Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অন্তর আলির নামচা: তোলপাড়ের যাবতীয়…

ঈশিতা দে সরকার

 

শেষ অব্ধি অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এমন কথা নিঝুম শুনতে হয়; শুনতে শুনতে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা চলে ডায়েরির পাতায়; কলমের অভ্যস্ত ডগায়। বইচিত্র সভাঘরে বই প্রকাশ। বলছেন কবিবন্ধু কিশোর দাস। একদম বাড়ির পাশের রোজ মুখ দেখা মানুষটা যেন। বলছেন কবির কথা। কবিতার কথা। কবি অনুপস্থিত। কবি গৌতম দাস।

এই অনুপস্থিতি; এই ফাঁকা; এই শূন্যতা ডুয়ার্সের কুয়াশা। রোদ ওঠার পরেও ভিজে ভাব থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ।

অবিকল আসলের মত প্রতিশ্রুতি; অবিকল আসলের মত প্রতিবাদ
আসলে গোপনে লাশ প্রেমিকায় পুঁতি
পায়ে পায়ে পড়ে থাকে এঁটো ফুটপাথ

(অবিকল কাব্য)

দীর্ঘমেয়াদি কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ে কবিতায়। ‘আসলের মত প্রতিবাদ’। চপেটাঘাত। নুয়ে থাকা অন্তরের গলি-পাকস্থলিতে। ঢুকে পড়ি কবিতার যন্তর মন্তরে। ‘গোপনে লাশ প্রেমিকায় পুঁতি’— এই উচ্চারণ থেকে পালাব কোথায়?

‘চম্পার গল্প’ কবিতার পেট থেকে প্রেমিক বলছে… ‘প্রেমিক ডুব দেয়; সঙ্গে এক কুড়ি/ কহো না প্যার হ্যায়/বলে কী মুখপুড়ি।’ প্রেম জল খোঁজে। ভাসে। নিমজ্জিত হতে হতে ‘লাশ’ কলম হয়ে ওঠে। এই বিস্তৃত নির্মাণ কবি রাখছেন। কবি কী রাখছেন; কী রাখেননি তার পুরোটাই এখন পাঠকের জিম্মায়। পাঠক নিজের মতো করে বুঝে না বুঝে স্বরলিপি বানিয়েছেন। হাত বুলিয়েছেন মরমিয়ায়। সারাদিন কবিতারা পাঠকের সঙ্গে স্কুল বাজার রিহার্সাল ডাক্তার স্নান ঘুম সারছে। কবিতার মালিকানা উঠে এসেছে কবিতা পড়ুয়ার কাছে। এই কবিতার বই এসব করাচ্ছে। কবি জানালার ধারে বসে মাপছেন অকাজের বরাদ্দ। যেন কবি মানে কাজ নেই। অথচ পৃষ্ঠা ভরছেন প্রেম; সমাজ; দর্শন; খিদের প্রাইমারি টাস্কে।

চম্পা কে? কী কথা তার সঙ্গে? তাহার সঙ্গে? ‘চম্পার গল্প’ কবিতায় মোড়ক কাহিনি উন্মোচন করছেন।

‘বাহির পরিপাটি ভিতর ভেসে যায় /কেউ কি বোঝে কিছু? বোঝানো কার দায়?’ সমাজচিন্তক। দার্শনিক। নয়ত নিছকই হৃদয় থেকে হৃদয়ে কাহিনির তরঙ্গায়ন। বাহির আর ভেতরের এই কনফ্লিক্ট-এ মানুষ আছে। আবার নেই। জন্ম নিচ্ছে কবিতা। শিল্প। গৌতম দাস এত নিরাভরণভাবে লিখে রাখলেন ভিতর বাহিরের গল্প।

আমি তোর কীর্তনিয়া
আমি তোর বিষ
খুব খিদে পেলে পরে আমাকে ডাকিস।

(ছোবল গীতিকা)

প্রেম বৈচিত্ত। বিদ্যপতির রাধিকার নব নব ধারা বিবর্তনের পথে কোহেন কিংবা সীগার হয়ে যাচ্ছে। কবে থেকেই যেন এই কবিতা ভরসার ডাকনাম। রোজকার গণ্ডগোল। গৌতম দাস খিদে পেলে ডাকার আঁচল পেতেছেন। এভাবে যদি প্রতিটা কবিতা নিজের মত করে গায়ে মাখিয়ে নিই; শেষ হবে না কথা। দাঁড়াতে হবে ঘটমান সত্যমিথ্যার মুখোমুখি। মিথ্যের পরেও মাশরুম ফোটে। বাঁচা তেমনই তুমুল। কবিতারা প্রমাণপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে….।

