Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফিনিক্স

কুশান গুপ্ত

 

নচিকেতার গানে একটা ব্যাপার আছে, বুঝলেন? একটা স্ট্রাগল, হার না মানা ভাব। ওই… যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, শুনেছেন? শোনেননি? আমি তো শুনি। ভেঙে পড়লে শুনি। চাঙ্গা করে দেয়।

আপনার সঙ্গে আমার মিলছে না, তবুও কথা তো হচ্ছে। আপনার রিয়েলিটি, আর আমার রিয়েলিটি, এক হয়েও আলাদা। এই যে দেখুন, চারপাশে এত লোক, গিজগিজ করছে ভিড়, বাতাস থেকে একই অক্সিজেন টানছে, সবাই কি একই রকম ভাবছে? কারও মেয়ের বিয়ে, তো কারও লটারি লেগেছে। কারও বাবা আইসিইউ। আলাদা নয়?

এক্ষুনি যে রামের কথা নিয়ে বলছিলেন, সেই প্রসঙ্গে বলতে গেলে তো অনেক কিছু বলতে হয়। কোত্থেকে শুরু করি? আজকাল রাম নিয়ে যা হচ্ছে… আমার কিন্তু হেব্বি রগড় লাগে।

আজ রাম, কাল রাম, পরশু রাম। পরশুরামের নাম যদি না শুনে থাকেন তো আপনার জীবন বৃথা। নিজের মাকে কুঠার দিয়ে কেটেছে, ক্ষত্রিয়ের রক্ত দিয়ে অনেকগুলো নদী বানিয়েছে। এসব ফ্যাক্ট। নিশ্চয়ই হয়েছিল। বাবাকে আসলে খুব ভালবাসত। সেই কিশোরের গানটা আছে না, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী?’

ভালোবাসা ব্যাপারটা, মানে ওই পিতাকে ভালোবাসার কেসটা, আগেকার দিনে কিন্তু ছিল। বুঝলেন? ভাবুন না, পিতার দেওয়া শপথ রাখতে ছেলে এতবছর ঘন রাক্ষসসঙ্কুল দণ্ডকবনে চলে গেল, সঙ্গে শুধু বউ আর ভাই। সে যুগে প্রেম ভালোবাসা, ভাইয়ের, দাদার প্রতিও কম ছিল না। কথায় আছে না, বউ গেলে বউ পাইব, ভাই গেলে ভাই কি পাইব? ওইজন্য লক্ষ্মণ বউ ফেলে সৎ দাদা আর বউদির সঙ্গে চলে গেল। এমনি এমনি কি আর সুভাষ ঘাই ‘রাম লক্ষ্মণ’ বইটা…

রাম লক্ষ্মণ দেখেননি মশায়? আপনি না একদম যুগোপযোগী নন। দেখলে বুঝতেন লক্ষ্মণ রামের চেয়ে কিছু কম যায় না। ওয়ান টু কা ফোর, ফোর টু কা ওয়ান, মাই নেম ইজ লাখান। ওই সিনেমায় অবশ্য দশরথ, বিশরথ— এসব ফালতু হ্যাজানো নেই। ওখানে কৌশল্যা যে, সে-ই সুমিত্রা। কিন্তু ডবল রোল নয়। আসলে সৎ ভাই হলে গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য হত না। কী বললেন, হিন্দি ছবি বিশ্বাসযোগ্য নয়? আপনার জন্য নয়, আমার জন্য অনেকটাই সত্যি। আপনি ও আমি আলাদা লোক। দেখুন না, এখানে কৈকেয়ী বলে হিংসুটে কেউ নেই। অপ্রয়োজনীয় বলেই নেই। যিনি কৌশল্যা, তিনিই সুমিত্রা, তিনিই রাখী গুলজার। হেবি ফর্সা। চোখটা মেমসাহেব। বিড়ালের মত, ইয়ে, কটা। বাঙালি কিন্তু। মায়ের রোলটা জাস্ট ফাটিয়ে দিলেন। পতির খুনের বদলা নেবেন। রাম লক্ষ্মণকে ঘষে মেজে তৈরি করছেন। তাছাড়া ওই সিনেমায় সীতার ভূমিকায় স্কার্ট-পরিহিতা গাম্বুট পরা ডিম্পল কাপাডিয়া, গটগট করে হাঁটে, তেমনি তিরিক্ষি মেজাজ। ঊর্মিলার ভূমিকায় ঘাঘরা চোলির মাধুরী দীক্ষিত বরং নরম সরম।

