Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এই সব সন্দেহ

বিপুল দাস

 

এক

–শুনছেন, কাল সমস্ত রাত শহরজুড়ে একটা বিশাল সাইজের ইঁদুর দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ভোর হতেই সেটা যেন বাতাসে মিশে গেল। তার লেজের ডগাও আর কেউ দেখতে পায়নি।

–কোথায় শুনলেন? আপনি নিজের চোখে দেখেছেন? আপনিও মাইরি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কমন পাবলিকের মত কথা বলছেন। কোথায় পিরবাবার তাবিজ-ধোয়া জল খেয়ে হাঁপানি সেরে গেছে। কোথায় কারেন্ট পাস-করানো আড়াই প্যাঁচের তামার তারের আংটি পরে অর্শ কমে গেছে, শুনেই পাবলিক পিলপিল করে দৌড়চ্ছে।

–সে রকম বিপদে পড়লে আপনিও দৌড়বেন মশাই। কত আগুনখেকো নকশাল দেখলাম। এখন মাকালীর ছবি প্রণাম না করে ঘর থেকে বেরোয় না। হাতে নবগ্রহ কন্ট্রোল করার জন্য দশটা পাথর, তাবিজকবচ, শেকড়বাকড়। আরও কোথায় কোথায় আংটি পরা আছে কে জানে।

–আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক মিন করিনি…

–আরে আমি কি বুঝিনি আমাকেই কেন এসব শোনাচ্ছেন। বছরে একবার মায়াপুরে যাই। তাতে আপনাদের তো কোনও ক্ষতি হয়নি। আর জানেন, দীক্ষা না নিলে এই শরীরটা শুদ্ধ হয় না। সংসারে থাকতে হলে এই শরীরে কত পাপ লাগে। অশুদ্ধ শরীরে ঠাকুরের নাম নিয়ে কোনও লাভ নেই। আপনাকে আর এসব বলে কী হবে। নিজের চোখে না দেখলে তো আপনি আবার কিছুই বিশ্বাস করবেন না।

–না, মানে বিশাল সাইজের ইঁদুর, শুওরের মত না হাতির মত… রাতভর শহরজুড়ে দাপাদাপি করল, অথচ আমি তো শুধু আপনার কাছেই শুনলাম। রীতিমত শোরগোল পড়ে যাওয়ার কথা। নিশ্চয় অনেকেই দেখেছে।

–আরে মশাই, যদিও আমাকে বলতে বারণ করেছিল, আমি তো বলে ফেললাম। আপনি আবার পাঁচকান করবেন না। আমাদের ক্লাবের পৃথ্বীশকে চেনেন তো, গতবার ক্যারম কম্পিটিশানে সিঙ্গলস্‌-এ চ্যাম্পিয়ান, ওর জামাইবাবুর কাল নাইট-ডিউটি ছিল। ভ্যান নিয়ে বাইপাসের মোড়ে ওরাই প্রথম দেখতে পায়। রাত দুটোর সময়।

–তা কী দেখল ওরা?

–প্রথমে ভেবেছে আঠারো চাকার বড় ট্রাক, ওভারলোডেড। রাত্তিরবেলা তো ছাই-ছাই রং কালো মনে হচ্ছিল। টর্চ মেরে ওরা নম্বর দেখছিল ভিন রাজ্যের গাড়ি কিনা। মোড় থেকে একটু দূরে বড় ধাবা পার হওয়ার পর অন্ধকার। ওখানে ওরা দেখতে পায় মস্ত একটা হাতি অন্ধকারের মত জমাট বেঁধে স্থির হয়ে রয়েছে। ওদের খুব আনন্দ হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছে বোঝাই গাড়ি, ওভারলোডেড। এখন দেখতে হবে গাড়ির নম্বর ডব্লিউ বি, নাকি ভিন রাজ্যের। অন্য রাজ্যের হলে কাগজপত্র চেক করা যায়, ওভারলোডের কেস দেওয়া যায়, রং-সাইডে দাঁড় করানোর জন্য ফাইন করা যায়। আপসরফা নিয়ে আলোচনায় বসা যায়। কিন্তু টর্চ জ্বালতেই ট্রাকের মুখটা অটোম্যাটিক ওদের দিকে ঘুরে যায়। ওরা দেখতে পায় ঝমঝম করে দুটো হেডলাইট বেজে উঠল যেন। তারপর কোনও শব্দ না করেই গাড়িটা বিদ্যুৎবেগে মুহূর্তে ভ্যানিশ হয়ে গেল। ওরা তো, কী বলে ইয়ে, পুরো গান্ডু বনে গেছে।

–মালফাল খেয়ে ছিল, কী দেখতে কী দেখেছে।

–না না, পৃথ্বীশ বলছিল ওর জামাইবাবু একদম টাচ করে না। ইদানীং অ্যানিম্যাল প্রোটিনও ছেড়ে দিয়েছে।

–ঘুষের পয়সা কীরকম প্রোটিন, অ্যানিম্যাল না ভেজিটেবল?

–ধুর মশাই, অ্যানিম্যাল কেন হবে, ম্যাক্সিমাম মিনারেলস্‌ হতে পারে।

–হ্যাঁ, তারপর? ওরা কী করে বুঝল ওটা ইঁদুর?

–একটু বাদেই শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অয়্যারলেসে খবর চালাচালি শুরু হয়ে যায়। হ্যালো চার্লি, নাম্বারপ্লেট ছাড়া একটা রহস্যজনক ওভারলোডেড ট্রাক কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। কোনও শব্দ না করে মুহূর্তে গাড়িটা ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। ওভার। হঠাৎ গুছাইতবাড়ি থানায় কারও মোবাইল থেকে একটা ফোন আসে। ভদ্রলোকের কালো মারুতি, শহরের বাইরে আম্বেদকর পার্কের সামনে উনি গাড়ির ভেতরে বসে ছিলেন। স্ত্রীকে স্টেশনে পৌঁছে দেবার জন্য ভদ্রলোক নিম্বার্ক হাউজিং কম্‌প্লেক্স থেকে রওনা হচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান একটু দূরে ঝাঁকড়া শিরীষ গাছের নীচে মস্ত বড়, যেন অনেকটা অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে, যেন কালো প্লাস্টিকে-মোড়া একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভদ্রলোক তার নিজের গাড়ির হেড-লাইট জ্বালাতেই আলো গিয়ে সেই গাড়ির সামনে পড়ল। তখনই তিনি দেখতে পান অনেক উঁচুতে ঝকঝকে দুটো আলো জ্বলে উঠল। কোনও শব্দ হল না, কিন্তু গাড়িটা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে উধাও হয়ে গেল।

–হুঁ, ভালো নামিয়েছে। এলিয়েন-এলিয়েন গন্ধ আছে। তারপর?

–পরে সেই ভদ্রলোক স্বরাষ্ট্রবিভাগের উচ্চপদস্থ আধিকারিককে জেরার মুখে জানিয়ে ছিলেন যে, অবশ্য খুব একটা জোর দিয়ে বলতে পারছিলেন না— অন্ধকারে প্রথমে সেটা ওভারলোডেড ট্রাক মনে হলেও তার গাড়ির আলোয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে তার একটা প্রকান্ড ইঁদুর মনে হয়েছিল। অবশ্য তিনি কনফার্ম হয়ে বলতে পারেননি। বারে বারে বলছিলেন— আমার যেন কেমন সন্দেহ হয়েছিল…

–আপনি এত ডিটেইলস্‌ জানলেন কী করে?

