প্রতিভা সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অধ্যাপক ও সমাজকর্মী
২০১৯ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে আপামর ভারতবাসী ‘গোরি’ কাশ্মিরি কন্যাকে বিবাহ করবার খোয়াবে বুঁদ হয়ে যেতে থাকে। ভারতীয় পুরুষের নারীর গাত্রবর্ণের প্রতি ফেটিশ সর্বজনবিদিত। কিন্তু হঠাৎ কী ঘটল যাতে সোশাল মিডিয়া এবং বাস্তবে এই মহা শোরগোল! বিজেপি নেতারা চেলাচামুন্ডাদের অনুপ্রাণিত করতে লাগল কাশ্মিরেই বিয়েসাদি করে ঘর বসাবার জন্য। এক ঝাঁকুনি মারা ভিডিওতে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরের এমএলএ বিক্রম সাইনিকে দেখা গেল কাশ্মিরি নারীদের দুঃখে বিগলিত প্রাণ, কারণ এতদিন অন্য প্রদেশের পুরুষকে বিবাহ করলে “কাশ্মিরের মেয়েদের নাগরিকত্ব চলে যেত। ভারতীয় নাগরিকত্ব এবং কাশ্মিরি নাগরিকত্ব এক বস্তু নয়… হিন্দু কী মুসলিম, সবাই আজ জোশ মানাও… সারা দেশের লোক জোশ মানাও।” নাগরিকত্ব চলে যাওয়া বলতে এমএলএ সাহেব কী বুঝিয়েছেন জানা নেই, তবে তার মূল আনন্দ কাশ্মিরি নারী বিবাহের সম্ভাবনায়, এ কথা বুঝতে দেরি হয় না।
এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সামরিক বাহিনি অধ্যুষিত জায়গাটির নাম হল কাশ্মির। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় শাসনকর্তারা সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৫এ খারিজ করে কাশ্মিরের জন্য বরাদ্দ সীমিত স্বায়ত্তশাসনকে নাকচ করে দেয়। রাজ্যটিকে দু খণ্ড করার পর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে এই সমস্ত কর্মকাণ্ড চলাকালীন একবারও কাশ্মিরি জনসাধারণকে জিজ্ঞাসা করা হয় না কী তাদের অভিমত। উপরন্তু অলিগলি ছয়লাপ করে দেওয়া হয় সামরিক উর্দিধারীতে, এবং যোগাযোগব্যবস্থায় নামিয়ে আনা হয় সম্পূর্ণ লকডাউন। এক বছর বাদে বিধিনিষেধ কিছু শিথিল হলেও ইন্টারনেট এবং পোস্টপেইড মোবাইলে প্রায়ই নিষেধাজ্ঞা চাপানো হতে থাকে। ভূমিপুত্র রাজনীতিক, নেতা, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সিভিল সোসাইটি মেম্বারদের অন্য রাজ্যের জেলে চালান করে দেওয়া হয় অথবা গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
এইসবই নাকি উন্নয়নের স্বার্থে এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার লক্ষ্যে। তখন গৃহমন্ত্রক থেকে বড় গলায় আরও বলা হয়েছিল যে অন্যান্য অনেককিছুর সঙ্গে এই পদক্ষেপ কাশ্মিরি নারীকে লাভবান করবে, দেশের অন্যত্র তার ভগিনীরা যে যে সুবিধা লাভ করে, সেগুলো তাদের দুয়ারে পৌঁছে দেবে বিজেপি সরকার। কিন্তু এই আশ্বাসের আড়ালে যে নামিয়ে আনা হবে আরও বেশি সামরিক আগ্রাসন, দেদার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, সেটা ভাবা যায়নি।
দেশের অন্যত্র কাশ্মিরের ওপর এই পিতৃতান্ত্রিক ও সামরিক বিজয় যতোই আদৃত হতে লাগল, ততই কাশ্মিরি মেয়েদের দেশজোড়া ভার্চুয়াল লাঞ্ছনা বৃদ্ধি পেতে লাগল। এর সঙ্গে জুড়ে গেল তাদের বাস্তব বন্দিত্ব, যেন ধাক্কা মেরে গৃহকোণে ঢুকিয়ে দেওয়া হল তাদের, অবরোধের সময় চিরকাল সর্বত্র যা হয়ে এসেছে। যত সেনার সংখ্যা ও দাপট বৃদ্ধি, ততই মেয়েরা অবরোধবাসিনী। তা যে একেবারেই কোনও অমূলক ভয়ের কারণে নয়, সে প্রসঙ্গ এই নিবন্ধে পরে আসবে। মেয়েদের বুনিয়াদি প্রয়োজনগুলি মেটানোও অসম্ভব হয়ে উঠল। দুই চোখে পেলেটবিদ্ধ শিশুকন্যা বা গর্ভিণীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়ও যে কত বাধাবিঘ্ন পেরোতে হয়, কাশ্মির তা জানে, জানে নাবালক