আগে সীতা-রূপী ডিম্পল নিয়ে একটা কথা বলে নিই। ঊর্মিলার-টা পরে বলব।

এই সীতা-রূপী ডিম্পলের চোখ দুটো বেশিক্ষণ দেখবেন না মশায়, প্রেম পেয়ে যাবে। তখন খামোখা দিবাস্বপ্ন নামক অসুখে আক্রান্ত হবেন। দিনের বেলায় ঘুম পাবে, রাতের ঘুম হাপিশ। শুধু গাইবেন, দিল হুম হুম করে, ঘাবড়ায়। আপনিও ঘাবড়ে যাবেন। ডিম্পল মানে রুদালি-চোখ। কান্না কান্না চোখ। মাশ্বেতা দেবীর লেখা কাহিনি অবলম্বনে। নাম শোনেননি? মহাশ্বেতা দেবীর নাম শোনেননি? বলেন কী? বাংলায় যা মহাশ্বেতা, হিন্দিতে তাই মাশ্বেতা। ম্যাগসাই না ম্যাগি আরও চাই না কী একটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেন। বিকট নাম। তবু, এ কি কম কথা? সেই কবে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেলেন, তারপর আর কেউ কি আন্তর্জাতিক পেল? ওসব রবীন্দ্র, নজরুল, একাডেমি তো সবাই ঝেঁটিয়ে পায়। ওগুলো ছাড়ুন। আমাদের বাঙালি লেখিকারা কম যান না। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, আশাপূর্ণা দেবী লক্ষ্মী, মহাশ্বেতা দেবী দুর্গা। সবাই দেবী। যা দেবী সর্বভূতেষু। আপনি এসব শুনে দেখছি মিটিমিটি হাসছেন। মানে, আপনি প্রথমে আমাকে একটু আন্ডার-এস্টিমেট করছিলেন তো? এখন দেখছেন তো, অনেক কিছুই জানি। দীপুদার সঙ্গে আমারও যোগাযোগ ছিল। দীপুদার ধরনটা আপনারই মতো, চোখে মোটা লেন্সের চশমা, একটু পড়াশুনো করতে ভালবাসে। দীপুদার সঙ্গে অনেককাল দেখা হয় না। আজকাল আর সময় পাই না, পেটের দায়, টাইম কোথায়? স্ট্রাগল করতে হয় রোজ। একটার পর একটা ব্যবসা ফেইল করে, ভেঙে পড়ি, কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়াই। কী একটা পাখি আছে না, দীপুদা বলে, নামটা মনে করতে পারছি না। আমি ওইরকম, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ঘুরে দাঁড়াই। সকাল সাতটায় দিন শুরু হয়। রাত দুটোয় ঘুমোতে যাই। তখন কানের মধ্যে ওই গানটা বাজে, নচিকেতার ওই গানটা: স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে মন।

যাই হোক, ডিম্পল চিক না চাবি চিন কী একটা বলে, আমি বলি ডিম্পল-চোখ। কী চোখ, কী চোখ, ববি দেখেছেন? ঝুট বোলে কাউয়া কাটে? আবার ঘাড় নাড়লেন! আপনি না মশাই, এক্কেবারে যাতারকমের নেতিবাচক!

তবে এই রাম লাখান বইটায় রাম আসলে সৎ আদর্শবাদী পুলিশ অফিসার। জ্যাকি শ্রফ। ওর নাম জ্যাকি দাদা। ‘তেরি মেহেরবানিয়া’ করে খুব নাম করেছিল। একটা কুকুর, বুঝলেন না, ইমানদার কুকুর। কুকুররা না খুব ভালো। ওদের পেছনে না লাগলে যেচে কামড়ায় না। একটা কুকুর, একা, একটা বই টানল। শেষে প্রভুভক্ত কুকুরটা মরে গেল। দেখলে চোখে জল এসে যায়। সেই কবে হাতি মেরা সাথী করেছিল রাজেশ খান্না। তনুজা বসে আছে, আর রাজেশ গাইছে, চল চল চল, মেরে সাথী, ও মেরে হাতি। ওই বইটা পুরো হাতির শুঁড় টানা। এটা কুকুর।

এরকম অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু কিছু কিছু হয়। দীপুদা বলে, লাইফ ইজ এ বিউটিফুল অ্যাকসিডেন্ট। প্রথমে মানে বুঝতাম না। এখন বুঝতে পারি। কিছু কিছু জিনিস বুঝতে এক্সপিরিয়েন্স লাগে। এই যে আমি-আপনি মুখোমুখি বসে গল্প করে যাচ্ছি, এটা, আপনি যাই বলুন, আমি বলব, পূর্ব-পরিকল্পিত। বিউটিফুল।

কিন্তু, রাম লাখানটা শুনে নিন। রামের ভূমিকায় ওই জ্যাকি। খুব পরিশ্রমী, সৎ। মাকে ভালবাসে খুব, সমস্ত চোর ছ্যাঁচড়, গুন্ডা, বদমায়েশদের বলে বলে শায়েস্তা করে। বড় বড় স্মাগলারদের ধরবে বলে তার এই উদয়াস্ত পরিশ্রম। তাছাড়া দশরথের হত্যা আছে, তার বদলা নেওয়া বাকি। কিন্তু, বললে হবে? খরচা আছে না? টাইম, টাইম। টাইম ইজ মানি। এই রাম-রূপী জ্যাকি শ্রফের হাতে সব আছে, একফোঁটা টাইম নেই। সকাল থেকে রাত অবধি দায়িত্ববান সৎ পুলিশ অফিসারের কাজ করতে করতেই কেটে যায়। উপরন্তু মা কৌশল্যার খেয়াল রাখতে হয়। ভাই লক্ষ্মণও বেকার, তাছাড়া কেমন বখে মতন যাচ্ছে, ওর ওপর নজর রাখা, এতরকম দায়িত্ব। ওর টাইম নেই। এখন এই জ্যাকির প্রেমিকা হল গিয়ে ডিম্পল। ওদের বিয়েও প্রায় ফিক্সড। এবার বলুন, ডিম্পলের রাগ তো হবেই। তার জন্য, শুধু তার জন্যই, জ্যাকির হাতে একফোঁটা টাইম নেই। কিন্তু আপনি হাই তুলছেন কেন? ইন্টারেস্টিং লাগছে না? আরে না না, এই মেয়েরা, মানে যারা আধুনিক সীতা, এই ব্যাপারটা না একদম পছন্দ করে না। মানে, প্রেমিকদের, এই সবার জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য, দশরথের জন্য, ভাইয়ের জন্য, মায়ের জন্য টাইম আছে, শুধু তার জন্যই নেই, এটা না মেয়েরা লাইক করে না। আরে বাবা একটু কম্প্রোমাইজ কর। একটু অ্যাডজাস্ট করলে কি মহাভারত উল্টে যায়?

তবে বইটা যে বানিয়েছে তার নাম সুভাষ ঘাই। ওর সিনেমায় যে মেইন নায়িকা তার নাম শুরু হবে ‘ম’ দিয়ে। হাসছেন? বলে দিই মশাই, মিলিয়েই দেখুন না। হিরো সিনেমায় নায়িকা কে? মীনাক্ষী শেষাদ্রি। রাম লাখান? মাধুরী। সওদাগর? মণীষা কৈরালা। আসলে ও কেরলের নয়, নেপালের, কৈরালা না হয়ে নৈপালা হলেই ভাল হত। নেপালের, তবু, নাক বাঁশির মত টিকোলো। এবার দেখুন, পরদেশ? মহিমা চৌধুরী। সবাই ম। এম। কংগ্রেস যেমন আই, সিপিআই তেমন এম। সুভাষ ঘাইও তেমনি এম। নেতাজি সুভাষ, সুভাষ চক্রবর্তীও কিন্তু এম। এম মানে বাঁদিকে কান্নিক। আমার না নেতাজির প্রতি হেবি দুর্বলতা। ওই তোমরা আমাকে রক্ত দাও, ওই ব্যাপারটা।

