অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখা ধরে

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী 

 

৪৪.৯৭৭৬, –৯৩.২৬৫০ ১৩:২৪:৪৩ 

৭৬৬-৫৩৪-৮০৪৩, ৬১২-৯৯১-২৩৪৫, ২৩৪-৩১৬-৫০৪৮, ৫৬১-৩৩২-২০৭১, ৬১২-৮৪৫-৭৬৯৯, ৬১২-০৯৮-৫২৪২, ৬১২…….

ওরা কেউ বধির নয়, কিন্তু মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার আর্তনাদ ওদের কাঁপাতে পারল না। লোকটার পিঠ যখন ভারী বুট দিয়ে রগড়াচ্ছিল, তখন তার হাড়ের মড়মড়ানি পাতা ঝরার শব্দ বলে ভুল হওয়ার কথা তো নয়। তবু পিঠ থেকে নামেনি ওই ধুমসোটা। লোকটা মুচড়ে যাচ্ছিল যন্ত্রণায়। জল চেয়েছিল। কাতরাতে কাতরাতে ওখানেই পেচ্ছাপ করে দিল। এতে ছররা গুলির আওয়াজ তুলে হেসে উঠল আরেকটা সেপাই।

সমবেত জনতা রুদ্ধশ্বাস দেখছিল। ওরা ভয়ে এক পা এগোতে পারছিল না। পিঠ দেওয়ালে ঠেকলে পিছোতেও পারা যায় না। মুখ থেকে আওয়াজ বের করার সাহস নেই। কিন্তু ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস তালে তালে পড়লেও এগিয়ে চলার গান তৈরি হয়ে যায়। ওরা সেটা জানত না। জানলে অতটা মুষড়ে পড়ত না।

ওই বিশাল চেহারার লোকটা ওইভাবে পড়ে থাকতে থাকতে একটা বালক হয়ে যাচ্ছিল। মার কথা মনে পড়ছিল, যে নিজের হাতে খাওয়াত তাকে বড় করার জন্য। ওদের আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে লোকটার শরীরে মা ছেয়ে যাচ্ছিল। বিছিয়ে দিচ্ছিল নিজের শরীর, তাই তো আর ব্যথা লাগছিল না। পরম নিশ্চিন্তে লোকটা ঘুমিয়ে পড়ল ওই মাঝ রাস্তায়, এত লোকের সামনে।

পিঠের লোকটা তখনও নাবেনি।

 

৪৪.৫১১৫, –৯৩.১৪৩২  ১৪:১২:০৯   

৬১২-৯৯১-২৩৪৫, ২৩৪-৩১৬-৫০৪৮, ৫৬১-৩৩২-২০৭১, ৬১২-০৯৮-৫২৪২

জলটা গলায় ঢুকতেই গাটা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল লোকটার রক্তাক্ত মুখ। নাকটা থেঁতলে গিয়েছিল। উপুড় হয়ে পড়েছিল রাস্তায়। তবু মাথা তুলে জল চেয়েছিল একবার। সঙ্গে সঙ্গে পিছনের পুলিশটা এসে ওর পিঠে চেপে বসল আর মাথাটাকে আবার অ্যাসফাল্টের সঙ্গে ঘষটে দিল। লোকটা কি আর কিছু বলেছিল?

সামনের ঝাঁকড়াচুলো ছেলেটা বলল, দাঁড়া না দেখাচ্ছি।

–কীভাবে?
–তোরা এখানে ঢুকে গেলি, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শেষ অবধি মোবাইলে রেকর্ড করেছি।

‘শেষ’ শব্দটায় গভীর শ্বাস মিশে গিয়েছিল।

এতগুলো পুলিশের গাড়ি এসে গেল, সাইরেনের আওয়াজে কথা ডুবে যাচ্ছিল। তবু সেপাইদের বুটের আওয়াজ চাপা পড়েনি। চারদিকে ঘিরে দিল। লোকের ভিড় কমাতে টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ল। ওরা তিনজন পালিয়ে ঢুকে গেছিল এই কাফেতে। ওরা কাঁপছিল, ভয় পেয়েছিল। প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তো কারও। ভিড়ের থেকে একটা ঢ্যাঙ্গামত লোক একবার শুধু বলেছিল, এমন করে মারছ কেন, ও তো মরে যাবে।

