Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্তোষ রানাকে মনে রাখার একটাই পথ— ঋণ শোধ করো গো ঋণ শোধ করো

সন্তোষ রানা | রাজনৈতিক কর্মী

আজিজুল হক

 

চলে গেলেন সন্তোষ রানা। সমাপ্তি ঘটল এক বর্ণময় জীবনের। বিগত শতকের ষাট-সত্তর দশকে যে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ আছড়ে পড়েছিল ভারতের বুকে, তার অন্যতম সংগঠক হিসেবে সেই জীবনের সঙ্গে পরিচিতির সূত্রপাত আমাদের, এবং সমাপ্তি আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত এক লেখক হিসেবে। যে লেখার মধ্যেও ওতপ্রোতভাবে রয়ে গেছে তাঁর রাজনৈতিক জীবনই। তাই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম তাঁকে স্মরণ করার জন্য পৌঁছে গেছিল তাঁরই এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা আজিজুল হকের কাছে। অশক্ত শরীর এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আজিজুল কথা বললেন চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে।

 

আমরা বাইরে থেকে যা বুঝি, পুরো নকশাল আন্দোলনটাকেই বোধহয় দুভাগে ভাগ করা যায়। চারু মজুমদার থাকতে, আর তার মৃত্যুর পরে। প্রথমে চারু মজুমদার থাকাকালীন ওনার (সন্তোষ রানার) ভূমিকা নিয়ে কিছু বলুন।

