“যে যায় সে যায়”

গৌতম দাস | কবি

শতানীক রায়

 



কবি, গদ্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক

 

 

 

যে যায় সে ফেরে না কখনও

তার গাছ ফেরে
পাখি ফেরে
নদী ফেরে
বৈঠকখানা ফেরে

যে যায় সে ফেরে না কখনও

তার জামা ফেরে
জুতো ফেরে
গেঞ্জি ফেরে
চিরুনিও ফেরে

যে যায় সে যায় কখনও ফেরে না

—যে যায় সে যায়

গৌতম দাস চলে গেছেন। গৌতমদা কোথায় গেল? হঠাৎ একদিন শুনছি গৌতমদা, কবি গৌতম দাস যাঁর সঙ্গে মনে হয় আমার একবার কি দু-বার কথা হয়েছিল, যখন ওঁর ‘অন্তর আলির নামচা’ কাব্যগ্রন্থের প্রুফ দেখছিলাম আমি। তারপর আর সরাসরি কথা হয়নি দেখাও হয়নি। শুধু ফেসবুকে আমরা একে-অপরকে দেখতাম। আমি ওঁর কবিতা পড়তাম। তিনিও পড়তেন আমার লেখা। আমার কবিতা তিনি ভীষণ গভীরভাবে পড়তেন। সেটা হঠাৎ একদিন কোনও একটা কবিতার পোস্টে কমেন্ট করে জানিয়েছিলেন। মানুষটার মধ্যে কোথাও ভীষণ একটা নির্জনতা ছিল। হ্যাঁ ‘নির্জনতা’ শব্দটা সচেতনভাবেই লিখছি। নিত্য জীবনমৃত্যুর যুদ্ধে ভীষণ নির্জন ছিলেন তিনি। তাঁর কথা বলা টের পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। কখনও ভীষণ আস্তে ধীরে পথচলাও টের পাওয়া যায়। তাঁর কল্পিত বাস্তব অনেকটাই বাস্তবিক জীবনের সঙ্গে খাপ খায়। ভীষণ কাছাকাছি পৌঁছে যায় কোনও একজন পথচলতি মানুষের ছন্দে। হঠাৎ ফুলের মতো হয়ে দেখা দেয় কবিতার বাক্য। ফুল ছিঁড়তে গেলেও দ্বিধা বোধ করি। হ্যাঁ, বোধ করি আরও অনেক কিছু। ভীষণই কোলাহল ঘিরে অথচ সেই সঞ্চিত ব্যথার বহিঃপ্রকাশ কবিতায় খুব সহজভাবে করতেন তিনি। খুব গভীর কথা বলছেন। আলো এ-ই আছে। অথচ সবই অন্ধকার। কোথাও তলিয়ে যাওয়া আছে অথচ তলিয়ে যাচ্ছি না। এটাই ছন্দ তাঁর কবিতার। এভাবে আমি অন্তত অনুভব করেছি তাঁর ‘অন্তর আলির নামচা’ বইয়ের কবিতাগুলিকে। প্রচ্ছদের অধিকাংশ সাদাটে। বাকি অংশে শিল্পী রং ঢেলে দিয়েছে। এরকম। এভাবে ধূসর-কালো-লাল-হলুদ মিলে মিশে চিতার ক্ষয়। ফুরিয়ে আসা দেখানো হয়েছে। কিংবা কবিতার বাইরের খোলসটা যে শরীরী সেটা টের পাওয়ার বোধটুকু ধরা আছে। কয়েকটি অবয়ব। মানুষেরই। হ্যাঁ, মানুষেরই ক্ষয়, চিতায় পোড়া দেখালে ঠিকঠাক হয়তো চৈতন্যোদয় আর চৈতন্য বিলীন হওয়া বোধ করা যাবে। মানুষেরই চিতা জ্বলে। মধ্যরাতের যেমন চিতা থাকে। গভীর শূন্যবোধ থেকে এই যে আমার মোহ আর নির্মোহ মেশানো লেখনী। কীভাবে যে তোমার চলে যাওয়া আর রেখে যাওয়া বোধের চলন ধরে রাখব। আপনারা জানেন?