মৎস্য পুরাণ

মৎস্য পুরাণ -- রুমা মোদক

রুমা মোদক

 

এই গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়ির বিয়েগুলোর ভাবমূর্তি বাঁধা থাকে হাওরের টাটকা মাছে। বিয়ের এক অলিখিত শর্ত। হাওরের টাটকা মাছ না খাওয়ালে ম্লান হয়ে যায় আভিজাত্য প্রকাশের অন্য সব আয়োজন। বিয়েশাদি সম্পন্ন হয়ে যাবার পর কয়েকদিন একই আলাপ মুখে মুখে কার বাড়ির কার বিয়ের মাছ কতটা ভালো ছিল!

মৎস্য ইতিবৃত্ত শুরু হয় একদম কাকডাকা ভোরে। হাওর থেকে এই গ্রাম থেকে শহরের সিঁড়িতে পা দেয়া গ্রামটিতে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় লেগে যায়। রিক্সা ছাড়া কোনও যান নেই। জেলেরা রাতভর জাল ফেলে মাছ ধরে, আর আড়তদাররা সকাল সকাল সেই মাছ মণ ধরে কিনে নেয়। জেলে থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে দাম বেড়ে যায় দ্বিগুন। তবু এই হাওরের টাটকা মাছের সুনাম দেশবিদেশ খ্যাত।

ভোরবেলায় সারিবাঁধা রিক্সাগুলো পিচ করা রাস্তার আলকাতরায় বাঁধা পাথর গুড়োর কঠোরতা ফেলে মাটির পথ ধরে এগুতে থাকে। এই কাকডাকা ভোরেই বালকের দল পথে নেমে গেছে। অনাহারের ঘরে ঘুম ভেঙে আদতে কোন কাজ নেই তাদের ঘর ছেড়ে মুরগির মতো বাইরে এসে খাবার খুঁটে খাওয়া ছাড়া। কখনও জোটে, কখনও জোটে না। দুটোই অনিশ্চিত। তবু দিন পার করার দায় এদের থাকে। কোনও কাজ না পেয়ে এরা পথ আটকে ডাংগুলি খেলে।

পথে ডাংগুলি খেলতে থাকা এই বালকের দলকে সরাতে রিক্সাগুলো একসঙ্গে ক্রিং ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতে থাকে, বালকের দল সরবে কি সরবে না দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদল পথ ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে পথের নীচে ঝোপঝাড়, লজ্জাবতীর কাঁটায়, চুলকানি পাতায়। আরেক দল বুভুক্ষু চোখে তাকিয়ে থাকে অগ্রসরমান রিক্সাগুলোর দিকে…। কিন্তু অবিরাম বেলের ক্রিংক্রিংয়ে দলবেঁধে পাখিরা ডানা ঝাপটে এদিক সেদিক উড়ে যায়, আর বালকের দল পথ ছেড়ে সরে না দাঁড়ানোয় পরপর রিক্সাগুলো ধাক্কা খায়। দু চারটি মাছ লেজ নাড়াতে নাড়াতে লাফিয়ে পড়ে রিক্সা থেকে। এদিক সেদিক ত্যারি কাটে জবাই হতে যাওয়া মুরগির মতো। ছুরির নিচে গলা নিয়েও মুরগি যেমন ভাবে দুই চারটে ডানা ঝাপটালেই সে ছাড়া পেয়ে যাবে, তেমনই নির্বোধ মাছগুলোও এদিকে সেদিকে অনর্থক লাফায় জলাশয়ের খোঁজে।

বালকের দল থেকে দৌড়ে আগায় সাদ্দাম। একটা একটা করে মাছ জাপটে ধরে ঝুড়িতে তুলে দিতে যায়। ধরলেই পিছলে যায় মাছগুলো। সাহেববাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে আজ। তারই মাছ। সাহেববাড়ির বড় ছেলে আরব আলি, সাদ্দামকে তাড়া দেয়, ধর,ধর, তুলে দে, তুলে দে। সাদ্দামের সঙ্গে মাছেদের কুস্তি দেখে বালকের দল খেলা ভুলে হাততালি দেয়। সাদ্দাম দমে যায় না। চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ওর গায়ের ময়লা গেঞ্জি আরও ময়লা হয়। অপরাজেয় বীরের মতো তিনটি মাছ পরপর তুলে দিতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু চার নাম্বার মাছটি তুলে দেয়ার সময় মাছভাজার এক প্রবল গন্ধ তাকে ঝড়ের তুলোর মতো উড়িয়ে নিয়ে যায় বছর চার আগে। সাহেববাড়ির বড় ছেলে আরব আলির বৌভাত ছিল সেদিন। আগের রাতে বাড়ির পেছনে আমগাছের নিচে চুলা বানিয়ে গমগম আগুনে মাছ ভাজছিল শহর থেকে আসা বাবুর্চি। পরদিন পাঁচ গাঁয়ের সব সম্ভ্রান্ত, আধা সম্ভ্রান্ত, জাতে ওঠা, ওঠার চেষ্টারত কয়েকশো মানুষের দাওয়াত।