ইট ভাটায় আগুন জ্বালালে
মনে হয় মা বোন পুড়ছে

(চণ্ডাল)

শরীর শ্লথ হয়ে আসে ভয়ে। মাথায় রক্তচাপ। অসহায় সস্তা শব্দ এখন। স্কুল যাওয়ার পথে তিনটে ইটভাটা পেরোই। গাণিতিক হিসেবে ক’জোড়া মা বোন পোড়ে!!

নিজের চোখে মুখে হাতে গলায় হাত বুলাই। আমি বেঁচে আছি। আমি কাঁদছি না।

আমাকে কাঁদতে নেই; যেন বলতে নেই— পারব না পারব না

(চণ্ডাল)

নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে থেকে প্রান্তবাসী কবি শুধু তাকান না। দেখেন। আমাদের এড়িয়ে যাওয়াগুলো দেখেন। দেখিয়ে দেন সাদা কালো ক্যালাইডোস্কোপে। অন্তর আলির নামচা আমার নিজস্ব ‘দূর দর্শন’!

প্রেম। একাধারে বনেদি ও ক্যাম্পাসী। ছন্দের বেলায় সহজ ভাব। বাকি ব্যাকরণ জানি না। মানি না। বুঝিও না।

আমি ঘোর পরকীয়া কেশবের পর
আমি তোর কীর্তনিয়া— প্রেমিক বাঁদর।

(ছোবল গীতিকা)

তা, নামেই তো অনেকটা হয়ে যায়। আসলে কি হয়? শরীরে মনে যে চুরমার চলে; শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে করতে যন্ত্র ছাড়া যখন সেই যন্ত্রণাকে তুলে আনতে হয়; তখন তা মহামূল্য খনিজ সম্পদ। যদিও খনিজ সম্পদ হয়ে ওঠে অন্য কোনও আনাচে—

খালি পেট
কালি পড়া
দু’চোখের হ্রদ।
বিশেষজ্ঞ দেখে বলে;
মারহাব্বা; খনিজ সম্পদ।

‘মারহাব্বা’ এই একটা শব্দে আমার রাষ্ট্রের দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়। বারবার পড়ার মত কবিতা। বারবার ধাক্কা দেওয়ার শব্দ মারহাব্বা। যাকে ‘মারহাব্বা’ দিয়েই বিশেষিত করা যায়। এ দেশে খালি পেট তো স্টাইল স্টেটমেন্ট। খালি পেটে মানুষ কীভাবে খনিজ হয়ে ওঠে; অল্প পরিসরে গল্প নয়; সত্য দেখছেন কবি।

অন্তর আলির নামচা
প্রকাশক- তবুও প্রয়াস
দাম- ১০০.০০
প্রথম প্রকাশ-  জুন, ২০১৯

এ বইয়ের পুরোটাই ভালো। মায়ের মত; কাছছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। এ বই পড়ার পর নিজের মত করেই লেখা আসে। কখনও বুঁদ সুরাবনত হয়ে থাকা যেন; কখনও বীভৎস তোলপাড় আর কী যেন একটা হয়! আমরা যারা শুধু ডিজিটাল প্রতিবাদ করি তাদের হয়ত ‘বুকে রাগী মেঘ’ একবার হলেও ডেকে ওঠে। একটা ম্যাজিক বই প্রকাশ করেছে ‘তবুও প্রয়াস’।

‘থালা; বড়ো কাসার থালা পেতে ধরেছে আমার মুখের তলে। হর হর করে বমি করছি আমি’ (আমি হই একটা কুকুর)। এই বমি ঢালতে হলে প্রলোভনের সয়ে থাকাকে তোয়াক্কা না করার দম থাকতে হয়।

থাকতে হয় ‘চেটে চেটে পরিষ্কার করে দিই পাতা/ লেজ বেঁচে গেছে কোন আছিলার ঘোরে’ বলার মত স্পর্ধা। গৌতম দাস পারেন। কবিতা ছাড়া কবিতার কাছে আর কোনও প্রত্যাশা নেই যে…।