আমি এই এমের ব্যাপারটা যেমন মিলিয়ে মিলিয়ে দেখলাম। মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে আমার ভাল্লাগে। যখন মিলে যায়, তখন মনে হয় সত্যিই লাইফ ইজ এ বিউটিফুল অ্যাকসিডেন্ট। দেখুন না, বাপ একটা কারখানায় চাকরি করত। পার্টি করত খুব। আদর্শ-টাদর্শ মানত। কিন্তু, দুম করে মরে গেল। দাদার অনার্স হয়ে গিয়েছিল। দাদার জন্য আমার একজন রিলেটিভ অনেক দৌড়াদৌড়ি করে ইস্কুলের চাকরিতে ঢুকিয়ে দিল। এরপর দাদা বিয়ে করেই বৌদিকে নিয়ে দুবছরের মাথায় আলাদা হয়ে গেল। দাদা ফ্ল্যাটে থাকে এখন। আমি মাকে নিয়ে থাকি। সঙ্গে আছে দিদি। বর ছেড়ে দিয়েছে। আমার গ্র্যাজুয়েশন হয়নি। কিন্তু লাস্ট পঁচিশ বছর ধরে স্ট্রাগল কিন্তু সগৌরবে চলিতেছে। পাঁচ ছটা ব্যবসায় ফেল মেরে, এখন, বলতে নেই, ভগবানের দয়ায়, ব্যবসা একটু দাঁড়িয়েছে। স্ট্রাগল, স্ট্রাগল। নচিকেতার গান আছে না, অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন।

কী কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম। সুভাষ ঘাইয়ের কথায় ফিরি। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। ওর সব সিনেমায় ওর নিজের সাড়ে একুশ সেকেন্ড অ্যাপিয়ারেন্স পাবেন। আমি স্টপ ওয়াচ মিলিয়ে দেখেছি। একটা নিছক পার্শ্বচরিত্র, ওটিতে সুভাষ সহসা রুই মাছের মতো ঘাই মেরে হালকা দেখা দিয়ে আবার সিনেমার অতল জলে তলিয়ে যাবেন। ওর সিনেমা দেখতে দেখতে অনেকেই উশখুশ করে। বলে সুভাষ ঘাই এখনও এল না, এদিকে বই এক ঘণ্টা হয়ে গেল! এই ঘাইমশাই কার গডফাদার ছিলেন জানেন? মাধুরী দীক্ষিত। মাধুরীর নিজের বাপের নাম জিজ্ঞেস করুন, কেউ বলতে পারবে না, আমিও না। কিন্তু গডফাদার কে? মার্লিন ব্রেন্ডো নয়, আল প্যাসিনো নয়, রবার্ট ডি নিরো নয়, সুভাষ ঘাই। এসব ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপার। একটা গডফাদার লাগে উঠতে গেলে। আমিও দু তিনটে ইংরিজি সিনেমা দেখেছি। দীপুদা বলল হলিউড দেখবি? দ্যাখ কেমন লাগে। দেখলাম। গড ফাদার। উরিত্তারা। ওর মিউজিকটাও হেব্বি। এই এরকম: তারারারারারারারারারারারা। কে একটা সুরটা হিন্দি বইয়ে ঝেঁপে দিয়েছে। এই ঝাঁপা সুরে বাংলা গানও আছে। জীবনে জুয়া খেলাই হল আমারই গান। শোনেননি?

তবে মাধুরী মানেই সব কিছুর মধ্যে বইয়ে তুখোড় সব নাচ থাকবে। নানা ধরনের নাচ। হরেকরকমের। আর থাকবে এক্সপ্রেশন। যা দেখে মকবুলও ফিদা হয়ে যাবে। চোখেমুখে কৃশানু দের বাঁ পায়ের কাজ থাকবে, সৌরভ গাঙ্গুলির অফ-স্ট্যাম্পের টাইমিং। ওর ফ্যান সবাই। আসমুদ্র হিমাচল। চা দোকানী মন্টুদা থেকে বড়লোক আর্টিস্ট মকবুল ফিদা হুসেন। ওর সৌন্দর্য একেবারে বিশুদ্ধ লাক্সের মতন। কী সুন্দর কথা বলে, দেখেছেন? দুনিয়া দেখে মেরা রং রূপ, লেকিন দেখভাল করে লাক্স। একবার পাকিস্তান সরকার বলল, মাধুরীকে দিয়ে দাও, কাশ্মির ছেড়ে দেব। ভেবে দেখুন। ইয়ার্কির ব্যাপার?

