Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাঘাইড়

স্বকৃত নোমান

 

হাইল হাওরের পানি তখন জনপদ গ্রাস করেছে। উঠানে পানি, ঘাটায় পানি, রাস্তায় পানি। উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে যেদিকেই তাকাও পানি আর পানি। জিয়লমাছের মতো নাক উঁচু করে কোনোমতে ভেসে আছে মাইমালদের বাড়িগুলো। হাওরের মোকাম বাইক্কা বিল তখন কচুরিপানার দঙ্গল, মাখনা, সিংরাই, শাপলা আর পদ্মফুলের দখলে। তারই ফাঁকে মাছেদের কিলবিল আর পানকৌড়ি, কানিবক, ধলাবক ও ফড়িংয়ের ওড়াওড়ি।

এমন ভাদ্রের দুপুরে, মেঘ আর সূর্য যখন লুকোচুরি খেলছিল, বাড়ির পেছনে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে পদ্মফুলে বসা একটা ফড়িংয়ের লেজের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল সাজু। সাত ছুঁই ছুঁই বয়স। নেংটো। কোমরের তাগাটিও নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ রাখায় নাকের সিকনি ঠোঁট বেয়ে গালে ঢুকছিল। খানিক দূরে গাইগরুটাকে গোসল করাচ্ছিল সোনাফর আলী। হঠাৎ, গাইয়ের ওলানে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বেটার চিৎকারে চমকে উঠল সোনাফর। ওলানের ফাঁকে সে দেখল, বিশাল সেই বাঘাইড় লাফ মেরে ঢুঁশ মারল সাজুর তলপেটে। চিৎ হয়ে পড়ে গেল সাজু। তার আত্মচিৎকার তলিয়ে গেল জলের অতলে।

ছুটে এসে বেটাকে কোলে তুলে নেয় সোনাফর। তলপেটের ফুটো দিয়ে গলগল করে রক্ত ছুটছে। ফুটোটা চেপে ধরল বিমর্ষ সোনাফর। জলে তুমুল আলোড়ন তুলে সাজুর চিৎকার চাপা দিয়ে এক লাফে ডাঙায় উঠে বসল মাছটা। বিস্মিত সোনাফর হাঁ-মুখে সেদিকে তাকায়। লম্বায় প্রায় তার সমান, দুই চোখের উপর গরুর শিঙের মতো সুচালো দুটি কাঁটা, পেটের দু-পাশে দুটি পাখনা, লেজ আর পিঠের দিকটায় অজগরের মতো কালো ডোরা। সোনাফর চোখ ফেরাতে পারে না। মুগ্ধতায়, বিস্ময়ে। পলক পড়ার আগেই মাছটা আবার লাফ দিল। হাঁটুজল দুই ভাগ করে হিজলগাছটার তলা দিয়ে কচুরিপনার দঙ্গলে তোলপাড় তুলে বাইক্কা বিলের দিকে ছুটে চলল। সোনাফর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, সেই দুরন্ত বাঘাইড়ের পিঠে সওয়ার হয়ে চলে যাচ্ছে তার জীবনের সব সুখ, সব শান্তি, সব আশা।