যারা দেশ চালায়; খিদে মারে খিদে জাগায়। মৃত ও জীবিতদের মধ্যে এক অদ্ভুত সহাবস্থান যেন।

‘মৃত ও জীবিতদের মিলিজুলি এক সরকার চালাচ্ছে আস্ত দেশ’— এমন ভানহীন কবিতা ক্যাথারসিসের মত তীব্র।

প্রসঙ্গ যখন সাম্প্রদায়িকতা; ভেতরে গিয়ে প্রশ্ন উত্তর যন্ত্রণা খুঁজছেন কবি।

উনুন নিজেই পোড়ে উনুনের আঁচে
জলে মাছ
মন পোড়ে
সম্পর্কের ভারতীয় সুতোগুলো

(সাম্প্রদায়িকতা)

এই পঙক্তি নিয়ে সেমিনার হোক। রচনায় কোট হোক। বহু চর্চিত হোক। চর্চিত হোক – সেমিনার ছাড়াও মানুষের সম্পর্কের সুতোগুলো ছিল মাঞ্জা দেওয়া। কবিতা সেই পথের দিশারী।

আবার; ‘ধার্মিক আনথ্রাক্স-এর জীবানু বহন করে কোন কোন কবিতা’ (মশারি টাঙিয়ে যে কবিতা) দূরত্বের স্কেল আর বিষাক্ত নখ দাঁতের ভয় দেখালেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। ভয়কে জয় করার খুঁটিও পুঁতে রেখেছেন কবিতার আগাগোড়ায়।

আমার সমস্ত ক্ষতে জ্বালা
আমার সমস্ত ক্ষত মধুময়..
এক কবি এসে দেখালো তার খয়েরি খাতা
খাতা ভরতি আলো -কালো তৃষ্ণার ঘরবাড়ি…

(কবি)

প্রচার-প্রাচুর্যের আলো থেকে দূরে থাকেন কবি। আসলে মানুষটির ভেতর সহজিয়া জীবন আর কবিতার আলো নিজেই সূর্য হয়ে জ্বলে ওঠে রোজ। আলোকিত হয় একেকটা কবিতার শরীর। গৌতম দাস; আমাদের কমে আসা নির্ভেজাল চলার মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকা বাতিঘর। সব কবিতার সামনেই দাঁড়িয়ে সেরে নিই ফেলে আসা ‘কনফেস’।

অন্তরের অন্ধকারে কবিতারা আলো হয়ে উঠছে দীপাবলির রাতে ফেলে দেওয়া নারকেলের খোলা; পাটকাঠি; মোমবাতি দিয়ে জ্বালানো টর্চের মত। একান্ত নিজের ছিল সে আলো। একান্ত নিজ অনুভবেই এতক্ষণ থামিনি। এবার চলে যাব। কিন্ত ‘আমি যতদূর যাই /সঙ্গে সঙ্গে যায় খিদে’ (পাঁচামির গান)।

কবি বা কবিতা পড়ুয়া। খিদে আলাদা হতে পারে। ক্ষুধার্ত তো দুজনেই…. সঙ্গ ছাড়া হয় না।।

মনে মনে ভাবি; কিন্ত ফেঁসে যায় সাইকেল টায়ার।
ফিরে দেখি বাড়ন্ত সংসার। বউ রঙিন শূন্যতা খুঁটছে। ফুটিয়ে তুলছে অপত্যের অনটনী বাহার
একলা শালিক বলে মনে হয় গো গোটা দুনিয়াটাকে।

হাঁটু মুড়ে বসে থাকে পাঠক। স্পষ্ট কথা কবিতা; কবিতা থেকে বোধের হিজল গাছ। জীবনানন্দ মনে পড়ে।

একলা শালিক। রোদ পোহায়। ভেজে। ডানা ঝাপ্টায়।

রোজ খড়কুটো পায় কিনা কে জানে!! খেতে পায় কি না রোজ! এই ‘একলা শালিক’ আমারও আছে। শুধু দুনিয়াটাকেই একক শালিকের মত নিঃস্ব অথবা পূর্ণ দেখতে পারি না বলে ‘অন্তর আলির নামচা’ লিখতে পারি না।