তা, সুভাষ ঘাই একবার একটা বই বানিয়েছিল, খলনায়ক। ওতে গান ছিল, চোলি কে পিছে ক্যা হ্যায়, চোলিকে পিছে। হেবি বিতর্ক, বুঝলেন? অনেকে বলল, সুভাষ ঘাই অসভ্য। চোলির নীচে কী থাকবে সবাই জানে, এটা মাইক ফুঁকে বলার কী আছে? কিন্তু, কেউ বুঝল না, ওটা আসলে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। মানে দিল, দিল, এই যে দেখুন, বাঁদিকে। ওটায় মাধুরী হেবি নেচেছিল। নীনা গুপ্ত আর বাকিরা কুক কুক কুক কুক করে যাচ্ছে। আর ঘাঘরা চোলি পরা মাধুরীর দিকে গোটা হল হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ওটাতে মাধুরী জ্যাকির ফিয়াসে হয়েছিল। মানে ওই মাঙ্গেতর বলে। ওটাতেও জ্যাকির নাম ছিল রাম। ওতেও পুলিশ অফিসার। রাম ব্যাপারটা খায় সবাই এই দেশে। এইসব যখন হত, আমি, বুঝলেন তো, কলেজে পড়ি। গ্র্যাজুয়েশনটা হতে হতেও হয়নি যদিও। সে যাই হোক আমরা সবাই তখন মাধুরীকে সাক্ষাৎ দেবীজ্ঞানে পুজো করতাম। আসলে, দেখুন, দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এখানে একটা ঐতিহ্য আছে। এখানে নারী হল দেবী। মহাশ্বেতাই হোন আর সুপ্রিয়াই হোন, সকলেই দেবী। আমরা প্রেমের সঙ্গে পূজা মেশাই। রবীন্দ্রনাথের গানের পূজা পর্যায়, প্রেম পর্যায় আলাদা। আমাদের প্রেমই পূজা, পূজাই প্রেম। অবশ্য পূজা বলে দুটো ফালতু মেয়ে আছে, একটা পূজা ভাট, আরেকটা পূজা বেদী। দুটোই সমান ধিঙ্গি। আর অসভ্য। শুনেছি সিগারেট খায়। আর আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে…

যাকগে, স্টেশন চলে আসবে। বাকি গল্পটা বলে দিই। লক্ষ্মণ ভিলেনের খপ্পরে পড়ে যাবে। ওই ভিলেনই ওর বাবাকে খুন করেছে, কিন্তু লক্ষ্মণ এসব জানে না। বা, ভুলে গেছে। ভিলেনের ডেরায় একটা অসভ্য ভ্যাম্প গার্ল আছে। গায়ে পড়া, খারাপ, অসভ্য মেয়ে, চোখটা নীল, কুচুটের মতো। ওটাই আসলে শূর্পনখা। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে সুন্দর, কিন্তু আসলে রাক্ষসী। সে ভিলেনের অঙ্কশায়িনী, কিন্তু লক্ষ্মণের প্রেমে পড়ে যাবে। আপনি কস্মিনকালে শুনেছেন, মেয়েরা ছেলেদের বলে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই? কিন্তু এই ভ্যাম্পগুলো ওই শূর্পনখার মতোই বেহায়া।

