদীয় রাজনীতি একটা দীর্ঘমেয়াদি লড়াই, এই সত্যিটা বামকর্মী-সমর্থকরা দ্রুত বুঝলে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ এবং তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি দেরি হবে বলে মনে হয় না।

এই মুহূর্তে অপর বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থা শোচনীয়। সমর্থনের হিসেবে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই মালদা, উত্তর দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদের মধ্যে সঙ্কুচিত, তারপর মৌসম বেনজির নূর কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় মালদার সমীকরণ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এবারের নির্বাচনে কোনও দাগ কাটা তো দূরস্থান, আগেরবারের দুটো আসন ধরে রাখাটাই কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জ। আর এই দুর্বল বিরোধী নেতৃত্বের সুযোগ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসতে মরিয়া বিজেপি।

ওপরের তিনটি ফ্যাক্টরে ভর করে বিজেপি এ রাজ্যে স্বপ্ন দেখছে। না, শুধু অলস দিবাস্বপ্ন দেখা নয়, বিজেপির তরফে লাগাতার জোরদার প্রচার চলছে, রোড শো-র আয়তন ও জৌলুস বাড়ানোর জন্য বিহার, উত্তরপ্রদেশে, ঝাড়খণ্ড থেকে বিপুল ক্যাডারবাহিনি তুলে এনে শহর কলকাতার রাস্তায় পেশিপ্রদর্শন করা হচ্ছে, অসমের মতো এই বাংলাতেও এনআরসি করবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এসবের ওপরে ভোট সুনিশ্চিত করার জন্য প্রচুর টাকাও পাম্প করা হচ্ছে, চলছে বাইরে থেকে ছেলে ঢুকিয়ে গ্রামীণ ভোটদাতাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি। সংবাদমাধ্যমে দেখছি, শেষ দু’দফা ভোটের আগে বিভিন্ন বিজেপি নেতা, নেতা-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এমনকি বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষের কাছ থেকেও হিসাব বহির্ভূত কোটি কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সর্বোপরি, বিজেপি-র টিমের দ্বাদশতম খেলোয়াড়ের নাম নির্বাচন কমিশন, যার একের পর এক শাসকবান্ধব সিদ্ধান্ত সংস্থাটির নিরপেক্ষতাকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। সবমিলিয়ে বিজেপি আশা করছে, বর্তমানে তৃণমূল ও তার আগে সিপিআইএমকে ‘মেপে নেওয়া’ রাজ্যের মানুষ, রাজ্যস্তরে এখনও বিজেপিকে না দেখা রাজ্যের মানুষ, নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য তৈরি এবং রাজ্যে বিজেপিকে স্বাগত জানাবেন।

এবারের নির্বাচনে তাই পশ্চিমবঙ্গে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ বিজেপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণের লক্ষ্য বানিয়ে এক ঢিকে দুই কাজ হাসিল করতে চায় তারা৷ প্রথমত, নিজেদের ভোট শেয়ার বাড়িয়ে নেওয়া। এর আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে ভাল ফল দলটির জন্মের আগেকার ঘটনা, তা ১৯৫২-এর বিধানসভা নির্বাচন, যেখানে বিজেএস (ভারতীয় জনসংঘ) পেয়েছিল ৯টি আসন এবং হিন্দু মহাসভা পেয়েছিল ৪টি আসন। ৫২ সালেই, দেশের প্রথম লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে জনসংঘের আসন সংখ্যা ২, হিন্দু মহাসভা ১। খেয়াল রাখতে হবে, তখন দেশনির্মাণ সেভাবে শুরুই হয়নি এবং দেশভাগের স্মৃতি ও ক্ষত এপার বাংলার মানুষের মনে তখনও টাটকা। এর পরের ৪৮ বছর, বাংলায় আসনশূন্য ছিল বিজেপি, ১৯৯৮-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের প্রথম আসনটি বিজেপি পায় দমদম লোকসভা থেকে (তপন শিকদার), যা একটি বড়সড় উদ্বাস্তু বেল্ট। ২০১৪-তে বিজেপির ভোটের শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৭%, এবারের নির্বাচনে সম্ভাব্য তৃণমূল ও বাম ভোটে বিপুল ধসের দিকে তাকিয়ে বিজেপি তার ভোটের শতাংশ ও আসন যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। সেটা করতে পারলে ২০২১-এ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি অনেক বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় চলে যাবে। ঠিক একই কারণে এবারের ভোট তৃণমূলের পক্ষেও এক মরণপণ লড়াই। এই নির্বাচনে নিজের ভোটভিত্তি ও আসন ধরে রাখতে না পারলে ২০২১-এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফিরে আসা ঘোরতর অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

দ্বিতীয়ত, বিজেপি জানে এই রাজ্যে তৃণমূলকে সফলভাবে আঘাত করতে পারার অর্থ সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি-বিরোধী জোটকে কমজোরি করে দেওয়া। সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে যে ‘মহাগঠবন্ধন’ তৈরি হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল গান্ধি থেকে শুরু করে চন্দ্রবাবু নাইডু, স্টালিন, কুমারস্বামী, অখিলেশ যাদব, ওমর আবদুল্লা প্রমুখ সকলের মধ্যেই ‘দিদি’-র গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এবং এই নির্বাচনে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির ফল খারাপ হলে, বিরোধী জোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব ও ভূমিকা নির্ণায়ক হতে পারে। এবারের ভোটে তৃণমূলের আসনসংখ্যা যথাসম্ভব কমিয়ে বিজেপি সে সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিতে চায়৷

আগামী বৃহস্পতিবার, ২৩ মে সন্ধেবেলা কাজ থেকে ফিরে, টিভির সামনে আমার পিতৃদেবের পাশে গিয়েই বসব। দুজনে মিলে ভোটের ফল দেখব। উনআশি বছরের বাবাকে এই বয়সে আর হয়তো বোঝানো যাবে না যে মানুষকে আসলে ওইভাবে হিন্দু মুসলমানের ধর্মপরিচয়ে ভেঙে দেওয়া যায় না, মানুষটির আর্থসামাজিক অবস্থানই তার মূল পরিচয়, যেখানে দাঁড়িয়ে অন্য অনেকের মতো সে তাঁর বেঁচে থাকার সহজ বা কঠিন লড়াইটা চালায়। পিতার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কেন্দ্রে রাজ্যে ফ্যাসিস্ট শক্তি, আগামী তেইশ মে উভয়েরই পরাজয় দেখার অপেক্ষায় থাকব।