সাদ্দামরা এর কোনওটাতেই পড়ে না। যে শ্রেণির মানুষেরা দাওয়াত পায় তার আরও কয়েক ধাপ নিচে তাদের বাস। চলার পথে ঘাস খাওয়া গরুছাগলের দিকে যেমন না তাকালে পৃথিবীর নিয়মের কিছু যায় আসে না, এরাও তেমনি। পাশেই তাদের ছাউনিতে টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সেদিন হু হু করে ঢুকছিল মাছভাজির তীব্র গন্ধ। ঘরে মাটির সানকিতে তখন কড়কড়া ভাত আর এনামেলের কড়াইয়ে শুঁটকিমাখা টেংরার ঝোল। এমনিতে এই ঝোল প্রতিদিন লবণ-কাঁচামরিচ দিয়ে খাবার চেয়ে দুর্লভ। অথচ আজ মাছভাজির প্রবল গন্ধ ক্রমেই ভাতে জড়িয়ে ঝোলের উপস্থিতিকে ম্লান করে দিচ্ছে। এই এলাকা হাওরের প্রাকৃতিক মাছের জন্য বিখ্যাত হলেও সে দুর্মূল্য জিনিস তাদের জোটে না। কড়াইয়ে শুঁটকি আর টেংরা মাছ অসহায় পড়ে থাকে। মা টের পান বাচ্চাদের আকাঙ্ক্ষা, ভাঙা টিনের ফাঁক দিয়ে বাবুর্চিকে ডাকেন, ও ভাই। বাবুর্চি কি বোঝেন কে জানে। ইশারা করেন। মা একটা টিনের থালা এগিয়ে দিলে বাবুর্চি গোটা আট দশখানা মাছভাজা বাড়ির পাহারা ডিঙিয়ে ঢেলে দিয়েছিল প্লেটে। এত বড় মাছের ভাজা জীবনে খাওয়া দূরে থাক চোখেও দেখেনি সাদ্দাম। আর এর স্বাদ! জীবনে আর কিছুর সঙ্গে তুলনীয় কিনা খুঁজে আজও পায়নি সে।

সাহেববাড়ির বিয়েতে দাওয়াত পায় না তারা। পাওয়ায় কথাও নয়। সাহেববাড়ি থেকে বড় রাস্তায় ওঠার যে মাটির সংযোগ রাস্তা, তার পাশে পতিত জমিতে ছাপড়া বানিয়ে থাকে। সাদ্দামের মা কয়েক বাড়িতে ছুটা কাম করতে বেরিয়ে গেলে সাদ্দামরা পাঁচ ভাইবোন এদিক সেদিক বেরিয়ে যায়। বোন দুইটা পাতা কুড়ায়, গাছের নিচে পড়ে থাকা আম, বেল কুড়ায়। কিছু গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে কুড়ানি নামকে সার্থক করে। মায়ের রাঁধতে লাগে, শুকনো গোবরের গৈঠা। ক্ষিধে পেলে সাহেববাড়ি, মিয়াবাড়ি ঢুকে বাসনের স্তুপ নিয়ে পুকুরে যায়, ছাই দিয়ে মেজে ধুয়ে আনে। মিয়াবাড়ির বৌ-ঝিরা আটকায় না। তাদের পরিশ্রম আসান হয়। ঘরের কোণে পড়ে থাকা টিনের থালায় ভাত আর পাতিলের তলায় পড়ে থাকা তলানি ঝোল দেয়। চেটেপুটে খায় তারা। ভিক্ষের চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া। পেট পুরলেই হল।

