কাঞ্চন দাস
তখন সে কী কী দ্যাখে?
????????????????
????????????????
ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে যখন কেউ হেঁটে যায় তখন সে ঠিক কী কী দ্যাখে আমি বলতে পারব না। কেননা সেই কারশেডের মধ্যে আমি কখনও প্রবেশ করিনি, জংশন থেকে যেখানে ক্লান্ত ও বিষণ্ণ রেলগাড়িদের পাঠানো হয় মুক্তিস্নানের জন্য। তবে বিশেষ করে শীতকালের ভোরবেলায় সূর্যোদয় হতে যখন বেশ কিছু সময় বাকি, আপদমস্তক চাদরমুড়ি দিয়ে এসে দাঁড়াতাম সেই প্রাচীন সেতুর উপর, বার্ডস-আই-ভিউ থেকে লক্ষ করতাম রহস্যময় কারশেডের চলচ্চিত্র।
কী দেখতাম?
দেখতাম ইঞ্জিনের ক্ষুধার্ত উদর থেকে গলগল করে রাশি রাশি সাদা ধোঁয়াদের কুয়াশাবন্দি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে। যেন আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষার আকারগত ইচ্ছের কাছে বাধ্য সমর্পণ। অবাধ্য যে গ্লানি, ঘনকৃষ্ণবর্ণ কেতনের মতো উড়িয়ে দিতে চাইত তার শোকগাথা পেঁজা তুলোর তুষারশুভ্র রাজত্বে।
আর কী দেখতাম?
দেখতাম তার ভিতরের সৈনিকদের, হাতে লোহার যন্ত্রপাতি, দৈর্ঘ্যপ্রস্থ মাপার ফিতে, মাথায় টুপি, পরনে খাকি কিংবা নীল ইউনিফর্ম। একজোড়া ঠ্যাং নিয়ে তারা ইতস্তত ঘোরাফেরা করত। আর পরক্ষণেই নির্গত ধোঁয়ার আস্তরণ তাদের ঢেকে দিত পুরোপুরি, ধোঁয়া পাতলা হয়ে এলে শ্রমিকরা অদৃশ্য হয়ে যেত ম্যাজিকের মতো। শুধু সেই গল্পের অস্পষ্টতার ভিতর দেখা যেত আরও অস্বচ্ছ একটি লোকাল ট্রেনের মাথা। কারশেড থেকে বেরিয়ে সে যেত প্ল্যাটফর্মের দিকে, আবার উল্টো দিক থেকে খয়েরি রঙের একটি মেল ট্রেনকেও দেখতাম কারশেডের দিকে আসতে। সাদা কালো গল্পের রহস্যের মধ্যে প্রবেশ করে উধাও হয়ে যেত এক সময় সেও। এরপর মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এরোপ্লেন, স্বচ্ছনীল আকাশের মুক্তাঙ্গন ফিরে পেয়ে উজ্জ্বল হাঁসেদের মতো যেমন মহানন্দে দুটি ডানা ছড়িয়ে দিয়ে তার সর্বাংশ উৎসর্গ করে দেয় শূন্যে, তেমন স্পষ্ট আনন্দের ভিতর দিয়ে উঠে এসে দাঁড়াত শ্রমিকেরা, একই ছন্দে একই দূরত্ব তাদের। হাতে ধরা হোসপাইপ। কারশেডে গাড়ি ঢুকলেই তারা সেই হোসপাইপ থেকে জলের ফোয়ারা ছুড়ে দিত কামরার গায়ে, পেটের ভিতর ঢুকত তারপর। ধর্ষণের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে যেন বদ্ধপরিকর। ……… অন্ধকার কেটে গিয়ে সূর্যোদয়ের সময় হয়ে আসত। গর্ত থেকে বেরিয়ে ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠত রাস্তাঘাট। অরেঞ্জ রঙের বিভা কালিঝুলিমাখা শ্রমিকদের মুখের উপরে পড়ে সৃষ্টি করত রেমব্রান্টিয় ছায়াপথের, পক্ষীচক্ষু থেকে দেখা সেইসব দৃশ্যগত সৌন্দর্য ছাড়া ধোঁয়া সম্বন্ধে আমার আর বিশেষ কোনও অভিজ্ঞতা নেই, যা আমাদের সেই অনিবার্যতা থেকে মুক্তি চাইবার ঝুঁকি নিতে সাহায্য করে।
নেই বললে ভুল হবে। অন্তত আমার মায়ের জেনারেশন অবধি আমি অনেক গরিব বাঙালি মহিলাদের দেখেছি যারা মুখের ফুঁ-এ এবং অসহ্যরকম ধৈর্যের সঙ্গে তালপাতার হাতপাখা নাড়াতে নাড়াতে মাটির উনুন ধরাতেন। উনুনের ধোঁয়া তাদের পুরোপুরি গ্রাস করে নিত। দাম্পত্যজীবন যাদের কাছে ছিল মস্তবড় মরীচিকার মতো। সেই ধোঁয়া ও মরীচিকার মধ্যে ক্যাকটাসের কাঁটা ও সৌন্দর্য নিয়ে বেড়ে উঠত তাদের স্বপ্নের ফসল।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি আলুক্ষেত আর ধানজমির ওধারে খড়ের চালের একটি বাড়ি, ১৯৮৫ সালের প্রথমদিকে গোটা একটা গ্রাম, তারপরের বছর রাসায়নিক সারের কারখানা (ট্রেন থেকে কলকাতা শহরে যাবার পথে যাকে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম) এবং সেই বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি বিশেষ থিয়েটার হল আর এই বছরের সেই অভিশপ্ত দুপুর, যেদিন এ পাড়ার গাঙ্গুলি জেঠিমা দাউদাউ করে জ্বলে উঠে ভয়ানক আর্তনাদ করতে করতে পুড়ে গিয়েছিল— পরে জেনেছিলাম বিধবা অসহায় জেঠিমাকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছিল তার বড় বউ— আর সে কাজে উৎসাহিত করেছিল তার মদ্যপ স্বামী, তার নামে বাড়ি আর সম্পত্তি উইল না করে