Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অসমের বন্যা— অর্ধ-শতাব্দী থেকে ভাসমান জীবন

তানিয়া লস্কর

 

সারাদেশ প্রতিবছর যখন মৌসুমী বায়ুর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে অসমের চরগুলো তখন অনিশ্চিত আশঙ্কায় প্রহর গুনতে থাকে। বন্যার ভয়, ভাঙনের ভয়, মৃত্যুর ভয়। ২০১৯ সনের ১৬ জুলাই রাজ্যের ৩০টি বন্যাক্রান্ত জেলায় আশিজনের অধিক লোকের মৃত্যু ঘটেছে। ১২টি এক শৃঙ্গযুক্ত গণ্ডারসহ প্রায় ১৪১টি লুপ্তপ্রায় প্রজাতির পশুপাখির মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ১,৬৩,৯৬২.০২ হেক্টর শস্যক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এ কমবেশি প্রায় প্রতিবছরের পরিসংখ্যান। প্রতিবছর প্রায় ৮০ কিলোমিটার জমি ব্রহ্মপুত্রে তলিয়ে যায়। ভারত সরকারের চোখের সামনেই হাজার-হাজার লোক জলবায়ুর কারণে উদ্বাস্তু হয়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল সেসব দিকে চোখ না দিয়ে অসমে বছরের পর বছর ধরে শুধু দেশভাগের ফলে এপারে চলে আসা রিফিউজিদের নিয়ে রাজনৈতিক কোন্দল চলছে। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের কথা হল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া দিন দিন খারাপ হচ্ছে, বৃষ্টি অনিশ্চিত হচ্ছে, প্রকৃতি ক্রমশ বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে। তাই এক্ষুনি তৎপর না হলে ধীরে ধীরে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চল তো বটেই, পুরো দেশেই এর কুপ্রভাব পড়বে।

 

বন্যা নিয়ন্ত্রণ— প্রহসনের আরেক নাম

প্রায় প্রতিবছরই বন্যা-নিয়ন্ত্রণের নামে অসমে একই নাটক মঞ্চস্থ হয়। বৃষ্টি শুরু হওয়ার কদিন আগে থেকে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু হয়। যার ফলে হিতে বিপরীত হয়। বাঁধগুলো আরও তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়। কেন্দ্রীয় জল আয়োগ প্রতিবছরই বন্যার পূর্বাভাস দেয়। কিন্তু জেলাস্তরে সেগুলি কাজে লাগানো হয় না। যদিও এই বন্যা নিয়ে গবেষণাদি করার জন্য কিংবা পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষকে সাহায্য করার জন্য সরকারি কিংবা আধা-সরকারি বিভাগ ইত্যাদি কম নয়। ব্রহ্মপুত্র বোর্ড নামে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বিভাগ আছে যাদের প্রধান কাজই হল ব্রহ্মপুত্রের বন্যা নিয়ে গবেষণা করা। তাদের মতে অসমের ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণ হল সরকারি বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। তাছাড়া নয়া উদার অর্থনীতির প্রভাবে যে হারে নতুন নতুন উদ্যোগ গড়ে উঠছে এবং বন-জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে এতে প্রতিবার নূতন করে কিছু জায়গা জলে ডুবছে, যা সরকারি বিভাগগুলোর জন্য সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।

 

সমাধানের পথ কোথায়

২০১৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ জাপানের সানডাই প্রদেশে তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি সম্মেলন করে। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ফলে তৈরি হওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয় এবং কিছু ভবিষ্যত পন্থা নিরূপণের চেষ্টা  করা হয়। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সানডাই ফ্রেমওয়ার্ক নামে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। ভারতও সেখানে একটি সিগনেটরি রাষ্ট্র। বলা হয় যে অসমে নাকি এই সানডাই ফ্রেমওয়ার্ক প্রথম প্রয়োগ করা হয়। ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের নামেও প্রতিবছর বাজেটে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। দুহাজার তেরো থেকে দুহাজার সতেরো পর্যন্ত বোর্ড প্রায় ৩৭৬ কোটি টাকা খরচ করেছে। অথচ নীচের স্তরে কোন পরিবর্তনই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। যাহোক সানডাই ফ্রেমওয়ার্ক সরকারগুলোকে চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে:

  1. বিপর্যয় ঝুঁকি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারণা লাভ করার চেষ্টা করা,
  2. বিপর্যয় ঝুঁকি সম্পর্কিত প্রশাসনিক বিভাগগুলোকে আরও শক্তিশালী বা কর্মঠ করে গড়ে তোলা,
  3. বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিনিয়োগ করা,
  4. দুর্যোগ-পূর্ব প্রস্তুতিকে তথা মোকাবেলা কর্মপন্থাকে আরও কার্যকর ভাবে গড়ে তোলা।

এছাড়াও বিবিবি মানে বিউল্ড বেঙ্ক বেটার বলে আরেকটি নীতির কথা মনে রাখা ভালো। যে নীতি মতে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পুনঃনির্মানের ক্ষেত্রে জনসাধারাণের সামাজিক, শারিরীক, অর্থনৈতিক তথা পরিবেশগত উন্নতির কথা মাথায় রেখে একটি হোলিস্টিক চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোতে হবে। এই নীতিগুলোকে মাথায় রেখে যদি বাজেট বণ্টন করা হয় এবং সুদক্ষভাবে তা বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে সমাধান অবশ্যই সম্ভব। তদুপরি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ইত্যাদি দক্ষিণ এশীয় দেশগেলোর সঙ্গে তথ্য–প্রযুক্তির আদান-প্রদান করে তাদের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি করে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই নগর উন্নয়ন, বন্যা-নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সানডাই ফ্রেমওয়ার্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে স্থানীয়ভাবেও যথেষ্ট উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চর এলাকাগুলিতে চর রুজগার কার্যক্রম বলে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাতে দারিদ্র দূরীকরণের মাধ্যমে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে তাদের পরিবেশ-বান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত করা যেতে পারে। অসম-ভূটান সীমান্তে একটি শ্রীঘ্র সতর্কবাণী পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় জলাধার যেমন, বিল-হাওর সেগুলিকে পুনর্জীবিত করতে হবে। এবং সর্বাগ্রে অসমের বন্যাকে রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা করতে হবে। এভবে একটি সর্বাঙ্গীন কর্মপন্থা হাতে না নিলে অসমের ব্যাপক বন্যা-নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব।