Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

৩৫এ প্রত্যাহার অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে বিপদের সঙ্কেত হতে পারে

সুদীপ চক্রবর্তী

 

এই নিবন্ধের পাঠকেরা দিল্লির সরাসরি হস্তক্ষেপে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজনের কথা স্মরণ করুন। কাশ্মিরি জঙ্গি বুরহানওয়ানি হত্যার পর যেভাবে প্রতিবাদের ঢেউ উঠতে শুরু করল, তা দেখে আমি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই এই বিভাজনকে বলেছিলাম সম্ভাব্য। আবার ২০১৮-র জুন মাসে, মেহবুবা মুফতির নেতৃত্বাধীন পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সরকারের ওপর থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি সমর্থন তুলে নেবার পরও আমি এই কথা বলি। বস্তুত, সংবিধানের আর্টিকল ৩৭০ ও ৩৫এ নিয়ে চতুর্দিকে হল্লার মধ্যে বসে এ-কথা বেশ অবিশ্বাস্য মনে হয়, যে ২০১৪-র জম্মু-কাশ্মির বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না-হওয়ায় বিজেপি পিডিপি-র সঙ্গে আদৌ জোট বেঁধেছিল।

রাজ্যের দু’টুকরো হওয়া আর আর্টিকল ৩৭০ আর ৩৫এ প্রত্যাহারের পটভূমি নিয়ে কয়েকটা কথা।

সংসদের ভিতরে বক্তৃতার ঝড় আর বাইরে জাতীয়তাবাদী বুক-ঠোকার কারণে এই বিভাজনের হয়ে-ওঠা নিয়ে কথাবার্তাগুলো চাপা পড়ে গেছে। ২০০২ সালে, জম্মু-কাশ্মিরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিকালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-চালিত জম্মু স্টেট মোর্চা নামের একটি সংগঠন জম্মু অঞ্চলের জন্য রাজ্যের মর্যাদা দাবি করে। ওই সময়ে, জম্মুতে, ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার হয়ে নির্বাচনের খবর করতে গিয়ে ইন্দ্রেশ কুমার নামে আরএসএস-এর এক বরিষ্ঠ পদাধিকারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। এই দাবি ইন্দ্রেশের কাছে ছিল যৌক্তিক।

অবুঝ দক্ষিণপন্থী দলের বাইরেও এই যুক্তি দীর্ঘদিন ধরে বলবৎ আছে। জম্মু-কাশ্মিরের তিন টুকরো হওয়া উচিত— স্বতন্ত্র কাশ্মির উপত্যকা, স্বতন্ত্র জম্মু আর কেন্দ্রশাসিত লাদাখ। এর পিছনে ছিল কাশ্মিরকে গোটা অঞ্চল থেকে আলাদা করে দেবার ভাবনা। সংসদে বিজেপি-র পদক্ষেপের পর এই অঞ্চলের আপাতত দুটো ভাগ হয়েছে— জম্মু-কাশ্মির আর লাদাখ। জম্মু আর কাশ্মিরের মধ্যে নাড়ীর যে বাঁধনটুকু আছে, তা বিজেপি চরমপন্থী ও অ-বিজেপি জাতীয়তাবাদী, এই দুই তরফেই বিজেপি-র জন্য যথেষ্ট সমর্থন মজুত করেছে।

এই বিভাজন একদিকে যেমন প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরীক্ষা হতে পারে, এই পদক্ষেপকে অন্যদিকে তেমনই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হচ্ছে। এ-কথা স্মরণে রাখতে হবে, যে “জম্মু ও কাশ্মিরের অস্থায়ী বাসিন্দা ও নারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক” এবং “রাজ্যের উন্নয়নের পরিপন্থী” হিসাবে চিহ্নিত আর্টিকল ৩৭০ ও ৩৫এ প্রত্যাহারের বিজেপি-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির, এবং তা পালনের, অন্যতর দিকও আছে। কিছু বিশ্লেষকের মতে আর্টিকল ৩৭০-এর প্রয়াণ অন্য কিছু রাজ্যের— বিশেষ করে উত্তর পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্রেক করতে পারে। তবে আর্টিকল ৩৭০ নয়, সেইসব উপাদান যা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে ভাবনার কারণ হতে পারে, নিহিত রয়েছে আর্টিকল ৩৫এ-র মধ্যে।