দেওয়ার ব্যপারে কঠোর থাকার অপরাধে এবং প্রশাসনিক দলের সহযোগিতায় খুব সহজেই তারা থানা পুলিশ কেস আদালত থেকে সম্মানের সঙ্গে মুক্তি পেতে সফল হয়েছিল— এইসব, স্বচক্ষে, আগুন এবং ধোঁয়াকেন্দ্রিক ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ওহোঃ, আরও একটা ঘটনার সামনে দাঁড়িয়ে আমার খুব প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এই দু এক বছর আগে একটা পুলিশের জিপ জ্বলছিল দাউদাউ করে আর তাকে ঘিরে ক্রুদ্ধ জনতা হাত পা ছুড়ছিল। দুর্নীতিটা ছিল অনেক গভীরে। কিছু পুলিশ জড়িত ছিল, সমাজবিরোধীদের মদত দিয়ে যাচ্ছিল, বেশ মোটা টাকার লেনদেন যে চলত এটা পরিষ্কার কেননা জায়গাটা ছিল সমাজবিরোধীদের স্বর্গ। এইসব কথার কোনও লিখিত প্রমাণ থাকে না। সম্ভবও নয়, তবে পুলিশের লোকেরা (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই) যে প্রশাসনিক দলের গোলাম, আর প্রশাসনিক দলের লোকজন (দুর্নীতিপ্রবণ) যে সমাজবিরোধীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তার কাজকর্ম চালায় এসব ‘সহজ পাঠের’ মতো বাচ্চা বুড়ো সবারই জানা। লেলিহান অগ্নিশিখা এবং ধোঁয়ার উল্লাস প্রায় সবক্ষেত্রে ছিল একইরকম। কেবল কাঁটা কম্পাসের মতো দাঁড়িয়ে আর দুপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা বৃত্তচাপ আঁকা ছাড়া কোনওক্ষেত্রেই আমার আর কিছুই করবার ছিল না।
উঁচু এবং নিচু ধোঁয়া সম্বন্ধে এই হল আমার প্রাথমিক বাহ্যদর্শন…
ধোঁয়াদের সঙ্গে আমার আর যেখানে যেখানে সাক্ষাৎ হয়েছে:
১) চায়ের দোকানে। সেখানে দুজন দেহাতি বৃদ্ধ বিড়ি টানতে টানতে পরস্পর গ্রাম্য ভাষায় তাদের দুঃখের কথা বলছিল, তারা এমন নেতিবাচকভাবে জীবনকে তুলে ধরতে চাইছিল যে, তাদের কথাগুলো বিড়িজাত নিকোটিন এবং ধোঁয়ার মধ্যেই যথাযথভাবে আকারগ্রস্ত হয়ে প্রদক্ষিণ করছিল। আমার দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছিল কিনা জানি না, দেখলাম দুই বৃদ্ধ ক্রমশ ধোঁয়ায় রূপান্তরিত হয়ে ঘুরতে লাগল খুব শান্তভাবে এবং দক্ষিণদিকের বারোয়ারি দুর্গামণ্ডপের দিকে উড়ে গেল হাত ধরাধরি করে।
২) আমাদের সান্ধ্য আড্ডায়। যেখানে ডাক্তার, মাস্টার, বাউন্ডুলে, বেকার, অঙ্ক জানা খিটখিটে দোকানি, পার্টির লেজধরা চামচে, ক্ষুধার্ত কামুক, ওলাইচন্ডি, ব্যর্থ শেয়ারহোল্ডার, ক্ষ্যাপা শিল্পী, মদ্যপ সমাজখেদানো কবি, ধূর্ত খেলোয়াড়— কে না থাকত। সে এক যজ্ঞ। এ চাটত ওকে, ও চাটত তাকে। তবে এদের মধ্যে এক-একজন ছিল খুব সরল আর বোকা। একজন সাংঘাতিক আত্মকেন্দ্রিক। একজন নিজেকে একটু উঁচু জায়গায় রাখতে ভালোবাসত, জবাই করতে চাইত সেই বোকা আর সরল ছেলেদুটোকে। আর একজন খুব লেকচার দিয়ে অকাট্য যুক্তির ধারাল ভাষণে সাংঘাতিক একটা আন্দোলন করতে চাইত এবং শেষমেশ কিছুই করতে না পারে ‘বাকি জীবনটা টাকার পিছনে ছুটিয়ে দিত’। কিন্তু সবার সঙ্গে একটা ব্যপারেই মিল ছিল খুব। সে হল ওই ধোঁয়া। সক্কলে একেবারে নেশারু হয়ে উঠেছিলাম। শেষপর্যন্ত এমন হল যে ধোঁয়ার ভিতরে কতকগুলো কালো মাথা ছাড়া আমরা আর কিছুই দেখতে পেতাম না।…
৩) সাড়ে তিন হাত ময়লা সাদা কাপড়টা কোনও রকমে শরীরে জড়িয়ে সেই পেটানো চেহারার প্রৌঢ়া, কুচকুচে কালো মহিলা মজুরটিকে আমি আজও ভুলতে পারিনি। বটগাছের নীচে বসে একটা একবিঘৎ লম্বা বিড়ির মুখ, কর্মঠ এবং কড়া দুই হাতের তালুর আড়ালে দেশলাই জ্বালিয়ে সে যখন ধরাচ্ছিল তাকে দেখে আমার একটুও মনে হয়নি যে ধোঁয়াপানের নেশা ফুসফুস কিম্বা হৃৎপিণ্ডকে দুর্বল করে দেয়।………
৪) কফিহাউসে বসে আমরা এস্ট্যাবলিশমেন্টের গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে কলেজপড়ুয়া সুন্দরী আর সেক্সি মেয়েদের শরীর প্রদক্ষিণ করছিলাম, দেখছিলাম তাদের ফর্সা ও লোমশ পায়ের ডিম, রহস্য রোমাঞ্চকর ভ্রমণের মতো তলপেট ও নাভি, ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাতে ভেসে চলা রাজহাঁসের মতো ঈষৎ উন্মুক্ত বক্ষদেশ এবং মাঝেমাঝেই আমাদের গল্প এঁকে বেঁকে সেইসব আলোকপ্রাপ্ত টেবিলের নরম ছায়ার বৃত্তে পোষা ডোবারম্যানের মতো গিয়ে আশ্রয় নিত, তখনই আমার চোখ পড়ে যেত আর একজনের দিকে। সে আসত একা, একটা ব্ল্যাক কফির গ্লাস নিয়ে কাটাত একঘন্টা— কোনওদিকেই তাকে কোনওদিকে তাকাতে দেখিনি। কোনও বন্ধু বা শত্রু ছিল না তার। কোথা থেকে আসত কে জানে তার উপর কারও কোনও আগ্রহও দেখিনি। কিন্তু অবচেতন মনে প্রত্যেক টেবিল থেকে প্রত্যেকটা চোখ তার একটা অদ্ভুত খেলার উপর রাজ্যের কৌতূহল ও বিস্ময় নিয়ে যেন লক্ষ করত। খেলাটা তেমন কিছু নয়। জলের গ্লাস ফাঁকা হলে সে একটা সিগারেট ধরাত আর ধোঁয়াটা জমা করত গ্লাসের মধ্যে। হাত দিয়ে চাপা রাখত গ্লাসের মুখ। গোটা সিগারেটের ধোঁয়া জমা হতে হতে সেটা যখন দুধের গ্লাসের মতো দেখাত, তখন আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে নিয়ে নিভন্ত সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে, ঈষৎ ঠোঁট বেঁকিয়ে, চেয়ারে হেলান দিয়ে তারপর সে বসে থাকত একটা আস্ত ইডিয়টের মতো। কিন্তু সামান্য একটা কাঁচের গ্লাস সেইমুহূর্তে পরিণত হয়ে উঠত অসাধারণ এক স্বর্গীয় দ্রব্যে। জমাট থাকার কারণে সেই দুধ রঙের ধোঁয়া স্লো-মশন পিকচারের মতো ধীরে ধীরে গোল হয়ে উঠে যেত উপরে। মনে হত পৃথিবীর সব আগুনকে লোকটা ম্যাজিকের মতো শান্তিকপোত করে একটা গ্লাসের মধ্যে পুড়ে ফেলেছে এবং সেইসব কপোতেরা একসঙ্গে মিশে গিয়ে নিঃশব্দে যেখানে উড়ে যাচ্ছে সে জায়গাটা আমাদের কারও জানা নেই, নেই কিন্তু কৌতূহল আছে, সদিচ্ছা আছে তবু কী যেন এক অহংবোধ আমাদের আটকে রেখেছে আমাদেরই স্বরচিত এক একটি মায়াবৃত্তে। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম ব্রিটিশ আমলের দেওয়াল ঘড়িটা, যেটা ক্যাশিয়ারের ঠিক মাথার উপরটায় টিকটিক করে আসছে একশো বছর ধরে, সেখানে ঠিক রাত আটটায় কাঁটাগুলো যাওয়া মাত্রই শেষ হয়ে যেত গ্লাসের ধোঁয়া, আর রহস্যজনক খোঁচা খোঁচা দাড়িওলা সেই লোকটা পরাজিত মানুষদের মতো উদাসীনভাবে হাউস থেকে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেত আস্তে আস্তে ট্রামলাইনটার ওধারে অথবা পুরনো বই-এর দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যেত আর পাঁচজনের মতো। তার রচিত সেই ধোঁয়ার মুগ্ধতা আমাদের এতটাই অবশ করে দিত যে তাই নিয়ে কেউ আর আলোচনার মধ্যে যাইনি কোনওদিন।
উঁচু এবং নিচু ধোঁয়া সম্বন্ধে এই হল আমার বাহ্যদর্শন।
আর দর্শন হল এমনই একটি আপেক্ষিক শব্দ— রৌদ্র ও ছায়ার মতো স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যার সংজ্ঞা ও রূপ পরিবর্তিত হয়। আসলে আমরা তো জানি ultimate বলে জগতে কিছুই নেই।
ULTIMATE বলে জগতে কিছুই নেই, জীবনে তো নেই-ই।
বিপলের জীবনেও তেমন কোনও ঘটনা নেই যা শুনে মনে হতে পারে সত্যিই একজন বিপর্যস্ত কবি শিল্পীকে এরকম উথালপাথাল অবস্থার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। দুবেলা দুমুঠো খেতে সে পেয়েছে। আশ্রয়ও আছে। কেবল যখন তার চাকরি করাই উচিত ছিল, পরিবারকে দেখাশোনা করাই ছিল কর্তব্য, প্রতিবেশীদের কাছে তার শিক্ষার মানদণ্ডকে একটা সম্মানজনক সফলতায় প্রদর্শন করাই ঠিক কাজ হত এবং বাস্তবিক নিজেকে একজন সুস্থ নাগরিক করে তুলে মহালক্ষ্মীর চরণকমলে দুশ্চিন্তাহীন একটা জীবন উৎসর্গ করে দেশের ও দশের সেবা করাই হত বুদ্ধিমানের কাজ, ঠিক তখনই মূলেই বিনাশ করেছিল সে সমস্ত সম্ভবনার অঙ্কুর। বন্ধুরা বলেছিল ‘নির্বুদ্ধিতা’। আত্মীয়স্বজন ফিসফাস করত সন্দেহ করে, প্রতিবেশীদের সরস্বতীর ছায়া না মারানো, আলু আর ছাগলের ব্যবসায় মনোযোগ দেওয়া সাহাবাড়ির লেটেস্ট জেনারেশন এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা খিস্তি দিয়ে বলেছিল— ‘এই বাজারে, ছাড়ো তো মামা ওসব বাংলা গল্প…।’ ছিল ইনক্রিমেন্ট, পেনশন, গ্র্যাচুইটি, বিদেশ ভ্রমণ, ফ্ল্যাট, ফ্রি মেডিকেল, ছিল নিশ্চয়তা, সুস্থ জীবন, অনন্ত সুযোগ, আলো… বিপলকে এইসব ছোবল মারে— অভাব, দারিদ্র্য, টিটকিরি, তাচ্ছিল্য। তবু মৃত্যুর নীল কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে পড়া আর বেঁচে ওঠার জাগলিং নিয়তির মতো নেমে আসে তার জীবনে, তার শরীরের মধ্যে মস্তিষ্কের মধ্যে বাসা বাধে। তবুও চাকরি ছাড়ার বিলাসিতা মানায় জিনিয়াসকে। লুডোখেলার ছক্কার মতো চাকরি ছাড়া বা না ছাড়া, বেঁচে থাকা বা বেঁচে ওঠার মধ্যে যে সাঁকো, যা তারা প্রতিনিয়ত ব্রহ্মত্ববোধের মহা চৈতন্যের ভিতর ভেঙে ফেলে ও উৎপন্ন করে। এই জগতের যা কিছু জাগতিক, যোগ বিয়োগ গুন ভাগের ফল হিসেবে আমাদের কাছে বিচার পায়, পরমব্রহ্মের দিকে যাত্রাপথে জিনিয়াসের কাছে অঙ্ক নয়, তা হল অখন্ড একটি ইতিহাস, কিংবা তাও নয়, হয়তো একটি বৈদ্যুতিক তারের মতো, যার একপ্রান্তে কাল আর অন্যপ্রান্তে মহাকাল টাইম ও স্পেসে বাঁধা-যার মধ্যবর্তী হয়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ ও বিদ্যুৎক্ষরণের শিল্প রচনা করে চলে। আমরা বলি— ‘ইনট্যালেকচুয়্যাল ক্রাইসিস’। কিন্তু বিপলের সেই ক্রাইসিস নেই। জাগতিক আর পরমব্রহ্ম তার কাছে দুই-ই সমান… একটা নদীর মতোই সহজ। আসলে একেক সময় স্বাধীনতাবোধের উন্মাদনা তাকে অস্থির করে তোলে। একটা অপ্রাকৃতশক্তি সব বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে টান মারে। টানটান হয়ে আকাশ আর মাটির মধ্যবর্তী অস্তিত্বের ভার্টিক্যাল কল্পনা তাকে আরাম দেয়, উৎসাহ দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির সঙ্গে adjustment করার অক্ষমতা, নিজ মুন্ডচ্ছেদ করার নির্বুদ্ধিতা, আত্মনিগ্রহের লোভ, বাস্তব জ্ঞানের অভাব- চরিত্রের এই দোষগুলো কেবল স্বাধীনতা অর্জন করার সততা দিয়ে বিপল ঢাকতে পারে না। একজন মানুষও যেমন পারে না, তেমন একজন কবিও নয়…।
(এটা খণ্ডচিত্র। যার শুরুটাই হল একটা ছোট ধোঁয়ার বৃত্তে, এবং এটাকে আর টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা পাঠক স্বয়ং সেই বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক সচল আত্মজীবনী প্রত্যক্ষ করে যা কখনওই তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং সেটা কখনও অখণ্ড নয়, খণ্ড খণ্ড দ্বীপের মতো, যারা প্রত্যেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ অথবা অসম্পূর্ণ, যা একটুর জন্যে হয়ে যেতে পারত অন্যরকম)।
আমরা বরং চৌধুরীর গল্পে এসে একটু দম নিয়ে নিই। ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে কেউ যখন হেঁটে যায় তাকে আমরা এইভাবে সহজ করে দেখার চেষ্টা করতেই পারি। কিছুটা পথ আর কিছুটা সময় তো সেইভাবেই ধরা দিতে চায়, যদিও তা খুব দীর্ঘ হতে পারে না, তবু সন্ধে নেমে আসার আগে আমরা নদীর পার ধরে একটু হেঁটে যাই…।
কিস্যা চৌধুরীকা
……………… চৌধুরীকে আমরা সরেজমিন তদন্তের পর প্রায় সবাই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলাম যে, সে চূড়ান্ত স্বার্থপর আর সুযোগসন্ধানী। দূর থেকে দেখলেই আমাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হত। বাবলু বলত, ‘শালা কাটার বাচ্চা কাটা।’ স্বপন বলত— ‘ঠিকই বলেছে মামা, শালা বজ্জাতের বজ্জাত। পদে পদে মিথ্যে কথা।’ সে কাউকে বিশ্বাস করত না, বন্ধু হয়েও আমাদের দলে মিশতে পারত না। কেননা নির্ভেজাল আড্ডা চলাকালীন যখন সে এসে মিশতে চাইত, তার চোখদুটো চকচক করত। আমাদের প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুযায়ী যোগাযোগের যে ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ গন্ডি সেটাকে প্রতি সেকেন্ডে কীভাবে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে gain করা যায় তার অক্লান্ত চেষ্টা, কিন্তু তার মনোবাঞ্ছাকে সবার চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখার একটা দূর্ত প্রচেষ্টাও চৌধুরীর চোখেমুখে ফুটে উঠত প্রকটভাবে, তবে যেহেতু সেটা তেমন মারাত্মক ক্ষতিকর মানুষদের মতো ছিল না, ফলে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তৈরি হত টানটান একটা টেনশন। চৌধুরীকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশাও হত, তার কারণও ছিল যথেষ্ট:
১) প্রশান্তর উপর আমরা সবাই ভরসা রাখতাম এবং আস্থা। কালক্রমে যদিও সেটা এখন ধূসর হয়ে গেছে, ‘সেই’ এরজন্য দায়ী ছিল বলা যায়। দন্তচিকিৎসক হওয়ার বাসনায় শহর থেকে হোমো সেপিয়েন্সের মাথার খুলি (চোরাপথে, সস্তা দামে) এনে দিতে সে রাজি হয়েছিল, কিন্তু শেষমেশ চৌধুরী মহাশয়, সদ্যোজাত গবেষণাগৃহের টেবিলে যখন তার মোড়ক খুলেছিল দেখা গেল সেটি কুকুরের মাথা। বিনিদ্র রাতের শেষে ভোরের দিকে একটু ঘুম যখন এসেছিল, দুঃস্বপ্নে আঁতকে উঠে চিৎকার করে উঠেছিল চৌধুরী…
২) হাল না ছেড়ে ধার করা একটা খুলি নিয়েই শেখা হল ডাক্তারি। শিক্ষক এবং খ্যাত চিকিৎসক ডাঃ মহঃ সিরাজুল মল্লিক। শিক্ষান্তে, আমাদের যৌথ চেষ্টায় খোলা হল ‘চৌধুরী দন্ত চিকিৎসালয়’। এতে চৌধুরী বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল, হওয়ারই কথা। কিন্তু সুখ তার ভাগ্যে নেই। দ্বিতীয় দিনেই কোনও এক মুমূর্ষু রোগীর দন্ত উৎপাটন করতে গিয়ে এবং সেই রক্তাক্ত দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে চৌধুরী গেল অজ্ঞান হয়ে, অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল রোগী। খবর পেয়ে আমরা ছুটে গেলাম। পার্টির লোকজন ধরে গণধোলাইয়ের হাত থেকে সে যাত্রা বেঁচে গেলেও চৌধুরী আর কখনও দাঁতমুখো হয়নি। তবে এই সত্যি গল্প আমাদের সত্যিই খুব আনন্দ দিত এবং প্রাণ খুলে প্রায়ই আমরা হেসে উঠতাম, যা খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। চৌধুরীর চেহারা ছিল লিকলিকে কলাপাতার মতো, মেরুদণ্ড থেকে তার বাকি অংশ সবসময় নেতিয়ে থাকত। একটা সাইকেল চেপে দূর পাড়াগাঁ থেকে আসত শহরে, বাড়ির অবস্থা খারাপ ছিল না। দশ বারো বিঘা জমি আর বড় খামার ছিল একটা, কিন্তু চৌধুরী যখন ঝোড়ো কাকের মতো চেহারায় ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক করে কাদামাখা সাইকেল নিয়ে শহরের মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ত আর এদিক সেদিক তাকাত বিপন্ন দৃষ্টিতে, মনে হত খুব বিপদে পড়ে গেছে। চোখে মুখে শুধু নেই নেই, চাই চাই। সংস্কৃতির নামগন্ধ ছিল না, সমস্ত ভালো জিনিস এবং গুণ সম্বন্ধে তার মানসিকতা ছিল নেতিবাচক। আপাদমস্তক সন্দেহ আর অবিশ্বাস মাখানো, ঘেন্না হলে আমাদের মুখ যেমন বিকৃত হয়, দাঁতের পাটি বেরিয়ে আসে, তার মুখমণ্ডলের চেহারা একসময় চিরস্থায়ীভাবে দাঁড়াল অনেকটা সেইরকম। চৌধুরীর এই বাহ্য চেহারাটাই ছিল সর্বজনীন হাস্যকর বস্তু। একদিন বিভ্রান্তভাবে তাকে প্ল্যাটফর্মের নীচে রাত্রি ৮টার সময় আবিষ্কার করে কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করায় সে হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল আপ এবং ডাউন উভয় দিকেই নাকি প্রায় একই দূরত্বে দুটি নেমন্তন্ন আছে একই সময়ে, তাই সে ঠিক করতে পারছে না কোন দিকে যাওয়া উচিত হবে। কেননা দুটোতেই না গেলে তার চলবে না। একথা খসবার পরেই ‘এইরে আমার সাইকেল’ বলে কিছুদূর উর্ধ্বশ্বাসে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে যাওয়ার এবং হোঁচট খাওয়ার পর আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফিরে এসে দাঁত বের করে বলেছিল ‘হেঁ হেঁ, সাইকেলটা তো গ্যারেজে…’ তার জন্যে আর সময় নষ্ট করার কোনও কারণ না থাকায় ফিরে এসেছিলাম এটা জেনেই যে এখনও ঘন্টাখানেক ওইভাবে উদ্বেগের সঙ্গে কাটিয়ে চৌধুরী এমন একটা কিছু করবে যা তাকেই মানায়। তবে রাত ১২টার সময় গাঁয়ের সারমেয়বৃন্দ যে তার সাইকেল ঘেরাও করবে এবং আরও কিছুক্ষণের জন্য আতঙ্ক ও উদ্বেগ সমেত তাকে দেরি করিয়ে দেবে সেটা আন্দাজ করাই যায়।
… এই চৌধুরীই একদিন লটারিতে পাঁচ লক্ষ টাকার বাম্পার প্রাইজ পেয়ে গেল। কিন্তু লটারি বিক্রেতাকেই অনেক খোঁজখবর নিয়ে যেতে হয়েছিল সে সংবাদ নিয়ে, ইতিমধ্যে যথারীতি টিকিট-টির টিকি পর্যন্ত খুইয়ে ফেলেছিল চৌধুরী, ফলে আবারও টেনশনের উদয়।.. শেষ পর্যন্ত লটারির কী হয়েছিল তা আর আমাদের জানা নেই, কারণ এসবের মধ্যে আমরা আর নাক গলাইনি। তবে সেবার আলুর মরশুমে বেশ কিছু টাকার বন্ড যে চৌধুরী কিনে ফেলেছিল সে খবর আমরা পেলাম। দুর্ভাগ্যবশত সেবার আলুর কারবারিদের মাথায় হাত পড়ল, দু-এক জায়গা থেকে প্রায়ই খবর আসতে লাগল একের পর এক চাষি হয় আত্মহত্যা করছে কিংবা বউছেলেকে বিষ খাইয়ে মারতে গেছে, কেউ কেউ জলের দরে জমি বেচে দিয়েছে দালালদের কাছে, একদিন জানা গেল আমাদের শহর থেকে মাত্র বিশ ক্রোশ দূরের একটা গ্রামের শেষে হরিহর নামে এক ভাগচাষি, পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে ঘুমের মধ্যে পুড়িয়ে মেরে মাঠের ধারে তেঁতুলগাছে গলায় গামছার ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে, পরের দিন সে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়ে খাস শহরের দর্শকদের কাছে ও বিরোধী দলের শিবিরে বেশ আলোড়ন তুলল, সরকার নিয়মমাফিক এসব দুঃসংবাদের সত্যতা অস্বীকার করলেন এবং জনসাধারণকে ওইসব উস্কানিমূলক খবরে প্ররোচিত না হয়ে শান্ত থাকার আর্জি জানিয়ে দেওয়া হল— বলা হল, কৃষকদের উপর সরকার যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। অথচ কেন টন টন আলু সেবার রাস্তার ধারে জমে পাহাড় হয়ে ও পচে নষ্ট হয়ে গেল, সরকারিভাবে সেসব অন্য রাজ্যে কেন নিয়ে যাওয়া হল না, কেন সেই পড়তি বাজারেও বাইরে থেকে লরি লরি আলু ঢুকে পড়ে উন্নতমানের জন্যে বাজার দখল করে নিল, কাদের মাথা ও পেশি শক্তি এই সবের পিছনে ছিল— প্রশাসনিক ইউনিয়নের ঝান্ডাবাজ লোকজনদের তখন দেখা যায়নি কেন— এইসব বিতর্ক উঠল না… এরপর আমরা আর চৌধুরীকে দেখতে পাইনি। শুনেছিলাম সোনার কাজ শিখে অবশেষে একজন চেনা এজেন্টের সহযোগিতায় সে আরবদেশে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু তাকে নিয়ে যেহেতু কেউ কোনওদিনই বেশি মাথা ঘামাতাম না, তাই একসময় আমরা তাকে খুব সহজেই ভুলে যেতে পারলাম এবং এমনকি তার চেহারাটাও অস্পষ্ট হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল, কেননা ততদিনে আরও একজন, ক্রমশই আমাদের খাদ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল এবং অনেকদিন পর আমরা আবার সতেজ ও হাসিখুশি হয়ে উঠেছিলাম।…
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো….
একজন ডেলিপ্যাসেঞ্জারের কলাম: ধোঁয়া আবার কী? ধোঁয়া, ধোঁয়াই। যেমন বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া, চিমনির ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া। কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে যাচ্ছে— ওই যে অপু দুর্গা কী যেন সিনেমাটার নাম। সেখানে অবশ্য অন্যরকম, তা তো হবেই, সেখানে ধোয়াঁকে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিচালকের ইচ্ছেমতো— আর তাতে তো ধোঁয়াটা খরগোশ হয়ে যাচ্ছে না। অবশ্য এখন কম্পিউটারের যুগ। এই তো সেদিন আইনক্সে দেখলাম একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি বনবন করে ঘুরে মানুষ হয়ে গেল তারপর মাথাটা ঘাড় থেকে খুলে ধোঁয়াটাকে বিদায় দিয়ে আবার গর্দানে সেট করে দিব্যি নাচতে আরম্ভ করল, সে কি নাচ!— হৃৎপিণ্ডটা একবার বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে আবার পক্ করে ঢুকে যাচ্ছে বুকে, বাপরে বাপ। ম্যাজিশিয়ানদের কথা ছাড়ুন। আপনি শব্দটাকে যেরকম পাত্তা দিচ্ছেন, ধুস, ওটা নস্ট্যালজিয়া। আসলে ব্যপারটা তো পাবলিককে বোকা বানিয়ে কীভাবে টিকে থাকা যায়। সঙ্গে ক্ষমতা, সে আর কে না চায় বলুন। নেতা, মন্ত্রী, ডাক্তার, অফিসার, ব্যবসাদার, আপনার বাবা, আমার বাবা— ডোন্ট মাইন্ড। দেখবেন প্রত্যেকটি লোক তার সামনের লোকটাকে ডাউন করে বোকা বানিয়ে দিতে পারলে কীরকম চকচক করে ওঠে, কেন! একটা কনফিডেন্স, একটা এনার্জি, একটা ভরসা পাওয়া যায় ওতে, এটার প্রমাণ পেয়ে যে তার তুলনায় অন্তত সে কয়েক কদম বেশি চালাক। নিজেকে চালাকচতুর ভাবতে কার না ভালো লাগে মশাই, ওটা দোষের কিছু নয়। যাক অনেক বেশি বলে ফেললাম। তবু শেষ পর্যন্ত আপনি এটাই ধরে নেবেন, ধোঁয়া বলতে আমি ধোঁয়াকেই বুঝি। সে হালকা তাই প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী মাটিতে না পড়ে গিয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়, আর হালকা বস্তুদের নিয়ে আমার মনে হয় না কোনও সিরিয়াস অর্থাৎ ভারী দার্শনিক চিন্তা করা উচিত। কেননা আপনি ধরবার আগেই সে আপনার নাগালের বাইরে চলে যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