ছেলে হওয়ার কারণে সাদ্দামের সে সুযোগ কম। প্রায় দুপুরই কাটে না খেয়ে। বোনদের মেয়েজন্মকে সে ঈর্ষা করে এজন্য। কোনওদিন দৌড়াতে দৌড়াতে বাজারে চলে গেলে ভাগ্যে জুটে যায় কারও আধখেয়ে ফেলে যাওয়া সিঙারা, পুরি জিলাপি। আবার হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি ফিরে বোনদের দেখিয়ে দেখিয়ে খায়। বোনরা একটু হাত পাতলে দিব্যি শুনিয়ে দেয়, কাইল যে মিয়া বাড়িত মুরগির ঘিলা কইলজা দিয়া ভাত খাইলি আমারে দিছস? বোন অস্বীকার করতে পারে না, ভাত তো একাই খেয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র মাথায় জুৎসই উত্তরও কুলায় না, পরের বাড়ির ভাত খেতে সে কেমনে ভাইকে ডাকে! ক্ষুধাপেটে ভাইয়ের বোনকে ভাগ না দেওয়ার অপরাধবোধ কিংবা বোনের ভাইকে ফেলে খাবার বেদনাবোধ জীবনে প্রবেশের কোনও সুযোগই পায় না।

আরব আলি তাড়া দেয়, কিরে মাছ লইয়া খাড়াইয়া রইলি ক্যান? তাড়াতাড়ি ঝাঁকায় দে। দিরং হইয়া যাইতেছে। সাদ্দাম দ্রুত পা বাড়াতে চায়। তখনই মাছটা ফিসফিসিয়ে তাকে বলে আমারে পাশের পুস্কুনিতে ছাইড়া দেও। আমারে বাঁচাও। সাদ্দাম দ্রুত পায়ে আগাতে গিয়ে থেমে যায়। মাছটার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে তোমারে ছাইড়া আমার লাভ কী? মাছটি কাতর কণ্ঠে বলে, না ছাইড়াই তোমার লাভ কী? সাদ্দাম এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করে না, নিজের আশার কথা বলতে, তোমারে ঝাঁকে উডাইয়া দিলে, হেরা আমারে মাছের ভাজা খাওয়াইব। বাঁচার আকুতির সঙ্গে এবার মাছটির ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বরে ভর করে উপহাস, হ বড়লোকদের ঠ্যাকা পড়ে নাই ছোটলোকদের তেলেভাজা মাছ খাওয়ায়। তেলা মাথায়ই সবাই তেল ঢালে। সাতসকালের উজ্জ্বল সূর্যোদয়ের মতো আশার আলো গিলে খাওয়া হতাশার বিষণ্ণতা সাদ্দামের দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য ঝাপসা করে দেয়, যত না তাকে ছোটলোক বলার দুঃখে, তারচেয়ে বেশি সে মাছভাজা খেতে না পারার সম্ভাবনায়। সে ক্ষণিক বিভ্রান্ত হয়, মাছটিকে কি ছেড়ে দেবে! আরব আলি তখন আবার তাড়া দেয়। আরে আসস না ক্যান। কী বিড়বিড় করস?  মেহমান আইসা পড়বে। দিরং হইয়া যাইতেছে।

সাদ্দাম তার পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্যে দ্রুত মনস্থির করে আবার। তড়িঘড়ি আগাতে চায়। মাছটি আবার আকুতি করে, বাঁচাও না আমারে। সাদ্দাম দ্বিধায় পড়ে যায়। মাছটার আকুতিভরা অনুরোধে তার মনে দয়া হয়, একবার মনে হয় মাছটা সত্যি পঞ্চায়েত পুকুরে ছেড়ে দিয়ে আসে। পরক্ষণেই মনে হয় মাছটা তুলে দিলে আরব আলি খুশি হয়ে দুপুরে তাকে খাওয়ার কথা বলতেও পারে। মাছটার আকুল আকুতি পরাজিত হয় খাবার ইচ্ছের কাছে। মাছটা দ্রুত ঝাঁকায় তুলে দেয় সাদ্দাম। মাছটা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

মাছটার জন্য মায়া পড়ে যায় সাদ্দামের। মাছটাকে লক্ষ করে সে রিক্সার পিছন পিছন যায়। ততক্ষণে সরে দাঁড়িয়ে বালকের দল রাস্তা খালি করে দেয়। পিছন থেকে সামনে আসে সাদ্দাম। মাছের আঁশটে গন্ধ তার সারা গায়ে। ধুলো ময়লাও।