তার অন্যান্য অনেক বিধানের মধ্যে আর্টিকল ৩৫এ জম্মু-কাশ্মিরের স্থায়ী বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার প্রদানের কথা বলে— যার মধ্যে আছে (১) রাজ্য সরকারের অধীনে চাকরির কথা, (২) রাজ্যে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণের কথা, (৩) বসতি গড়ে তোলার কথা, এবং অবশ্যই (৪) কারা এই স্থায়ী বাসিন্দা, তার সংজ্ঞায়ন।

আর্টিকল ৩৭১এ, যা নাগাল্যান্ড রাজ্যের জন্য “নাগাদের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি”, “নাগাদের প্রথাসিদ্ধ আইন ও প্রথা”, “প্রথাসিদ্ধ আইনানুসারে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ন্যায়বিচারের পরিচালনা করা”, এবং “জমির মালিকানা ও হস্তান্তর”-এর অধিকারকে সুনিশ্চিত করে, তার বক্তব্যও কি ৩৫এ-র মতনই নয়? সরকারি চাকরির ব্যাপারটা কেবল বাদ রাখা যায়।

একইরকমভাবে আর্টিকল ৩৭১সি মণিপুরের আদিবাসী-অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক রক্ষাকবচ দান করে, যেখানে রাজ্যের অন্যত্র লাগু হয় স্থানীয় নিয়ম এবং আদিবাসীদের প্রথাসিদ্ধ আইন। মিজোরামে বলবৎ আর্টিকল ৩৭১জি-র বিধান প্রায় নাগাল্যান্ডের মতনই। বহিরাগতদের প্রবেশ, স্থায়ী বসবাস এবং সম্পত্তির মালিকানার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে অরুণাচল প্রদেশের সরকার। অসম ও মেঘালয়ের মতন রাজ্যে আদিবাসী ও বনবাসীদের জন্য বিশেষ নিয়ম বলবৎ, যদিও বর্তমান কেন্ত্রীয় সরকারের নিয়মনীতির কল্যাণে বনবাসীদের অবস্থা খুব সুবিধার নয়। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিসগড়ের কিয়দংশে, এবং আরও কিছু রাজ্যে বহিরাগতদের সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। এই সমস্ত রাজ্যগুলোই বর্তমান পদক্ষেপে নড়েচড়ে বসেছে। আর্টিকল ৩৫এ যদি সত্যিই জম্মু-কাশ্মিরের ক্ষেত্রে উন্নয়নের পরিপন্থী হয়ে থাকে, এবং সে-কারণে যদি তাকে মুছে ফেলাই শ্রেয় বলে মনে করা হয়, তবে অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম উন্নয়ন সম্ভব করবে কী করে? উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে— যেখানে এই বিশেষ বিধানকে স্বশাসনের অধিকার, সম্পত্তি ও জীবিকা সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বলে মনে করা হচ্ছে— এ-নিয়ে উদ্বেগ ভাষা পাচ্ছে। মুহুর্মুহু বদলে চলা রাজনৈতিক সমীকরণ-সম্বলিত এই রাজ্যগুলোতে— যেখানে মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিচ্ছে অভিবাসন সমস্যা এবং চেষ্টা চলছে বিভিন্ন বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সঙ্গে সমঝোতার— এই প্রশ্নগুলো উঠবে, এবং তার সন্তোষজনক জবাব নিয়ে নয়াদিল্লিকে তৈরি থাকতে হবে।

 

(লাইভমিন্ট-এ পূর্বপ্রকাশিত)