সেই যে গেল, আর ফিরে এল না, শোকের দখলে চলে গেল তার জীবন। পুত্রশোক সহজে যায় না। দিন নেই রাত নেই, সোনাফরের চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরে, আর ঝরে প্রতিশোধের আগুন। দেড় বছর ধরে সে খুঁজে বেড়াচ্ছে ঘাতক বাঘাইড়টাকে। নৌকাটা নিয়ে সেই ভোরে বেরোয়। দুপুরে কোনোদিন ফেরে, কোনোদিন উপোস থাকে। খিদায় পেট তেতে উঠলে শাপলা-শালুক চিবোয় অথবা নৌকার তোলাচুলোয় দুটো চাল ফুটিয়ে নুন মেখে খেয়ে নেয়। কোনো কোনো দিন রাত আটটা-নটা বেজে গেলেও বাড়ি ফেরার কথা খেয়ালে থাকে না। বহু রাত হাওরেই কাটিয়ে দিয়েছে। সারারাত কুপি জ্বালিয়ে তার অপেক্ষায় জেগেছে আকলিমা, হাওরপারে দাঁড়িয়ে ‘সাজুর বাপ সাজুর বাপ’ বলে হাঁকের পর হাঁক দিয়েছে, রাত গড়িয়ে ভোর হয়েছে, তবু ফেরেনি সোনাফর। ইচ্ছে করেই যে ফেরেনি তা নয়। বাঘাইড়টার সন্ধান করতে করতে কখন যে সূর্য ডুবে গেছে টের পায়নি। যখন পেয়েছে চারদিকে তখন অন্ধকার। যেদিকে তাকায় পানি আর পানি। কোনদিকে বেইয়াবিল, কোনদিকে বাইক্কা বিল, কোনদিকে খাগউরা, চাপড়া, কুলিমারা বিল আর কোনদিকে তার বাড়ি কিছুই ঠাওর করতে পারে না। অগত্যা সে হাল ছেড়ে দেয়। নৌকায় ছই আছে। পুরনো একটা কাঁথাও আছে। কাঁথাটা ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়ে।

ভোরে উঠে আবার শুরু করে হন্তারক বঘাইড়ের সন্ধান। অক্লান্ত হাতে বৈঠা বায়। হাওরের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় চক্কর দেয়। মাথার উপর গনগনে সূর্যের তাত কেয়ার করে না, হাড়কাঁপানো শীত কেয়ার করে না, ঝড়-বৃষ্টি কেয়ার করে না। চোখ দুটো থির থাকে জলের উপর। একবার ডানে তাকায়, একবার বাঁয়ে। কোচটা রাখে হাতের কাছে। বরুণা বাজার থেকে তিন শ টাকায় কিনেছে। সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে সুচালো। ঘাতক বাঘাইড়ের পেটটা এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় না করা পর্যন্ত এই কোচ দিয়ে সে অন্য কোনো মাছ মারবে না। যতদিন লাগে, যত মাস লাগে, যত বছর লাগে লাগুক, সে হাল ছাড়বে না, হন্তারক মাছটাকে খুঁজে বের করবেই। তার শরীরের জব্বর মাইমালের রক্ত। সেই জব্বর মাইমাল, যার ভয়ে তটস্থ থাকত হাইল হাওরের মাছেরা। জলের গভীরে ডুব দিয়ে কানকোতে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনতো বড় বড় সব শোল গজার আইড় মাগুর। ভরা পূর্ণিমার রাতে কোচ হাতে যখন সে মাছ শিকারে বেরোতো, হুলুস্থুল পড়ে যেত মাঝহাওরে, বাপ বাপ করে মেছোভূতেরা ছুটতে শুরু করত দিগ্বিদিক। সেই বাপের বেটা সোনাফর মাইমাল। জীবনভর সে হাইল হাওরের মাছ শিকার করেছে, অথচ তার বেটা কিনা মাছের শিকারে পরিণত হল! ঘাতক মাছটাকে টুকরো টুকরো করে বেটার কবরের উপর না রাখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই।

সোনাফরের নৌকা যখন বাইক্কা বিলের সীমানায় ঢোকে কোচটা তখন কোলে তুলে নেয়। তার বিশ্বাস, এই বিলের কোথাও লুকিয়ে আছে তার শিকার। বহু বছর ধরে বাইক্কা বিলের মাছ মারা বারণ। হাইল হাওর ইজারা দেওয়া। ইজারাদারের অনুমতি নিয়ে হাওরের যেখানে খুশি মাইমালরা মাছ মারে, কিন্তু হাওরের মোকাম বাইক্কা বিলের মাছে হাত দেয় না। মাছের বংশ বিস্তার, পাখির আবাস তৈরি আর বিলুপ্তপ্রায় জলজ উদ্ভিদ সংরক্ষণে এই বিলকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে সরকার। সোনাফরের বুকে প্রতিশোধের আগুন, সে কি আর সরকারি আইন-কানুনের পরোয়া করে! প্রয়োজনে জেল খাটবে, বসতভিটা বেচে ক্ষতিপূরণ দেবে, তবু পুত্রহত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে সে দমবে না।