সাহেববাড়ির পেছনে আমগাছের নিচে চাটাই বিছিয়ে একের পর এক ঝাঁকা থেকে মাছ ঢালা হয়। তিন চারজন লোক ঝিনুক চারা নিয়ে দ্রুত হাতে মাছের আঁশ ছাড়াতে লেগে যায় তৎক্ষনাৎ। তীব্র আঁশটে গন্ধ এবার নিজের গায়ের গন্ধ ছাপিয়ে বাতাসে ঢেঊ খেলে। সাদ্দামের চৌদ্দ বছরের দেহের গন্ধ এর কাছে পাত্তাই পায় না। সাদ্দাম দেখে সেই বাঁচতে যাওয়া মাছটি এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। সাদ্দাম একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। মাছের স্তূপের থেকে একটা মাছ ছেড়ে দিলে কী হত! এবার মাছটার চোখে আর আকুতি নেই। বরং বিদ্রূপ— খুব ভাবছিস মাছের ভাজা খাবি! দেখ জোটে কিনা!

মনটা একটু খারাপ হয়, মাছটা তাকে অভিশাপ দিচ্ছে! এখন আর তাকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। হাঁটু গেড়ে সে বসে পড়ে ছড়ানো মাছগুলোর পাশে। একটা একটা করে আঁশ ছাড়িয়ে মাছগুলো স্তূপ করা হচ্ছে একপাশে। চার বছর আগে এরকম ভীড় করে মাছ কাটা দেখার সময় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল বড়রা। এবারও ভয়ে ভয়ে থাকে সাদ্দাম। কখন বড়রা এসে তাড়িয়ে দেয় উটকো ভীড়টাকে। কিন্তু না এবার কেউ তাকে তাড়ায় না, বরং আরব আলির বউ তাকে রান্নাঘর থেকে ডেকে পাঠায়, চায়ের ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সাদ্দাম নিজেকে বেশ আবশ্যক ভাবে বিয়ে বাড়িতে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানের শারীরিক বৃদ্ধি তার পদমর্যাদা অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে টের পায় সে। ডেকে যখন কাজ করাচ্ছে, না খাইয়ে ছাড়বে নাকি! নিজের মাছভাজা খাবার সম্ভাবনা সম্পর্কে সে নিশ্চিন্ত হয়।

তারপর আগ বাড়িয়ে অনেক কাজে হাত লাগায় সে। চায়ের কাপগুলো জনে জনে পৌঁছে দেয়। মাছের আঁশগুলো এক করে ঝাঁকায় তোলে। লুঙ্গি গেঞ্জি আঁশটে গন্ধ আর পিচ্ছিল শ্লেষে মাখামাখি হয়ে যায়। সব ছাপিয়ে তার নাকে চার বছর আগের মাছের ভাজার গন্ধই আকাশে বাতাসে ভাসে। যারা মাছ কাটতে বসে লাইন ধরে, তাদের নিচে পলিথিনগুলো বিছিয়ে দেয় তাড়াতাড়ি হাত লাগিয়ে। না সেই চারবছর আগের মতো “সর সর” বলে কেউ তেড়ে আসে না। সবাই তার সহযোগিতা সহজভাবে নেয়। তখন সেই মাছটি আবার চোখে পড়ে তার। পরিণতি নিশ্চিত জেনে এবার অনেক নির্ভার চোখে ওর দিকে তাকায়। জ্বলজ্বলে পাতিহীন চোখে ব্যঙ্গ, উপহাস সব মাখামাখি। কর, কর, যতই কাজ করছ মাছভাজা কপালে জুটবে না। সাদ্দাম কথাটা না শোনার ভান করে এগিয়ে যায়। বটি দাগুলো এগিয়ে দেয় মাছ কোটার জন্য বসে থাকা দলটির কাছে।