পিঠে চেপে বসে থাকা লোকটা দাঁত বের করেছিল, অত সহজে মরলে তো সমস্যা ছিল না। ওর দাঁতে দুপুরে খাওয়া চারপেয়ে মাংসের দাগ লেগে ছিল।

যে পুলিশগুলো তাদেরকে ফুটপাথে ঠেলে রেখেছিল তাদের একজন হেঁড়ে গলায় বলল, হাজতে মারার থেকে এখানে মারাই ভাল, যদি সেটা দেখে মাদারচোদগুলোর শিক্ষা হয়।

ওরা ভয়ের শিক্ষা ভালই পেল। তা না হলে হুড়মুড় করে কেন এই কাফেতে ঢুকে পড়বে? ওদের না এখন আঠেরো বছর বয়স, রক্ত টগবগ করে ফোটার কথা, অন্যায় দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা? কিন্তু ভয় ব্যাপারটা এমনি। ভিতর থেকে জাঁকিয়ে বসে।

–আমরা কেমন ইঁদুরের মত গর্তে ঢুকে গেলাম। ফোঁস করে উঠল সবুজ চুলের মেয়েটা।

ঝাঁকড়াচুলো সবার শেষে কাফেতে ঢুকেছিল। ওকে হাত ধরে টেনেও নিয়ে আসা যায়নি। তারপর ঢুকেও নিজের মোবাইলে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল এতক্ষণ। এবার যখন মুখ তুলল, ওর মুখে একটা না হেরে যাওয়ার হাসি ছিল।

–বললাম না, সব এখানে আছে!

চারটে মাথা এবার ওর মোবাইলের স্ক্রিনে ঝুঁকে পড়ল। প্রায় শুরু থেকেই আছে। যখন লোকটাকে রাস্তায় ফেলে দিল, পিঠে চেপে বসল, রাস্তায় মাথা ঠুকে ঠুকে মুখটা দুমড়ে মুচড়ে দিল। সব। লোকটা জল খেতে চেয়েছিল, তার উত্তরে পেটমোটা পুলিশটা এসে মাথার পিছনে বুট চেপে ধরল। ধরেই রইল যতক্ষণ না ওর জল চাওয়া বন্ধ হয়। নিথর হয়ে গেল ওর শরীর। ওখানেই। এতগুলো লোক ছিল ওখানে, দুই একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ গুঞ্জনের মাথায় চড়ে ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়তে পারল না তবু।

–কী করবি এবার?
–আমি তোদেরকে দিলাম, সবদিকে ছড়িয়ে দে।

মুখে দাগওয়ালা ছেলেটা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার বলল, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।

–সেই দেওয়ালটা ভাঙতে হবে।
–প্রতিরোধ গড়তে হবে।
–তার জন্য সবাইকে জানাতে হবে। ভাইরাল করে দিতে হবে এই ভিডিও।
–বড় জমায়েত চাই। সবাইকে ডাকতে হবে।
–ঠিক, তারপর সবাই মিলে তিন নম্বর পুলিশ চৌকিতে যাব। শরীরটা ওখানেই নিয়ে গেল ওরা।

সবুজ চুলের মেয়েটা ঝাপসা চোখ থেকে ঘসে ঘসে জল মুছে বলল, আমরা আর ভয় পাব না। ওর চোখের কাজল ধেবড়ে গিয়ে চোখের সাদাটাকে বেশি বেশি জায়গা ছেড়ে দিল।

–ভয় পেতে কোনও দোষ নেই, মেনে নেওয়াটা অন্যায়।
–হ্যাঁ, আমরা ঘাড় গুঁজে চলে যাই বলে এত সহজে জিতে যাচ্ছে ওরা।
–আমাদের ছড়িয়ে যেতে হবে। ঝাঁকড়াচুলো একটু ভেবে ভেবে বলল— গ্রেস বেকারি, ২ নাম্বার ওয়াটার ট্যাঙ্ক, লাইটস অ্যান্ড গ্লো, হেভেন অন আর্থ। শহরের চারদিকটা ধরা হয়ে গেল। ওখানে সবাইকে ডাক দে। যে যেখানে আছে এই ভিডিও দেখে যেন এখুনি তাদের কাছাকাছি স্পটটায় চলে আসে।
–তারপর?
–ওখান থেকে আমরা তিন নম্বর চৌকির দিকে এগোব।
–আমরা সবাইকে নিয়ে এগোব? কিন্তু আমাদের কথা যদি না শোনে?
–যদির বেড়া ভাঙ, সময় নেই। বেরিয়ে পড়।
–কীভাবে যাব?
–বাসে, ট্যাক্সিতে, দৌড়ে। যেভাবে হয়।

 

৪৪.৯১০৭, –৯৩.২৮৪৩  ১৬:০৪:৩৮   

৬১২-১৩৪-৫১৩৪, ২৩৪-৩১৬-৫০৪৮,৫৬১-৪৬৫-২৩০৯, ৬১২-০৯৮-৫২৪২ , ৬১২-০৬৮-৩১৮৯, ,৬১২…….