ভিলেন, যে, রাম ও লক্ষ্মণের বাপকে মেরেছে, সে সবাইকে নিজের ডেরায় আটকে রেখেছে। এমনই অবস্থা যে, জ্যাকি শ্রফও কিছু করতে পারছে না। সবাই ভাবছে লক্ষ্মণ ভিলেনের দলে মিশে গেছে। এইসময় ভিলেন মাধুরীকে নাচতে বলবে। এই ভিলেনদের, নায়িকাদের নাচতে বলাটা, শুরু হয় শোলে থেকে। কালজয়ী বই। আমি প্রায় তিরিশবার দেখেছি। ওখানে আছে, নিশ্চয়ই জানেন, গব্বরের ডেরায় বীরুর হাত দুটো বাঁধা। আর গব্বর হেমাকে বললো, নাচ, ছামিয়া, নাচ। হেমা মালিনী শুরু করল নাচ। আ জব তক হ্যায় জান, ম্যায় নাচুঙ্গি। গব্বর কাচের বোতল ছুঁড়ল। ভাঙা কাচের টুকরোর ওপর এক পায়ে নেচে যাচ্ছে হেমা। বীরু ওদিকে চেঁচাচ্ছে, বাসন্তী, কুত্তার সামনে নাচিস না। তবু, রক্ত ঝরা পায়ে হেমা নেচে যাচ্ছে। আগে ড্রিমগার্ল হেমাও লাক্স মাখত আর ওইরকম বলত, দুনিয়া দেখে মেরা রং রূপ। সেই থেকে আমিও পয়সা জমিয়ে লাক্স মাখতে শুরু করি। ছোটবেলায় লাইফবয় মাখতাম, ফুটবল খেলার পর, আর গাইতাম, লাইফবয় যেখানে, স্বাস্থ্যও সেখানে। রাইট উইং-এ খেলতাম। সোনালী সঙ্ঘ ক্লাবে খেলতাম। এ ও খেপ খেলতে ডাকত। নতুন জার্সি। মাংসভাত। কিট। জুতো। দশ বিশ টাকা হাতেও ধরিয়ে দিত। স্বয়ং সুরজিৎ সেনগুপ্ত আমার খেলা দেখে প্রশংসা করে যান। ওই লাইনে থাকলে এত দিনে….

কোলাঘাট ব্রিজ। দেখুন দাদা, রূপনারায়ণ দেখুন, আহা। এই নদীটা আমার নাম বহন করে। আপনাকে বলাই হয়নি, আমার নাম নারাণ। নারায়ণ চন্দ্র জানা। বন্ধুরা নাড়ু বলে। জুনিয়াররা বলে নাড়ুদা। দীপুদা আমাকে নেরুদা বলে ডাকে। নেরুদার গোটা লাইফটাও একটা স্ট্রাগল। দীপুদা গল্প বলেছে।

ওই শোলের সেরা দৃশ্য গব্বরকে ঠাকুরের বদলা নেওয়া নয়। অমিতাভের ডেথ সিনও নয়। সাদা কাপড় পরা জয়া ভাদুড়ী একটা একটা করে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। আর অমিতাভ, মানে জয়, একা একটা মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে আপন মনে। ওটা খুব মনে পড়ে যায়। মনটা কেমন হু হু করে। আমি অনেক কষ্ট করে একটা অমনি মাউথ অর্গান কিনেছিলাম। কেন? কার জন্য? সব বলতে নেই দাদা। সব বললে সর্বনাশ।

মেচেদা ঢুকছে ট্রেন। আসি দাদা। কী সুন্দর সময় কেটে গেল। এইজন্যই দীপুদার মত আমিও বলি, লাইফ ইজ এ বিউটিফুল অ্যাকসিডেন্ট। আপনাকে অবশ্য যেতে হবে সেই খড়গপুর। রাম লাখানের বাকি গল্পটা মোটামুটি মিলনান্তক। একটুই বাকি ছিল।

আমিও স্ট্রাগল করে এখনও বেঁচে-বর্তে আছি। ভগবান আছেন। আপনার রিয়েলিটিতে হয়তো নেই, আমার রিয়েলিটিতে আছেন। আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কোনও শালাকে বিশ্বাস করা যায় না, যা দিনকাল। ভগবান আমাকে কানে কানে বলে দেয় কখন কী করতে হবে।

ভালো থাকবেন। মাইরি বলছি, নচিকেতার দিব্যি, মন বলছে, আপনি লোক মন্দ না।