আজকের এই রাজনৈতিক চৌর্যবৃত্তির যুগে ওই সময়কার যারা বুদ্ধিমান বা মেধাবী বলে কথিত সেই ছেলেদের মানসিকতা কী ছিল, সেইটা না বুঝলে পরে কিছুই বোঝা যাবে না। ছাত্র এবং যুবকদের বিশেষ করে যৌবনকে চাকরির ধান্দায় আদর্শ, স্বপ্ন ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘দরখাস্ত বিছিয়ে চাকরি চাই’, কাটমানি ফেরত চাই, কিম্বা যে ছেলে টাটার কারখানা করতে দেব না বলে লাথি মারত, সে-ই গিয়ে আবার টিসিএস-এ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সেইটার বিরুদ্ধে মেধাবী অমেধাবী সমস্ত ছাত্র তারা বলেছিলেন— ইচ্ছে হল কপাল খাবার খাচ্ছি তাই, তোর বাবার কী? তারা নিজেদের কপালে বোমা বেঁধে ঘুরেছিলেন, এবং একটি কথাই বলেছিলেন— ছাত্র আন্দোলন ছাত্র যুবকদের স্বার্থে হয় না, সেটা সবসময় দেশের স্বার্থে হয়, যা কিছু দেশের শ্রমিক কৃষক স্বার্থবিরোধী তার বিরুদ্ধে হয়। এইজন্য যাদবপুর, আরজি কর, প্রেসিডেন্সি— এই সমস্ত কলেজেই বড় বড় করে পোস্টার পড়েছিল— গরিবের জুতো তৈরি হবে বড়লোকের চামড়ায়। এটা ওই যুগের বৈশিষ্ট ছিল। সেটা তো আকাশ থেকে পড়েনি। সেই সময় গোটা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো যদি, ভিয়েতনাম জ্বলছে, আমেরিকায় প্রতিদিন যুদ্ধবিরোধী মিছিল হচ্ছে, প্যালেস্টাইন আরব থেকে শুরু করে গোটা বিশ্বটা আগুনের ভাটার মত গনগন করে জ্বলছে। ছাত্রযুবদের যে অংশটা আগে ছিল বুদ্ধজীবী, এখন বুদ্ধিজীবী, এদের কোনও অস্তিত্বই তখন ছিল না। সাধারণভাবে মানুষের কাছে প্রশ্ন ছিল— ঋণ শোধ করো গো নগরবাসী। তুমি আজকে যাদবপুরে পড়ছ, এতে তোমার কয় পয়সা? এতে তোমার বাবামা-র কয় পয়সা আর জনগণের কয় পয়সা? কার বিনিময়ে আমি আজকে আজিজুল হক হয়েছি? সুতরাং আমি যাদের কাছে ঋণী, সেই ঋণটা শোধ করতে হবে। কৃষকের সঙ্গে অন্তরে অন্তর মিলিয়েই তুমি পরিচয়টা পেতে পারো। ‘বাহিরে কুটিল সে, অন্তরে ঋজু’— এই মানুষকে খুঁজে বের করো, এই মানুষকে বলো যে এই দেশ কার। এই দেশের যা কিছু মহান, সে অজন্তা ইলোরা থেকে তাজমহল পর্যন্ত, কবি যতই বলুক না অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরে শাজাহান, আদৌ তো তা নয়। এ সমস্ত আর্টিসান এবং কৃষকদের সৃষ্টি। বিযুক্ত করা হয়েছে দেশের সম্পদ সৃষ্টিকারীদের, তাদের কাছে গিয়ে ঋণ শোধ করো। এই ঋণ শোধ করার অঙ্গীকার নিয়েই সন্তোষ এবং সন্তোষের মত যুবকরা বেরিয়ে এসেছিলেন। এবং এই আহ্বান এসেছিল নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন এবং যিনি মূলত এর ভিত্তি রচনা করেছিলেন সেই চারু মজুমদারের কাছ থেকে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই, চারু মজুমদারপন্থী বলতে যাদের বোঝায়, চারু মজুমদারের কথা, উনি কী বলতে চাইছেন তা বোঝা, হাতে কলমে সেটা প্রয়োগ করা, এই সমস্ত দিক থেকে তাঁরা চেষ্টা করেন। সন্তোষ তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে সিনিয়র রিসার্চ স্কলার, রিসার্চ গাইড বোধহয়, এই অবস্থায় ও বেশ কিছু ছেলেপুলেদের নিয়ে ওর গ্রামে, ডেবরায়, মেদিনীপুরে চলে যায়, গ্রামে আন্দোলন গড়তে শুরু করে। আজকের সময় যখন দেখি, সেইটাই সন্তোষের সঙ্গে কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল, আজকেও সবই আছে, জোতদার আছে, অন্য ফর্মে, কৃষকদের উপর শোষণ আছে, তোলাবাজি আছে, জরিমানা আছে, গ্রামের সেই মানুষখেকোগুলো এখনও আছে, দেশটা আরও বেশি খারাপের দিকে গেছে, ‘দুহাতে সরাব জঞ্জাল’ বলে জঞ্জাল জমিয়েই যাচ্ছি! কেন হচ্ছে না? কোথায় একটা অসুবিধে হচ্ছে বলো তো? শুধু কি একটা চারু মজুমদারের অভাব বোধ করছি? এমন বিশ্বাসযোগ্য একটা নেতা যিনি দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েদের সামনে বলবেন, I am the alternative party. যিনি বলবেন কৃষকের ঋণ শোধ করো। যিনি চলনে বলনে প্রেস্টিজ অফ দা লেফট অ্যান্ড প্রিভিলেজ অফ দা রাইট-এতে বিশ্বাস করেন না। এরকম একটা নেতার অভাব? ছাত্রযুবরা বিশ্বাস করতে পারছে না? যৌবন তার ধর্ম, বিদ্রোহ করার মেজাজ, প্রতিবাদ করার মেজাজ তো হারায়নি। হারালে তো বলতে হবে তারা বুড়ো হয়ে গেছে। তাহলে