সবুজ চুল জলের ট্যাঙ্কের নিচে যতক্ষণে পৌঁছাল, অন্তত শ দুয়েক হাজির। কোনও চেনামুখ দেখতে পেল না সে। মোবাইলে চোখ রাখল। দশ হাজার লোক দেখে ফেলেছে ভিডিওটা। এবার কী করতে হবে? সে দেখল শর্টস আর জার্সি পরা একটা ছেলে একটা উঁচু পাথরে উঠে কিছু একটা বলছে। সে কান পাতল।

–গায়ে রক্ত আছে? ফুটছে সেই রক্ত? টগবগ করছে?

হইহই আওয়াজ উঠল ভিড়ের মধ্যে। সবুজ চুল বুঝল তাকে আর কিছু করতে হবে না, এর পিছনে থাকলেই হবে।

আজ ওই রাস্তায় আমিও পড়ে থাকতে পারতাম। অথবা আপনি। তুমি, তুই, ও। যে কেউ। জল না পেয়ে নিজের রক্ত চেটে খেতে হত। আমরা কি ছেড়ে দেব ওই শুয়োরগুলোকে?

ঘূর্ণির মত না শব্দটা ভেসে গেল ওই জমায়েতের মাথার উপর।

–আমাদেরই এক ভাইয়ের শরীর এখন তিন নম্বর চৌকিতে। কী করব আমরা এখন?

সবুজ চুল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জমায়েতে এখন হাজারের বেশি লোক। সেই ভিড়ে এবার তুফান উঠল যা ঢেউ হয়ে তিন নম্বর চৌকিতে আছড়ে পড়তে চায়। ওই ছেলেটা নিজেকে ঢেউয়ের মাথায় চাপিয়ে ছুটে চলেছে এখন। মেয়েটা জমায়েতের ছবি আপলোড করে জানিয়ে দিল জলের ট্যাঙ্ক থেকে মিছিল চলেছে তিন নম্বর চৌকি।

 

৪৪.৮৮০১, – ৯৩.২৭৪৩  ১৬:২৪:৩৮   

৫৬১-৩৩২-২০৭১, ২৩৪-৪২৫-৬১৩৯,৬৬১-৭৬৫-৯০১৩, ৬১২-০৯৮-৬১৩৪ , ৬১২-০৩৪-৯০১২, ,৬১২…….

গ্রেস বেকারির সামনের কাঁচের দরজাটা ভেঙে কাঠামো থেকে ঝুলছে। দোকানের দেওয়ালে এখন তার মুখের মতই খোদরাবোদরা দাগ। ছেলেটা এসে পৌঁছানোর আগেই লোক জড়ো হতে শুরু করেছিল। হল্লা চলেছে। চারপাশের অন্য দোকানগুলো শাটার নাবিয়ে দিয়েছে। গ্রেস বেকারির মধ্যে ঢুকে অনেকে চেয়ার টেবিল উল্টেছে। ছেলেটা একটা টেবিল টেনে নিয়ে তার উপরে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মুখের সামনে হাতদুটো চোঙার মত জড়ো করে দিল এক বিশাল হাঁক। মঞ্চে উঠে চ্যাঁচানোর অভ্যাস আছে তার। থামো সবাই! এই দোকান ভাঙার জন্য তোমাদের ডাকা হয়নি! থামো!

চার পাশের দোকানের বন্ধ দরজায় ধাক্কা খেয়ে থামো শব্দটা কবার ঘুরপাক খেতেই থমকে দাঁড়াল ক্রুদ্ধ জনতা।

–শুনতে পাচ্ছ?
–হ্যাঁ। সমস্বরে আওয়াজ উঠল।
–দেখেছ ভিডিওটা?