সন্তানকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর সে বাচ্চা খাতায়কলমে মিসিং হয়ে গেলে তার মা কেমন আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদে। কন্যার এবং নিজের সম্ভ্রম নিয়ে সন্ত্রস্ত কাশ্মিরি মায়েরা খুব শান্তিতে আছে বোধহয়, কারণ গোটা রাজ্যে এখন স্কুলছুট বাচ্চার সংখ্যা ১৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। প্রিয়জনেরা রাষ্টের হাতে বন্দি, বহু মানুষ নিখোঁজ। বৃদ্ধ মানুষ সংসারে থাকলে সামরিক বাহিনির অত্যাচারের ভয়ে পুরুষশূন্য এলাকায় মেয়েরাই তাদের একমাত্র ভরসা।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের সুরাহার জন্য সেই রাষ্ট্রেরই চাপিয়ে দেওয়া দীর্ঘসূত্রী আইনব্যবস্থার জোয়াল টেনে মরতে হয় উপত্যকাবাসিনীকে। এ এক অদ্ভুত বিরোধাভাস। অনেক পরিবারেই সমর্থ পুরুষেরা কারাবদ্ধ। তাদের জন্য আইনি ব্যবস্থা করা, দিনের পর দিন কোর্টে গিয়ে বসে থাকা, সে কোর্টের অবস্থানও ইচ্ছাকৃতভাবে পালটে যায় কিছুদিন বাদে বাদে। যারা অর্থনৈতিক বা বৌদ্ধিক কারণে এই লড়াইটা লড়তে পারে না তাদের মানসিক অবস্থা কী হয়! অথচ আশ্চর্য এই যে, মেয়েদেরই ঘাড়ে যখন ভিতর ও বাহিরের সকল দায়িত্বের বোঝা, তখন তাদের শিক্ষা, কাজ এবং সমস্তরকম নাগরিক অধিকার হাসিল করবার পথে মস্ত মস্ত প্রতিবন্ধকতা খাড়া করে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হল অস্তিত্বহীনতার অন্ধকারে। প্রবল আর্থ-সামাজিক এবং মানসিক চাপ এবং চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতা উপত্যকার মহিলাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। অথচ ভারত সরকার ক্রমাগত ঢ্যাঁড়া পিটিয়েই চলেছে কাশ্মিরে নারীমুক্তি ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে তাদের পদক্ষেপ নাকি যুগান্তকারী।
এই হল মোটামুটিভাবে কাশ্মিরের মেয়েদের ওপর আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৫এ খারিজ করবার এবং যেভাবে তা খারিজ করা হয়েছিল তার প্রভাব।
আর্টিকেল ৩৭০-এর তাৎপর্য কী ছিল? অর্থ, সুরক্ষা, বৈদেশিক নীতি এবং যোগাযোগ চিরকালই ভারত সরকারের অধিকারে ছিল। এই ধারার কাজ ছিল এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতিগত ভিন্নতা এবং বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রাখা। এই কারণেই ভারত রাষ্ট্রের অন্য কয়েকটি রাজ্যের মতোই এখানে আলাদা সাংবিধানিক অধিকার এবং আলাদা ফ্ল্যাগ ছিল। যাতে বহিরাগতের ভিড়ে স্থানীয় সংস্কৃতির ক্ষতি না হয়, সেজন্য অকাশ্মিরিদের জমি কেনাবেচার ওপর কিছু বিধিনিষেধ ছিল, ভূসম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত নিয়ম অন্যরকম ছিল। কাশ্মিরি নয় এমন কেউ এখানে জমিজমা কিনে বসবাস করতে পারত না, স্থানীয় সরকারে চাকরি পেত না বা শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও স্কলারশিপ পাবার অধিকারী হত না। ৩৫এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক যদি কোনও কাশ্মিরি মহিলা কোনও অকাশ্মিরিকে বিবাহ করত তাহলেও স্বামীটি পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হতে পারত না। না হতে পারলে জমিজমাও কেনা যেত না। আপাতদৃষ্টিতে এই পয়েন্টেই অন্য রাজ্যের নারীদের সঙ্গে সমানাধিকার পাওয়ার টোপটি বিজেপি কাশ্মির-কন্যাদের নাকের ডগায় ঝুলিয়েছে। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এতে ছলনার পরিমাণ কত বেশি।
কাশ্মির তো আর সত্যি সত্যি পিতৃতন্ত্রবর্জিত এক টুকরো স্বর্গ নয় যে এখানকার মেয়েরা শুধু মানুষ পরিচয়েই স্বাধীনভাবে বড় হয়ে উঠবে। তাই এখানে গার্হস্থ্য হিংসা, মৌলবাদীর রক্তচক্ষু থেকে মেয়েরা একেবারে ছাড় পায় এরকম বলা যাবে না। হয়ত অন্য রাজ্যের মেয়েদের সঙ্গে তুলনার মানদণ্ডে তারা কোথাও পিছিয়ে, কোথাওবা এগিয়ে। দেখা যাক এইসব ধারা রদ করার আগে কেমন ছিল উপত্যকার মেয়েরা। ২০১১ সালের সেন্সাসে, (তারপর আর সেন্সাস হয়নি এ দেশে) কাশ্মিরি মেয়েদের ৫৮.০১ শতাংশ জন সাক্ষর। মেয়েদের বিরুদ্ধে সাধারণত যে অপরাধ সংঘটিত হয় তাতে কাশ্মির উপত্যকার নাম একেবারেই শেষ দিকে। অনার কিলিং-এ গোবলয়ের ধারেকাছে আসে না, এমনকি ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীর মাতৃত্বের হার সারা দেশে ৭.৯ শতাংশ হলেও, কাশ্মিরে তা মাত্র ২.৯ শতাংশ। বাল্যবিবাহ খুব কম। শিশু অপুষ্টির হার, যা মায়ের স্বাস্থ্যেরও সূচক, তা এখানে ১৬.৬ শতাংশ, গোটা দেশে ৩৫.৮ শতাংশ। খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে সরকারি তথ্য অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও এই রাজ্য জাতীয় গড়ের থেকে এগিয়ে। জাতীয় গড় ৫৩.৫ শতাংশ, জম্মু-কাশ্মির ৫৭.৩ শতাংশ। মুসলমানের বহু সন্তানের অপবাদকে এই মুসলমান প্রধান রাজ্যেই মিথ্যে প্রমাণিত হতে হল! পণের জন্য বধূহননেও সবচেয়ে পিছিয়ে এই রাজ্য।
নারীস্বাস্থ্য এবং নারীর প্রতি সংবেদনশীলতায় এ রাজ্য তাহলে আগেও খুব একটা খারাপ জায়গায় ছিল না। এখন ঠিক কেমন তার সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও, পারিপার্শ্বিকতার চাপে কেমন থাকতে পারে এবং আছে তা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এবার দেখে নেওয়া যাক তথাকথিত নারীমুক্তির আইনি দিকটিকে।
৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপকারীরা এই কাজের সুফল বলে যেসব দাবি জানিয়েছে তার মধ্যে অনেকগুলোই অনেকদিন ধরে কাশ্মিরিরা ভোগ করে আসছেন। যেমন রাইট টু এডুকেশন। দাবি করা হল, এখন এই অধিকার উপত্যকার জনগণও পাবে। কিন্তু ঘটনা হল, ভারতে অন্তর্ভুক্তির সময় থেকেই এই রাজ্যে শিক্ষার অধিকার বলবৎ রয়েছে। সেটাও কেবল চোদ্দ বছরে সীমাবদ্ধ নয়, একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অব্দি আছে। এই অধিকারের সংবিধানভুক্তি গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক পরে হয়েছে, তা কাশ্মিরকে দেখে শেখা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
যেমন তিনতালাক রদ। এই বিল কাশ্মিরি মেয়েদের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেবে, এরকম বলা যাবে না। ২০০৭ সালের আগে এই রাজ্যে শরিয়তি আইন প্রচলিত ছিল না। শ্রী প্রতাপ জম্মু এন্ড কাশ্মির ল’জ কনসোলিডেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী বিচারব্যবস্থা চলত। এতে পরিষ্কার বলা আছে যদি কোনও ক্ষেত্রে আবহমান কাল ধরে চলে আসা কোনও প্রথা বা কাস্টমের সঙ্গে বিচারপদ্ধতির কোনও বিরোধ ঘটে, তাহলে প্রাধান্য পাবে সামাজিক রীতি। ২০০৭ সালের পরেও প্রথাকে এই মান্যতা দেওয়া কাশ্মিরিদের মধ্যে বহুল প্রচারিত। ফলে মৌখিক তিন তালাক এই রাজ্যে আদৌ চালু ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। এমন কোনও সমীক্ষাও কখনও হয়নি। কোরানসম্মত তিন তালাক ব্যবস্থা এখন সারা দেশেই বলবৎ আছে, ফলে কাশ্মিরি মেয়েরা মৌখিক তিন তালাক রদে কতটা উপকৃত হয়েছে সে সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ তথ্য না পাওয়া অব্দি তাই নিয়ে নারীমুক্তির ঢাক বাজানো কি উচিত হবে?