কি এইরকম একটা জায়গায় তারা বিশ্বাস রাখতে পারছে না? নকশালবাড়ি বলো চারু মজুমদারই বলো এটা দীর্ঘ কমিউনিস্ট আন্দোলনের ফল, এটা আকাশ থেকে পড়েনি। সেগুলো এই ধারাবাহিকতার শ্রেষ্ঠ ফসল হিসেবে এসেছিল। তারপর চারু মজুমদারের শহীদ হওয়া। পার্টির মধ্যে তথাকথিত চিনের সমালোচনা বলে বস্তুটা এল, নানাভাবে। একটা কমিউনিস্ট পার্টিকে কোনওসময় শত্রুরা ধ্বংস করতে পারে না। কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস হয় অভ্যন্তরীণ কারণে। কমিউনিস্ট পার্টি যদি ধ্বংস হয় জিন্দাবাদপন্থীদের হাতেই হবে। আজকে যখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই সময় যারা বলেছিল চারু মজুমদারকে আনক্রিটিকালি মানতে হবে, অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে, আজকে কিন্তু তাদের পাত্তা নেই। আমরা যারা ক্রিটিকালি নিয়েছিলাম আমাদের ঘাড়েই দায়িত্ব এসেছে যে সত্তরের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা এবং অমিত শাহের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার ফারাকটা কী সেটা বলার। সত্তরের বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে কিছু না হোক, বিনয় ঘোষ সুমিত সরকারদের জন্ম দিয়েছে। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি খুন করেছেন, পৃথিবী পেয়েছেন মানুষের ব্লাড সার্কুলেটরি সিসটেম, অ্যানাটমি। আর জ্যাক দা রিপারও খুন করেছে। দুটোকে এক করে দেখলে চলবে না। সেইটা ছিল ঐতিহাসিক অনুসন্ধানকে জাগিয়ে দেবার জন্য সিম্বলিক আঘাত আর এটা বিদ্যাসাগরকে বিদিয়াসাগর বানিয়ে তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। যারা সত্তরের সঙ্গে এটাকে ইকুযেট করে দেবার চেষ্টা করছে তারা ছিল জিন্দাবাদপন্থী, আনক্রিটিকালি মানার পন্থী। একটা কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস হয় জিন্দাবাদপন্থীদের হাতেই। যারা অক্ষরে অক্ষরে চারু মজুমদারকে মানতে গেছিল তারা সব থেকে আগে চারু মজুমদারের বিরোধিতা করেছে। সন্তোষ গ্রামের ছেলে হওয়ার জন্য, অসম্ভব বৈজ্ঞানিক মননশীলতার জন্য ওর নানান সময়ে নানান কনফিউশন এসেছে। কিন্তু চারু মজুমদার বিরোধী বলে যখন ওকে চিহ্নিত করা হয় আমার কষ্ট হয় এইকারণেই যে সন্তোষের সঙ্গে চারু মজুমদার বিরোধীদের ফারাক আছে। যেহেতু ও গ্রামে ছিল ও বুঝতে পারত চারু মজুমদারের কথার কোথায় এক্সেস প্রয়োগ হয়েছে। অন্যদের চারু মজুমদার বিরোধিতা যেভাবে ইতরামোর জায়গায় পৌঁছে গেছিল, ওরটা সেরকম না। আলাদা পার্টিও করেছে। কিন্তু আমরা যারা তথাকথিত চারু মজুমদারপন্থী (কিনা জানি না), আমাদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কোনওদিন খারাপ হয়নি। বিশেষ করে শ্রেণি লাইন এবং কৃষকের প্রশ্নে তার দৃঢ় অবস্থান, সে এখান থেকে কখনওই সরেনি। তার কাছে মৌলিক সমস্যা হিসেবে এসেছে ভারতবর্ষে কাস্ট এবং ক্লাসের দ্বন্দ্ব, গোটা কমিউনিস্ট ধারা এটাকে অ্যাড্রেস করেনি। এইটা বারবার তাকে নাড়া দিয়েছে। এই নির্বাচনে জাতপাতভিত্তিক নির্বাচন তো হল না, উত্তরপ্রদেশে গুজরাটে রাজস্থানে বিহারে এই সমীকরণ তছনছ হয়ে গেছে। আমার আফসোস সন্তোষের সঙ্গে এ নিয়ে আর কথা হল না। মৃত্যুশয্যাতেও সে কাস্ট এবং ক্লাসের সম্পর্ক নিয়ে ভেবে গেছে। আইডেন্টিটির সঙ্গে ক্লাস-এর সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছে। একটা সময় অবধি ও ভাবত মুসলিমরা দলিতদের থেকেও যেহেতু বেশি নির্যাতিত, মুসলিমদের জন্য আলাদা কমিউনিস্ট পার্টি হবে না কেন? এরকম ভাবনাও এসেছে ওর মাথাতে, কিন্তু ও ডিসকার্ড করেছে ওর অভিজ্ঞতা দিয়েই, বিকজ হি ইজ সন্তোষ রানা। ও সবসময়েই পরীক্ষানিরীক্ষা এসবের মধ্যে যেতে যেতেই পাল্টে যাচ্ছিল। এবারের নির্বাচনের ফলাফল হয়ত কাস্ট এবং ক্লাসের সম্পর্কে তাকে নতুন দিকে নিয়ে যেত, অসময়ে চলে গেল। সন্তোষের চারু মজুমদারের বিরোধিতা একেবারে জেনুইন। এ হল ওর অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেটা ও চারু মজুমদারের লেখা থেকে হয়তো সন্তুষ্ট হতে পারেনি, অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