এবার গর্জে উঠল এই ভিড়।

একজনের খেলার ব্যাট দোকানের জানালায় আছড়ে পড়তেই ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ল। লোকজন আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখানে ঝাঁকরাচুলো থাকলে সুবিধা হত।

চারপাশে পড়ে থাকা কাঁচের টুকরো মারিয়ে তিন নম্বর চৌকির দিকে দৌড়াচ্ছিল জনতা।

 

৪৪.৯৮৬৬, – ৯৩.২৫৮১  ১৮:১৪:১০

৬১২-৬৭৩-৫২৭৫, ৬১২-৪২৫-১১৩৯,৬১২-৭৫৫-৮০২৫, ৬১২-০৯৮-৬১৩৭ , ৬১২-০৩৪-৮১৩৬

–শহরের চারদিক থেকে লোক আসছে এদিকে।
–এদিকেই আসছে কী করে জানলে?
–প্রতি মুহূর্তে মেসেজ আসছে, কোন রাস্তায় যাচ্ছে জানিয়ে আরও লোককে আসতে বলছে।
–কত লোক মনে হয়?
–উত্তরে দশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দক্ষিণে চার। পশ্চিমে কুড়ি হাজার। হবেই তো, ওদের লোক ওখানেই বেশি। ভাঙচুর হচ্ছে। পূব দিকে জলের ট্যাঙ্কের ওখানে শুরুতে হাজার খানেক ছিল। কিন্তু পথ চলতে চলতে এখন সেটা সাত হাজারে দাঁড়িয়েছে, আরও বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে।
–যেখানে বডি পড়ল, সেখানে কত লোক?
–হাজার পাঁচেক সিগন্যাল পাচ্ছি।
–একসঙ্গে শহরের চারদিক থেকে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল? দেখো তো তিনটে পনেরোর সময়ে স্পটে ছিল এমন কোনও নাম্বার এই চারটে জায়গার কোথাও গেছে কি না।

 

৪৪.৯৮৬৬, – ৯৩.২৫৮১  ২১:০১:৫২     

৬১২- ৫৩৪-৮০৪৩, ৬১২-৯৯১-২৩৪৫, ২৩৪-৩১৬-৫০৪৮,৫৬১-৩৩২-২০৭১,৬১২-৮৪৫-৭৬৯৯, ৬১২-০৯৮-৫২৪২,৬১২…….

ঝাঁকড়া চুল রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুলটা ঝুঁটি বাঁধছিল। সবুজ চুল ওর দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকাল। জনতা যে ক্ষেপে উঠেছে, এবার কে ওদের পথ দেখাবে?

চুলের ঝুঁটিতে ঘোড়ার লেজের মত আদর আদর করতে করতে সবুজ চুলের দিকে তাকিয়ে হাসল ছেলেটা।  বাইরে থেকে লোক এসে রাস্তা দেখানোর দরকার নেই। মানুষকে মানুষের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে, তারপর তারা নিজেদের পথ বানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাবে।

জুড়বে কী করে?

ছেলেটার সাদা দাঁতের হাসিটায় শিশুর সারল্য আর যৌবনের অহঙ্কার মিলেমিশে ছিল। সে হাত তুলে মোবাইলটা দেখাল। জুড়ে গেছে বলেই না সবার চোখের জল মিশে এমন ঢেউ তৈরি হয়েছে, দেখছ না সামনে? এখন শুধু আছড়ে পড়ার অপেক্ষা।

খোদরাবোদরা মুখের ছেলেটাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। লোকজন অশান্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পশ্চিমের লোকেরা। ওরা গ্রেস বেকারিকে তছনছ করে দিয়েছে। খুব ক্ষতি হয়ে গেছে দোকানটায়।

বড় বড় কাজে এমন ছোটখাটো ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো যায় না। ছেলেটা সাবানের বাবল হাওয়ায় ছুঁড়ে দেওয়ার মত হাসি বানাচ্ছিল।

কিন্তু ওরা এখানেও যে গণ্ডগোল পাকাতে চলেছে। তিন নম্বর চৌকিতে আগুন লাগাতে চায়।

খবর ছড়িয়ে দাও বডি এখন মেন হাসপাতালে নিয়ে চলে গ্যাছে। তিন নম্বর চৌকিতে কোন সেপাইও নেই আর। এত লোক দেখে ভয় পেয়ে সবকটা পালিয়েছে। এখানে হল্লা করে আর কোনও লাভ নেই। আমাদের এখন মেন হাসপাতালের দিকে যেতে হবে।

খবরটা ছড়াতে অনেক লোক মিছিল করে হাসপাতালের দিকে চলল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা হল্লাও উঠল। এক দঙ্গল লোক হইহই করে তিন নম্বর চৌকির দিকে ছুটল। তারপর জ্বলে উঠল আগুন। চারপাশের অন্ধকার সরিয়ে আকাশ পাহাড়ি ডিমের কুসুমের মত লাল হয়ে উঠল।

সবুজ চুল ভয় পেয়ে ঝুঁটিওলার কবজি পাকড়ে ধরেছিল। এটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?