সে-বছর শীত মৌসুমের শেষদিকে হাওরে পানিতে টান ধরল। এমন টান আর কখনো দেখেনি সোনাফর। খাগউরা, চাপড়া, কুলিমারা, পাত্রডোবা, চরাডোবা, ধলিডোবা বল্লাবিল, ডুমের বিল―বিস্তীর্ণ হাইল হাওরে ছোটবড় যত বিল আছে সব বিলের পানি নেমে গেছে হাঁটুর নিচে। মাস শেষে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। ওসব বিলে মাছ মারার ধুম লেগেছে। মাইমালদের তাড়া খেয়ে হাওরের মাছেরা সব ভিড় করছে বাইক্কা বিলে। এই বিল কখনো শুকায় না। শুকাতে কখনো দেখেনি সোনাফর। দেখেছিল একবার, তার বয়স তখন আট কি দশ, খরা লেগেছিল সে-বছর। তার মনে আছে, বিলের মাটিতে ফাটল ধরেছিল। মাটির চাঙড়ের ফাঁকে ফাঁকে ঘাপটি মেরে বসে থাকত সেয়ানা কাইমাছ। চাঙড় সরিয়ে কত মাছ যে ধরেছে তখন! তারপর, প্রায় তিরিশ বছর তো হয়ে গেল, আর কোনোদিন শুকায়নি।

হাওরের এমন দশায় ঈদের বাঁকা চাঁদ ভাসে সোনাফরের চোখে। যত দিন যায় পানি তত কমতে থাকে। কমতে কমতে ফাল্গুনের শুরুতে ডাঙার রূপ নিল বিস্তীর্ণ হাইল হাওর। শুরু হলো সোনাফরের দিনগোণা। বারবার সে আসমানের দিকে তাকায়। সে আসমানের মতি বোঝে। বৈশাখের আগে বৃষ্টির আলামত দেখতে পায় না আসমানে। সবে তো ফাল্গুনের শুরু, বৈশাখ আসতে এখনো পাক্কা দুই মাস দেরি, বাইক্কা বিলের পানি তলানিতে ঠেকার জন্য এক মাসই যথেষ্ট। এদিকে বিলের পানি কমতে থাকে, ওদিকে বাড়তে থাকে সোনাফরের উত্তেজনা। দিন নেই রাত নেই সে পড়ে থাকে হাওরে, পুত্রহন্তা সেই বাঘাইড়টাকে খুঁজে বেড়ায়। কত শোল কত গজার কত মৃগেল মাগুর চিতল বোয়াল এমনকি আইড়-বাঘাইড়ও চোখে পড়ে, অথচ সেই বাঘাইড়, লম্বায় যে তার সমান, চোখে পড়ে না।

সন্দেহ হানা দেয় সোনাফরের মনে। মাছটা কি এখনো বেঁচে আছে? মাত্র তো দেড় বছর গেল, এত তাড়াতাড়ি তো মরার কথা নয়। কিন্তু বেঁচে থাকলে তো একটিবার হলেও তার চোখে ধরা দিত। মাইমালদের জালে আটকা পড়েনি তো? তা তো হওয়ার কথা নয়। এত বড় মাছ ধরা পড়লে নিশ্চয়ই দশ গ্রাম খবর হয়ে যেত। কে জানে, এমনও হতে পারে, ভরা বর্ষায় ভাসতে ভাসতে চলে গেছে কুশিয়ারা অথবা মেঘনায়।

