বইমেলা ২০২৩ — ষষ্ঠ বর্ষ, সপ্তম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

বইমেলা বাঙালির চতুর্দশতম পার্বণ।

ওপরের বাক্যটি আরেকবার ফিরে পড়া যাক। বইমেলা বাঙালির চতুর্দশতম পার্বণ। প্রথমত, এখানে বইমেলা-র আগে ‘কলকাতা’ শব্দটি বসানো উচিত কি উচিত নয়, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল। গত দু-তিন দশক ধরেই কলকাতা বইমেলার পাশাপাশি রাজ্যের নানা জেলা সদরেও বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, এমনকি বেশ কয়েক বছর সদর ছাড়িয়েও বইমেলা ছড়িয়ে পড়েছে ছোটবড় নানা শহর-মফস্বল-আধা শহরে। সেইসব বইমেলা ধারে ও ভারে স্বাভাবিকভাবেই কলকাতা বইমেলার সঙ্গে তুলনীয় নয়, তুলনা করার কথাও নয়, এমনকি এইসব বইমেলায় বই বিক্রির ধাঁচ ও ধরন নিয়ে প্রকাশকদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র, অনেক ক্ষেত্রে হতাশাজনক, তা সত্ত্বেও জেলায় বইমেলাগুলির বিস্তার যে সাধারণভাবে বাঙালির বইপ্রেম ও সংস্কৃতিমনস্কতার দিকে ধাবমানতার একটি ইতিবাচক লক্ষণ, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াই যায়। অতএব শুধুমাত্র কলকাতা বইমেলা নয়, সাধারণভাবে বসন্তের বিকেলে রাজ্যজুড়ে ছোটবড় নানা বইমেলার উপস্থিতি নিঃসন্দেহে আমাদের রাজ্যের একটি সুস্থ বিজ্ঞাপন।

সারা রাজ্যে বইমেলার প্রসার বাঙালি সংস্কৃতির কলকাতা-কেন্দ্রিকতার প্রতি একটি মৃদু বার্তা পাঠায় বটে, কিন্তু এ বাঙালি কোন বাঙালি? প্রতিটি জাতির মতো বাঙালির মধ্যেও যে বিপুল আর্থসামাজিক বিভিন্নতা ও অসাম্য, সেখানে শুধুমাত্র বইকেন্দ্রিক একটি উৎসবের সঙ্গে তো সমস্ত বাঙালির সম্পৃক্ত হওয়ার কথা নয়। অতএব এ বইমেলা শিক্ষিত বাঙালির পার্বণ। এমনি শুধু শিক্ষিত বাঙালি কথাটা বললেও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়, পাশ থেকে উঁকি মারতে চায় মধ্যবিত্ত শব্দটিও। বস্তুত, লোকসংস্কৃতি বাদে আমাদের সমস্ত সাংস্কৃতিক উপযাপনই তো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটিকে ঘিরেই। এর অর্থ এটাও নয় যে বইমেলার সংজ্ঞায়নে ‘শিক্ষিত’ ও ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দের ব্যবহার কোনও উচ্চভ্রূ এলিটিস্ট উচ্চারণ, বরং আমাদের এই বিশেষ শ্রেণির বাইরেও এক বিরাট বাংলা ও বিপুল সংখ্যক বাঙালি আছেন একথাটা সবিনয়ে মনে করিয়ে দেওয়া। ঠিক যেমন শহর কলকাতা গোটা বাংলার ঠিকাদার নয়, কলকাতাকেন্দ্রিক নস্টালজিয়ার উদগার মানেই তা বাঙালিয়ানার সার্বিক প্রতিনিধিত্ব নয়, ঠিক তেমনই বইমেলাও প্রথমত ও প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত বাঙালিদের একাংশের উৎসব। ছোটবেলায় আমাদের দুর্গাপূজা রচনা শুরু হত— দুর্গাপূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব… এই ভুল বাক্যটি দিয়ে। এখানে ‘শিক্ষিত’ ও ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দের উচ্চারণে সেই একই ধরনের ভুল শোধরানো হল মাত্র।

অর্থাৎ বইমেলা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির চতুর্দশতম পার্বণ।

তবে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তো আমাদের দেশের প্রতিটি রাজ্যেই, প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের মধ্যেই বর্তমান, সে সব রাজ্যে তো বইকে ঘিরে প্রায় পক্ষকালব্যাপী এই উন্মাদনা দেখা যায় না। আসলে শিল্প মাত্রেই তা অহৈতুকী, তার চর্চা তাই সংখ্যালঘুর একান্ত যাপন, সর্বকালে সর্বদেশে। সেখানে অন্য সমস্ত জাগতিক সমস্যাকে পাশ সরিয়ে রেখে এক এক বিপুল জনতা মেতে উঠছে কালো অক্ষরের উদযাপনে— এ-ও কি খুব কম কথা? মফস্বলের এক তরুণ বা তরুণী লোকাল ট্রেন বা বাসে করে বহুদূর থেকে এসে বইমেলার ভিড় ও ধুলো পেরিয়ে হাতে তুলে নিচ্ছে এক নবীন কবির বা গল্পকারের প্রথম বই, যে নবীন কবি বা লেখক রাত জেগে লিপিবদ্ধ করেছেন তার নিভৃততম অনুভূতিমালাকে, আর তেমনই চন্দ্রাহত এক প্রকাশক নিজের সঞ্চয় ভেঙে জাগতিক লাভের তোয়াক্কা না করে প্রকাশ করেছেন সেইসব বই— এই পৃথিবীর এমন বিরলতম ঘটনাক্রমের সাক্ষী এই আমাদের বইমেলা। এও কি কম শ্লাঘার বিষয়?

শ্লাঘার পাশাপাশি, চেতনায় ঘা মারে কিছু অপ্রিয়। রাজধানীর বুকে সংস্কৃতিমন্য বাঙালির অস্তিত্বের এই শীলিত উদযাপন, তার প্রভাব ও সম্প্রসারণ সমাজের অন্য স্তরে দেখা যায় না কেন? সমাজ ও রাজনীতির অপরিশীলন, শিক্ষাক্ষেত্রে অশিক্ষা, ক্ষমতাকেন্দ্রগুলিতে চূড়ান্ত দুর্নীতি— সর্বত্র মেধাহীনতার এই যে উৎকট আস্ফালন, তার সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালির সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটির সম্পর্ক একশো আশি ডিগ্রির। অনুভূতির সততা ও প্যাশন বেড়া ভেঙে কেন ছড়িয়ে পড়ে না বাঙালির যাপনের অন্য পরিসরগুলিতে? এই দ্বিখণ্ডনের রহস্য কী?

অপ্রিয় প্রশ্নগুলি আপাতত তোলা থাক। আমরা মেলায় ফিরি। ‘বইমেলা ২০২৩’— এই শিরোনামে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রচ্ছদকাহিনিতে এবার শুধুমাত্র বই ও বইমেলার উদযাপন, যাতে আমাদের সঙ্গে আছেন সহৃদয় লেখক, পাঠক ও প্রকাশকেরা। প্রিয় পাঠক, আসুন, আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হোক করুণাময়ীতে, বনবিতানে বইমেলার মাঠে।

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...