সে নির্নিমেষ আগুনের দিকে তাকিয়েছিল। আগুনের আলোয় ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। ধীর গলায় বলল, ভয় ভাঙার দিন এমনি করেই উৎসবের আলো জ্বলে।

 

৪৪.২৩১৫, –৯৩.৭৪১৮  ২০:৩১:০১   

৬১২-৯৯১-২৩৪৫, ২৩৪-৩১৬-৫০৪৮,৫৬১-৩৩২-২০৭১, ৬১২-০৯৮-৫২৪২

–আজকের দিনটা অদ্ভুত ছিল। তাই না? ঠিক স্বপ্নের মত। চুলের সবুজ আবেশ মেয়েটার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
–এই দুনিয়া অপেক্ষা করে থাকে স্বপ্নের সংঘবদ্ধ আস্ফালনের। ঝুঁটিধর স্মিত হাস্যে বলেছিল। জয়ের তৃপ্তি তার পেশিতে, চোখের ভাষায়, মুখের কথায়।
–মানুষকে জাগিয়ে তোলা গেছে। অন্ধকারে খোদরাবোদরার মুখ এখন পেলব।
–মানুষ যখন জেগে স্বপ্ন দেখে দুনিয়া কেঁপে ওঠে। চোখের তারা চিকচিক করে ওঠে সবার।

ঝুঁটিধরের ডান হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে সবুজ চুল চোখে চোখ ভাসায়। ভাবতেও অবাক লাগছে, আমরা কীভাবে সারা শহরকে একসঙ্গে জড়ো করলাম?

–কোনও নেতা ছাড়াই।

ঝুঁটি থেকে রাবার ব্যান্ডটা খুলে ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল জোরে। আমরা করিনি। তারপর ডান হাতটা তুলে মোবাইলটা দেখাল। এর কেরামতি।

ওরা সবাই মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে হাত উপরে করে নাড়ছিল, ঠিক যেমন কোন কনসার্টে করে।

–আমার কিন্তু ভয় করছে?
–কেন?
–ওরা এরপর দলবল নিয়ে আসবে।
–কার পিছনে? ওদের তাহলে পুরো শহরকে ঘিরে ফেলতে হবে।
–এ বিপ্লবে কোনও নেতা নেই।
–এই মিছিলে অনেক মুখ।
–কেউ আগে নেই, কেউ পিছিয়ে নেই।
–মশাল সবার হাতে হাতে ছড়িয়ে যাবে। শহর থেকে শহরে, বন্দর থেকে কন্দরে।
–এর টুঁটি চেপা যাবে না।
–স্বপ্নের শ্বাসরোধ করা যায় না।

ঝাঁকড়া চুল আবার কথার রাশ ধরে।

–কালকের প্ল্যান সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে?
–হ্যাঁ সকাল আটটায়, সিটি পার্ক।

ওদের শরীর উত্তেজনায় টানটান হয়েছিল। এই অবস্থায় বাড়ি ফেরা যায় না। তবু ফিরতে হবে। সবুজ মেয়েটা নিজের ঘরে ফিরবে, ঝাঁকড়া চুলের হাতের আঙুলে আঙুল এমনভাবে জড়িয়েছিল যে ওকেও সঙ্গে যেতে হল।

 

৪৪.২৭৪৫, – ৯৩.৩১১৮ ; ০১:১৪:৫০     

২৩৪-৩১৬-৫০৪৮, ৬১২-০৯৮-৫২৪২

ঝুঁটি খুলে ছেলেটা এখন চিত হয়ে শুয়েছিল। ওর চুল এখন সিংহের কেশরের মত সারা মুখ জড়িয়ে রেখেছে। ভাবনার কুয়াশা চোখে ভিড় করলেও মুখের তৃপ্তিটা দৃষ্টি এড়ায় না।

মোবাইলে চোখ রেখে সবুজ চুল বলল, দেখেছ তো কীভাবে সব খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কিসের ভাবনা?