আচ্ছা উনি কি মেদিনীপুরেই কাজ করতেন? তাহলে সেই সময়ে ডেবরা গোপীবল্লভপুরের সংগঠক অসীম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্টির যখন টু লাইন হয় বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রশ্নে, তখন ওনার ভূমিকা কী ছিল?

আমরা তখন জেলে। ওর পার্টিকুলার ভূমিকাটা কী জানি না, তবে অসীমের ভূমিকা যে মেনে নেয়নি সেটা পরিষ্কার। অসীমের সঙ্গে এই বিরোধটাই বোধহয় অসীমের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রাথমিক কারণ হিসেবে থেকেছে। অসীমের বিবৃতি তখন BBORC (বাংলা বিহার ওড়িশা সীমান্ত কমিটি) নামেই বেরিয়েছিল— কমরেড ইয়াহিয়া খান লাল সেলাম। এখন BBORC-র মধ্যে সন্তোষের ভূমিকা কী ছিল এটা আমি জানার চেষ্টাও করিনি। জানতে যাওয়াটা অভদ্রতা হত। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে বোধহয় ও ব্যাপারটাকে হজম করেনি।

উনি যেহেতু পার্টির উপরের স্তরের নেতা ছিলেন, তাই অন্যান্য টু লাইনগুলিতে ওনার ভূমিকা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন…

প্রথম পার্টি কংগ্রেসের লাইন, নীতি, কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে খুব দৃঢ়ভাবে সমালোচনা পাইনি। তখন ও নিজে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছে। কিন্তু খুব সোচ্চারভাবে বিরোধিতা করতেও ওকে কখনও দেখিনি। ইভেন সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের সময়েও লক্ষ করলে দেখবে অন্যরা যখন সিপিএম মারছে বলে মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চেয়ে লম্ফঝম্প করছে, সন্তোষ কিন্তু খুব রিজার্ভড থেকেছে। নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলোকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হিসেবেই চিরকাল দেখে গেছে। খুব দৃঢ়ভাবে পক্ষ অবলম্বন ও করেছে বলে আমার অন্ততপক্ষে মনে নেই, ওর ডকুমেন্টেও নেই। তদ্দিনে ও নতুনভাবে ভাবছে বৃহত্তর ভারতবর্ষ নিয়ে, কাস্ট ক্লাস রিলিজিয়ন নিয়ে। এখানে হয়তো কুমারেরও অবদান থাকতে পারে।

আচ্ছা এবার আসি সিএম-এর মৃত্যুর পরে। তখন তো ভাঙনের সময়। উনি যে সত্যনারায়ণ সিং-এর সঙ্গে যোগ দিলেন, তার ঘোষিত কারণ কী ছিল?

ঘোষিত কারণ কিছু না। ধাক্কাটা খাওয়ার পরে খুব স্বাভাবিকভাবেই নানানরকম প্রশ্ন আসতে শুরু করে। একটা কেন্দ্র তো তার দরকার। বিশেষ করে ও যে অঞ্চলে কাজ করে। চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরে বিকল্প কেন্দ্র হিসেবে যারা চারু মজুমদারের লাইন মেনে চলা বলতে যা বোঝায় তা করছিল, তাদের উপর আস্থা রাখার মত ছিল না বলে ও মনে করেছে। ওর মত হাই ইন্টেলেক্টের একটা ছেলে বিকল্প হিসেবে সত্যনারায়ণ সিংকে খুঁজে পেয়েছিল।

ওনার চারু মজুমদারের বিরোধিতা করার মূল প্রশ্নটা কী ছিল?