— কবিতার অনুভূতি ঠিকঠাক ধরে রাখা যায় অনেকদিন। প্রকাশ করা যায় অনেকদিন পরে। অনেক বছর পরে যখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে নিজেরই চেতনার অভ্যন্তরে গিয়ে লালমাথার মানুষটার যে কোনও অভ্যন্তরই ছিল না! দানিল খার্মস-এর একটি লেখার উল্লেখ করলাম যার ক্ষয়ের রেশ কবিতার মতো ধীরে পুঞ্জীভূত হয়। বেঁচে থাকে অথবা বিলীন হওয়ার পরে যেভাবে ফিরে আসে। তুমি কি ফিরে আসবে গৌতমদা? এই একটা কবিতার সঙ্কলনে কত কী না করেছেন গৌতম দাস! প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা, ছন্দ, সহজ জীবনের দেখা, সেখানে আলো-ছায়া মাখানো শব্দেরা অনাবিল ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। তাঁর কবিতা কখনওই দুষ্প্রবেশ্য মনে হয়নি আমার। একাধিকবার যে ফিরে পড়িনি এমনও নয়, একই কবিতা অনেকবার পড়েছি। একদিন পড়ে রেখে দিলাম বইটা। হারিয়ে গেলাম জীবনে। তারপর অনেক অনেক সময় কেটে যাওয়ার পর আবার যখন ফিরে পড়েছি দেখেছি এরকম জীবনবোধ আর এবড়ো-খেবড়ো দেখা তার সঙ্গে ভাষাপ্রয়োগ তারই ভেতর আরও অন্য লেখা। কবিতার ভেতর কবিতা। কথার ভেতর কথা। দর্শনের ভেতর দর্শন। কুহকী জীবন। আপনার পড়ে কখনও কখনও ভালো লাগবে না তবে তার গতিপ্রকৃতি আপনার ভালো লেগে যাবে। পা ফেলতে গিয়ে মনে পড়ে যাবে। যেন গৌতম দাস এইসব কবিতাগুলোকে লিখেছেন পথ হাঁটতে গিয়ে। কিংবা ফিরে এসে কিছুটা শান্তি আর শূন্যতা নিয়ে। কিছুটা তৃপ্তিও আছে। কোথাও অস্তিত্বের সেই ব্যাকুল শূন্যতা নেই অথচ কবিতার ভেতর নিজেকে যেভাবে মিশিয়েছেন তাতে কোথাও কোনও কিছুর ভারসাম্যহীনতা নেই। আমি কবিতার কিছু বলছি না। জীবনের ভারসাম্যহীনতা নেই। আয়না কবিতা। তবুও সেটা তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে আয়না নয়। তিনি ভারতবর্ষের কথা বলেছেন। লিখতে চেয়েছেন মানুষের কথা। প্রতিটি মানুষের মুখের মধ্যে মনের মধ্যে প্রবেশ করে কথা বলেছেন। যেমন ‘চম্পার গল্প’ কবিতাটি।