ছেলেটা জোরে শ্বাস নিল। এই পথ জুড়ে ছড়ানোছিটানো থাকবে আগুন। সেই আগুন টপকে টপকে যেতে হবে আমাদের।

আছে তো সবাই সঙ্গে। আমরা করব জয়। গুনগুন করে উঠল মেয়েটা।

জানে ছেলেটা। সবাইকে জুড়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু তবু কি এক নিঃসঙ্গতা জেঁকে ধরে তাকে।

সবুজ চুল ওর নরম ঠোঁট এখন ছেলেটার মুখে চেপে ধরে গানের শব্দ আঁকতে থাকল। হচ্ছিল নিশ্বাসের স্থানবদল।

ছেলেটা নিজের ঠোঁটকে মুক্ত করল তার ভাবনাকে একটা একটা করে শব্দে ভরে দেওয়ার জন্য। কখনও সেই আগুন আমাদের গ্রাসও করতে পারে। ঠিক যেমন ওই লোকটাকে হারালাম আজ। সেই মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ না হওয়া অবধি আমাদের শোকের কাল। এমনভাবে বলল যেন এক সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

মেয়েটা ঠোঁট ফোলাল, রক্তে শোক নিয়ে বুঝি গান গাওয়া মানা?

–গান নয়, এখন মশাল জ্বালাবার সময়।

মেয়েটা হাসিতে ছড়াল। বেশ, তাহলে আমি আগুন হই।

–বাহ, তাহলে আমি কে ?
–তুমি হবে মশাল। মশাল জ্বালাবার সময় কি হয়নি এখনও?

অনেকক্ষণ বাদে হাসল ছেলেটা। মেয়েটার দুহাতের সব কটা আঙুলে আঙুল জড়াল। তাহলে চলো, মশাল জ্বালিয়ে আমরা পেরিয়ে যাই শহর নগর প্রান্তর।

মশাল জ্বলল।

 

৪৪.৯৮৬৬, – ৯৩.২৫৮১  ০০:২৪:৪০    

৬১২-৬৭৩-৫২৭৫, ৬১২-৪২৫-১১৩৯

–কে প্রথম আপলোড করেছিল?
–৬১২-০৯৮-৫২৪২।
–চুতিয়াটা স্পটে ছিল?
–হ্যাঁ।
–কাফেতেও?
–ওখানেই দল পাকাচ্ছিল।
–তারপর?
–হেভেন অন আর্থ।
–তিন নম্বর চৌকিতে?
–এই বাঞ্চোতটাই নাটের গুরু। ও তো থাকবেই।
–এখন কোথায়?
–৪৪.২৭৪৫, – ৯৩.৩১১৮।
–একা, না আর কেউ আছে?
–২৩৪-৩১৬-৫০৪৮। এও তিন নম্বর চৌকিতে ছিল।
–ওদের ওড়ার খুব শখ, উড়তে দাও।
–উড়িয়ে দেব?
–একদম।

 

৪৪.২৭৪৫, – ৯৩.৩১১৮ ; ০১:১৪:৫০     

২৩৪-৩১৬-৫০৪৮৬১২-০৯৮-৫২৪২, ৬১২-৬৭৩-৫২৭৫,

৬১২-৪২৫-১১৩৯

ছেলেটা বালিশে হেলান দিয়ে উল্টোদিকের জানালা দিয়ে কাঁচা হলুদরঙা চাঁদটা দেখতে পাচ্ছিল। তার মনে হল, পৃথিবীটা স্বপ্নের মত হতে পারে।

মেয়েটা ওর বুকে মাথা রেখে ভাবল, জীবনটা এখনই কি স্বপ্নের মত নয়?

ঠিক সেই সময়ে বুটের ধাক্কায় ওদের ঘরের দরজা ভেঙে পড়ল। ঢুকে আসল সেই লোকেরা। ছুটে এল আগুন।

আগুনবৃষ্টি থামার পরেও ছেলেটার মাথার দুদিকে ছড়ানো দুই হাত ধরেছিল আরও দুটি হাত। ওর বুকে লুটিয়ে রইল সবুজ চুল, গানের শেষ শব্দটা তখনও ওর ঠোঁটের কিনারায় ঝুলছে।

দুপাশে রাখা দুটো মোবাইলে তখনও অজস্র মেসেজ আসছে টুংটাং শব্দে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...