অনেক প্রশ্ন ছিল। খতমের প্রশ্ন ছিল। শ্রেণি এবং জাতপাতের প্রশ্ন ছিল। সরাসরি চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে না হলেও চারু মজুমদারপন্থী কেন্দ্রের সঙ্গে চারু মজুমদারের কর্তৃত্বের প্রশ্ন, চিন থেকে সমালোচনা এসেছে বলে যা যা এসেছে, সমস্ত প্রশ্নেই অলমোস্ট বিরোধিতা ছিল। কিছুটা সুসম্পর্ক রাখার জন্যই বিরোধিতা নিয়ে অত জিজ্ঞেসও করিনি। তবে সম্পর্কটাই প্রমাণ করে দেয় বিরোধিতাটা সেই পর্যায়ে ছিল না। তবে ও সমস্ত প্রশ্নে ভাবত, গোটা দেশটাকে নিয়ে ভাবত, নানানরকমভাবে ভাবত। আমরা যেখানে ভাবনাটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, বোধহয় গবেষক হওয়ার জন্যই ভাবনাটাকে ও শেষ করত না। আমরা যেখানে E=mc2 সিদ্ধান্তে এসে হাজির হয়েছিলাম ও সেখান থেকে কোয়ান্টামে চলে গেল। ভাবনাটাকে কোনসময়েই ও অফ করেনি। চারু মজুমদারও ভাবতেন দেশটা কৃষকের, সন্তোষও ভাবত দেশটা কৃষকের। অন্যরা ভাবত দেশটা আমার। সন্তোষ কৃষক বাড়ির ছেলে বলে খুব সহনশীল ছিল। একটা কৃষকের সহনশীলতা দীর্ঘস্থায়ী সহজাত। ধানটা রুইয়ে দিয়ে তাকে তিনমাস অপেক্ষা করতেই হবে, পোকা লাগতে পারে, খরা হতে পারে, বর্ষায় ভেসে যেতে পারে, কৃষকের অস্থির হওয়ার উপায় নেই। মাও সে তুং যেটা বলছেন ধৈর্যকে কৃষকের মত বাড়িয়ে তোলো। ও ধৈর্যটাকে অসম্ভব বাড়িয়ে তুলেছিল।

উনি তো তারপর ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন, বিধায়কও হয়েছিলেন। মূল ধারার সংসদীয় বামপন্থী পার্টিগুলির সঙ্গে ওনার সম্পর্ক কীরকম ছিল?

সংসদীয় পার্টিগুলি ওকে পাত্তা দিত না, ওর থেকে ওরা অনেক বেশি পাত্তা দিয়েছে অসীম চ্যাটার্জিকে। ও এমএলএ হওয়ার পরেও ওরা ওর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। ওরা যেহেতু বুঝতে পারত লোকটা সুবিধের লোক নয়, সম্পর্ক খুব একটা রাখত না। সন্তোষ কোনওদিন নিজের সততা বিসর্জন দিয়ে ইলেকশনে দাড়াবে ভাবেনি। ও জিতেছে নিজের হিম্মতেই জিতেছে। অসম্ভব পপুলার ছিল এলাকায়। সেখানে এদের খুব বেশি কন্ট্রিবিউশন ছিলও না। সেটা থাকলে ওদের পার্টির প্রোগ্রামগুলোয় এক্সিবিট করত ওরা। বাধের টাকা হেন টাকা তেন টাকা তমুক জায়গায় চলে যাবে এগুলো ওকে দিয়ে করানো যাবে না বুঝে গেছিল, তাইজন্য পরেরবারে হারিয়ে দিল ওকে।

চারু মজুমদারের মৃত্যুর পরেও সিপিআই(এম-এল) সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, এবং আশির দশকে তা বেশ বিস্তার লাভ করেছিল, যার অন্যতম নেতা ছিলেন আপনি। তা সেই সংগ্রামের প্রতি ওনার মনোভাব কেমন ছিল?

ও মনে করত যে আমরা শিক্ষা না নিয়ে উড়বার চেষ্টা করছি, আমরা ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমরা আবার ধাক্কা খাব, তারপর নেমে পড়ব। কিন্তু অন্য নকশাল গ্রুপগুলো ওই পিরিয়ডটাকে সিপিআই(এম-এল)-এর ইতিহাস থেকে মুছে দেবার যে চেষ্টা করে, মিডিয়া থেকে নকশালবাড়ির ইতিহাসবিদ অবধি, ও অন্ততপক্ষে রেকগনাইজ করেছে। বলত, ওরা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝবে। এ পথটা আমরা অতিক্রম করে এসেছি, এ পথটা পথ নয়। খুবই ক্রিটিকাল ছিল, কিন্তু সহনশীলতার সঙ্গে ক্রিটিকাল ছিল। দুঃখ পেত, যে আমরা শিক্ষিত হচ্ছি না।

শেষ প্রশ্ন, এবিপি আনন্দে আজ লিখছে দেখলাম, সাহিত্যিক সন্তোষ রানার জীবনাবসান। তা সন্তোষ রানাকে আপনি ঠিক কী হিসেবে মনে রাখতে চান? এবং জনগণ মনে রাখুক, চান?