সন্দেহটাকে বেশিক্ষণ মনে ঠাঁই দেয় না সোনাফর। মাছটা নিশ্চয়ই বাইক্কা বিলে আছে―বারবার নিজেকে একথা শোনায়। বৈঠা বাইতে বাইতে বিড়বিড় করে, ‘হারামজাদা, খয়দিন আর ভাগিয়া থাখবে? তর তামশা আর খয় দিন? আমার কুচার ফলা থাকি ভাগি যাইবে বুঝচ্ছনি? ওয় দেখ রশি। তর খানখাত ঢুকাইমু খানকির ফুয়া। টানি টানি আমার ফুয়ার কবরর খান্দাত লইয়া যাইমু তরে। ছেনি দিয়া তর বুক খাটমু। খত বড় খইলজা তর দেখমু আমি। অয়, দেখমু আমি। হিয়াল দিয়া খাওয়াইমু তর খইলজা হারামজাদা।’ কখনো ঘুমের ঘোরেও এইসব বকে সোনাফর। বকতে বকতে জেগে ওঠে। তখন ইচ্ছে করে কোচটা হাতে নিয়ে বিলের দিকে ছুট লাগাতে। কেননা সে খোয়াবে দেখেছে, বিলের ঠিক মাঝখানে, যেখানটায় উত্তর-দক্ষিণ লম্বা খাল, মস্ত বাঘাইড়টা পাখনা দুলিয়ে দুলিয়ে সাতার কাটছে। সাতার কাটছে আর হাপুস-হুপুস করে গিলে খাচ্ছে অসংখ্য ট্যাংরা-পুঁটি। কোচ কোচ বলে তখন সে চিৎকার করে ওঠে। আকলিমা তখন তাকে ধাক্কা মারে, ‘আপনি ফাগল অইছইন? মাছ ওটা মারলে কিতা ফিরিয়া আইবনি আমার সাজু?’ বলে রাও ধরে কান্না শুরু করে। মধ্যরাতে বউয়ের কান্নায় সোনাফরের বুকটা আষাঢ়ী আসমানের মতো ভারী হয়ে ওঠে, প্রতিশোধের নেশাটা মাথায় চড়ে কুটকুট করে কামড়াতে শুরু করে।

তখন ফাল্গুনের মাঝামাঝি। বাইক্কা বিল ছাড়া হাইল হাওরের কোথাও পানি নেই। শীতের পাখিরা সাইবেরিয়ার উদ্দেশে উড়াল দিতে শুরু করেছে। বাইক্কা বিলে মাছেদের তুমুল দাপাদাপি। বিলে নামা বারণ করে দিয়েছে বিল সংরক্ষণ কমিটি। কুড়ি-বাইশজন লোক পালা করে পাহারা দিচ্ছে দিন-রাত। পাহারা না বসালেও কি কেউ বিলে নামবে? দিনে এনে দিনে খায় হাওরপারের মাইমালরা, মামলার আসামি হয়ে জেলে গেলে বউ-বাচ্চাদের খাওয়াবে কে? শুধু বারণ মানে না সোনাফর। রোজ রোজ নৌকাটা নিয়ে চলে যায় মাঝবিলে। কোচ হাতে মাছটাকে খুঁজে বেড়ায়। উঠে আসার জন্য প্রহরীরা তার উদ্দেশে হাঁকের পর হাঁক মারে, সে কানেই তোলে না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে প্রহরীরা তাকে শাসায়, ‘কোন সাহসে তুমি বিলো নেমেছ? সে পাল্টা দেয়, ‘আমি চুর নু ডাখাইত? বিল থাকি এখটা মাছও কি ধরছি কোনোদিন? কেউ খইতো ফারবো নি? এতো অবিশ্বাস কিতার? আমি নামলে বিলোর ফানি কিতা নাফাক অই যাইবোনি?’