শরিয়তি আইন যে উপত্যকায় অবশ্যপালনীয় ছিল না, তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় মেয়েদের জন্য অনুসৃত উত্তরাধিকার আইনে। শরিয়তে সম্পত্তি ভাগের ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত কন্যার মধ্যে তফাত করা হয় না। কাশ্মিরে করা হয়। বিবাহিতা কন্যাকে বলা হয় দফতরেখানানাশিন। সে যদি পিতার সংসারে একত্রে বসবাস করে তাহলে পিতা তাকে তার ভাইয়ের সমান সম্পত্তি দিতে বাধ্য। স্বামীটি কিন্তু কিছুই পাবে না। এটি কাশ্মিরি প্রথা। নারী যদি অকাশ্মিরি পুরুষকে বিবাহ করে, তাহলে সে প্রথা অনুযায়ী স্বামীর মৃত্যুর পরই পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পাবে। আর্টিকেল ৩৫এ তুলে দিয়ে তাহলে খুব যে বলা হচ্ছে বিবাহিত মেয়ের সম্পত্তির অধিকার নিষ্কণ্টক করা হল, সেটা তাহলে ভুল। আসলে একা নারীকে আমরা পূর্ণ মানুষ বলে ভাবতে পারি না। তার যে কোনও অধিকারকেই যেন স্বামী সন্তান সহ ভোগের উপযুক্ত হতে হবে!
নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই আরও একটি অন্যরকম কাশ্মিরি প্রথার উল্লেখ করছি। দত্তক নেওয়া শরিয়তে নিষিদ্ধ, কাশ্মিরি প্রথায় মান্য।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ‘কাশ্মিরিয়ত’, যা ছিল উপত্যকার এসেন্স অব লাইফ বা জীবনের মূল সুধা, তা নারীকে একেবারে মর্যাদা দেয়নি একথা ঠিক নয়। বরং ভারত রাষ্টের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের, বিশেষত গোবলয়ের তুলনায় হয়ত একটু বেশিই দিয়েছে। অথচ এইসব রদবদলের পর কাশ্মিরি নারী রাজনীতিকদের দ্বারা এবং মিডিয়াতে চূড়ান্ত বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে। যেন সে মানুষ নয়, বস্তু মাত্র। এমন কিছু উদাহরণ এই নিবন্ধের একেবারে শুরুতেই রাখা আছে। তাকে লাগাতার অশালীন যৌন ইঙ্গিত এবং অবজেক্টিফিকেশন সহ্য করতে হচ্ছে। লিঙ্গভিত্তিক হিংসার শিকার না হতে চেয়ে সে নিজেই নিজেকে অবরোধবাসিনী করে তুলেছে। তার এই আশঙ্কা এবং নিরাপত্তাহীনতার কথা সিপিআইএম পার্টি এবং কবিতা কৃষ্ণনের মতো এক্টিভিস্টদের রিপোর্টে উঠে এলেও কোনও সুরাহা হয়নি। বরং তার পরেও আল জাজিরার রিপোর্টে পাক অধিকৃত কাশ্মিরের সীমান্তে ভারতীয় সামরিক বাহিনির দ্বারা নারীহত্যার কথা উঠে এসেছে।
শুধু সামরিক অত্যাচারই নয়, দেশের অন্যত্রও সমাজজীবনে কাশ্মিরি মেয়েদের অনেক বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। দেরাদুনে একদল কাশ্মিরি ছাত্রীকে ঘরে আটকে রেখে তাদের বহিষ্কার চাইছে স্থানীয় লোকজন, এইরকম একটি টুইট করবার অপরাধে ছাত্রনেতা শেহলা রশিদকে প্রবল বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু একথা ঠিক যে চাকরির ক্ষেত্রে তো বটেই, পড়াশুনো, ঘর ভাড়া, ব্যবহার সর্বত্রই কাশ্মিরিরা বৈষম্যের শিকার। জম্মু ও কাশ্মিরের প্রতি ভারত রাষ্ট্রের বিমাতৃসুলভ মনোভাবই এর মূল। আর্টিকেল ৩৭০ এবং ৩৫এ রদের পর এই প্রবণতা বেড়েছে বৈ কমেনি। এখন শিক্ষিত কাশ্মিরি ছেলেমেয়ে মানেই আতঙ্কবাদী। শেহলা রশিদকে দেশদ্রোহী আইনে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পর এই মনোভাব আরও শেকড় ছড়িয়েছে।