এবিপির কাছে সাহিত্যিক সন্তোষ রানাই বটে। যে যেভাবে দেখে। ঐখানেই বোধহয় সন্তোষ থাকলে খুব মজা পেত যে পরিচিতি কাকে বলে। সাহিত্যিক সন্তোষ রানা, রাজনীতিক সন্তোষ রানা, পারিবারিক সন্তোষ রানা। একটা মানুষের তো একটা পরিচয় নয়, অনেকগুলো পরিচয়। আনন্দবাজার সাহিত্যিক পরিচয়টা ধরেছে, তোমরা তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিচয়টা ধরেছ। যারা পরিচিতি নিয়ে লাফালাফি করে— একটা মানুষের কম করে তিনটে পরিচয়। কর্মস্থলে, মর্মস্থলে, সমাজে। একজন শ্রমিক কারখানায় শ্রমিক, বাড়ি ফিরে এসে সে গৃহকর্তা, সেখানে সে মালিক, একইসঙ্গে শ্রমিক এবং মালিক, একইসঙ্গে বিহারী এবং ভারতীয়, একইসঙ্গে হিন্দু এবং কাজ করছে মুসলমান শ্রমিকের সঙ্গে। একজন মানুষের একটাই পরিচয় কখনও হতে পারে না। যারা পরিচিতি নিয়ে কথা বলে তাদের এই মৌলিক বোধটাই নেই। একইসঙ্গে একজন শ্রমিক মালিকও বটে। কোন পরিচয়টা কোনখানে প্রধান সেইটা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই আনন্দবাজার বাজারী আনন্দে যেটা চলে সেভাবেই চালিয়েছে।

সন্তোষ রানাকে মনে রাখার একটাই পথ— ঋণ শোধ করো গো ঋণ শোধ করো। সমস্ত শহীদদের মনে রাখার এটাই পথ। তাদের একটাই আহ্বান আমার এই পার্কিনসন রোগে, আশি বছর বয়সেও কানের কাছে বাজে। এই ঋণ শোধ করার কোনও বিকল্প নেই। মিথ্যা অনেকগুলো, সত্য একটাই। মিথ্যা দিয়ে যেমন উদরপূর্তি হয় সত্য দিয়ে হয় না। সেই সত্যটা হচ্ছে মানুষ, To quote চারু মজুমদার, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভয় স্বার্থপরতা থাকবেই। পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যার এগুলো নেই। গবেষণার বিষয়, ভালোবাসার বিষয়, কাজের বিষয়— ওই সত্যটা মানুষ। আবার এই মানুষই মানুষকে দুর্দিন থেকে সুদিনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। নাহলে আমার তো বেঁচে থাকার কথা নয়। মানুষই ইতিহাস তৈরি করে। মানুষকে ভালোবাসো। পাগলের মত ভালোবাসো। ফেস ভ্যালুতে তাকে দুম করে বিচার করতে যেও না। বাহিরে কুটিল সে, অন্তরে ঋজু। বাইরে যাকে দেখছ বিজেপি করছে তার ভেতরে গিয়ে দেখো, সে একটা নিরাপত্তার বলয় চাইছে, কেন্দ্র চাইছে, যেখান থেকে সে তার ঘৃণা প্রকাশ করতে পারে। যেটা তোমার আমার কাছ থেকে সে আশা করেছিল। জয় শ্রীরাম বলে তৃণমূলের অফিসে যাচ্ছে, লাল ঝান্ডা টাঙিয়ে দিয়ে চলে আসছে, সে জয় শ্রীরাম না লাল ঝান্ডা? সে যা আশা করেছিল, একটা কমিউনিস্ট পার্টি, একটা কেন্দ্র যে জনগণকে বলবে সশস্ত্র হও, বলবে হত্যাকারীকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থই মৃত্যু, সেই আস্থার জায়গাটা নেই। সত্য হচ্ছে মানুষ, সে দ্বিধাগ্রস্ত হবে, সে ভয় পাবে, সমস্ত কিছু জেনেই মানুষকে ভালোবাসতে হবে। অন্তরে অন্তর না মিলিয়ে সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।