প্রহরীরা তাকে আর ঘাঁটায় না। নামুক। মাছ তো আর ধরছে না, নামলে অসুবিধা কী। কিন্তু তাদের মনে সন্দেহ জাগে। মাছের প্রতি লোভ নেই সোনাফরের, সারাবেলা ঘুরে ঘুরে তবে খোঁজেটা কী? সোনাফরের কাছে জানতেও চেয়েছে একবার। মনের কথা গোপন রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে ওঠা সোনাফর বলে দিল, ‘আমি সেই হার্মাদটাকে খুঁজি, যে আমার বেটাকে মারছে।’ তার কথা শুনে প্রহরীরা হাসল। হাসবে না? বাইক্কা বিল কত লক্ষ-কোটি মাছের বসতি তার কি শুমার আছে! কোন মাছ সাজুকে ঢুঁশ মেরেছিল তার কি হদিস আছে! মাছ কি মানুষ, যে দেখলেই চেনা যাবে? সোনাফর বলেছে, ‘আমি চিনমু। এখবারোর দেখায় চউখর তারায় তারে আমি খুদাই খরছি। চউখর সামনে হার্মাদটা হখলসময় ভাসে। আমি তারে চিনমু। হাছা তারে দেখলেউ চিনমু।’

এই তাহলে গোমর কথা! এতদিন ধরে তবে বিলের মাছ মারার ধান্দায় আছে সোনাফর! কথাটা প্রহরীরা পৌঁছে দিল বিল সংরক্ষণ কমিটির সভাপতির কানে। সোনাফর কি আর বিলে নামতে পারে? সভাপতি সেদিনই তাকে ডেকে হুঁশিয়ার করে দিল, ‘আইজ থাকি তুমার বিলো নামা নিষেধ।’ প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় না সোনাফর। সভাপতি বলল, ‘মনে থাখে যেন। বাড়াবাড়ি খরলে কিন্তু তুমার বিরুদ্ধে থানা ফুলিশ খরমু।’

 

সোনাফর এবার কী করে? প্রতিশোধের আগুনটা এবার সে নেভাতে চাইল। কত আর বয়ে বেড়ানো যায়! দেড় বছর ধরে একটা মাছের পিছে ছুটতে ছুটতে দেউলিয়া হওয়ার দশা। একদিন কাজ করলে তিন দিন মাছটার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে চাল থাকলে ডাল থাকে না, ডাল থাকলে তেল থাকে না। আকলিমার শরীরে নানা রোগ-ব্যাধি বাসা বেঁধেছে, ভালো একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সময় পায় না সোনাফর। প্রতিশোধের আগুনটা এবার মাটিচাপা না দিলেই নয়। কিন্তু বড় রাস্তার ধারে বেটার কবরটার দিকে তাকালে আগুনটা আবার দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। কোচ নিয়ে বিলে নামার জন্য সে ছটফট শুরু করে।

সেদিন বারুণা বাজারের চা দোকানে বসে কথাটা প্রথম পাড়ে সোনাফর। নিজ থেকেই সে বাইক্কা বিলের প্রসঙ্গ তোলে। খেদের সঙ্গে বলে, ‘বিল হুকাইয়া মাছ মরিয়া ফছি যার, অথছ কেউররে ধরতে দের না। মরিয়া ফচার থাকি মানষে খাইলে সমস্যা কুন জাগাত?’

তার কথার সমর্থন দিল সবাই। ঠিক কথাই বলেছে সোনাফর। বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, পানি ছাড়া কি মাছ বাঁচে? সরকারের মাথায় কি গোবর? কোটি কোটি টাকার সম্পদ এভাবে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে! সরকার চালায় কোন শালা! সোনাফর খেদ ঝাড়ে, ‘চেয়ারম্যানো দেখি ই ব্যাফারে চুপ। কেমন আক্কেল তার! ভুট দিয়া তারে আমরা চেয়ারম্যান বানাইছি কিতার লাগি? আমরার সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব কিতা তার নায়নি?’