–পৃথ্বীশের জামাইবাবু ভোরবেলা বাড়ি ফিরে তার স্ত্রীকে এসব সন্দেহের কথা জানিয়েছে। পৃথ্বীশের দিদি তার বরের প্রতিটি ইনকামের হিসেব বুঝে নেয়। জামাইবাবু তার বউয়ের কাছে কিছুই লুকোয় না। চেষ্টা করেও পারেনি।

–হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি ওসব। তারপর কী হল? ইন্টারেস্টিং।

–সেখান থেকে পৃথ্বীশ শুনে আবার আমাকে বলেছে। ভোরবেলায় আমরা একসঙ্গে হাসাহাসি করি। লাফিং ক্লাবেই হাসতে হাসতেই পৃথ্বীশ বলছিল। আরে আছে মশাই, সব কিছু কি বিজ্ঞান আর যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায়। ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস, বাতাস— এসব কি আমরা দেখতে পাই? নেই নাকি?

–একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। “এসব সন্দেহ” বলতে পৃথ্বীশের জামাইবাবু ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন।

–মানে বিভিন্ন থানায় সমস্ত রাত ধরেই ফোন এসেছে। সবাই বলছে প্রকান্ড একটা ধূসর রং-এর প্রাণী, ইঁদুর বলেই সন্দেহ হচ্ছে, রাত দু’টো থেকে চারটের মধ্যে তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পেয়েছে। তারা বলছে  মনে হল একটা বিশাল কালো জন্তু চোখের পলক পড়ার আগেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ট্রাফিক পুলিশের দুটো গাড়ি দেখেছে, কিন্তু ওরাও পরে রিপোর্ট করেছে তাদের সন্দেহ হয় এটা পারমাণবিক শক্তিচালিত কোনও বিদেশি স্পায়িং গাড়ি হতে পারে। আবার এ রকমও হতে পারে জাপানি বুলেট ট্রেনের গতি নিয়ে একটা শুঁড়বিহীন হাতি ছুটে গেল। কনফার্ম করে কিছু বলা যাচ্ছে না।

–কিন্তু আজকের কোনও কাগজে বা টিভিতে কোনও চ্যানেলে কিছুই তো দেখলাম না। মাস-হিস্টিরিয়া হতে পারে। এ রকম হয় অনেক সময়। একবার ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরের কাছে একসঙ্গে অন্তত পাঁচ হাজার লোক দেখেছিল শূন্যে একটা…

–পৃথ্বীশের জামাইবাবু বলেছে স্বরাষ্ট্রদপ্তর ব্যাপারটা গম্ভীরভাবে নিয়েছে। মিডিয়াকে কিছু জানতে দেওয়া হয়নি। পুরো চেপে দেওয়া হয়েছে।

–পুরনো দিনের জাহাজ উলটো হয়ে ভাসছে। সেটা কি সম্ভব? গণ, কী বলে, সম্মোহন। তবে এই কেসটা একটু আন-কমন মনে হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, মানে আমেরিকার হাত থাকলেও থাকতে পারে।

–ধুর মশাই, কোথাও কিছু হলে আপনারা ওই এক আমেরিকার হাত ছাড়া আর কিছু খুঁজে পান না। লুজ মোশন হলেও ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঘরে বসে, অফিসের ক্যান্টিনে বসে আমেরিকার হাত খুঁজে বেড়ান। আপনাকে অবশ্য বলে লাভ নেই, সন্দেহের ব্যাপার তো বটেই। তবে, আই ডাউট আমেরিকা থেকে কোটি কোটি মাইল দূরের ব্যাপার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত রহস্য মশাই। আমি আপনি সেখানে হরিদাস পাল।

 

দুই

–আজ দুপুরে কিংবা বিকেলে মোবাইলে আমার কোনও কল বা মেসেজ এসেছিল?

–কেন? কোনও কল আসার কথা ছিল নাকি? আর মেসেজ এলে তো ইনবক্সেই পাবে, দেখে নাও।

–আমার কোনও প্রশ্নের তুমি সোজা উত্তর দিতে পারো না?