আধিপত্যকামী রাষ্ট্র নারীর মর্যাদাকে বার বার ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। যতবার সেনাবাহিনির বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠেছে ততবারই তা নিয়ে সঠিক তদন্তের অভাব উপত্যকার মেয়েদের মধ্যে আরও নিরাপত্তাহীনতাকে চারিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, সবচেয়ে বেশি দিয়েছে নারীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া হিংসাকে। কুনান পশপোরায় প্রায় একশো জন নারীকে সামরিক বাহিনি দ্বারা গণধর্ষণের মতো মারাত্মক অভিযোগের বিচারকে সবসময়ই টেনে লম্বা করা হয়েছে এবং যাতে কিছুই প্রমাণিত না হয় তার ফুলপ্রুফ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সার্ভাইভারদের অনুমতি দেওয়া হয়নি বর্ষপূর্তিতে একত্রিত হয়ে ঐ জঘন্য ঘটনা সম্পর্কে পরস্পরের ভাব বিনিময় করতে বা সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে।
চক সাদিপোরায় ছজনের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, হারান এবং গুরিহাখারে ধর্ষণ, ২০০৯-এ আসিফা এবং নীলোফারের ওপর অত্যাচার, সবগুলোই সাক্ষ্যপ্রমাণ মজুত থাকা সত্বেও তদন্ত এগোয়নি। নারীশরীর যেন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ফলাবার জন্য বিছিয়ে রাখা যুদ্ধক্ষেত্র, তাকে ছিন্নভিন্ন করবার জন্য আক্রমকদের কোনও সাজা হয় না। যে যে কেসের কথা উল্লেখ করা হল, তার একটিতেও রাষ্ট্রীয় তদন্তের নির্দেশ আসেনি। সবসময়ই ‘জাতীয় স্বার্থে’র দোহাই দিয়ে এবং সেনাবাহিনির মানসিকতাকে ‘লৌহদৃঢ়’ রাখবার চেষ্টায় কাশ্মিরি নারীর ইচ্ছেমতো বাঁচার অধিকার এবং আকুতিকে পদদলিত করা হয়েছে।
আফস্পার মতো দানবীয় আইন প্রত্যাহার না করে নারীকে সমানাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি একই সঙ্গে খুবই হাস্যকর ও বেদনাদায়ক। সবচাইতে জঘন্য এবং নির্মম অত্যাচার ঘটানো হয়েছে এই আইনের আড়ালে। ২০১৩ সালে জাস্টিস ভার্মার সুপারিশ ছিল আর্মড ফোর্স স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টকে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ছুতোয় যেভাবে মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে তাই নিয়ে তদন্ত করবার। সেই সুপারিশ নিয়ে কোনও মহল থেকে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।
দেশের সরকার যদি সত্যি কাশ্মিরে নারীমুক্তির জন্য ব্যগ্র হয়, তাহলে এই সমস্তই তার বিবেচনায় থাকা উচিত। তার বোঝা উচিত শুধু যৌন হিংসাই নয়, রাজ্যটির পূর্ণ সামরিকীকরণ নারীর বিচরণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করেছে, সমাজে ও পরিবারে তাদেরকে অত্যন্ত কষ্টকর ভূমিকা নিতে বাধ্য করেছে। তাদের জীবনে চূড়ান্ত ওলট-পালট নেমে এসেছে। মা অথবা স্ত্রীর প্রথাগত ভূমিকা থেকে ছিটকে গেছে অনেকেই। খুব কষ্ট এবং কৌতূহল-জাগানিয়া তাদের এই মেটামরফোসিস। অবাক হয়ে দেখতে হয় কিছু মহিলার স্মৃতিরক্ষকে পরিণত হওয়া, যারা না জেনেই ওরাল হিস্ট্রির ধারাটিকে বহমান ও সতেজ রাখে। তাদের কাজ হল চোখে দেখা, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আসা হিংসার ঘটনাগুলিকে, ব্যক্তিগত