যত প্রতিবাদ সব দোকানেই, বাড়ি ফিরে মাছের কথা আর খেয়ালে থাকে না কারো। কেন থাকবে? সরকারের মালিকানায় যে বিল, তার মাছ ধরতে গেলে সরকার কি চুপ করে বসে থাকবে? জেনেশুনে কে চায় মামলায় জড়িয়ে জেলে যেতে! ফলে শত উস্কানি দিয়েও বিলে নামার ব্যাপারে কাউকে রাজি করাতে পারে না সোনাফর। তাই বলে চুপ করে বসেও থাকল না। দুদিন পর সে গুজব ছড়িয়ে দিল―বাইক্কা বিলের মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে সরকার, মাছ ধরতে এখন আর কোনো বাধা নেই। দেরিতে হলেও সরকার বুঝেছে বিলে মাছ মরে পচার চেয়ে মানুষের পেটে যাওয়া ভালো। কিন্তু কমিটির নেতারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা গোপন করছে। ইজারাদারদের সঙ্গে চুক্তি করেছে তারা। কদিনের মধ্যে মাছ ধরা শুরু হবে। সব মাছ চলে যাবে শহরে।

বাতাসে সওয়ার হয়ে গুজবটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল গ্রামে গ্রামে। পরদিন সকাল থেকে আসতে লাগল দলে দলে মানুষ। সবার হাতে হাতে কোচ পলো ডুলা জাল। কেউ যাতে বিলে নামার সাহস না দেখায় প্রহরীরা হুঁশিয়ার করে দেয়। কিন্তু কে শোনে তাদের হুঁশিয়ারি! মাছের লোভ আর পুত্রের লোভ কি কেউ সামলাতে পারে? রোদ তেতে উঠলে বিলজুড়ে যখন মাছেদের দাপাদাপি শুরু হল অমনি হৈহৈ করে নেমে পড়ল অন্তত দেড়-দুই শ মানুষ। প্রহরীরা তখন কী করে? চোখের সামনে বিলের মাছ লুট হয়ে যাচ্ছে, তারা কি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? দেখাটাই শুধু তাদের কাজ? একজন-দুজন করে নামতে নামতে সব প্রহরী নেমে গেল বিলে। সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও ডুলা ভরতে লাগল। বাইম, গুথুম, পাবদা, বোয়াল, শিং, মাগুর, আইড়, পুঁটি, চান্দা, ইছা, বালিগড়া, টেংরা―যে যত পারল ধরে নিয়ে গেল।

পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই বাইক্কা বিলের দিকে মানুষের স্রোত। বেলা যত বাড়ে স্রোত তত বাড়ে। স্রোত যত বাড়ে মাছ তত কমে। খবর পেয়ে উপজেলা সদর থেকে ছুটে এলেন ইউএনও, ওসি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। ততক্ষণে বিলের প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মাছ লুট হয়ে গেছে। মানুষের স্রোত দেখে চিন্তায় পড়ে গেলেন তারা। ডাঙা হলে একটা কথা ছিল, লাঠিচার্জ করে পুলিশ একটা গতি করতে পারত। খাল-বিলের ব্যাপার, কাদাজলে নেমে পুলিশ লোকজনকে হটাবে সে উপায় নেই। নামলই না হয়। কিন্তু মানুষ যদি উল্টো পুলিশের গায়ে হাত তুলে বসে কী করবে পুলিশ? কজনের বিরুদ্ধে মামলা দেবে? কজনকেই-বা গ্রেপ্তার করবে? অগত্যা হাত-পা গুটিয়ে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে মাছ মারার মহোৎসব দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকল না।

বিকেলে এসপির ফোন পেলেন ওসি। এসপির কড়া নির্দেশ, ‘যে করেই হোক বাইক্কা বিলের মাছ রক্ষা করতে হবে। সরকারি বিলের মাছ এভাবে লুট হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বিল এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে দাও।’ ওসি কি আর দেরি করেন? পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে মাইক বেঁধে সহরত করলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে খালি করতে হবে বিল। সরকারি হুকুম। ঠিক এক ঘণ্টা পর ১৪৪ ধারা কার্যকর হবে। নির্দিষ্ট সময় পর বিল এলাকায় কাউকে দেখলে গুলি চালাতে বাধ্য হবে পুলিশ।