রাম শ্যাম যদু মধু সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলিত সাক্ষাৎকার
ধোঁ-ও-য়া-নি-য়ে-এ, হ্যাঁ হতে পারে, বেশ ভালো লেখা একটা দাঁড় করানো যায়, আমি কখনও ভাবিনি, হ্যাঁ হ্যাঁ হতেই পারে… তবে কিনা ওসব নিয়ে এখন, আরে কালিদাস যদি ‘মেঘদূতম’ (?) লিখতে পারে… বেশ শক্ত অথবা খুবই সহজ, পথের পাঁচালি পড়েছেন? ওঃ ওই জায়গাটা… ‘একশো বছরের বিষণ্ণতা’ কিংবা খুব রিসেন্ট একটা সিনেমা ‘দা গোল্ডেন রিং’— তবে কুরোসাওয়ায় কিন্তু নেই, আর রাশিয়ান সিনেমা মানেই তো… আসলে কী জানেন যে কোনও ঐতিহাসিক মানে সিরিয়াস এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প উপন্যাস সিনেমায়— তা যে কোনও দেশই হোক, ধোঁয়া একটি অপরিহার্য বস্তু, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, হয়তো অন্যরূপে হাজির হবেই… ঠিক বললাম কী! হেঁ হেঁ.. আপনাকে আমি ধরে ফেলেছি মশাই, আচ্ছা তার আগে বলুন তো আপনি হঠাৎ ‘ধোঁয়া’ নিয়ে পড়লেন কেন! রবীন্দ্রজয়ন্তী নজরুল জয়ন্তী বইমেলা গানমেলা শতবর্ষ রজতজয়ন্তী, এই সবের জন্যেই তো আসে সবাই, চাঁদাও চাইছেন না… আপনাকে নিয়ে আমিই তো ধোঁয়া দেখছি হাঃ হাঃ করেন কী, থাকেন কোথায়… চা খাবেন? আরে বাবা! এই তো! এই তো! ইউরেকা! গরম চা থেকে ওঠা ধোঁয়া সে কি শুধুই ধোঁয়া। তুমি কি কেবলি ছবি— আহা রবিঠাকুর! কী জিনিস! আপনি কি চোখের ডাক্তার, এতদিন কী দেখলাম! অন্ধ! অন্ধ! অন্ধ ছিলাম! থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ… হ্যাঁ, বুঝলেন, রাউত পদবীর একটা ছেলেকে জানতাম, আমাদের থেকে এক ক্লাস সিনিয়ার। ভিস্যুয়াল আর্টসের। ওয়াটার কালারে ও যেভাবে ধোঁয়াকে ধরত, আগে বা পরে কোনও শিল্পীর ছবিতে অমনটা দেখিনি। একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে ফ্রন্ট প্রোফাইল থেকে দেখা রেলইঞ্জিন আর লেবারদের গায়ে পড়া আলো অন্ধকার। ধোঁয়া যে কত বীভৎস সুন্দর, কত কৃষ্ণশুভ্র হতে পারে, কত স্তর থাকতে পারে তার— কত জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, ছবি নয়, যেন কোনও মহৎ উপন্যাসের এক একটা পাতা— সাংঘাতিক স্টাডি ছিল প্রথমদিকে। আমিও টুকটাক ছবি আঁকতাম, ভালো লাগত, কিন্তু না, ধোঁয়া নিয়ে কখনও চেষ্টাই করিনি— করিনি কারণ ওটাতে আমার তেমন আগ্রহ নেই, হয়তো সাহসও ছিলনা…। …ধ্রুপদ সঙ্গীত শোনেন তো, নিশ্চয় শোনেন। সা রে গা মা পা ধা নি সা, এই সা থেকে সা পর্যন্ত ধ্বনিগুলো, সুরগুলো একটু এদিক ওদিক দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ছড়িয়ে টেনে ঘন্টার পর ঘন্টা একজন শিল্পী যে আপনাকে জাদু করে দিয়ে, সম্মোহিত করে দিয়ে বসিয়ে রাখতে পারে তা আপনি জানেন? নিশ্চয় জানেন, তো এটা কী? ধোঁয়া নয়?… ধোঁয়া দিয়ে অনেকসময় স্বর্গের একটা আবহ তৈরি করা হয়, ওটা তো প্রথাগত ব্যপার। টেকনিক্যাল সাইড। না, প্রভু দেবা কি মডার্ন যেগুলোকে বলতে চাইছেন ওসবই ওয়েস্টার্ন কালচারের দুর্বল অনুকরণ, বাজারি ব্যপার। মানুষকে উত্তেজিত করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবদমিত কামনার একটা কদর্য, বিকৃত চর্চা। হ্যাঁ, রবীন্দ্রঘরানাটা আমার পছন্দের, তবে খুবই হালকা লাগে। উদয়শঙ্কর ইজ কারেক্ট, যদি আধুনিক নৃত্য বলেন তো- হি ইজ এ গ্রেট, ন্যাশনাল এ্যান্ড অ্যাবসোলিউটলি ইনট্যারন্যাশনাল মডার্ন ড্যানসার। তবে ভারতীয় নৃত্য বা সঙ্গীত বলতে এখনও শাস্ত্রীয় ব্যাপারটাই সকলে, অন্তত আমি…।
….না না ধোঁয়া নিয়ে আমার বিশেষ চিন্তার এখনও কোনও কারণ ঘটেনি। ধোঁয়া আবার গবেষণার বিষয় হতে পারে!