–সোজা উত্তর দিলেও তুমি সেখানে বাঁকা কথার গন্ধ পাও। কী করব, আমার মন বাঁকা, আমার বাপের বাড়ির সব কিছু বাঁকা। গিয়ে দ্যাখো, আমাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনটাও তোমার কাছে বাঁকা মনে হবে।

–বেশি বড় বড় কথা বোলো না। ভুল করে বাড়িতে ফোন রেখে গেলে তুমি কল-লিস্ট চেক করো না? ইনবক্স খুলে মেসেজগুলো পড়ো না?

–কে বলেছে?

–কেন, ক’দিন আগেই তো শোনালে আমি এখন বেশ ভালোই মোবাইল অপারেট করা শিখেছি। মেসেজ ডিলিট করাও শিখে গেছি। নিশ্চয় তুমি আমার ইনবক্স খুলে দেখেছ ফাঁকা।

–কী হয়েছে তাতে? স্বামীস্ত্রীর ভেতরে কেন কোনও গোপনীয়তার আড়াল থাকবে। তাদের কেন আলাদা কোনও প্রাইভেট লাইফ থাকবে।

–প্রাইভেট লাইফ বলতে কী বোঝাতে চাইছ তুমি? বিবাহ-বহির্ভূত কোনও বিশেষ সম্পর্ক? আমাকে অবিশ্বাস করো তুমি। শ্রদ্ধাভক্তি তো দূরের কথা, আমার ওপরে সামান্য বিশ্বাসটুকুও তোমার আর নেই। প্রত্যেকটা মানুষের একটা ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তার জগৎ থাকতে পারে। সেখানে সে একদম একা। সেটা তোমারও থাকতে পারে। প্রত্যেকটা মানুষের বুকের গভীরে একটা দীঘি থাকে। সেখানে সে শুধু নিজের মুখের ছায়া দেখতে পায়। তুমি তো এসব বিশ্বাস করো না। তুমি মনে করো ইনবক্স ফাঁকা, সুতরাং গোপন কোনও জীবন আমি যাপন করছি। তোমার ধারণা আমার ফোনে রোজ অসংখ্য মেসেজ আসে বা কল আসে, সেগুলো নিশ্চয় সবই সুন্দরী তরুণীদের। পড়া হলে আমি সেগুলো মুছে ফেলি। শুধু সন্দেহ একটা ধূসর অন্ধকারের মত তোমার মনের ভেতরে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে। আর এই সন্দেহের স্বপক্ষে স্পষ্ট অবয়ব তৈরি করতে না পারার কষ্টে তুমি ক্রমশ স্বরাষ্ট্রদপ্তরের দুঁদে আমলার মত রাগে অন্ধ হয়ে যাচ্ছ।

–কী করে এত বড় বড় কথা বুঝব বলো। মূর্খ পরিবার থেকে এসেছি। তোমাদের কত মহান পরিবার। তোমার কত কবিবন্ধু, লেখকবন্ধু। কত উচ্চমার্গের আলোচনা হয় তোমাদের। কত মেয়ে তোমার কবিতার গুণমুগ্ধ পাঠক। সরি, পাঠিকা। আমি কী এমন খারাপ কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম স্বামীস্ত্রীর আর আলাদা কোনও ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না। একটা জীবন কাটিয়ে দেবার জন্য দু’জনই দু’জনের কাছে যথেষ্ট।

–ভুল জানো। এই ভুল জানা থেকে তোমার চিন্তাভাবনার জগতে একটা ছোট্ট ধূসর বিন্দু ক্রমশ বিশাল জমাট অন্ধকার হয়ে আমাদের সম্পর্কের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত ছুটে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের শিরাধমনী বেয়ে। ওর সঙ্গে আমাদের আঁতাত আছে, এই সন্দেহে আমরা দু’জনই খতম হয়ে যেতে পারি। স্বরাষ্ট্রদপ্তর নজর রাখছে।