সন্ধ্যার আগেই খালি হয়ে গেল তামাম বিল। পুলিশ ভাবল, গুলির কথা শুনেই বুঝি ভয় পেয়ে গেছে মানুষ। ভয় যে কেউ পায়নি, টের পেল পরদিন। সেদিন ভোরে বিল পাহারায় অতিরিক্ত এক প্লাটুন পুলিশ এল শহর থেকে। ১৪৪ ধারা তখনো বলবৎ। পুলিশ আসার আগেই কয়েক হাজার মানুষ বিলে নেমে গেল। আরো মানুষ আসতে লাগল দলে দলে। বিলের উত্তরে দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে যত গ্রাম আছে সব গ্রামের মানুষ যোগ দিচ্ছে মাছ লুটের মহোৎসবে। চারদিকে মানুষের হাঁকডাক। মাছ ধরছে আর চাঙ্গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ১৪৪ ধারা ভাঙার অপরাধে তারা গুলি চালাতে পারে, সেই ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু কজনের উপর গুলি চালাবে? একটা মানুষ মরলে রৈ রৈ পড়ে যাবে দেশজুড়ে। বিরোধীদল তো সরকারবিরোধী আন্দোলনের মওকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইস্যুকে মোয়া বানিয়ে তো তাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না।

দিনভর লুটপাট চলল। বিকেলে আচমকা গুলির শব্দে কেঁপে উঠল বাইক্কা বিলের দিগ্বিদিক। প্রথম শব্দ হল বিলের উত্তরে। হৈ হৈ রব উঠল সেদিকে। তারপর বিলের দক্ষিণে। কয়েক মিনিট বিরতি দিয়ে পুবে আর পশ্চিমে। সত্যি এবার ভয় পেয়ে গেল মানুষ। কোচ পোলো জাল ফেলে যে যেদিকে পারল পালাতে লাগল। মাছের জন্য জানটা তো আর খোয়ানো যায় না। পুলিশের বিশ্বাস আছে? তারা পারে না এমন কিছু নেই। এখন ফাঁকা গুলি করছে, উপরের নির্দেশে খানিক পর গায়ে যে করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে!

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জনশূন্য হয়ে পড়ল বাইক্কা বিল। আছে শুধু একটা মানুষ―সোনাফর। হাতে কোচ, চোখে প্রতিশোধের আগুন। পাগলের মতো ছুটছে। একবার উত্তরে, একবার দক্ষিণে, একবার পুবে, একবার পশ্চিমে। বহুদিন ধরে যে শিকার সে খুঁজে বেড়াচ্ছে, ছুটছে তার পেছনে। সেই বিশাল বাঘাইড়, যে লম্বায় তার সমান, যার দুই চোখের উপর গরুর শিঙের মতো সুচালো দুটি কাঁটা, পেটের দু-পাশে দুটি পাখনা এবং লেজ ও পিঠের দিকটায় অজগরের মতো কালো ডোরা। দেড় বছর আগের দেখার সঙ্গে এখনকার দেখার কোনো ফারাক নেই। সে তো চোখের তারায় মাছাটার অবয়ব খোদাই করে নিয়েছে, দেখা মাত্র হার্মাদটাকে চিনতে ভুল করেনি।