বাহির পরিপাটি ভিতর ভেসে যায়
কেউ কি বোঝে কিছু? বোঝানো কার দায়?

আমার নয় জামি— আকাশপাখি বলে।
আমার জানি নয়— ঘূর্ণি, হাওয়া তোলে।

কলের গান বাজে বাজাজ শো-রুমে
বাজারি মেয়ে হাসে ছেলের কাঁচা ঘুমে।

জরুরি ফাইলেরা টেবিল সাঁতরায়
কুমারী চম্পাকে ধরেছে ‘সাত ভাই’।

কাগজে ছাপা হলে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে
যৌন আক্ষেপ পুলিশ হয়ে ফেরে।

কমিটি লাল হয় কমিটি হয় নীল
কবিরা কতকাল খুঁজিবে তার মিল?

প্রেমিক ডুব দেয় সঙ্গে ‘এক কুড়ি’
‘কহো না প্যার হ্যায়’ বলে কী মুখপুড়ি!

ঝামটা মুখে মুখে ঝামটা প্রতিদিন
এখনও পাওয়া যায় রেশনে কেরোসিন।

কখনও আবার তিনি সংবাদপত্রের খবরের থেকে কবিতার ডিসকোর্স আনছেন। সেখানে সংবাদের কোনও সন নেই। সময় এখানে চিহ্নিত হচ্ছে না নির্দিষ্ট সীমারেখায়। মানুষের অসহায়ত্বও তাঁর অনেক কবিতার বিষয় হয়ে উঠছে। তাঁর কবিতার অনেক স্বর। নানাভাবে নানারকম পাঠকের সঙ্গে যোগস্থাপন করার স্ফুরণ তাঁর কবিতায় আছে।

এরই মাঝে মাঝে তাঁর চলে যাওয়া আমাকে ভাবাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে কোনওদিন দেখা হল না আমার। সংযোগ তৈরি। সংযোগের ইচ্ছা আমাকে জীবনের পথ চলতে সহযোগিতা করে। মানুষ হয়ে আমি অন্য একজন চিন্তকের কবিতা পড়ছি। ফিরে পড়ছি তাঁর চলে যাওয়ার পর। কোথায় গেলে তুমি! আমি চিহ্ন খুঁজে চলি। যে-মানুষটা চলে গেল আমি তারই চিহ্ন খুঁজে চলেছি। তীব্রতা এখানেই। দিনরাতের শূন্যতা। এভাবে তাঁর কবিতার কাছে যাওয়া।

মিথ্যের দেবদূত

রাস্তায় বোতাম খুলে পড়ে—
কত শত বোতাম যে পড়ে থাকে

এ-রাস্তায় সে-রাস্তায়

কথা দিয়ে কথা না রাখার মতো রঙিন— বাস্তব।

কলরব করে ওঠে হাত।

বরাত বরাত বলে ছুটে যাই আমি মায় আমার বাবর
কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করি অতঃপর
সুতো দিয়ে গেঁথে রাখি রংচটা ছেঁড়া আসমানে।
রোদ লেগে ছায়া লেগে বোতামের মানে
বদলে যায়। বোতামের ঘ্রাণে দেখা দেয়

আহামরি মাহাত্ম্য অদ্ভুত।

সিউড়ির বাসস্টপের ভিড়ে
আমি মায় আমার বাবর আসমান গায়ে দিয়ে ভিক্ষে করি যখন
আমাকে দেখায় নাকি ইচ্ছেধারী

মিথ্যের দেবদূত!

তাঁর কিছু কবিতার কাছে গেলে ফিরে আসা যায় না। “রাস্তায় বোতাম খুলে পড়ে—/কত শত বোতাম যে পড়ে থাকে/এ-রাস্তায় সে-রাস্তায়/কথা দিয়ে কথা না রাখার মতো রঙিন— বাস্তব।” কোথাও মনে হয় এই কবিতা আসলে উপস্থিতির কবিতা। কবির শরীর এখুনি হয়তো কবিতার ভেতর থেকে জানান দিয়ে উঠবে। পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলে উঠবে তাঁর হাত। ঠিক পরের অংশেই কবির হাত জানান দেয়। থাকা-না-থাকার সহজ অথচ জটিলকে শূন্যতা ব্যতীত তুলে আনছেন কবিতায়। লৌকিক পথের কবিতা হয়ে উঠছে কবিতা। ‘আমি’ আছে, কিন্তু এই ‘আমি’র পরিধি ‘নেই-আমি’র দিয়ে যায়। আমাকে প্রতীক্ষা শেখায়।

এভাবেই গত বছর ফেসবুক খুলেই জানতে পারলাম তিনি আমাকে একটি কবিতা উৎসর্গ করেছেন। একটি ধাঁধা।

দরজা

উৎসর্গ: শতানীক রায়

এটি একটি দরজা। নগরের প্রবেশ ও প্রস্থানের দরজা।
বাতাসের মৌসুমী স্থাপত্য। আমরা এক কল্পিত কাহিনির মোহে পড়ে গেছি। যার স্তরে স্তরে কেবলই শ্রুতি—
মুহূর্তের মাহাত্ম্য। জানি না কবে এই দরজায় পা রেখেছি। আর লোকে উল্লাস করে উঠেছে— নাগরিক না গ রি ক…
বংশানুক্রমিক, নাকি দরজাটি গড়ে উঠেছে আমাদের সঙ্গেই। আমাদের হৃদপিণ্ডে, নিতান্তই শক্তিক্ষয় ও বিকিরণের মধ্যে। স্বপ্নযন্ত্রণায় দণ্ডিত এক দরজা!

তিনি চলে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের সূত্রবিন্দু হয়ে থাকল এই কবিতা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...