ট্রমাকে মৌখিক ইতিহাসের রূপ দিয়ে জাতির স্মৃতিতে সেগুলিকে জাগরুক রাখা। এই করতে গিয়ে কখনও তারা বহিরঙ্গের জীবন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে, কখনও ব্যক্তিগত জীবন থেকে হঠাৎ গিয়ে পড়েছে বহু লোকের মাঝখানে, মেনে নিতে হয়েছে সাধাসিধা জীবনের জটিল রাজনীতিকরণ। যে কাশ্মিরিরা দিনের পর দিন নিখোঁজ, তাদের মা বাবারা তৈরি করলেন অ্যাসোসিয়েশন অব পেরেন্টস অব ডিসঅ্যাপিয়ারড পার্সনস। এই অস্বাভাবিক সময়ে মায়েরা ঘরের বাইরে আসতে বাধ্য হলেন, মাতৃত্বের রাজনীতিকরণ ঘটল, তাদের কাজ হয়ে দাঁড়াল গত ত্রিশ বছর ধরে অহিংস এবং নিয়মিত প্রতিবাদের মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক বাহিনি দ্বারা চল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষের খুন ও অনেক মানুষের হারিয়ে যাওয়ার গাথা গণমানসে টাটকা রাখা।
এই সর্বনাশা সময়ে উপত্যকার নারী একই সঙ্গে আশঙ্কা এবং আশার সমাহার। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের কারণে তার ওপর নেমে আসে দমনপীড়ন। কিন্তু সে অদম্য। উপত্যকায় যা প্রতিবাদ এখন হয়, তার বেশিরভাগেরই পুরোভাগে থাকে মেয়েরা। নিজেদের শুধু ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপিত করা তাদের না-পসন্দ, তাই নিজেদের এজেন্ট হিসেবেও সক্রিয় এই মেয়েরা। কিন্তু সরকার পক্ষ তাদের সক্রিয়তার জবাবে শীতল নৈঃশব্দ এবং পীড়ন ছাড়া আর কিছুই দেয়নি। কাশ্মিরের বিশেষ অধিকার উচ্ছেদের পর শ্রীনগরে মেয়েদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ করা হয়। সামনে ছিলেন উপত্যকার কিছু খ্যাত মহিলা। তাদেরকে অ্যারেস্ট করে ফাইন নিয়ে, মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বৈরাচারী সরকার আলোচনার কোনও প্রসঙ্গই তোলে না।
ভারত কিন্তু ইউএনও রেজোলিউশন ১৩২৫ এ অংশগ্রহণ করেছিল। তাহলে সরকার নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছে যে দ্বন্দ্বসঙ্কুল এলাকায় শান্তি প্রক্রিয়া এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের সামিল করতেই হবে। তাদের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করা সরকারের কর্তব্য। এর কোনওটাই মানেনি যে শাসক, বরং রক্ষককে প্রায়ই দেখা গেছে ভক্ষকের ভূমিকায়, তারাই সুবিধেমত নারীমুক্তির দোহাই দেয়!
শাসক এখন পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে ব্যস্ত যে তার পদক্ষেপের পর জম্মু কাশ্মিরে সন্ত্রাসবাদী হানা অনেক কম। একটি জনগোষ্ঠী ও একটি রাজ্যকে চূড়ান্ত বিধিনিষেধ ও হিংসার কালো কম্বলে মুড়ে ফেলে কতদিন শান্তির ঠুনকো বাতাবরণ বজায় রাখা যায় তাইই এখন দেখার।
ইতিহাসের কাছ থেকে কেন যে আমরা কিছু শিখি না!
ভীষণ মনখারাপ করা লেখা। ভূস্বর্গ বলে যতই ধেইধেই নাচি বাস্তবের কাশ্মীর এক অসম ডেভিড আর গোলিয়াথিয় সংঘর্ষের বধ্যভূমি। মেইনল্যান্ডের ভারতবাসীরা ওখানে যাব, খাব-দাব, কলকলাব। সামান্য গিল্ট বিষফোঁড়ার মত টনটন করতে পারে। কোনও কাশ্মিরি তরুণী হয়ত আমাদের দেখে তখন বিড়বিড় করবে —-
তুম জু়ল্ম কহাঁ তক তহ-ই-অফলাক করোগে
ইয়ে বাত না ভুলো কি হমারা ভি খুদা হ্যায়।
(হাবিব জালিব)