মাছটাকে সে প্রথম দেখে উত্তরের বিলে, ঠিক দুপুরে। পেট বরবার তাক করে কোচটা মারতে যাবে অমনি মাছটা লেজের আঘাতে পানির ঝাপটা দিয়ে পালিয়ে গেল। আর খুঁজে পায় না সোনাফর। তামাম বিলে সে চক্কর দেয়। কোথাও নেই হার্মাদটা। বিকেলে বাইক্কা খালের উজানে আবার সে মাছটার দেখা পেল। তার তাড়া খেয়ে মাছটা খাল থেকে উঠে পশ্চিমের বিলে ছুট লাগাল। পেছনে ছুট দিল সোনাফর। আচমকা গোত্তা খেয়ে মাছটা এবার ছুট লাগাল দক্ষিণে। সোনাফর থামে না। মাছটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে কুলিয়ে উঠতে পারে না, কাদায় বারবার পা দেবে যায়। কিন্তু তখন তো তার মাথায় প্রতিশোধের নেশা। যদি ডানা থাকত, উড়াল দিয়ে মাছটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কোচের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে দিত। সে মরণপণ ছুটতে থাকে। বিলের মাঝামাঝি এসে মাছটা এবার ছুট লাগল পশ্চিমে। তারপর আবার পাক খেয়ে দক্ষিণে। বাইক্কাখালের কাছাকাছি এসে মাছটার নাগাল পেয়ে সে কোচের আঘাত হানল। ফস্কে গিয়ে কাদায় দেবে গেল কোচটা। মাছটা বুঝি টের পেয়ে গেছে তাকে হত্যার জন্য পিছু লেগেছে তার শত্রু। নইলে এভাবে সে অবিশ্রাম ছুটবে কেন?

সূর্য তখন অস্তাচলে। বাইক্কা বিলে সোনালি আভা। সোনাফর হঠাৎ মাইকের আওয়াজ শুনতে পায়। বিল থেকে উঠে আসার জন্য তাকে আহ্বান জানাচ্ছে পুলিশ। সে কানেই তুলল না। সে তখন মাঝবিলে কোচ হাতে ছুটছে। মাছটা তার দু-তিন হাত দূরে। খানিক দূরেই বিলের মোকাম বাইক্কা খাল। মাছটা খালে নেমে পড়লে খুঁজে পাওয়াটা মুশকিল হবে, তাই ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। ছুটতে ছুটতে খালের কাছাকাছি এসে যেই না মাছটার গায়ে কোচের আঘাত হানবে, অমনি মাছটা নেমে পড়ল খালে। সোনাফর থমকে দাঁড়ায়। ভাটির দিকে একটা নৌকা দেখতে পায়। বৈঠা বাইছে এক প্রহরী, দুই পুলিশ ছইয়ে দাঁড়িয়ে। সোনাফর ভাবল, তাকে বুঝি গ্রেপ্তার করতে আসছে তারা! খালের দিকে তাকাল সে। মাছটা তখন জুতসই পানির নাগাল পেয়ে উত্তরে ছুটছে। এক মুহূর্তও দেরি না করে খালের কূল ধরে ছুটতে শুরু করল সোনাফর। পেছন থেকে শুনতে পেল পুলিশের হাঁক, ‘থাম মাইমালের বাচ্চা মাইমাল। নইলে গুলি করে মারব।’ যেন আগুনের আঁচ লাগল সোনাফরের মাথায়। ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল। ছুটতে মাছটার কাছাকাছি এসে খালে ঝাঁপ দিল অকস্মাৎ। দুই হাতে মাছটাকে জড়িয়ে ধরল। শুরু হলো মাছে-মানুষের ধুন্দুমার লড়াই।

পুলিশের নৌকাটা যখন কাছাকাছি এলো অকস্মাৎ চিৎকার করে উঠল সোনাফর। হামাগুড়ি দিয়ে সে খালের কূলের উঠে বসল। কাদাজলে বসে হাঁপাতে লাগল। বুক আর চোখ থেকে গল গল করে রক্ত ঝরছে। বুক থেকে পেট পর্যন্ত কেউ যেন ছুরি দিয়ে চিরে দিয়েছে। বাঁয়ের চোখটা যেন ছুরির ফলায় তুলে নিয়েছে কেউ। চিৎকার করতে করতে ঝাপসা চোখে উত্তরে তাকায় সোনাফর। শত্রুর কবল থেকে মুক্তি পেয়ে দুরন্ত গতিতে খালের পানি দু-ভাগ করে ছুটে চলছে সেই দুরন্ত বাঘাইড়।

 

 

(ছবি: ইন্টারনেট)