সাহেববাড়ির বড়ছেলে আরব আলি আবার দৌড়ে এগিয়ে আসে, এখনও তরা মাছ কাইট্টা সারছ নাই, বেলা কই চড়ছে দেখছস নি? ঐ সাদ্দাম একটু আগাইয়া পিছাইয়া দে তো। নিজের নামটা আরব আলির মুখে শুনে ভীষণ খুশি হয় সাদ্দাম। এত বড় আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা যে, সে যদি নাম ধরে ডেকে কাজের নির্দেশ দেয়, তবে কি আর না খাইয়ে ছাড়বে? মাছটার দিকে কৈফিয়তের চোখে তাকায় সাদ্দাম, দেখছস তো, বড় ব্যাটা আমার নাম পর্যন্ত জানে। না খাওয়াইয়া ছাড়বে! মাছটাও বটিতে গলা পেতে দেওয়ার আগে শেষবারের মতো মরা মাছের চকচকে চোখ নিয়েও সাদ্দামকে বলে, দেখ কী হয়, কপালে মাছ ভাজা জোটে কিনা! মাছটা কী তাকে অভিশাপ দিচ্ছে! দিক। মাছভাজা সে খাবেই। মাছভাজা খাওয়া নিশ্চিত করতে নোংরা পোশাকেই সব কাজে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। কাটার পর টুকরো মাছের ভীড়ে মাছটি হারিয়ে যায়।

বিরাট কড়াইয়ে ডুবো তেলে মাছগুলো যখন ভাজা হতে থাকে তখন ভেতর বাড়িতে আত্মীয়পরিজনদের সাজগোজের প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে। কাঁচা কাঠে বাবুর্চি যতই কেরোসিন ঢালে, চুলায় দাউদাউ করে জ্বলে আগুন, ততই ভেতরবাড়ি থেকে নারীকণ্ঠের কোলাহল বাড়ে। বরযাত্রী আসার সময় সমাগত। আরব আলি আবার তাড়া দিয়ে যায়। মুরগির রোস্ট, গরুর রেজালা সব রাত থেকেই রান্না শুরু করে সকাল সকাল শেষ হয়েছে। বাকি আছে কেবল এই টাটকা মাছের ভাজা। চাষের মাছ নয়। একেবারে কাকডাকা ভোরে হাওর থেকে জাল দিয়ে উঠানো মাছ। এর ভাজার গন্ধের কাছে, মোরগ পোলাও, গরুর রেজালার গন্ধ কোন ছার! সেই যে বছর চার আগে খেয়েছিল! এই স্বাদ জিভে লেগে আছে বছরের পর বছর কতো খাবার ডিঙিয়ে। আর কোনও কিছুতেই এমন মুখ ভরে পানি আসে না তার।

জোহরের আজানের আগেই পৌঁছে যায় বরযাত্রীর দল। সাদ্দাম শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয়া, প্লেট এগিয়ে দেয়া, ধোয়া, টেবিল পরিষ্কার করা কোনও কাজেই হাত লাগানো বাকি রাখে না। শুধু মাঝে মাঝে মোরগ নয়, গরু নয় কেবল মাছ ভাজার সংগ্রহের দিকে তাকায়। আহা সেই স্বাদ। কতদিন পর খাবে আবার। সেই স্বাদ! হাওরের মাছের অভূতপূর্ব স্বাদের প্রশংসা করতে কারও কারও প্লেটে একের অধিক ভাজাও ঢেলে দেয় কনেপক্ষের লোকজন। সাদ্দামের মনটা টনটন করে। বুঝি টান পড়ে ভাজার ভাঁড়ারে, বঞ্চিত হয় সে।

বরযাত্রী, কনেপক্ষের অভ্যাগত মিলে হাজার খানেক মানুষের খাওয়া শেষ হতে হতে দুপুর ফিরতে থাকে বিকালের দিকে। সাদ্দাম হতাশ হয়। সবাই কনে বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ ওকে খেতে ডাকে না। কিচ্ছু খাওয়া হয়নি এত বেলা। তার উপর সারাদিন খাটুনিও কম যায়নি।