… ওক্কে, আসুন, সরি… বললাম তো, এক কথা কেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, যত্তসব! আমি আকাট মুখ্যু লোক, ভুল জায়গায় এসেছেন, এখনও চান হয়নি, খাওয়া হয়নি, আর ধোঁয়া ধোঁয়া করে যত সব উৎপাত… কী হল এখনও দাঁড়িয়ে আছেন… খুব ভালো লাগল শুনে। আপনাদের মতো লোক মশাই, বেশ ইন্টারেস্টিং (ঘনিষ্ঠভাবে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে) কী ব্যাপার একটু খুলে বলুন তো। পলিটিক্যাল কি মিরাকল না গ্যাঁড়াকল! এই গণতান্ত্রিক ফনতান্ত্রিক হলে মশাই আসুন। মুশকিলটা কী জানেন, সংস্কৃতি দিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত আকৃতিটা কি রকম দাঁড়াবে। ফাইনান্স বিমা হলে আগেই বলুন। বন্ধক, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া কি লোন পাওয়া যাবে? আমার নিজের বাড়ি নেই, চাকরি করি না— নাটক, যাত্রা এই সব লিখেটিখে কোনওরকম পেট চালাই। দেখুন একটা চিত্রনাট্যও লিখেছি, একমিনিট… এ-এ-এই দেখুন! ধরুন ধরুন! সেক্স, অ্যাকশন, রোমান্স, সেনসেসন, সুরসুরি সবগুলোকে এক জায়গায় এনে একেবারে কানায় কানায় ফেলেছি। বাজারে ছাড়লেই ছাবারিয়া, ঝুনঝুনিওয়ালারা লুফে নেবে, গ্যারান্টি আছে। দেখুন না মশাই, এটা রেখে যদি টাকাপয়সা কিছু… যাঃশ্শালা, মাথা নাড়েন কেন! হাসছেন মশাই। মাথা আমার ঠিকই আছে। আপনার হাসি পাচ্ছে? নিকুচি মেরেছে আপনার ধোঁয়ার। ধোঁয়া, ধোঁয়া, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, এয়ার পলিউশন, দূষণটা কি শুধু এই সবের মধ্যে ভেবেছেন। ইডিয়ট। বুঝলেন না। বুঝে আর কাজ নেই। আসুন, নমস্কার। রাবিশ!…
…“ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া
চারিদিকে ধোঁয়া,
না পারি সইতে, না পারি কইতে…”
গানটা শুনেছেন তো, হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ.. হাঃ হাঃ হাঃ-ও হোঃ হো হো… এছাড়া আর কী বলব বলুন তো, ধোঁয়া নিয়ে কি আর গভীর কোনও গান হয়। তবে হ্যাঁ, নাইট ক্লাবগুলোতে এখন খুব ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে বিপ বিপ। রঙ্গিন আলো আর রক পপ, ডিস্কো, বাংলা ব্যান্ড— আহা! আহা! অন্ধকারের মধ্যে গলগল করে বেরোচ্ছে সাদা ধোঁয়া, কখনো গোলাপি কখনো পিকক ব্লু মাঝে মাঝে কিছু মুখ, সাতরঙা আলোর চমক। ষোড়শী, অষ্টাদশী, মধ্যবয়সী সব চাবুক ফিগার, সে কী দৃশ্য না দেখলে, হাউ ফ্যান্টাসি। হাউ রোম্যান্টিক। অপার্থিব মশাই অপার্থিব। মনে হবে ইন্ডিয়া নয়, প্যারিস— ধোঁয়া কি শুধুই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট! যান না, সাহিত্য টাহিত্য পরে করবেন, ফার্স্ট এনজয় করুন, ফিল করুন— ওকে বাই, মিট এগেন…। …হ্যাঁ কী যেন বললেন, ধোঁয়া। আমি তখন এলাহাবাদে। আমার ওস্তাদজি একদিন ইশারা করে বললেন বসতে। আমি বসলাম। আবার ইশারা করে চোখ বন্ধ করতে বললেন, করলাম। তখন বয়স আর কত হবে। মন চঞ্চল, তিনি বুঝতেন সে কথা, প্রকাশ না করে শিক্ষা দিতেন এইভাবেই। চোখ খোলার জন্য আনচান করছি কিন্তু ভয়ে পারছি না, প্রায় তিরিশ মিনিট ওস্তাদজি তারে টান দিলেন। খুব আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল আমার। ধোঁয়া, ধুনো আর মিষ্টি ধূপের গন্ধে ভরে গেছে ঘরটা। দেখলাম স্বয়ং ওস্তাদজিই চোখদুটো বন্ধ করে আধাঘন্টা আলাপ করার পর যেন পাখা মেলতে মেলতে চলে গেলেন ‘রাগে’। রাগটা সচরাচর আপনি শুনতে পাবেন না। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয় আমার ছিল। ‘হংসধ্বনি’। খোলা চোখ কখন যে আবার আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল আমার! ভেতরে কী যে এক তোলপাড় করে চলল, তারপর খাঁচা থেকে বেরিয়ে বন্দি পাখি যেমন বিস্তীর্ণ দিগন্তের মধ্যে গিয়ে বোঝে মুক্তির আনন্দ তেমন বোধ হল। পরমব্রহ্ম কী জিনিস এতদিন বইয়ের পাতায় পড়েছি, শুনেছি, কিন্তু সেইদিনই প্রথম উপলব্ধি করলাম। আমার জীবন সার্থক। সেই দিনটার কথা চোখ বুজলেই জীবন্ত হয়ে ওঠে এখনও। ঘর ভর্তি ধুনো ধোঁয়া, গুরুজি চোখ বুজে বাজিয়ে চলেছেন হংসধ্বনি। কোথা থেকে যেন জল চলে আসে, দুই চোখ ভেসে যায় আমার— এ কি আনন্দের না বেদনার!… আপনি বুঝিয়ে দেবেন? পারবেন না, আমিও জানি না। কোনও ব্যর্থতাই আমাকে আর কাবু করতে পারে না। এই যে এত যুদ্ধ, অশান্তি। লোভ, কামনা, হিংসা, অহং-বলতে পারেন মানুষ সত্যিই কি এ সবের মধ্যে আনন্দ পায়? নিশ্চয়ই পায়! আনন্দ থেকেই তো যত কিছু, শাস্ত্রের কথা। গোলমাল হয়ে যায় ধাঁধা লেগে যায় ওসব ভাবলে— এছাড়া ধোঁয়া নিয়ে কী আর বলব বলুন। যানবাহন থেকে অনর্গল ছেড়ে চলা বীভৎস কালো ধোঁয়াদের কথা নিশ্চয়ই আপনি শুনতে চাইবেন না…।