বাবুর্চিদের দল নিজেরাই প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেছে নিজেদের মতো। নিজেকে কেমন অপাংক্তেয় লাগে তার।  কেউ এগিয়ে এসে তাকে খেতে দেবে সে সুযোগ বা সময় কারও নেই। সাদ্দাম বোঝে, কী এমন প্রয়োজনীয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সে যে কেউ তাকে খুঁজে খাওয়াতে হবে। বুঝতে পারে কনে বিদায় করতে আর কতক্ষণ লাগবে ঠিক নেই। ক্ষিদে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। বাবুর্চি দলের কাছে একটা প্লেট নিয়ে আগায় সে। দলের সবাই সাক্ষী। সারাদিন সব কাজে ছিল সে। কেউ আপত্তি করে না। প্লেটে হাড়ি থেকে পোলাও আর তলানি থেকে গরুর ঘেঁটে যাওয়া গোশত প্লেটের পাশে দিয়ে খেতে দেয় সাদ্দামকে। সাদ্দাম মাছের ভাজার ঝাঁকাটা দেখে। বেশ কয়েকটা ভাজা রয়েছে এখনও। চাইবে কি চাইবে না দ্বিধায় দ্বিধায় সবার চোখ এড়িয়ে সাদ্দাম নিজেই হাত বাড়ায় ঝাঁকার দিকে। কিন্তু এড়ানো যায় না। সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। ধরিছ না, ধরিছ না। এগুলান বাড়ির মাইনষের জন্য রাখা। বড় বাবুর্চি একটু ধমকও দেয়। সাহস কত্ত, দেহস না আমরাই খাই নাই। তুই কুন সাহসে হাত দেছ! তখনই কি ভাজা মাছের একটা টুকরো তাকে ইশারা দেয়, যে ইশারার মানে, কি কইছিলাম না! শেষ পর্যন্ত মাছের অভিশাপটাই সত্য হল! অপমান ছাপিয়ে আফসোসের অশ্রুতে তার চোখ ভরে ওঠে।

অসহ্য খিদে পেটে, চোখমুখ আঁধার করে আসে। মাছভাজার আশা বাদ দিয়ে উঠানের এক কোণে বসে মাংসের হাড়গোড় আর ঝোল মেখে পোলাওটুকু খেয়ে নেয় সাদ্দাম। টিউবওয়েল টিপে প্লেটভরে পানি খাওয়ার পর তার শরীর শ্রান্তিতে নুয়ে আসে। ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। মনে মনে ভাবে, অনেক হইছে খাটাখাটনি। এবার ছাপড়ায় গিয়া একখান লম্বা ঘুম দেবে সে।

কনে বিদায় করে তখন সাহেববাড়ির বৌ ঝি মুরুব্বিদের বিরাট বহরটি ফিরতে থাকে বাড়ির দিকে, আরব আলির হঠাৎ চোখ পড়ে সীমানা বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সাদ্দামের দিকে। কী জানি কেন ইশারা করেন সাদ্দামকে ভেতরে আসতে। সাদ্দামের সাহস নেই তার ইশারা উপেক্ষা করে। দম দেয়া পুতুলের মতো অনুসরণ করে সাদ্দাম।

একটা টেবিল পরিষ্কার করে সাজানো ছিলো, বাড়ির সবাই টেবিলের নানা চেয়ার দখল করে বসে খেতে। বিয়ের আসরের টুকটাক নিয়ে কথা হয়, স্বর্ণের গয়নার ডিজাইনগুলো ভালো ছিল, কাবিনের টাকাটা আগেই ঠিক করা উচিত ছিল ইত্যাদি। বড়লোকের বাড়ির বাহারি বিয়ের কার্ডের মধ্যে অর্থহীন ভুল বানানের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সাদ্দাম।

সবার সামনে প্লেট আসে। রান্না করা স্পেশাল গরম পোলাও আসে। ঘিলা কলিজার ডাল আসে। সব আলাপের ভীড়ে সাদ্দামের কথা তারা ভুলেই যায়। দু লোকমা ভাত মুখে দিয়ে হঠাৎ আরব আলির চোখ পড়ে তার দিকে। এবার উপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা সাদ্দামের কিছুটা উপযোগিতা তৈরি হয় যেন। তিনি ব্যস্ত হন। এই সাদ্দামরে আরেকখান চেয়ার দে এইখানে, পোলাডা সারাদিন অনেক খাটছে, বলে তিনি চেয়ারটা একটু সরিয়ে জায়গা করে দেন। সাদ্দাম বসতে চায়, এদের সঙ্গে বসলে নিশ্চয়ই ভাজা একটুকরো জুটবে। সাদ্দাম দেখে মাছের ভাজার বাটি নিয়ে আসছে বাবুর্চি। মনে মনে শঙ্কিত হয় সে। বাবুর্চি যদি বলে দেয় সে একবার খেয়েছে।

ঠিক তাই ঘটে, আরে এ তো খাইল আমাদের সঙ্গে, ব্যস্ত হইয়েন না, চেয়ারটা সরিয়ে প্লেটে প্লেটে মাছের ভাজা দেয় সে। ও খাইছস, বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে আরব আলি মাছভাজা ভেঙে এক টুকরো মুখে দেয়। মরা মাছের চকচকে চোখ দুটো সাদ্দামের দৃষ্টিকে আবার ঝাপসা করে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...